১০. দূর পাহাড়ের দিকে

বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি মহামান্য থুল দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলেন, তার পাশে তথ্যবিজ্ঞানী জুহু দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবার সাথে সাথে চারদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসে।

মহামান্য থুল নিচু গলায় বললেন, যতক্ষণ সূর্য আকাশে থাকে ততক্ষণ একটিবারও মনে হয় না সেটি আড়াল হয়ে গেলে অন্ধকার নেমে আসবে।

তথ্যবিজ্ঞানী জুহু কী বলবে বুঝতে না পেরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। মহামান্য থুল মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের হাতে আর কতোক্ষণ সময় আছে?

সময় নেই। রবোমানবেরা ইচ্ছে করলে এখন যে কোনো মুহূর্তে নেটওয়ার্ক দখল করে নিতে পারে। তারা করছে না, অনুমান করছি তারা আরো একটু গুছিয়ে নিতে চাইছে।

তার মানে আমাদের হাতে খুব বেশি হলে আটচল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘণ্টা সময়।

জুহু বলল, কিংবা আরো কম!

নেটওয়ার্কটি দখল করে নেবার পর কী হবে বলতে পারবে?

সবার আগে আমাদের এগারোজনকে খুন করবে।

তারপর?

তারা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের সকল তথ্য পেয়ে যাবে। যত প্রতিষ্ঠান আছে তা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। পানি, বিদ্যুৎ, খাবার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবে। চিকিৎসার নিয়ন্ত্রণ নেবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করবে। এক সময় পৃথিবীতে বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডার ছিল, এখন নেই। যদি থাকত তাহলে সবার আগে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতো।

তারপর কী করবে বলে তোমার ধারণা?

পৃথিবীর সবচেয়ে কর্মক্ষম মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে যাবে।

হত্যা করার জন্যে?

ভয় দেখানোর জন্যে প্রথমে নিশ্চয়ই অনেক মানুষকে হত্যা করবে। তারপর তারা কর্মক্ষম মানুষগুলোকে রবোমানবে পাল্টে দিতে শুরু করবে।

তারপর?

তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব মানুষকে রবোমানবে পাল্টে দেবে। কেউ কেউ হয়তো পালিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ রবোমানব হয়ে যাবে। নেটওয়ার্ক দিয়ে নিখুঁতভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে।

তারপর?

জুহুকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল। ইতস্তত করে বলল, পৃথিবীর সব মানুষকে রবোমানবে পাল্টে দেয়ার পর কী আর কিছু বাকি থাকল?

নিশ্চয়ই বাকি আছে। তারপর কী হবে বলে তোমার ধারণা?

জুহু কোনো উত্তর দিল না।

রবোমানব বাবা-মায়ের রবোমানব সন্তান হবে পরের প্রজন্ম?

নিশ্চয়ই তাই হবে।

মহামান্য থুল খুব ধীরে ধীরে ঘুরে জুহুর দিকে তাকালেন, বললেন, তোমার ধারণা মানুষের মায়েরা যেভাবে তাদের সন্তানদের ভালোবেসে বুক আগলে রক্ষা করে রোমানবের মায়েরাও তাই করবে? যে ভালোবাসাকে তাদের মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সন্তানের জন্যে সেই ভালোবাসা আবার ফিরে আসবে?

জুহু ইতস্তত করে বলল, আমি জানি না মহামান্য থুল। আমি সত্যিই জানি। আপনি কী জানেন?।

না। জানি না।

আপনি কি অনুমান করতে পারেন?

যে বিষয়টি সত্যি সত্যি জানা সম্ভব আমি সেটা অনুমান করতে চাই না।

এটা সত্যি সত্যি জানা সম্ভব?

মহামান্য থুল হাসলেন, বললেন, আজকে শুধু আমি প্রশ্ন করব। তুমি উত্তর দেবে। ঠিক আছে?

আপনি যেটি বলবেন সেটিই হবে মহামান্য থুল।

এবার আমি তোমাকে সম্পূর্ণ অন্য একটি প্রশ্ন করি।

জুহু মাথা নেড়ে বলল, করেন মহামান্য থুল।

আমাদের নেটওয়ার্কটি যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কী হবে?

জুহু চোখ বড় বড় করে মহামান্য থুলের দিকে তাকাল, আমতা আমতা করে বলল, নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে গেলে?

হ্যাঁ। আমাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে গেলে-

আমাকে ক্ষমা করবেন মহামান্য থুল, কিন্তু আপনার প্রশ্নটি তো একটি অবাস্তব প্রশ্ন। এই নেটওয়ার্কটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন কোনোভাবে এটি ধ্বংস না হয়। ঝড়, ভূমিকম্প, সুনামি, বন্যা, নিউক্লিয়ার বোমা কোনো কিছু যেন ধ্বংস করতে না পারে ঠিক সেভাবে এই নেটওয়ার্কটি তৈরি করা হয়েছে। মহামান্য থুল আপনি সবচেয়ে ভালো করে জানেন কোনোভাবে এই নেটওয়ার্ক

ধ্বংস করা সম্ভব নয়, আপনার যৌবনে আপনি এর ডিজাইন টিমে ছিলেন।

হ্যাঁ। আমি ছিলাম। আমি জানি যদি একটি নেটওয়ার্ক কোনোভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তাহলে সেই নেটওয়ার্ককে পৃথিবীর সব মানুষের দায়িত্ব দেয়া যায় না। কাজেই এই নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করা যাবে না। তারপরেও আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করি, যদি এই নেটওয়ার্কটি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কী হবে?

জুহু মাথা চুলকে বলল, মহামান্য থুল, আমার কথাকে আপনি ধৃষ্টতা হিসেবে নেবেন না। আপনার প্রশ্নটি অনেকটা এরকম, আমরা জানি পৃথিবীর আহ্নিক গতি কখনো বন্ধ হবে না, এটি সবসময়েই নিজের অক্ষের উপর চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘুরবে। কিন্তু যদি বন্ধ হয় তাহলে কী হবে?

মহামান্য থুল হাসলেন, বললেন, হ্যাঁ। অনেকটা সেরকম।

জুহু বলল, মুহর্তে পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। পানি, খাবার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলবে না। প্লেন উড়বে না। মানুষ মানুষকে চিনবে না। কাজে বের হয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসতে পারবে না। চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। স্কুল কলেজ গবেষণা বন্ধ হয়ে যাবে। এক কথায় সমস্ত পৃথিবী অচল হয়ে যাবে।

তারপর কী হবে?

সারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যাবে।

তারপর কী হবে?

মানুষে মানুষে হানাহানি শুরু হয়ে যাবে।

মহামান্য থুল খুব ধীরে ধীরে ঘুরে জুহুর দিকে তাকালেন, নিচু গলায় বললেন, তোমার তাই ধারণা? যখন খুব বড় বিপদ নেমে আসে তখন মানুষ একে অন্যকে সাহায্য না করে একে অন্যের সাথে হানাহানি শুরু করে? মানুষ তখন স্বার্থপরের মতো নিজের বিষয়টা দেখবে?

জুহু অপ্রস্তুত মুখে বলল, এর উত্তর আমি জানি না মহামান্য থুল। একটু থেমে সে যোগ করল, আপনি কী জানেন?

মহামান্য থুল মাথা নাড়লেন, না। জানি না।

অনুমান করতে পারেন?

যে বিষয়টা সত্যি সত্যি জানা সম্ভব আমি সেটা অনুমান করতে চাই না।

জুহু অবাক হয়ে মহামান্য থুলের দিকে তাকাল, একটু আগে তিনি ঠিক এই বাক্যটিই বলেছিলেন! জুহু দ্বিতীয়বার তাকে প্রশ্ন করার সাহস পেল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, মহামান্য থুল।

বল।

আমি আসলে আপনাকে একটা খারাপ খবর দিতে এসেছিলাম।

কী খারাপ খবর?।

মানুষের সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমরা একটি মহাকাশযানে করে সাতজন মহাকাশচারী পাঠিয়েছিলাম।

হ্যাঁ। সাতজনের একটি পূর্ণাঙ্গ টিম। একজন শিশুসহ।

সেই টিমটিতে যেন কোনো রবোমানব যেতে না পারে তার জন্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু–

কিন্তু কী?

সাতজনের ভেতর দুইজন রবোমানব ঢুকে গেছে।

মহামান্য থুল ঘুরে জুহুর দিকে তাকালেন, কোন দুইজন?

জানি না। কেউ জানে না।

এখন কী করবে?

বুঝতে পারছি না মহামান্য থুল। সেজন্যে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।

আমার মনে হয় কিছুই করার প্রয়োজন নেই। যেভাবে চলছে চলুক।

আমরা পৃথিবী থেকে সিগন্যাল পাঠিয়ে মহাকাশযানটা ধ্বংস করে দিতে পারি।

মহামান্য থুল মাথা নাড়লেন, আমরা যদি রবোমানব হয়ে যেতাম তাহলে নিশ্চয়ই তাই করতাম। কিন্তু আমরা তো রবোমানব নই। আমরা খুব সাধারণ মানুষ। একটি তুচ্ছ কীটপতঙ্গের উপর হাত তুলতেও আমাদের হাত কাঁপে। আমরা কেমন করে কিছু অসহায় নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করব?