গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১০. নূতন পথে

দশম পরিচ্ছেদ – নূতন পথে

সত্য যখন অপ্রত্যাশিতভাবে মানুষের সম্মুখে আসিয়া আবির্ভূত হয়, তখন তাহার রূপ যতই অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় হোক, তাহাকে সত্য বলিয়া চিনিয়া লইতে বিলম্ব হয় না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে নিজেকে সহজে স্বাভাবিক রূপে প্রতিষ্ঠিত করিবার এমন একটি অসন্দিগ্ধ ভঙ্গি সত্যের আছে যে তাহাকে অস্বীকার করা একেবারেই অসম্ভব।

পৃথার মুখে চিত্রক যখন নিজের পরিচয় শুনিল তখন ক্ষণেকের তরেও তাহার মনে সন্দেহ বা অবিশ্বাস জন্মিল না। বরং তাহার অতীত জীবনের সমস্ত পূর্বসংযোগ, তাহার সর্বাঙ্গে অসি-রেখাঙ্ক, সমস্তই যেন এই নূতন পরিচয়ের সমর্থন করিল। কিন্তু তথাপি, চিরাভ্যস্ত দর্পণে নিজের মুখ দেখিতে গিয়া কেহ যদি একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখ দেখিতে পায় তাহা হইলে সে যেমন চমকিয়া উঠে, চিত্রকও আদৌ নিজের প্রকৃত পরিচয় জানিতে পারিয়া বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু তাহা ক্ষণেকের জন্য; পরক্ষণেই সে দৃঢ়বলে নিজেকে সম্বরণ করিয়া লইয়াছিল। তাহার মস্তিষ্ক রন্ধ্রে অযুত উন্মত্ত চিন্তা ঝাঁক বাঁধিয়া প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু প্রতুৎপন্নমতি যোদ্ধার সবল সতর্কতার দ্বারা সে তাহার প্রতিরোধ করিয়াছিল। সঙ্কটকালে বুদ্ধিভ্রংশ হইলে সর্বনাশ।

উপরন্তু এই বাহ্য সংযমের তলে তলে তাহার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছিল। শৈশব হইতে যে বিচিত্র বাতাবরণের মধ্যে সে বর্ধিত হইয়াছে, বাঁচিয়া থাকার জৈব চেষ্টায় যে নিষ্ঠুর ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হইয়াছে, তাহা তাহাকে একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র দান করিয়াছিল; এই চরিত্র কঠিন, স্বার্থপরায়ণ, নীতি-বিমুখ ও সুযোগসন্ধী— ইহা আমরা পূর্বে দেখিয়াছি। এখন নিজের প্রকৃত পরিচয় জানিবার পর তাহার নিগূঢ় অন্তর্লোকে ধীরে ধীরে একটি পরিবর্তনের সূত্রপাত হইল; সে নিজেও জানিল না যে তাহার রক্তের প্রভাব— যাহা এতদিন আত্মপরিচয়ের অভাবে সুপ্ত ছিল— তাহা তাহার অর্জিত চরিত্রকে অলক্ষিতে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে আরম্ভ করিয়াছে।

পৃথার মৃত্যুর পরদিন প্রাতঃকালে চিত্রক যখন রাজপুরীতে ফিরিয়া আসিল তখন তাহার মুখের ভাব ক্লান্ত, ঈষৎ গম্ভীর; তাহার অন্তরে যে শীততন্দ্রাচ্ছন্ন বুভুক্ষু নাগ জাগিয়া উঠিয়াছে তাহা কেহ জানিতে পারিল না। চারিদিকে সূর্যকরোজ্জ্বল পুরভূমি, চুর্ণবিলোপিত ভবনগুলি ইতস্তত শুভ্র বুদ্‌বুদ্‌-বিম্বের ন্যায় শোভা পাইতেছে। ইহাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া চিত্রক ভাবিতে লাগিল— আমার! আমার! এ সকলই আমার!

কিন্তু— একথা কাহাকেও বলিবার নয়। বলিলে লোকে হাসিবে, উন্মাদ বলিয়া ব্যঙ্গ করিবে। একজন সাক্ষী ছিল, সে মরিয়া গিয়াছে। সে যদি বাঁচিয়া থাকিত তাহাতেই বা কি হইত? তাহার কথাও কেহ বিশ্বাস করিত না, অসম্ভব প্রলাপ বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিত। কিম্বা যদি বিশ্বাস করিত, তাহা হইলে পরিস্থিতি আরও সঙ্কটাপন্ন হইয়া উঠিত; চিত্রককে বেশি দিন বাঁচিয়া থাকিতে হইত না। বরং এই ভাল। শুধু সুগোপা জানিল, তাহাতে ক্ষতি নাই; সুগোপা-ভগিনী শপথ করিয়াছে কাহাকেও বলিবে না। কিছুদিন নিভৃতে চিন্তা করিবার অবসর পাওয়া যাইবে। তারপর—

এদিকে লক্ষ্মণ কঞ্চুকী গত রাত্রে দুশ্চিন্তায় নিদ্রা যায় নাই। কিন্তু আজ প্রভাতে চিত্রক যখন পলায়নের কোনও চেষ্টা না করিয়া স্বেচ্ছায় রাজপুরীতে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার মন অনেকটা নিশ্চিন্ত হইল; তাহার মনে হইল চতুর ভট্ট বৃথাই চিত্রককে সন্দেহ করিয়াছিলেন। সে দ্বিগুণ সমাদরের সহিত চিত্রকের সেবা করিতে লাগিল।

দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর চিত্রক বিশ্রামের জন্য শয্যাশ্রয় করিলে কঞ্চুকী লক্ষ্মণ বলিল— ‘আজ আপনাকে কিছু অধিক বিমনা দেখিতেছি। চিন্তার কোনও কারণ ঘটিয়াছে কি?’

চিত্রক বলিল— ‘জীবন-মৃত্যুর অচিন্তনীয় সম্ভাব্যতার কথা ভাবিতেছি। পৃথা পঁচিশ বৎসর অন্ধকূপে বন্দিনী থাকিয়াও মরিল না; যেমনি মুক্তি পাইল, সেবা-যত্ন পাইল, অমনি মরিয়া গেল। বিচিত্র নয়?

লক্ষ্মণ বলিল— ‘সত্যই বিচিত্র। মানুষের ভাগ্যে কখন কী আছে কেহই বলিতে পারে না; আজ যে রাজা, কাল সে ভিক্ষুক। এই পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে কতই যে দেখিলাম!’ বলিয়া সে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল।

চিত্রক কঞ্চুকীকে কিয়ৎকাল নিরীক্ষণ করিয়া বলিল— ‘কঞ্চুকী মহাশয়, আপনি কতকাল এই কার্য করিতেছেন?’

‘কঞ্চুকীর কার্য? তা প্রায় বিশ বছর হইল। আমার পিতা আমার পূর্বে কঞ্চুকী ছিলেন—’ লক্ষ্মণের স্বর নিম্ন হইল— ‘রাষ্ট্রবিপ্লবে তিনি হত হন। তারপর নূতন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে কয়েক বছর গেল; ক্রমে বর্তমান মহারাজ আর্যভাবাপন্ন হইলেন। তদবধি আমি আছি।’

‘পূর্বতন রাজার কি হইল?’

‘শুনিয়াছি বর্তমান মহারাজ তাঁহাকে বধ করিয়াছিলেন।’

‘আর রানী?’

‘রানী বিষ ভক্ষণে দেহত্যাগ করেন। তাঁহাকে কেহ স্পর্শ করিতে পারে নাই।’

উদ্‌গত নিশ্বাস চাপিয়া চিত্রক অবহেলাভরে প্রশ্ন করিল— ‘রাজপুত্রটাও নিশ্চয় মরিয়াছিল?’

‘সম্ভবত মরিয়াছিল। কিন্তু তাহার মৃতদেহ পাওয়া যায় নাই।’

চিত্রক আর অধিক প্রশ্ন করিতে সাহস করিল না, তন্দ্রার ছলে জৃম্ভণ ত্যাগ করিয়া চক্ষু মুদিত করিল।

দিনটা বিরস শূন্যতার মধ্য দিয়া কাটিয়া গেল।

সন্ধ্যার প্রাক্কালে চিত্রক উত্তরীয় স্কন্ধে ফেলিয়া ভবন হইতে বাহির হইল। কঞ্চুকী আজ আর তাহার সঙ্গ লইবার চেষ্টা করিল না, শুধু জিজ্ঞাসা করিল— ‘পুরীর বাহিরে যাইবেন নাকি?’

চিত্রক বলিল— ‘না, ভিতরেই একটু ঘুরিয়া বেড়াইব।’

সূর্য অস্ত গিয়াছে। প্রাসাদের বলভিতে কপোতগণ কলহ-কূজন করিয়া রাত্রির জন্য নিজ নিজ বিশ্রামস্থল সংগ্রহ করিতেছে। ক্রমে পূর্বদিগন্ত জ্যোতির্মণ্ডিত করিয়া চন্দ্রোদয় হইল।

পুরভূমি প্রায় জনশূন্য, কদাচিৎ দুই একজন কিঙ্কর-কিঙ্করী এক ভবন হইতে অন্য ভবনে যাতায়াত করিতেছে। চিত্রক অনায়াস-পদে ইতস্তত ভ্রমণ করিতে করিতে অবশেষে একটি শীর্ণ সোপান অতিবাহিত করিয়া প্রাকারে উঠিল।

জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রাকারচক্র রৌপ্যনির্মিত অংসুলির ন্যায় শোভা পাইতেছে। তাহার উপর উদ্‌ভ্রান্ত চিত্তে পরিভ্রমণ করিতে করিতে এক স্থানে আসিয়া চিত্রক সহসা থামিয়া গেল।

অদূরে প্রাকার কুড্যের উপর একটি নারী বসিয়া আছে। জ্যোৎস্নাকুহেলির মধ্যে শুভ্রবসনা রমণীকে তুষারীভূত জ্যোৎস্নার মতই দেখাইতেছে। চিত্রকের চিনিতে বিলম্ব হইল না— কুমারী রট্টা যশোধরা।

রট্টা অন্য মনে চন্দ্রের পানে চাহিয়া আছেন। কোন্‌ বহির্মুখী বৃত্তির আকর্ষণে তিনি আজ প্রাসাদ-শীর্ষের ছাদে না গিয়া একাকিনী এই প্রাকারে আসিয়া বসিয়াছেন তাহা তিনিই জানেন, কিম্বা হয়তো তিনিও জানেন না। চাঁদের পানে চাহিয়া চাহিয়া তিনি কী ভাবিতেছেন তাহাও বোধকরি তাঁহার সচেতন মনের অগোচর।

নিশ্বাস রোধ করিয়া চিত্রক ক্ষণেক দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার ললাটে ধীরে ধীরে তিলক ফুটিয়া উঠিল; তপ্ত সূচির ন্যায় জ্বালাময় অসূয়া হৃদয় বিদ্ধ করিল। ইনি রাজনন্দিনী রট্টা— এই বিস্তীর্ণ রাজ্যের অধীশ্বরী! আর আমি—? এক ভাগ্যান্বেষী অসিজীবী সৈনিক—

অধর দংশন করিয়া চিত্রক নিঃশব্দে ফিরিয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে মৃদু কণ্ঠে আহ্বান আসিল— ‘আর্য চিত্রক বর্মা!’

চিত্রক ফিরিল। রাজকুমারীর কাছে গিয়া যুক্তকরে অভিবাদন করিল, গম্ভীর মুখে বলিল— ‘দেবদুহিতা এখানে আছেন আমি জানিতাম না। জানিলে আসিতাম না।’

রট্টা ঈষৎ হাসিলেন; বলিলেন— ‘কোনও হানি হয় নাই, বরং ভালই হইয়াছে। অবরোধে একাকিনী অতিষ্ঠ হইয়াছিলাম, তাই এখানে আসিয়া বসিয়াছি। আপনিও বসুন।’

চিত্রক বসিল না; কুড্যে বসিলে রাজকন্যার সহিত সমান আসনে বসা হয়; ভূমিতে বসিলে অত্যধিক দীনতা প্রকাশ করা হয়। সে কুড্যের উপর বাহু রাখিয়া দাঁড়াইল; বলিল — ‘আপনার সুগোপা সখী বোধ করি আজ আসিতে পারেন নাই।’

‘সুগোপা আমাকে না দেখিয়া থাকিতে পারে না— প্রভাতে একবার মুহূর্তের জন্য আসিয়াছিল। আপনার কত কথা বলিল। সারারাত্রি জাগিয়া আপনি তাহাকে সাহায্য ও সাহচর্য দান করিয়াছিলেন। এমন কেহ করে না।’

‘সুগোপা আর কিছু বলে নাই?’

রট্টা ঈষৎ বিস্ময়ে চক্ষু ফিরাইলেন— ‘আর কী বলিবে?’

‘না, কিছু না—’ প্রসঙ্গান্তর উত্থাপনের জন্য চিত্রক চন্দ্রের পানে চাহিয়া বলিল— ‘আজ বোধহয় পৌর্ণমাসী।’

‘হাঁ।’ রট্টাও কিয়ৎকাল চাঁদের পানে চক্ষু তুলিয়া রহিলেন— ‘শুনিয়াছি আর্যাবর্তের অন্যত্র আজিকার দিনে উৎসব হয়— বসন্ত ঋতুর পূজা হয়। এখানে কিছু হয় না।’

‘হয় না কেন?’

‘ঠিক জানি না। পূর্বে বোধহয় হইত, এখন হূণ অধিকারের পর বন্ধ হইয়াছে। হূণদের মধ্যে বসন্ত উৎসবের প্রথা নাই। তবে বুদ্ধ-পূর্ণিমার দিন উৎসবের প্রথা মহারাজ পুনঃ-প্রবর্তিত করিয়াছেন।’

এই সকল অলস কথাবার্তার মধ্যে চিত্রক দেখিল, রট্টা প্রাকারের কুড্যের উপর এমনভাবে বসিয়া আছেন যে তাঁহাকে একটু ঠেলিয়া দিলে কিম্বা আপনা হইতে ভারকেন্দ্র বিচলিত হইলে তিনি প্রাকারের বাহিরে বিশ হাত নীচে পড়িবেন; মৃত্যু অনিবার্য। চিত্রকের বুকের ভিতর দুষ্ট বাষ্পের মত একটা অশান্ত উদ্বেগ পাক খাইতে লাগিল। তৃতীয় ব্যক্তি এখানে নাই; রট্টা যদি পড়িয়া যান কেহ কিছু সন্দেহ করিতে পরিবে না। যে বর্বর হূণ তাহার সর্বস্ব অপহরণ করিয়াছে, যাহার হস্তে তাহার পিতা নৃশংসভাবে হত হইয়াছিলেন, এই যুবতী তাঁহারই কন্যা—

চিত্রকের চোখে জ্যোৎস্নার শুভ্রতা লোহিতাভ হইয়া উঠিল।

রট্টার কিন্তু নিজের সঙ্কটময় অবিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য নাই; তিনি স্বচ্ছন্দে নির্ভয়ে কুড্যের উপর বসিয়া আছেন। চিত্রক সহসা যেন নিজেকে ব্যঙ্গ করিয়াই হাসিয়া উঠিল। বলিল— ‘রাজকুমারি, আপনি কুড্য হইতে নামিয়া বসুন। ওখান হইতে নিম্নে পড়িলে প্রাণহানির সম্ভাবনা।’

রট্টা একবার অবহেলাভরে নীচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, বলিলেন— ‘ভয় নাই, আমি পড়িব না। কিন্তু আপনি হাসিতেছেন কেন?’

ক্ষোভে অধর দংশন করিয়া চিত্রক বলিল— ‘ক্ষমা করুন, আমি কৌতুকবশে হাসি নাই। আপনার নির্ভীক অপরিণামদর্শিতা— কিন্তু যাক। রাজনন্দিনি, যদি ধৃষ্টতা না হয়, একটি প্রশ্ন করিতে পারি?

‘কি প্রশ্ন?’

‘আপনি হূণদুহিতা। আর্য জাতি অপেক্ষা হূণ জাতির প্রতি আপনার মনে নিশ্চয় পক্ষপাত আছে?’

কিছুক্ষণ নীরবে মনন করিয়া রট্টা ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘আর্য—! হূণ—! আমার মাতা আর্য ছিলেন, পিতা হূণ। আমি তবে কোন্‌ জাতি? জানি না। সম্ভবত মনুষ্য জাতি।’ রট্টা একটু হাসিলেন,— ‘আর পক্ষপাত? দূত মহাশয়, এই আর্যভূমিতে যাহারা বাস করে তাহাদের সকলের প্রতি আমার পক্ষপাত আছে। কারণ তাহাদের ছাড়া অন্য মানুষ আমি দেখি নাই।’

‘সকলকে আপনি সমান বিশ্বাস করিতে পারেন?’

‘পারি। যে বিশ্বাসের যোগ্য সে আর্যই হোক আর হূণই হোক, বিশ্বাস করিতে পারি।’ রট্টা লঘুপদে কুড্য হইতে অবতরণ করিলেন— ‘এবার আমি অন্তঃপুরে ফিরিব; নহিলে আর্য লক্ষ্মণ রুষ্ট হইবেন।’

চিত্রক বলিল— ‘চলুন, আমি আপনার রক্ষী হইয়া যাইতেছি।’

‘আসুন—’ বলিয়া রট্টা যেন কোন্‌ গোপন কৌতুকে সুন্দর মুখ উদ্ভাসিত করিয়া হাসিলেন; চন্দ্রালোকে সেই হাসি তরঙ্গের মত চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।

চিত্রক ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে বলিল— ‘হাসিলেন কেন?’

রট্টা এবার বঙ্কিম দৃষ্টিতে চটুলতা ভরিয়া তাহার পানে চাহিলেন; মুখ টিপিয়া বলিলেন— ‘ও কিছু নয়। স্ত্রীলোকের হাসি-কান্নার কি কোনও অর্থ আছে?— চলুন।’

গভীর রাত্রে রট্টা শয্যা হইতে উঠিলেন। তাঁহার শয্যার শিয়রে প্রাচীরগাত্রে একটি কুটঙ্গক ছিল, তন্মধ্যে একটি মণিময় ক্ষুদ্র বুদ্ধমূর্তি থাকিত। সিংহল দ্বীপে রচিত নীলকান্তমণির অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এই বুদ্ধমূর্তি মহারাজ রোট্ট ধর্মাদিত্য কন্যাকে উপহার দিয়াছিলেন।

শয্যা হইতে উঠিয়া রট্টা একটি দীপ জ্বালিলেন। ধ্যানাসীন বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে দীপ রাখিয়া তিনি যুক্তকরে তদ্‌গতচিত্তে দীর্ঘকাল ঐ দিব্যমূর্তির পানে চাহিয়া রহিলেন; — বান্ধুলি পুষ্পতুল্য অধর অল্প অল্প নড়িতে লাগিল। তাঁহার কুমারী হৃদয়ের কোন্‌ নিভৃত প্রার্থনা তথাগতের চরণে নিবেদিত হইল তাহা কেবল তথাগত জানিলেন।

তারপর দীপ নিভাইয়া রট্টা আবার শয়ন করিলেন।

পরদিন অপরাহ্লে চষ্টন দুর্গ হইতে বার্তাবহ ফিরিয়া আসিল। মহারাজ রোট্ট ধর্মাদিত্য পত্র দিয়াছেন। পত্র পাঠ করিয়া মন্ত্রী চতুরানন ভট্ট চিন্তিত মনে রট্টার কাছে গেলেন।

‘মহারাজের শরীর ভাল নয়, তিনি আরও কিছুকাল চষ্টন দুর্গে থাকিবেন। কিন্তু কন্যাকে দেখিবার জন্য তাঁহার মন বড় উতলা হইয়াছে।’

রট্টা বলিলেন— ‘আমি পিতার কাছে যাইব।’

চতুরানন বলিলেন— ‘কিন্তু— যাওয়া উচিত কিনা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না।’

‘যাওয়া অনুচিত কেন?’

ইতস্তত করিয়া চতুরানন বলিলেন— ‘কিরাত লোক ভাল নয়। সে চষ্টন দুর্গের সর্বময় কর্তা; তাহার যদি কোনও কুবুদ্ধি থাকে—’

রট্টার মুখ রক্তবর্ণ হইল— ‘কিরূপ কুবুদ্ধি? আপনি কি সন্দেহ করেন, কিরাত পিতাকে নিজের কবলে পাইয়া এখন ছলনা দ্বারা আমাকেও কবলে আনিতে চায়?’

‘কে বলিতে পারে? সাবধানের মার নাই।’

রট্টা সদর্পে বলিলেন— ‘আমি বিশ্বাস করি না। মহারাজের সহিত এরূপ ধৃষ্টতা করিবে কিরাতের এত সাহস নাই। আপনি ব্যবস্থা করুন, কাল প্রাতেই আমি চষ্টন দুর্গে যাইব। পিতৃদেবকে দেখিবার জন্য আমারও মন অস্থির হইয়াছে।’

‘উত্তম। — মহারাজ মগধের দূতকেও চষ্টন দুর্গে আহ্বান করিয়াছেন।’

রট্টার চোখের উপর অৃদশ্য আবরণ নামিয়া আসিল। তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘ভাল। তিনিও আমার সঙ্গে যাইবেন। তাঁহাকে সংবাদ দিন।’

চতুর ভট্ট বলিলেন— ‘সঙ্গে একদল শরীর-রক্ষীও থাকিবে। — ভাল কথা, চষ্টন দুর্গের পথ দীর্ঘ ও ক্লেশদায়ক; পৌঁছিতে দুই দিন লাগিবে। মধ্যে এক রাত্রি পান্থশালায় কাটাইতে হইবে। দেবদুহিতার জন্য দোলার ব্যবস্থা করি?’

‘না, আমি অশ্বপৃষ্ঠে যাইব।’

‘দাসী কিঙ্করী কেহ সঙ্গে যাইবে না?’

‘না।’

রট্টার নিকট হইতে চতুরানন চিত্রকের কাছে গেলেন। চিত্রক সমস্ত কথা শুনিয়া কিছুক্ষণ অধোমুখে বসিয়া রহিল। তাহার বক্ষে যে অদৃশ্য তুষানল জ্বলিতেছিল তাহা সহসা লেলিহ শিখায় আলোড়িত হইয়া উঠিল; কিন্তু সে মনের ভাব গোপন করিয়া উদাস নিস্পৃহ স্বরে বলিল— ‘আমি এখন আপনাদের অধীন; যাহা বলিবেন তাহাই করিব।’

পর দিবস প্রভাতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রট্টা এবং চিত্রক অশ্বারোহণে রাজপুরী হইতে বাহির হইলেন। এক সেনানী পাঁচজন সশস্ত্র আরোহী লইয়া সঙ্গে চলিল।

কপোতকূট নগর তখন জাগিয়া উঠিয়াছে। পথে পথে গৃহ ও বিপণির দ্বার খুলিয়াছে নাগরিকগণ ইতস্তত যাতায়াত করিতেছে; নাগরিকরা কলসী কক্ষে জল ভরিতে যাইতেছে; কেহ বা পূজার অর্ঘ্য লইয়া দেবায়তন অভিমুখে চলিয়াছে। পথের উপর বালকবৃন্দ দল বাঁধিয়া ক্রীড়া করিতেছে। বৈদেহক স্কন্ধে পণ্য লইয়া হাঁকিতেছে— ‘আয়ে লাজা—।’

পুরুষবেশা রট্টা যখন অশ্বক্ষুরধ্বনিতে চারিদিক সচকিত করিয়া রক্ষীসহ রাজপথ দিয়া চলিলেন, তখন জনগণ সকলে পথপার্শ্বে দাঁড়াইয়া সগর্বে উৎফুল্ল নেত্রে দেখিল।

পণ্য পাটকের ভিতর দিয়া যাইবার সময় রট্টা দেখিলেন, চতুষ্পথের উপর একটা কিম্ভূতকিমাকার মানুষকে ঘিরিয়া ভিড় জমিয়াছে। লোকটা রোমশ রুক্ষকেশ স্থূলকায়; অঙ্গে বস্ত্রাদি আছে কিনা ভিড়ের মধ্যে বুঝা যায় না। সে উচ্চকণ্ঠে সকলকে কী একটা কথা বলিতেছে; শুনিয়া সকলে হাসিতেছে ও রঙ্গ তামাসা করিতেছে।

রট্টা অশ্বের রশ্মি সংযত করিয়া একজন পথচারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘ও কে? কী বলিতেছে?’

পথচারী রাজকন্যার সম্বোধনে কৃতার্থ হইয়া হাস্যমুখে বলিল— ‘ও একটা গড্ডল্‌— বলিতেছে ও নাকি কোথাকার রাজদূত।’

চিত্রক একবার দৃষ্টিপাত করিয়াই চিনিয়াছিল-শশিশেখর! সে আর সেদিকে মুখ ফিরাইল না।

রট্টা আবার অশ্বচালনা করিলেন। ক্রমে তাঁহারা নগরের উত্তর দ্বারে উপস্থিত হইলেন। এইখানে শশিশেখরের কথা শেষ করা যাক। সেইদিন সন্ধ্যাকালে নগরের কোট্টপাল মন্ত্রী চতুর ভট্টের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; বলিলেন— ‘একটা বিকৃতবুদ্ধি বিদেশী নগরে প্রবেশ করিয়াছে। সে বলে সে মগধের রাজদূত; কোনও এক তস্কর নাকি তাহার সর্বস্ব কাড়িয়া তাহাকে দিগম্বর করিয়া মৃগয়া-কাননে ছাড়িয়া দিয়াছিল। — লোকটা লতাপাতা দিয়া কোনও ক্রমে লজ্জা নিবারণ করিয়াছে।’

চতুরানন ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া শুনিলেন।

‘তারপর?’

‘নগররক্ষীরা তাহাকে আমার কাছে ধরিয়া আনিয়াছিল। দেখিলাম, লোকটার বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে। কখনও এক কথা বলে, কখনও অন্য কথা বলে, কখনও বুদবুদাক্ষ হইয়া ক্রন্দন করে। তাহাকে লইয়া কি করিব বুঝিতে না পারিয়া কোৎঘরে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছি।’

চতুর ভট্ট বলিলেন— ‘বেশ করিয়াছ। গর্ভদাসটা একদিন আগে আসিতে পারিল না! এখন আর উপায় নাই। আপাতত কিছুদিন লপ্সিকা ভক্ষণ করুক, তারপর দেখা যাইবে।’

অতঃপর এ কাহিনীর সহিত শশিশেখরের আর কোনও সম্বন্ধ নাই। শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই আখ্যায়িকা শেষ হইবার পূর্বেই সে মুক্তি পাইয়াছিল এবং ভবিষ্যতে আর কখনও দেশ পর্যটনে বাহির হইবে না প্রতিজ্ঞা করিয়া স্বদেশে ফিরিয়া গিয়াছিল।