১০ম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রের সবিস্তার কর্ণবধবৃত্তান্তশ্রবণেচ্ছা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র শোকব্যাকুল ও বিষামদগ্ন হইয়া এইরূপ বহুতর বিলাপপূর্ব্বক পুনর্ব্বার সঞ্জয়কে কহিলেন, “বৎস! যে বীর দুর্য্যোধনের বৃদ্ধির নিমিত্ত সমুদয় কম্বোজ, অম্বষ্ট, কৈকেয়, গান্ধার ও বিদেহগণকে জয় করিয়া সমুদয় পৃথিবী বশীভূত করিয়াছিল, বাহুবলশালী পাণ্ডবগণ শরনিকরদ্বারা সেই কর্ণকে সমরে পরাজিত করিয়াছে। সেই মহাধনুর্দ্ধর অর্জ্জুনশরে নিহত হইলে অস্মৎপক্ষীয় কোন্ কোন্ বীর সমরাঙ্গনে অবস্থান করিল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর। সূতপুত্র পাণ্ডবশরে নিহত হইলে অস্মৎপক্ষীয় বীরগণ ত’ তাহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করে নাই? হে সঞ্জয়! যে বীর যেরূপে নিহত হইয়াছে, তুমি তাহা ইতিপূর্ব্বে আমার নিকট বর্ণন করিয়াছ। দ্রুপদনন্দন শিখণ্ডী উৎকৃষ্ট শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক প্রতিপ্রহারপরাঙ্মুখ ভীষ্মদেবকে নিপাতিত এবং মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন মহাধনুৰ্ধর ন্যস্তশস্ত্র [অস্ত্রপরিত্যাগী] যোগান্বিত দ্রোণাচাৰ্য্যকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া খড়্গাঘাতে নিহত করিয়াছে। ঐ বীরদ্বয়ের মৃত্যু ছিদ্রান্বেষণতৎপর অরাতিগণের ছলপ্রভাবেই হইয়াছে। ন্যায়যুদ্ধে বজ্রধর ইন্দ্রও উহাদিগকে সংহার করিতে সমর্থ নহেন। যাহা হউক, এক্ষণে দিব্যাস্ত্রবর্ষী ইন্দোপম মহাবীর কর্ণ কিরূপে মৃত্যুগ্রস্ত হইল, তাহা কীৰ্ত্তন কর। সুররাজ পুরন্দর যাহাকে কবচ ও কুণ্ডলযুগলের বিনিময়ে কনকভূষণ, অরাতিনিপাতন দিব্যশক্তি প্রদান করিয়াছিলেন, যাহার নিকট সুবর্ণভূষণ সর্পমুখ দিব্যশর বিদ্যমান ছিল, যে বীর ভীষ্ম, দ্রোণপ্রমুখ মহারথগণকে অবজ্ঞা করিয়া জামদগ্ন্যের [পরশুরামের] নিকট ভয়ঙ্কর ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিল, যে বীর শরপীড়িত দ্রোণপ্রমুখ বীরগণকে বিমুখ দেখিয়া শরনিকরে সৌভদ্রের শরাসনচ্ছেদনে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিল, যে বীর অযুতনাগতুল্য পরাক্রান্ত ও বজ্রের ন্যায় বেগবান ভীমসেনকে সহসা বলহীন করিয়া উপহাস করিয়াছিল, যে বীর নতপর্ব্বশরনিকরে সহদেবকে নির্জ্জিত ও বিরথ করিয়া কেবল ধর্ম্মানুরোধে নিহত করে নাই, যে বীর ইন্দ্রশক্তিদ্বারা অশেষমায়াবলম্বী, জয়লিপ্সু, রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচকে নিপাতিত করিয়াছে এবং মহাবীর ধনঞ্জয় ভীত হইয়া যাহার সহিত এতাবৎকাল দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় নাই, সেই মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ কিরূপে সংগ্রামে নিহত হইল? তাহার রথ ভগ্ন, শরাসন বিশীর্ণ বা অস্ত্র বিনষ্ট না হইলে সে কখনই অরাতিশরে নিপাতিত হইত না। মহাবীর কর্ণ সমরে মহাচাপ বিঘূর্ণনপূর্ব্বক ভীষণ শর ও দিব্যাস্ত্রসমুদয় পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলে তাহাকে পরাজিত করা কাহার সাধ্য? হে সঞ্জয়! তোমার মুখে কর্ণের নিধনবার্ত্তাশ্রবণে আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, তাহার শরাসন ছিন্ন বা রথ ভূতলগত অথবা অস্ত্রসমুদয় বিনষ্ট হইয়াছিল। এই সমুদয়ের অন্যতর কারণ ব্যতীত আর কিছুতেই তাহার বিনাশের সম্ভাবনা নাই।
“হে সঞ্জয়! যে মহাত্মা ‘আমি অর্জ্জুনকে নিহত না করিয়া পাদ প্রক্ষালন করিব না’ বলিয়া দৃঢ়ব্রত করিয়াছিল, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির যাহার রণনৈপুণ্য স্মরণে ভীত হইয়া ত্রয়োদশ বৎসর নিদ্রাগত হয় নাই, যে বীরের বলবীর্য্যপ্রভাবে আমার পুত্র দুর্য্যোধন পাণ্ডবগণের প্রেয়সী পাঞ্চালীকে বলপূর্ব্বক সভামধ্যে আনয়ন করিয়া পাণ্ডবগণসমক্ষে দাসভাৰ্য্যা বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিল, যে বীর রোষাবিষ্ট হইয়া সভামধ্যে দ্রৌপদীকে ‘হে বরবর্ণিনি! তোমার ষণ্ডতিলসদৃশ পতিগণ আর বর্ত্তমান নাই; অতএব অন্য কোন ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ কর’ বলিয়া উপহাস করিয়াছিল, সেই সূতনন্দন কিরূপে শত্ৰুকর্ত্তৃক নিহত হইয়াছে? ঐ মহাবীর পূর্ব্বে দুৰ্য্যোধনকে কহিয়াছিল, হে মহারাজ! আপনি চিন্তা পরিত্যাগ করুন। যদি সমরনিপুণ ভীষ্ম ও যুদ্ধদুর্ম্মদ দ্রোণাচাৰ্য্য পক্ষপাতপযুক্ত কৌন্তেয়গণকে নিপাতিত না করেন, তবে আমি উহাদের সকলকেই নিহত করিব। আমার স্নিগ্ধচন্দনদিগ্ধ শর সমরাঙ্গনে ধাবমান হইলে গাণ্ডীবশরাসন ও অক্ষয়তূণীরদ্বয় কি করিতে পারিবে? যে মহাধনুর্দ্ধর এইরূপে আস্ফালন করিয়া দুৰ্য্যোধনকে আশ্বস্ত করিয়াছিল, সেই সূতপুত্র কিরূপে অর্জ্জুনকর্ত্তৃক নিহত হইয়াছে? যে মহাবীর গাণ্ডীবনর্ম্মুক্ত শরনিকরের উগ্রতা অগ্রাহ্য করিয়া দ্রৌপদীকে ‘হে পাঞ্চালি! তুমি পতিহীনা হইয়াছ’ বলিতে বলিতে পাণ্ডবগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল, যে বীর বাহুবলপ্রভাবে মুহূর্ত্তকালও জনার্দ্দন ও সপুত্র পাণ্ডবগণ হইতে ভীত হয় নাই, আমার মতে পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্রাদি দেবগণও তাহাকে সংগ্রামে বিনাশ করিতে সমর্থ নহেন। অধিরথনন্দন কর্ণ মৌৰ্ব্বী [ধনুকের গুণ] স্পর্শ বা বর্ম্ম ধারণ করিলে কোন্ ব্যক্তি তাহার অগ্রে অবস্থান করিতে পারে? বরং ভূমণ্ডল চন্দ্র, সূৰ্য্য ও বহ্নির অংশুবিহীন হইতে পারে, কিন্তু সমরে অপরাঙ্মুখ কর্ণের বিনাশ কখনই সম্ভবপর নহে।
“‘আমার পুত্র দুর্ব্বুদ্ধি দুৰ্য্যোধন যে সূতপুত্র কর্ণ ও ভ্রাতা দুঃশাসনকে সহায় করিয়া বাসুদেবকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল, বোধ করি, সে এক্ষণে তাহাদের উভয়কে নিহত অবলোকন করিয়া নিতান্ত শোকসন্তপ্ত হইতেছে। হে সঞ্জয়! দুৰ্য্যোধন দ্বৈরথযুদ্ধে অর্জ্জুনকর্ত্তৃক কর্ণকে নিহত ও পাণ্ডবগণকে জয়যুক্ত দর্শন করিয়া কি কহিল? বোধ করি, সে দুর্ম্মর্ষণ ও বৃষসেনকে নিহত, সৈন্যসমুদয়কে মহারথগণকর্ত্তৃক ভগ্ন, ভূপতিগণকে পলায়নপরায়ণ এবং রথীগণকে বিদ্রুত অবলোকন করিয়া শোকার্ণবে নিমগ্ন হইয়াছে। হে সঞ্জয়! দুর্ব্বিনীত, অভিমানী, দুর্ব্বুদ্ধি, অজিতেন্দ্রিয় দুর্য্যোধন পূর্ব্বে সুহৃদগণকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও ঐ সুমহান্ বৈরাগ্নি প্রজ্বলিত করিয়াছে। এক্ষণে সৈন্যগণকে ভগ্নোৎসাহ ও প্রধান প্রধান বীরগণের প্রায় সমুদয়কে নিহত দেখিয়া কি কহিল? গান্ধাররাজ শকুনি পূর্ব্বে সন্তুষ্টচিত্তে দ্যূতক্রীড়া করিয়া পাণ্ডবগণকে বঞ্চিত করিয়াছিল; এক্ষণে সে কর্ণকে নিহত অবলোকন করিয়া কি বলিল? সাত্বতবংশীয় মহারথ মহাধনুর্দ্ধর কৃতবর্ম্মা কর্ণকে নিহত দেখিয়া কি কহিলেন? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণ যাঁহার নিকট ধনুর্ব্বেদশিক্ষা করিতে বাঞ্ছা করেন, সেই রূপযৌবনসম্পন্ন মহাযশস্বী দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা কর্ণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া কি বলিলেন? আর ধনুৰ্বেদবিশারদ রথীসত্তম কৃপ, কর্ণের সারথ্যকাৰ্য্যে নিযুক্ত রণদুর্ম্মদ মহাধনুর্দ্ধর মদ্ররাজ শল্য এবং যুদ্ধার্থ সমাগত অন্যান্য নৃপতিগণই বা কর্ণকে নিহত দেখিয়া কি কহিলেন?
“হে সঞ্জয়! পূর্ব্বে নরশ্রেষ্ঠ মহাবীর দ্রোণ নিহত হইলে কোন্ কোন বীর অংশক্রমে সেনামুখে অবস্থান করিয়াছিলেন? মহারথ মদ্ররাজ শল্য কি নিমিত্ত কর্ণের সারথ্যকার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন? মহারথ সূতপুত্র সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে কোন কোন বীর তাঁহার দক্ষিণচক্র, কে বামচক্র এবং কাহারাই বা পৃষ্ঠদেশ রক্ষা করিয়াছিল? তৎকালে কোন্ কোন্ মহাবীর কর্ণকে পরিত্যাগ করেন নাই এবং কাহারাই বা ক্ষুদ্রভাব অবলম্বনপূর্ব্বক তাঁহার সমীপ হইতে পলায়নে প্রবৃত্ত হইয়াছিল? এক সমবেত কৌরবগণসমক্ষে মহারথ কর্ণ কিরূপে নিহত হইল? মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ পাণ্ডবগণ সমরে সমাগত হইয়া কিরূপে জলধারাবর্ষী জলদের ন্যায় শরবর্ষণ করিতে লাগিল এবং মহাবীর কর্ণের সেই সর্পমুখ দিব্যশর কি নিমিত্ত তকালে ব্যর্থ হইয়া গেল? তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।
“হে সঞ্জয়! যখন আমাদের প্রধান প্রধান বীরগণ নিহত হইয়াছে, তখন আমি হতোৎসাহ অবশিষ্ট সৈন্যগণকেও নিঃশেষিত বোধ করিতেছি। মহাধনুর্দ্ধর মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণ আমার নিমিত্ত প্রাণত্যাগ করিয়াছেন শ্রবণ করিয়া আমি কিরূপে জীবনধারণ করিব? যাহার অযুত কুঞ্জরের তুল্য বাহুবল ছিল, এক্ষণে সেই কর্ণও পাণ্ডবকর্ত্তৃক নিহত হইল। আমি বারংবার আর এরূপ ক্লেশ সহ্য করিতে পারি না। যাহা হউক, দ্রোণের নিধনানন্তর মহাবীর কর্ণ কৌরবগণের হিতার্থে পাণ্ডবগণের সহিত কিরূপ সংগ্রাম করিয়া প্রাণপরিত্যাগ করিল, তাহা সমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”