নিকের সঙ্গে চলল দুই গোয়েন্দার ইঁদুর-বেড়াল খেলা। ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে খেলাটা। রাত দুটোর বেশি। এই সময় রাস্তায় যানবাহনের ভিড় খুব কম। নিকের অগোচরে থাকার জন্যে কয়েক ব্লক দূরে থেকে অনুসরণ করতে হচ্ছে মুসাকে।
এত কষ্ট তো করছি, হাই তুলে বলল সে, ফল পেলেই হয় এখন।
আমি কি ভাবছি জানো? কিশোর বলল, নিক আমাদেরকে ডিলনের কাছে নিয়ে যাবে। যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।
সোজা হয়ে বসল মুসা। গতি বাড়িয়ে ক্যামারোর দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। বোনহেড আর নিক এই কিডন্যাপে জড়িত?
শীতল, ভোতা গলায় জবাব দিল কিশোর, ওরা মিথ্যুক।
লস অ্যাঞ্জেলেসের সম্ভ্রান্ত এলাকা বেল এয়ারে এসে ঢুকল ওরা। তিনতলা গোলাপী রঙ করা একটা কাঠের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল নিক। টালির ছাত বাড়িটার। চাঁদের আলোয় উইলো গাছ বিচিত্র ছায়া ফেলেছে, যেন বাড়িটার পটভূমিতে ঘাপটি মেরে রয়েছে একটা বেড়াল।
গাড়ি থেকে বেরোল নিক। ঘুমন্ত অঞ্চলটার ওপর চোখ বোলাল। গাড়ি থেকে কালচে রঙের একটা ব্যাকপ্যাক বের করে পিঠে বেঁধে সাবধানে এগোল অন্ধকার বাড়িটার দিকে। ওর আচরণেই বোঝা যাচ্ছে, সিকিউরিটি সিসটেমে পা দিয়ে। বসার ভয় করছে।
চুরি করে ঢোকার তালে আছে, ফিসফিস করে বলল মুসা। নইলে দরজায় টোকা দিত।
ওরাও বেরোল গাড়ি থেকে। অনেক বেশি সতর্ক হয়ে আছে। সিকিউরিটি সিসটেম চালু করে বিপদে পড়তে চায় না ওরাও। নিকের হাতে ধরা পড়তে চায় না।
বাড়ির সামনের দিকে এগোল নিক, প্রতিটি জানালা দেখতে দেখতে।
পুরানো মোটা একটা গাছের আড়ালে লুকাল কিশোর আর মুসা।
কি করছে? মুসার প্রশ্ন।
জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, কিশোর বলল। বাড়িতে কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখো, ঘোট একটা জিনিস ধরে রেখেছে মুখের কাছে। নিশ্চয় টেপ রেকর্ডার। কথা বলছে।
কথা বলা শেষ করে একটা ক্যামেরা বের করে অন্ধকার জানালার ভেতর দিয়ে ছবি তুলতে লাগল নিক। তারপর গিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।
বোনহেডের ওখানেই গেল, হতাশ ভঙ্গিতে বলল মুসা। যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেলাম আমরা। এগোতে আর পারলাম না।
চুপ করে রয়েছে কিশোর। কিছু বলছে না।
গাড়িতে উঠেও চুপ হয়ে রইল সে। সীটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়।
পরদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে বসেছে তিন গোয়েন্দা। রবিনও এসেছে। আগের রাতের ঘটনাগুলোর কথা তাকে বলছে অন্য দুজন।
সাংঘাতিক কাণ্ড করে এসেছ, রবিন বলল। কিন্তু ডিলনের হলোটা কি? তাকে কি বের করা যাবেই না?
কাল রাতে পাইনি বলে যে কোনদিনই পাব না, তা হতে পারে না, কিশোর বলল। একটা জরুরী কথা জানতে পেরেছি কাল। ডিলনের ওপর বোনহেডের খুব প্রভাব।
এবং বোনহেড মিছে কথা বলেছে, যোগ করল মুসা। বলেছে, ডিলনের বাড়িতে কখনও যায়নি, অথচ ওই বাড়িতে যে একটা ভাস্কর্য আছে সেটা জানে।
ছাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কিছু ভাবছে। বিড়বিড় করে বলল, মনে হয় ভুল লোকের পিছে ছুটেছি আমরা…
ট্রেলারের দরজায় টোকা পড়ল। ক্ষণিকের জন্যে জমে গেল যেন সবাই। দরজা খোলার আগে শার্টটা প্যান্টের ভেতরে গুঁজে নিল কিশোর।
হাই, বলল একটা মেয়ে। ওর লম্বা, সোনালি চুল এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। সবুজ চোখ। রবিন আছে?
অ্যাঁ! অস্বস্তি আরম্ভ হয়ে গেছে কিশোরের। পেছনে তাকিয়ে রবিনের মুখ দেখে নিল একবার। তারপর মেয়েটার দিকে ফিরে ডাকল, এসো, ভেতরে।
আই, রবিন, একটা হাসি দিয়ে বলল মেয়েটা, বেশি তাড়াতাড়ি চলে এলাম?…বাপরে, কি জায়গা!
তাড়াতাড়ি? না না, আসলে আমিই ভুলে গিয়েছি। জরুরী আলোচনা চলছে। তো…পরিচয় করিয়ে দিই। আমার বন্ধু কিশোর পাশা…
সুন্দর নাম তো, মেয়েটা বলল। নিশ্চয় আমেরিকান নয়?
না। বাংলাদেশী..আর ও মুসা আমান।
হাই, বলল মুসা। কোন হাই স্কুল?
হলিউড হাই, হেসে বলল রবিন, মেয়েটার হয়ে। ওর নাম চায়না।
মেয়েটাও হাসল। হাসার সময় নিচের ঠোঁটে কামড় লাগে তার। রবিনকে জিজ্ঞেস করল, আরও দেরি হবে?
না, অস্বস্তি বোধ করছে রবিনও। যাওয়ারও ইচ্ছে আছে, আবার এখানেও থাকতে চায়। আমতা আমতা করে শেষে বলে ফেলল, কিশোর, আজ রাতে চায়নাদের বাড়িতে পার্টিতে একটা ব্যাও গ্রুপ পাঠাতে হবে। আমাকে যেতে হচ্ছে এখন।
যেতে হলে যাও, ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।
আর কদিন পরে তোমার চেহারাই ভুলে যাব আমরা, বিষণ কণ্ঠে বলল মুসা। কেন যে বড় হতে গেলাম! ছোট ছিলাম আগে, সে-ই ভাল ছিল…
হ্যাঁ, সময় তো আর সব সময় এক রকম যায় না, কষ্ট রবিনেরও হচ্ছে। ভাবছি ট্যালেন্ট এজেন্সির চাকরিটাই ছেড়ে দেব। আমার লাইব্রেরিই ভাল। দেখি…
অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে চায়না। কথাবার্তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
তোমরা চালিয়ে যাও, বেরোনোর আগে বলল রবিন। জরুরী প্রয়োজন পড়লে ফোন করো আমাকে।
দুজনে বেরিয়ে গেলে কিশোর বলল, মেয়েটাকে দেখলে?
ভালমত, জবাব দিল মুসা।
ভাবতে অবাক লাগে, বুঝলে, এই সেই আমাদের মুখচোরা রবিন! কি স্মার্ট হয়ে গেছে। আর মেয়েগুলোও যেন সব ওর জন্যে পাগল। আচ্ছা, আমাদের দিকে তাকায় না কেন, বলো তো?
ভুল বললে। তোমার দিকে তো তাকায়ই, তুমিই তাকাও না। মেয়েদের সামনে মুখ ওরকম হাঁড়ির মত করে রাখলে কি আর পছন্দ করবে ওরা? তোমার কথাবার্তাও বড় বেশি চাছাছোলা। আসলে একমাত্র জিনাই সহ্য করতে পারে তোমাকে, তুমিও পারো। দুজনেরই স্বভাব এক তো…
হাত নাড়ল কিশোর। বাদ দা ও মেয়েদের আলোচনা। আসল কথায় আসি…আমাদের কেস…
পরদিন শনিবার। সৈকতে সাঁতার কাটতে গেল তিন গোয়েন্দা। নভেম্বর সাঁতারের মাস নয়। কেবল মুসার মত পানি-পাগল কিছু মানুষ ছাড়া সাগরে যেতে চায় না। আবহাওয়াটা সেদিন ভাল বলে কিশোর আর রবিনকে রাজি করাতে পেরেছে সে। কিন্তু সৈকতে এসে মত পরিবর্তন করল দুজনে। শেষে একাই গিয়ে। পানিতে নামতে হলো মুসাকে। খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে ভাল না লাগায় উঠে এল। ইয়ার্ডে ফিরে চলল ওরা।
পরদিন শনিবার। হেডকোয়ার্টারের বাইরে দুটো পুরানো চেয়ারে বসে কথা বলছে কিশোর আর মুসা। এই সময় রবিনের গাড়িটা ঢুকতে দেখা গেল।
গাড়ি থেকে নামল রবিন আর চায়না।
এই সেরেছে রে! বলে উঠল মুসা, একেবারে বান্ধবীকে নিয়েই হাজির!
বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকাল কিশোর। কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল রবিন আর, চায়নার দিকে।
এগিয়ে এল রবিন। বুঝলে কিশোর, খুব ভাল গাইতে পারে চায়না। গত রাতে পার্টি ও একাই মাত করে রেখেছিল।
তাই নাকি? খুব ভাল, দায়সারা জবাব দিয়ে চুপ হয়ে গেল কিশোর।
আরও একটা ভাল ব্যাপার আছে, হেসে বলল রবিন। কিশোরের চুপ হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছে। পটার বোনহেডের ব্যাপারে আর আগ্রহ আছে?
ঝট করে মুখ তুলল কিশোর। কেন? কিছু জেনেছ নাকি?
চায়নার দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, তুমিই বলো?
বোনহেডের সমস্ত বই আমি পড়েছি। একটা চেয়ারে বসল চায়না। ঝুঁকি দিয়ে মুখ থেকে চুল সরাল। একটা মেটাফিজিক্যাল মিনিকিউব। তবে এই বয়েসেও বাদিং সুটে ভালই লাগে ওকে।
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝকাল রবিন। দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাতে চায়নাদের বাড়ির সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে নেমেছিল বোনহেড।
পুরো সতর্ক হয়ে গেছে কিশোর।
প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা, কিন্তু ও তো সাঁতার জানে না!
সেটা কি আর মানতে চায়, রবিন বলল। মনের খোলা অংশ না কি ঘোড়ার ডিম নিয়ে লম্বা এক লেকচার ঝেড়ে দিল। ছয় জন লোক গিয়ে তুলে এনেছে তাকে, নইলে ডুবেই মরত। ওস্তাদ শোম্যান বলতে হবে। একজন বৃদ্ধার দিকে তার নজর, মহিলা সাংঘাতিক ধনী। আরও কি করেছে, শোনো। দাঁড়াও, দেখাই, একটা ছোট নুড়ি কুড়িয়ে আনল রবিন। একটা স্ফটিককে এরকম করে হাতের তালুতে রেখে বিড়বিড় করে কি পড়ল। তারপর মহিলার কপালে ছোঁয়াল, এমনি করে, বলে চায়নার কপালে পাথরটা ছুঁইয়ে দেখিয়ে দিল কি ভাবে চুঁইয়েছে। বোনহেড। ভারি গলায় বলতে লাগল, লোকটার স্বর নকল করে বলার চেষ্টা করল রবিন, মিসেস অ্যাণ্ডারসন, আপনার সঙ্গে আগে কখনও দেখা হয়নি আমার। অথচ আমি অনুভব করছি, আমাদের পথ দুদিক থেকে এসে এক জায়গায় মিলিত হতে যাচ্ছে।
আর চুপ থাকতে পারল না চায়না। মিসেস অ্যাণ্ডারসনের অনুকরণে বলল, কি যে বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনার বাড়ির দেয়ালে, বোনহেডকে অনুকরণ করল। রবিন, শুগলের আঁকা একটা ছবি ঝুলছে। কাঠের ফ্রেম। ডান দিকে নিচের কোণটা ভাঙা। পড়ে গিয়েছিল হয়তো।
ঠিক, ঠিক বলেছেন! আপনি জানলেন কি করে? চায়না বলল।
ওর কপালে নুড়িটা আলতো করে চুঁইয়ে চোখ মুদল রবিন। আরও অনেক কিছুই জানি আমি। একটা অ্যানটিক সিরামিক বাউলে একটা বেড়াল ছানা ঘুমিয়ে আছে!
আশ্চর্য! অবিশ্বাস্য! চিৎকার করে উঠল চায়না, দক্ষিণাঞ্চলীয় টানে। অবশ্যই টানটা মিসেস অ্যাণ্ডারসনের।
আবার চায়নার কপালে পাথর ছোঁয়াল রবিন। উইলো গাছটাও দারুণ। বাড়ির ওপর ছায়া ফেলেছে এমন করে, মনে হচ্ছে একটা বেড়ালের ছায়া।
উইলো গাছ? বেড়ালের ছায়া? চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। নিক!
তার দিকে তাকাল না রবিন। অভিনয় চালিয়ে গেল। চায়নার দিকে মাথা সামান্য নুইয়ে বাউ করে বলল, আশা করি ঠিক ঠিক বলতে পেরেছি সব।
তাহলে এই ব্যাপার, মাথা দুলিয়ে বলল কিশোর। সে রাতে মিসেস অ্যাণ্ডারসনের বাড়িতেই গিয়েছিল নিক, তথ্য জোগাড় করতে, চায়নাদের পার্টিতে মহিলাকে তাজ্জব করে দেয়ার জন্যে।
করতে পেরেছে, রবিন বলল। গেঁথে ফেলেছে মহিলাকে। পরামর্শ দাতা হিসেবে বোনহেডকে বহাল করতে রাজি হয়ে যাবে মিসেস অ্যাণ্ডারসন। বললেই মোটা অংকের চেক লিখে দেবে।
শয়তান লোক! ঠগবাজ!
ডিলনের বাড়িতে না গিয়েও এভাবেই ভাস্কর্যটার কথা জেনেছে বোনহেড, মুসা বলল। নিশ্চয় ছবি তুলে নিয়ে এসেছিল নিক।
আমিও তখনই বুঝতে পেরেছি, ঠকাচ্ছে, রবিন বলল। মুখের ওপর বলার সাহস হয়নি। গায়ের জোরে পারতাম না। কারাত-ফারাত কিছু খাটত না ওর সঙ্গে, পিষে ফেলত আমাকে।
আমি হলাম একটা গাধা! জোরে জোরে কপালে চাপড় মারল মুসা। রামছাগল! নইলে ভুললাম কি করে!
কি ভুলেছ?
বলেছি না, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল মুসা, বোনহেডকে আগেও কোথাও দেখেছি, শুটিং স্পটে দেখার আগে। ও হল টমি দা টু-টন টিটান! অনেক বছর আগে টিভিতে দেখতাম ওকে, রেসলার ছিল। রিঙে উঠত দুটো কাল ধাতুর টুকরো নিয়ে। গুল মারত একেকটা টুকরো একেক টন। সে জন্যেই নাম হয়েছে টু-টন। আরও চাপাবাজি করত। বুকে চাপড় মেরে বলত, আমি হলাম পৃথিবীর সব চেয়ে শক্তিশালী রেসলার।
ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে কিশোর। রবিন আমার বিশ্বাস, মুসা কাল রাতে ভজঘট করে দেয়ার পর আর ফোন ধরবে না ডিলন। তার সঙ্গে। যোগাযোগ করতে হলে তখন অলিংগারকে বেরোতেই হবে। যেখানে লুকিয়ে আছে ডিলন। আমরা তখন তার পিছু নেব।