ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

১০. দাসত্বের শৃঙ্খল

১০. দাসত্বের শৃঙ্খল

বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মানুষের ক্ষমতার পরিচয় পেতে লাগল হোয়াইট ফ্যাং এবং ধীরে ধীরে মানুষের বশ্যতা স্বীকার করতে লাগল সে। ব্যাপারটা অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি ঘটেনি, বিভিন্ন ঘটনার ভিতর দিয়ে নেকড়েশিশুর বন্য চরিত্রের পরিবর্তন ঘটতে লাগল ধীরে ধীরে মানুষকে প্রভু বলে মেনে নিতে শিখল সে।

বাচ্চা কুকুরের কাছে গেলে যে মা-কুকুরের কামড় খেতে হয়, এই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকেও বঞ্চিত হয়নি হোয়াইট ফ্যাং। এখন বাচ্চা কুকুরের মায়ের সামনে সে কখনোই যায় না, দূর থেকে বাচ্চার সঙ্গে মা-কুকুরকে দেখলেই সে চটপট সরে পড়ে।

মানুষদের মধ্যেও শ্রেণিভেদ করতে শিখেছে হোয়াইট ফ্যাং। সে জানে পুরুষরা ন্যায়-অন্যায় বুঝে যথাযথ বিচার করে, শিশুরা নিষ্ঠুর এবং মেয়েরা দয়ালু হয়। কিন্তু একটা বিপদ তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়ায়। লিপ-লিপ তাকে দেখলেই আক্রমণ করে। হোয়াইট ফ্যাং এখনও ছোটো, বয়সে কিছু বড়ো লিপ-লিপের সঙ্গে প্রাণপণে লড়াই করেও সে সুবিধা করতে পারে না। অন্যান্য বাচ্চা-কুকুরদের সঙ্গে খেলা করার সুযোগও তার নেই। কারণ, বাচ্চাদের কাছাকাছি গেলে লিপ-লিপ তাকে তেড়ে কামড়াতে আসে আর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই ছুটে পালাতে বাধ্য হয় হোয়াইটা ফ্যাং। নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে কাটাতে নেকড়েশিশু ধূর্ত হয়ে উঠল, বলে না হয় ছলে, প্রতিশোধ গ্রহণের ফন্দি আঁটল সে………

অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও হোয়াইট ফ্যাংকে তাড়া করেছে লিপ-লিপ। হোয়াইট ফ্যাং দারুণ জোরে ছুটতে পারত। দুরন্ত গতিবেগই তাকে বার বার বাঁচিয়ে দিয়েছে শত্রুর কবল থেকে। আজ কিন্তু সে লিপ-লিপের দৃষ্টিসীমার বাইরে তীরবেগে অন্তর্ধান করল না। ধাবমান শত্রুর সঙ্গে সামান্য দূরত্ব রেখে সে পালাতে লাগল- এই বুঝি তাকে ধরে ফেলে লিপ-লিপ।

দারুণ উত্তেজনায় লিপ-লিপ স্থান-কাল-পাত্র বিচার করতে ভুলে গেল, নেকড়েশিশুর পিছনে ছুটতে ছুটতে একটা তাবুকে কেন্দ্র করে পাক দিতেই সে এসে পড়ল খুঁটিতে বাঁধা কিচির সামনে। বিপদ বুঝে সে সরে পড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে তার গায়ের উপর পড়েছে কিচির ধারাল দাঁতের কামড়। খুঁটিতে বাঁধা ছিল বলে সে-যাত্ৰা কিচির কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিল লিপ-লিপ। কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে লিপ-লিপ সরে গেল কিচির নাগালের বাইরে– তারপর কাঁদতে লাগল তারস্বরে। কিন্তু প্রাণভয়ে কাদার সুযোগও পেল না বেচারা, হোয়াইট ফ্যাং এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে। লিপ-লিপের তখন আর লড়াই করার ক্ষমতা নেই, সে তার আস্তানার দিকে ছুটল। তৎক্ষণাৎ তার পিছু নিল হোয়াইট ফ্যাং। অবশেষে লিপ-লিপের কাতর আর্তনাদ শুনে তাঁবু থেকে মেয়েরা বেরিয়ে এসে তাকে বাঁচাল। মেয়েদের হাত থেকে কয়েকটা পাথর যখন তাকে লক্ষ্য করে ছুটে এল, তখনই বুদ্ধিমানের মতো স্থানত্যাগ করে হোয়াইট ফ্যাং পালিয়ে গেল তার মায়ের কাছে। কিছুদিন পরে গ্রে বিভার বুঝল কিচি আর তাঁবু ছেড়ে পালাবে না, সে গলার বাঁধন খুলে কিচিকে মুক্ত করে দিল।

এখন মহা-আনন্দে আছে হোয়াইট ফ্যাং। লিপ-লিপ তার ধারে কাছে আসে না। নেকড়েশাবক দুই একবার লিপ-লিপকে যুদ্ধে আহবান জানিয়েছিল, কিন্তু লিপ-লিপ চটপট সরে পড়েছে। নেকড়ের বাচ্চাটাকে একলা পেলে সে তাকে দেখে নেবে, তবে তার মায়ের সামনে এগিয়ে গেলে যে কামড় খেয়ে মরতে হবে, সে-কথা ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে। লিপ-লিপ। অমন মারাত্মক ভুল সে দ্বিতীয়বার করবে না।

কিন্তু বেশিদিন মায়ের সান্নিধ্য উপভোগ করার সুযোগ পেল না হোয়াইট ফ্যাং। তিন ঈগল নামে একটি রেড ইন্ডিয়ানের কাছে ঋণী ছিল গ্রে বিভার। একটা ভালুকের চামড়া, একটুকরো লাল কাপড় আর কিচিকে দিয়ে ঋণশোধ করল সে। একটা ক্যানোর (এক ধরনের নৌকা) উপর কিচিকে চাপিয়ে তিন ঈগল নদীপথে তার গন্তব্য স্থানের উদ্দেশে যাত্রা করল। হোয়াইট ফ্যাং ক্যানোতে উঠে মায়ের সঙ্গ নেওয়ার চেষ্টা করতেই তিন ঈগল তাকে ডাঙার উপর ছিটকে ফেলে দিল। বাচ্চাটা তখন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যানো লক্ষ্য করে সাঁতার দিতে লাগল। নদীতীরে দাঁড়িয়ে তাকে চিৎকার করে ডাকতে লাগল গ্রে বিভার। কে কার কথা শোনে? মাকে হারানোর ভয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল হোয়াইট ফ্যাং, সে প্রভুর আদেশ অমান্য করে আগের চেয়েও জোরে সাঁতার কেটে ক্যানোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

এমন অবাধ্যতা ক্ষমা করা যায় না— অতএব তৎক্ষণাৎ একটা ক্যানো ভাসাল গ্রে বিভার এবং বাচ্চাটার কাছে গিয়ে তার ঘাড় ধরে জল থেকে তুলে ফেলল। ক্ষিপ্ত নেকড়েশিশু সঙ্গেসঙ্গে তার দাঁত বসিয়ে দিল প্রভুর হাতে। তখন শুরু হল প্রহার। এমন দারুণ মার কখনো খায়নি বাচ্চাটা। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। গ্রে বিভার তাকে এবার নৌকার পাটাতনের উপর ছুঁড়ে ফেলে দাঁড় তুলে নৌকা চালাতে সচেষ্ট হল। বাচ্চাটার বন্য স্বভাব আবার বিদ্রোহী হয়ে উঠল, প্রভুর জুতো সমেত একটা পা কামড়ে ধরলো সে। এইবার যে প্রহার শুরু হল, আগের মার তার কাছে ছেলেখেলা মাত্র। শুধু হাত নয়, দাঁড়ের বাড়ির সঙ্গে পড়তে লাগল জুতো-পরা পায়ের লাথি বাচ্চাটার সর্বাঙ্গে। গ্রে বিভার যখন প্রহার থামাল, বাচ্চাটা তখন ভয়ে আর যন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে আর্তনাদ করছে। নৌকা তীরে এসে লাগতেই বাচ্চাটাকে ডাঙার উপর ছুঁড়ে ফেলল গ্রে বিভার। কোনোরকমে টলতে টলতে হোয়াইট ফ্যাং উঠে দাঁড়াল, তার গলা থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো চাপা কান্নার শব্দ। দূর থেকে সব কিছু লক্ষ্য করছিল লিপ-লিপ। এইবার সে বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল হোয়াইট ফ্যাং-এর ঘাড়ে। বাচ্চাটার তখন আর লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না, লিপ-লিপ তাকে মাটিতে ফেলে তার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিল। কিন্তু শত্ৰু নির্যাতনের সুযোগ পেল না লিপ-লিপ, এক লাথি মেরে তাকে বারো ফুট দূরে ছিটকে ফেলে দিল গ্রে বিভার। হোয়াইট ফ্যাং বুঝল মানুষ ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে জানে। সেই মুহূর্তে কৃতজ্ঞতার শিহরণ অনুভব করল নেকড়েশাবক; নিতান্ত অনুগত ভৃত্যের মতো গ্রে বিভারকে অনুসরণ করল সে।

ধীরে ধীরে মনুষ্য সমাজে জীবন-যাপনের পদ্ধতি শিখতে লাগল বাচ্চাটা। সে বুঝল বিনা প্রতিবাদে প্রভুর আদেশ পালন করতে হবে এটাই নিয়ম। এই নিয়মের অন্যথা হলে অর্থাৎ প্রভুর অবাধ্য হলে শাস্তি পেতে হবে।

কিছুদিন পর এই দাসত্বের মধ্যেও সে আনন্দের স্বাদ পেতে শুরু করল। প্রভুর প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করত সে। তীব্র শীতে উষ্ণ আশ্রয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে পরিবেশিত খাদ্য তার উগ্র বন্য স্বভাবকে ধীরে ধীরে মানুষের প্রতি অনুগত করে তুলছিল। কিন্তু এই পরিবর্তন সম্পর্কে বাচ্চাটা সচেতন ছিল না। মায়ের বিচ্ছেদ ব্যথা আর ফেলে আসা বন্যজীবনের স্মৃতি তাকে সর্বদা ব্যাকুল করে রাখত– সে আশা করত মা একদিন আবার ফিরে আসবে তার কাছে।

.

১১. সমাজচ্যুত শ্বাপদশিশু

লিপ-লিপ নামে বাচ্চা কুকুরটার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল হোয়াইট ফ্যাং। তার স্বাভাবিক হিংস্র প্রকৃতি হয়ে উঠল আরও হিংস্র। মানুষরাও তাকে পছন্দ করত না। কুকুরদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে, চিৎকার শোনা যাচ্ছে কে দায়ী?

–হোয়াইট ফ্যাং।

তাঁবু থেকে বেমালুম মাংস চুরি হয়েছে, কে দায়ী?

-অবশ্যই হোয়াইট ফ্যাং।

অল্পবয়সী কুকুরগুলো লিপ-লিপকে নেতা বলে মেনে নিয়েছিল। সুযোগ পেলেই তারা দলবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত হোয়াইট ফ্যাং-এর উপরে। শুধুমাত্র তীব্র গতিবেগের জন্যই নেকড়েশাবক আত্মরক্ষা করতে পারত। দৌড়ের প্রতিযোগিতায় তাকে হারানোর ক্ষমতা কোনো কুকুরের ছিল না। ক্রমশঃ ধূর্ত আর ফন্দিবাজ হয়ে উঠল হোয়াইট ফ্যাং। তীরবেগে ছুটতে ছুটতে সে যখন দেখত একটা কুকুর দল ছেড়ে তার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে, তখনই পিছন ফিরে সে দলছাড়া অগ্রবর্তী কুকুরটাকে আক্রমণ করতো। পুরো দলটা তার কাছে পৌঁছানোর আগেই দলছাড়া কুকুর-বাচ্চাকে ধরাশায়ী করে আবার উধাও হয়ে যেত হোয়াইট ফ্যাং। কোনোসময়েই একক শত্রুকে সে মারাত্মকভাবে আহত করতে পারত না; কারণ, খুব কম সময়ের মধ্যেই নিঃসঙ্গ কুকুরটাকে কাবু করে তাকে সরে পড়তে হত দলের ভয়ে। অল্পবয়সী বাচ্চা কুকুরগুলো জানত দ্বন্দ্বযুদ্ধে তারা কেউ নেকড়ে শাবকের মোকাবিলা করতে পারবে না, তাই তাদের মধ্যে কাউকে হোয়াইট ফ্যাং আক্রমণ করলেই পুরো দলটা ছুটে যেত আক্রান্ত কুকুরকে সাহায্য করতে। কুকুরগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলেও নেকড়েশাবক হোয়াইট ফ্যাং-এর বিরুদ্ধে তারা লড়াই করত দলবদ্ধ হয়ে। সারমেয় শাবকদের সম্মিলিত আক্রমণের সম্মুখে রণেভঙ্গ দিলেও সর্বদাই প্রতিশোধ গ্রহণের সযোগ খাঁজ হোয়াইট ফ্যাং। কোনো দলছাড়া অল্পবয়সী কুকুর নদীর ধারে এলে তার রক্ষা ছিল না। নেকড়েশাবক হোয়াইট ফ্যাং-এর আক্রমণে তার মৃত্যু ছিল অবধারিত। যার ভাগ্য ভালো সে রক্তাক্ত দেহে পালিয়ে এসে মানুষের আস্তানার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচাত এবং অতি ক্রন্দনে কাঁপিয়ে তুলত চারদিক।

একমাত্র লিপ-লিপ নামে কিশোর বয়সী কুকুরটাকে এড়িয়ে চলত হোয়াইট ফ্যাং। তার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার ক্ষমতা ছিল না নেকড়েশাবকের। সুকৌশলে তার সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলত হোয়াইট ফ্যাং।

ওই বিরুদ্ধে পরিবেশের মধ্যেই ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠতে লাগল নেকডেশাবক। ক্রমাগত লড়াই করার ফলে তার স্বাভাবিক বন্য চরিত্র হয়ে উঠল আরও-বন্য, আরও-হিংস্র, আরও-ভয়ংকর। সে বুঝেছিল এই দুনিয়ায় দুর্বলের বাঁচার অধিকার নেই– হয় মারতে হবে, নয় মরতে হবে, এই হচ্ছে দুনিয়ায় নিয়ম।

মানুষের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হলেও দিনে দিনে বনচারী নেকড়ের মতোই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল হোয়াইট ফ্যাং।

.

১২. পথের ঠিকানা

বছরের শেষে যাযাবর রেড ইন্ডিয়ানের দল তাঁবু গুটিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে ক্যানো ভাসাল ম্যাকেনজি নদীর বুকে। বনের আড়ালে লুকিয়ে তাদের উপর নজর রাখছিল হোয়াইট ফ্যাং। তার প্রভু গ্রে বিভার অনেক ডাকাডাকি করেও যখন পোষা নেকড়ে শাবকের সাড়া পেল, তখন নাচার হয়ে সে-ও একটা ক্যানোতে উঠে দলের সঙ্গে অন্তর্ধান করল পুরানো আস্তানা ছেড়ে নতুন জায়গায় ডেরা বাঁধার জন্য…

মানুষের সংসর্গ আর ভালো লাগছিল না, ফেলে আসা বন্যজীবনের দিনগুলো হোয়াইট ফ্যাংকে আকর্ষণ করছিল। তাই প্রভুর দৃষ্টি এড়িয়ে বনের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করল সে।

অরণ্যবক্ষে দণ্ডায়মান গাছগুলির ফাঁকে ফাঁকে ছুটোছুটি করে সদ্য ফিরে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ সে গ্রহণ করতে লাগল পরমানন্দে, তারপর একসময়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল বিশ্রামের জন্য। দিনের আলো নিভে গেল, অন্ধকার ক্রমশঃ ঘন হয়ে জমতে লাগল অরণ্যের গর্ভে, তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল শীতের দংশন। দৈত্যের মতো অতিকায় গাছের সারি এবং মাটির উপর লুটিয়ে পড়া অন্ধকার ছায়ার দিকে বার বার দৃষ্টিপাত করছিল হোয়াইট ফ্যাং প্রতি মুহূর্তে তার ভয় হচ্ছিল এই বুঝি অন্ধকারের আড়াল থেকে তার উপর লাফিয়ে প কোনো অদৃশ্য শত্রু।

অন্ধকার-আচ্ছন্ন শীতার্ত বনভুমি এখন মৃত্যুপুরীর মতো স্তব্ধ, নীরব। এই নীরবতা নেকড়ে শাবকের অন্তরে আতঙ্কের সঞ্চার করল। ক্ষুধার্ত হোয়াইট ফ্যাং অনুভব করতে লাগল মানুষের সাহচর্য তাকে দুর্বল করে তুলেছে। এখানে স্বাধীনতা আছে, কিন্তু নেই ক্ষুধার খাদ্য, নেই শীতের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উষ্ণ সান্নিধ্য, নেই সর্বশক্তিমান মানুষ-দেবতার নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি- এই অন্ধকার নিঃশব্দ অরণ্যের সর্বত্র হানা দিয়ে ফিরছে অদৃশ্য মৃত্যুদূত গৃহপালিত শ্বাপদশিশুকে গ্রাস করার জন্যে…।

দিনের আলো দেখা দিতেই দূর হয়ে গেল রাত্রির বিভীষিকা, সাহস ফিরে পেল হোয়াইট ফ্যাং। নদীপথে যেদিকে ভেসে গেছে রেড ইন্ডিয়ানদের নৌকাগুলি, নদীর পার ধরে সেই পথ অনুসরণ করে ছুটতে লাগল হোয়াইট ফ্যাং যেভাবেই হোক মানুষের আশ্রয়ে ফিরে যেতে হবে তাকে, নইলে সে বাঁচবে না…

নদী যেখানে দুরারোহ উচ্চভূমিকে পাশে ফেলে বাঁক নিয়ে ঘুরেছে, সেখানে পশ্চাৎবর্তী পাহাড়ে উঠে সে অনুসরণ করছে। যেখানে তার পথ রোধ করে পার্বতীয় জলধারা ছুটে গেছে মূল নদীর বুকে, সেখানে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে, সাঁতার কেটেছে তুহিন শীতল জলধারার বুকে, আলগা বরফের তলায় মরণফাঁদকে ফাঁকি দিয়েছে বার বার যেভাবে হোক, যেমন করে হোক, তার দেবতাদের অর্থাৎ মানুষদের চলার পথটাকে খুঁজে বার করার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে হোয়াইট ফ্যাং…

অবশেষে একসময়ে অপরিসীম ধৈর্যের পুরস্কার পাওয়া গেল, নদীর তীর থেকে মানুষের পথ চলার চিহ্ন খুঁজে পেল সে। চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাদ্য পায়নি সে, দারুণ ক্ষুধায় তার সর্বশরীর অবসন্ন কিন্তু পথের নিশানা পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তার সমস্ত দুর্বলতা দুর হয়ে গেল, গাছের ফাঁকে ফাঁকে তুষারের উপর মানুষের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চলল সে। কিছুক্ষণ পরে রেড ইন্ডিয়ানদের নতুন আস্তানাটা তার নজরে পড়ল, ওই যে গ্রে বিভারের বউ রান্না করছে আর একটু দূরে বসে এক টুকরো কাঁচা চর্বি নিয়ে চুষছে আর চিবোচ্ছে গ্রে বিভার। হোয়াইট ফ্যাং বুঝে নিল তাঁবুতে এখন মজুত রয়েছে টাটকা মাংস।

তার অনুমান নির্ভুল, একটু আগেই একটা মুজ হরিণকে গুলি চালিয়ে মেরেছে গ্রে বিভার।

খুব ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে প্রভুর কাছে এগিয়ে এল হোয়াইট ফ্যাং। প্রতি মুহূর্তে সে আশঙ্কা করছিল এই বুঝি তার উপর নেমে আসে নির্দয় প্রহার– তবু সে এগিয়ে এল, সে জানে প্রভু তাকে মারতে পারে, শাস্তি দিতে পারে, কিন্তু খাদ্য ও আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করবে না।

আশঙ্কা অমূলক, গ্রে বিভার তাকে আঘাত করল না, এমন কি তিরস্কারও করল না, বরং স্ত্রীকে ডেকে হেয়াইট ফ্যাং-এর জন্যে মাংস আনতে বললো। খাওয়ার সময়ে অন্য কুকুরগুলো তাকে বিরক্ত করতে পারল না, কারণ সেইসময় তাকে সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছিল স্বয়ং গ্রে বিভর। দীর্ঘ উপবাসের পর পূর্ণ উদর নিয়ে প্রভুর পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল হোয়াইট ফ্যাং। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উষ্ণ সান্নিধ্য তাকে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে দিল নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে। নিশ্চিন্ত সুখে ঘুমিয়ে পড়ল সে। পরের দিন স্তব্ধ নির্জন অরণ্যের গর্ভে শীর্তাত অভুক্ত দেহ নিয়ে তাকে আর ছুটোছুটি করতে হবে না তার, দেবতার কাছে পৌঁছে গেছে সে, এখানে আছে ক্ষুধার খাদ্য, নিরাপত্তার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি।

.

১৩. দ্বিপদ ও শ্বাপদ

ডিসেম্বর মাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ম্যাকেজি নদী এখন নিরেট বরফে পরিণত। উজানপথে যাত্রা শুরু করল গ্রে বিভার দুটি স্লেজ নিয়ে, সঙ্গে স্ত্রী কু-কুচ আর পুত্র মিট-সা। পূর্ণবয়স্ক বড়ো কুকুরদের নিয়ে বড়ো স্লেজটি চালনা করার ভার নিল গ্রে বিভার স্বয়ং। ছোটো স্লেজটির দায়িত্ব গ্রহণ করল মিট-সা। তার গাড়ি টানার জন্যে নির্বাচিত হল অল্পবয়সী কুকুরের দল। বলাই বাহুল্য মিট-সার গাড়িতেই নিযুক্ত হল হোয়াইট ফ্যাং।

কুকুরগুলোকে একটা সরলরেখায় গাড়ির সঙ্গে না জুতে অর্ধচন্দ্রের আকারে, স্লেজের সঙ্গে জুতে দেওয়া হল। সাতটি কুকুরের শরীরে আবদ্ধ সাতটি দড়ি এসে যুক্ত হয়েছে স্লেজের সম্মুখবর্তী একটা রিং বা চাকতির সঙ্গে। দড়িগুলির দৈর্ঘ্য সমান ছিল না, ফলে পিছনের কুকুর যদি সামনের কুকুরকে আক্রমণ করতে চায়, তাহলে অপেক্ষাকৃত কম দৈর্ঘ্যের দড়িতে টান পড়ে আর আক্রান্ত করতে কুকুরও ঘুরে আক্রমণকারীর সম্মুখীন হতে পারে। সেইসঙ্গে চালকের চাবুকও সপাং করে আছড়ে পড়তে পারে আক্রমণকারী কুকুরের উপর। আরও। একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে পিছনের কুকুরটা যখনই সামনের কুকুরকে আক্রমণ করতে চাইত, তখনই তাকে স্লেজটাকে খুব জোরে টানতে হবে এবং স্লেজের গতি দ্রুত হলেই সম্মুখবর্তী আক্রান্ত কুকুরটির গতি হবে দ্রুত থেকে দ্রুততর। এইভাবে ক্রমশঃ গতিবেগ বৃদ্ধি করে এগিয়ে চলে স্লেজ এবং এইভাবেই স্লেজটানা কুকুরদের উপর সুকৌশলে প্রভুত্ব বজায় রাখে মানুষ।

মিট-সা বুদ্ধিমান ছেলে। লিপ-লিপ যে সর্বদাই হোয়াইট ফ্যাং-এর উপর অত্যাচার চালাতে চায় সেটা লক্ষ্য করেছিল সে। কিন্তু তখন লিপ-লিপ ছিল অন্য লোকের অধীন, তাকে শাসনের অধিকার ছিল না মিট-সার। এখন লিপ-লিপ মিট-সার কুকুর, সুতরাং তাকে শায়েস্তা করতে সচেষ্ট হল মিট-সা। সবচেয়ে লম্বা দড়িটার সঙ্গে লিপ-লিপকে বেঁধে দিয়ে মিট-সা তাকে দলের নায়ক বানিয়ে দিল। দলনায়কের পদ সবচেয়ে সম্মানজনক হলেও আদৌ আনন্দদায়ক নয়। সামনে দ্রুতবেগে ধাবমান লিপ-লিপকেই পিছনের কুকুরগুলো তাদের দুর্দশার জন্য দায়ী মনে করতে লাগল। ফলে যে কুকুরগুলো এতদিন লিপ-লিপকে নেতা বলে মেনে নিয়েছিল, তারাই হয়ে উঠল লিপ-লিপের শত্রু। দলের প্রত্যেকটি কুকুর ঘৃণা আর বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগল লিপ-লিপ সম্পর্কে।

এখন আর লিপ-লিপকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না হোয়াইট ফ্যাং। লিপ-লিপ এখন আর দলের নেতা নয়। দলের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে সে এখন সর্বদাই মানুষের কাছাকাছি থাকে। স্লেজ থেকে যখন কুকুরগুলোকে বন্ধনমুক্ত করে বিশ্রাম দেওয়া হয়, তখনই তাঁবুর ভিতর মিট-সা, গ্রে বিভার বা কু-কুচের কাছাকাছি থাকে লিপ-লিপ। এতদিন হোয়াইট ফ্যাংকে যে পদ্ধতিতে নির্যাতন করেছে লিপ-লিপ, এখন ঠিক সেই ধরনের নির্যাতন এসে পড়েছে তার উপর।

হোয়াইট ফ্যাং ইচ্ছা করলেই লিপ-লিপের জায়গা অর্থাৎ দলের নেতৃত্বের পদ দখল করতে পারত। কিন্তু নেতা হওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ, একক জীবন-যাপন করত সে। খাদ্য পরিবেশেনের পর অন্যের মাংসে মুখ বাড়াত হোয়াইট ফ্যাং। মাংসের ন্যায্য অধিকারী আপত্তি জানাতে সাহত পেত না, সে জানত আপত্তি করলেই নিষ্ঠুর দংশনে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে হোয়াইট ফ্যাং নামক নেকড়েশাবক। অতএব কুকুরের দল খাবার দেওয়া হলেই খুব তাড়াতাড়ি খাদ্যকে উদরসাৎ করতে সচেষ্ট হত। যে কুকুরটা খাবার খেতে দেরি করে ফেলত, তার খাদ্য ছিনিয়ে নিয়ে হোয়াইটি ফ্যাং খেয়ে ফেলত। অবশ্য আশেপাশে প্রভুদের কেউ উপস্থিত থাকলে এমন দুষ্কর্ম করত না হোয়াইট ফ্যাং। সে জানত অপরের খাদ্যে ভাগ বসানো অন্যায়। মানুষ-দেবতা কখনো অন্যায় সহ্য করে না, অন্যায়কারীকে সে শাস্তি দেয় কঠোরভাবে।

বন্যজীবনের নিষ্ঠুর আইন ভালোভাবেই বুঝেছিল হোয়াইট ফ্যাং- অত্যাচার চালাও দুর্বলের উপর, কিন্তু নতি স্বীকার করো সবলের কাছে।

হোয়াইট ফ্যাং জানত, মানুষ-দেবতার গায়ে দাঁত বসালে শাস্তি পেতে হয়। পরবর্তীকালে সে জানতে পারল সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। একটি হ্রদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে একটি অল্পবয়সী ছেলে একদিন অন্যায়ভাবে হোয়াইট ফ্যাংকে আক্রমণ করল। নেকড়ে শাবকের দু-পাশে ছিল দুটি তাবু, পিছনে পলায়নের পথ রুদ্ধ করে অবস্থান করছিল খাড়া উঁচু জমি আর সামনে লাঠি হাতে এগিয়ে আসছিল এক অপরিচিত গ্রাম্য বালক। পরক্ষণেই যে কী ঘটল ছেলেটি নিজেও তা ভালোভাবে বুঝতে পারল না– সে শুধু দেখতে পেল তুষারের উপর সে ছিটকে পড়েছে এবং তার লাঠি ধরা হাতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঝরে পড়ছে লাল রক্তের ধারা! তার সামনে বা পিছনে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কোণঠাসা কুকুরটাকে?

কুকুরটা অর্থাৎ হোয়াইট ফ্যাং ততক্ষণে তাঁবুর মধ্যে গ্রে বিভারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আহত ছেলেটি ও তার পরিবারের সকলে এসে হানা দিল গ্রে বিভারের তাবুতে পাজি কুকুরটাকে তারা শাস্তি দিতে চায়। গ্রে বিভার তাদের প্রস্তাবে সায় দিল না। গ্রে বিভারকে সমর্থন জানিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল তার স্ত্রী-পুত্র কু-কুচ আর মিট-সা।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল ক্রুদ্ধ বাক্যের ঝড়, তারপর অসন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় নিল আহত বালক ও তার পরিবারভুক্ত লোকজন। হোয়াইট ফ্যাং ব্যাপারটা লক্ষ্য করল; সে বুঝতে পারল একমাত্র তার নিজস্ব দেবতারাই তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকারি অন্য কোনো দেবতা তার উপর অন্যায় ব্যবহার করলে ধারাল দাঁতের সাহায্যে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার তার আছে। এটাও দেবতাদেরই আইন।

সেইদিনই দেবতাদের প্রতিষ্ঠিত আইন সম্পর্কে আরও কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করল হোয়াইট ফ্যাং। অগ্নিকুণ্ডের জন্যে কাঠ সংগ্রহ করতে বনের মধ্যে ঢুকেছিল মিট-সা, হঠাৎ হোয়াইট ফ্যাং-এর দন্তাঘাতে আহত বালকটি এসে পড়ল তার সামনে। আহত বালকের সঙ্গে ছিল তার কয়েকটি বন্ধু। কিছুক্ষণ উভয়পক্ষে কথা কাটাকাটি চললো, তারপরই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মিট-সার উপর। চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে নিরুপায় ভাবে মার খেতে লাগল মিট-সা। প্রথমে বিশেষ মাথা ঘামায়নি হোয়াইট ফ্যাং– এটা হল দেবতাদের নিজস্ব ব্যাপার, সুতরাং তার নাক গলানো উচিত নয়। কিন্তু মিট-সার নির্যাতন দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল, হিংস্র আক্রোশে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলেগুলোর উপর। মিনিট পাঁচেক পরেই দেখা গেল আক্রমণকারী ছেলের দল ছুটে পালাচ্ছে উধ্বশ্বাসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা অকুস্থল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু নির্জন বনপথে সাদা তুষারের উপর রক্তধারার রক্তিম স্বাক্ষর প্রমাণ করে দিল একমুহূর্তও নিশ্চেষ্ট থাকেনি হোয়াইট ফ্যাং-এর নিষ্ঠুর দাঁতের সারি।

মিট-সার মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে খুশি হল গ্রে বিভার, তার হুকুমে প্রচুর মাংসের ভোজে তৃপ্ত হল হোয়াইট ফ্যাং। নেকড়েশাবক বুঝল নিয়ম যেমন আছে, তেমনি নিয়মের ব্যতিক্রমও আছে। এই ব্যতিক্রমও সৃষ্টি করেছে মানুষ-দেবতা। এইভাবেই দ্বিপদ মানুষের নিয়ম-কানুনের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে লাগল বন্য শ্বাপদ।

.

১৪. দুর্ভিক্ষ

ঋতুরাজ বসন্তের উষ্ণ আবির্ভাবের সম্ভাবনায় যখন আনন্দে উদবেল হয়ে উঠেছে শীতার্ত ধরিত্রী, সেইসময় একদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যাত্রা শেষ করল গ্রে বিভার।

সেটা ছিল এপ্রিল মাস। হোয়াইট ফ্যাংকে যখন স্লেজের বন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়া হল, তখন তার বয়স হল এক বছর। বাচ্চা কুকুরদের মধ্যে একমাত্র লিপ-লিপ ছাড়া সকলেরই দেহের আয়তন ছিল হোয়াইট ফ্যাং-এর চাইতে ছোটো। এখন আর নিতান্ত বাচ্চা নয় হোয়াইট ফ্যাং। বয়স্ক কুকুরদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে না চাইলেও আগের মতো তাদের দেখে ভয় পায় না সে। নেকড়েশাবক জানত না দিনবদলের পালা শুরু হয়ে গেছে যে বয়সের ভার প্রবীণ যোদ্ধাকে দুর্বল করে দিচ্ছে সেই বয়সই নতন শক্তির সঞ্চার করছে শাপদশিশুর শরীরে।

কিছুদিনের মধ্যেই এই পরিবর্তন বুঝতে পারল নেকড়েশাবক। বাসিক নামে একটা মস্ত বুড়ো কুকুর দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিলেই আতঙ্কে শিউরে উঠতে হোয়াইট ফ্যাং। এসব হচ্ছে কয়েক মাস আগের কথা এখন কিছুটা বড়ো হয়েছে নেকড়েশাবক, সাহসও বেড়ে গেছে তার, তবু বাসিককে অগ্রাহ্য করার মতো মনের জোর এখনও তার হয়নি। কিন্তু সময়ের সঙ্গেসঙ্গে কুকুরদের সামাজিক সম্পর্কও যে বদলে যাচ্ছে একদিন তার প্রমাণ পেল কিশোর হোয়াইট ফ্যাং।

খাদ্য পরিবেশনের সময়ে সেদিন একটা হরিণের ঠ্যাং পেয়েছিল হোয়াইট ফ্যাং। সেটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল সে। উদ্দেশ্য একটাই– অন্য কোনো কুকুর এসে যেন খাওয়ার সময়ে হামলা না করে। নিরালায় বসে হরিণের ঠ্যাং দিয়ে ভোজনপর্ব শুরু করেছিল সে, হঠাৎ কোথা থেকে মূর্তিমান বিঘের মতো ছুটে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাসিক। নিজের অজান্তেই আঘাত হানল হোয়াইট ফ্যাং বিদ্যুৎ চমকের মতো পর পর দু-বার কামড় বসিয়ে আবার শক্রর নাগালের বাইরে চলে গেল সে। বাসিক হতভম্ব এমন দ্রুত হিংস্র আক্রমণ তার কল্পনার বাইরে।

বোকার মতো বিহ্বল দৃষ্টি মেলে বাসিক তাকিয়ে রইল নেকড়েশাবকের দিকে; তার সামনে পড়ে রইল রক্তমাখা হরিণের ঠ্যাং। ঠ্যাংটাকে মাঝখানে রেখে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। কয়েকমাস আগে হলে উদ্ধত বাচ্চাটাকে শাস্তি দিতে এগিয়ে যেত বাসিক, কিন্তু বয়সের ভার আজ তাকে মন্থর ও কিছুটা দুর্বল করে দিয়েছে, তাই তীরবেগে পালটা আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষমতা তার ছিল না। নিষ্ফল আক্রোশে তার সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হয়ে উঠল, ঠ্যাংটার উলটোদিকে অবস্থিত নেকড়ে-বাচ্চার দিকে তাকিয়ে জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলতে লাগলো তার দুই হিংস্র চক্ষু। অতীত দিনের ভীতি তখন হোয়াইট ফ্যাং-এর মন থেকে মুছে যায়নি, যন্ত্রচালিতের মতোই স্নায়ুর তাড়নায় সে দংশন করেছিল বটে, কিন্তু এখন কোনোরকমে সরে পড়ার কথাই ভাবছিল সে।

এই সময়ে ভুল করল বাসিক। ক্রুদ্ধ ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে সে যদি জ্বলন্ত চক্ষে তাকিয়ে থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই মাংসের লোভ ছেড়ে মানে মানে সরে পড়ত হোয়াইট ফ্যাং। কিন্তু নেকড়েশাবককে ভীত ও সংকুচিত দেখে বাসিক ধরে নিল তার জয় হয়েছে, অতএব বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে সে হরিণের ঠ্যাংটার উপর কামড় বসিয়ে দিল।

নাঃ, বড়ো বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এতটা সহ্য করা সম্ভব নয় নেকড়েশাবকের পক্ষে। এতকাল তার নিজস্ব দলের উপর প্রভুত্ব করে এসেছে সে এখন তারই সামনে তার খাদ্য ছিনিয়ে নেবে একটা গুণ্ডা আর অলস দৃষ্টি মেলে সে নিরীক্ষণ করবে সেই ভোজনদৃশ্য– এতখানি অত্যাচার সহ্য করতে রাজি হল না হোয়াইট ফ্যাং। অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে আক্রমণ করল সে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বাসিকের একটা কান, ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল বাসিক এবং ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গেসঙ্গে কিশোর নেকড়ে বয়স্ক কুকুরটার গলা আর কাঁধ ক্ষতবিক্ষত করে দিল তীব্র দংশনে। বাসিক কামড় বসানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে তার আক্রমণ ব্যর্থ করে আবার আঘাত হানল হোয়াইট ফ্যাং বাসিকের নাক চিরে ফাঁক হয়ে গেল, দারুণ যন্ত্রণায় টলতে টলতে সে পিছিয়ে এল, হরিণের ঠ্যাং পড়ে রইল যথাস্থানে।

বাসিক বুঝল বয়স তার ক্ষিপ্রতা ও শক্তি হরণ করেছে। ওই জীবন্ত বিদ্যুতের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা এখন তার নেই। যুদ্ধজয় করতে না পারলেও উদ্ধত কিশোরকে অগ্রাহ্য করার শক্তি তার আছে। শান্তভাবে পিছন ফিরে একবারও প্রতিপক্ষ বা খাদ্যের দিকে নজর না দিয়ে ধীরে ধীরে স্থানত্যাগ করল সে। শত্রুর দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার আগে রক্তাক্ত ক্ষতস্থানগুলিকে জিভ দিয়ে চেটে যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টা করেনি বাসিক।

এই লড়াইটা নেকড়ে শাবকের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দিল। বড় কুকুরগুলোকে সে আর বিশেষ মর্যাদা দিতে রাজি হল না। অবশ্য সে যে গায়ে পড়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাত, তা নয়। নিজের সম্মান অটুট রেখে সে চলাফেরা করত, বড়ো কুকুরদের পথ ছেড়ে দিত না কখনোই।

হোয়াইট ফ্যাং-এর সমবয়সী কুকুররা বড়োদের পথ ছেড়ে সরে যেত সভয়ে এবং বড়ো কুকুররা তাদের বরাদ্দ মাংসে ভাগ বসালে কখনোই সাহস করে প্রতিবাদ জানাত না। কিন্তু নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ হোয়াইট ফ্যাং ছিল বেপরোয়া। বড়ো কুকুররা অবাক হয়ে দেখল এই বাচ্চা জন্তুটা বড়োদের হামলা সহ্য করতে রাজি নয় এবং সে রুখে দাঁড়ালে প্রবীণ যোদ্ধাদেরও মান বাঁচানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। কয়েকবার নেকড়েশাবকের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে বয়স্ক কুকুররা বুঝল এই বাচ্চাটাকে না ঘটানোই ভালো হোয়াইট ফ্যাংকে বিরক্ত না করলে সে গায়ে পড়ে ঝগড়া করে না, অতএব তার সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখাই নিরাপদ। বয়স্ক কুকুররা তাই তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল।

গ্রীষ্মকালের মাঝমাঝি আর একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করল হোয়াইট ফ্যাং। অন্য একদল রেড ইন্ডিয়ানের আস্তানায় সে একদিন তার মা কিচিকে দেখতে পেল। মায়ের স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি তার মন থেকে, সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে মায়ের কাছে ছুটে গেল সে। সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক- মুহূর্তের মধ্যে নেকড়ে শাবকের গালের মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে হাড় পর্যন্ত বসে গেল কিচির ধারাল দাঁত।

মায়ের এই অপ্রত্যাশিত আচরণে অবাক হয়ে গেল হোয়াইট ফ্যাং! হতভম্ব হয়ে পিছিয়ে এল সে।

কিচির একটা বাচ্চা আগন্তুকের কাছে এগিয়ে গেল। তারা দুজনে একই মায়ের সন্তান। কিন্তু এই সত্যটা তাদের জানা ছিল না। বাচ্চাটার চালচলন হোয়াইট ফ্যাং-এর মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করল, সে মুখ নামিয়ে ছোট্ট জন্তুটার দেহ শুঁকতে সচেষ্ট হল। আবার এগিয়ে এল কিচি, আবার হিংস্র দংশনে রক্ত ঝরতে লাগল হোয়াইট ফ্যাং-এর মুখ থেকে আবার পিছিয়ে এল সে। মায়ের এমন ব্যবহার তার কল্পনার অতীত। বোকার মতো বিহ্বল দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। কিন্তু তৃতীয়বার যখন কিচি তাকে আক্রমণ করল, তখন সে বুঝলো মা তার সান্নিধ্য পছন্দ করছে না। তাদের জাতে পুরুষরা কখনো মেয়েদের আক্রমণ করে না। হোয়াইট ফ্যাং তার সহজাত সংস্কার দিয়েই অরণ্য সমাজের অলিখিত নিয়ম মেনে নিল। বিনা প্রতিবাদে স্থান ত্যাগ করে চলে গেল সে।

কিশোর বয়সী ছেলের প্রতি রূঢ় আচরণের জন্য কিচিকে দোষ দেওয়া যায় না। নেকড়ে-মা একবছরের বেশি মনে রাখে না তার সন্তানকে। কিচির চোখে কিশোর বয়সী হোয়াইট ফ্যাং-এর উপস্থিতি তার বাচ্চাদের পক্ষে বিপদজনক, তাই আগন্তুক জন্তুটাকে সে তাড়াতে চেয়েছিল।

এই ঘটনার পর মায়ের স্মৃতি মুছে গেল হোয়াইট ফ্যাং-এর মন থেকে। সে এখন যে-কোনো পরিবেশের সম্মুখীন হতে পারে, মায়ের সাহায্য তার দরকার হয় না….

আবার এল দুঃসময়, দেখা দিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হোয়াইট ফ্যাং-এর তখন তিন বৎসর বয়স। যেখানে দলে দলে ঘুরে বেড়ায় মুজ এবং ক্যারিবু হরিণ, সেখানে কালে-ভদ্রে একটা কি দুটো জন্তুর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। খরগোশরা অদৃশ্য, জলের মাছও দুর্লভ। খাদ্যের অভাবে মাংসাশী পশুরা পরস্পরকে আক্রমণ করতে লাগল। পরাজিত পশু বিজয়ীর খাদ্যে পরিণত হল। সবচেয়ে বলিষ্ঠ পশুগুলো বেঁচে রইল কোনোমতে।

মানুষের আশ্রিত কুকুরের দল ক্ষুধাত হয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করতে লাগল। দুর্বল জাতভাই-এর রক্তমাংসে ক্ষুধানিবারণ করল বলিষ্ঠ কুকুরগুলো। মানুষরা খিদের জ্বালায় কুকুর মেরে খেতে শুরু করল। সবচেয়ে অক্ষম আর দুর্বল কুকুরগুলিকেই প্রথমে খাদ্য হিসাবে বেছে নিয়েছিল মানুষরা, তারপর সমর্থ ও বলিষ্ঠ কুকুরগুলোর দিকে আকৃষ্ট হল তাদের ক্ষুধিত দৃষ্টি। কুকুরগুলো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় তাদের জানা ছিল না। কয়েকটা সাহসী কুকুর প্রভুদের বিপদজনক সান্নিধ্য ত্যাগ করে বনের মধ্যে আশ্রয় নিল। তারাও বাঁচল না, উপবাসে জীর্ণ হয়ে অথবা বনচারী নেকড়ের ক্ষুধিত গ্রাসে প্রাণ দিল সবাই।

হোয়াইট ফ্যাং বোকা নয়। সে বুঝেছিল যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বর্তমান আস্তানা ছেড়ে না  পালালে তার দেহ দিয়েই হয়তো একদিন প্রভুরা উপবাস ভঙ্গ করবে। সুতরাং একদিন নিঃশব্দে সে অন্তর্ধান করল বনের মধ্যে অন্যান্য পলাতক কুকুরের মতো বন্যজীবনে অনভ্যস্ত ছিল না হোয়াইট ফ্যাং, তাই তাদের মতো অন্যায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেনি সে। কাঠবিড়ালি গাছ থেকে নেমে এসে আবার গাছের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়ার আগেই অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরে ফেলতো হোয়াইট ফ্যাং। যখন কাঠবিড়ালিদের পাওয়া যেত না, তখন বুনো ইঁদুরের গর্তে হানা দিয়ে সে খাদ্য সংগ্রহ করত। শুধু কাঠবিড়ালি ও ইঁদুর নয়– উইজেল, বনবিড়াল বা বনের পথে ভ্রাম্যমান নেকড়ের মতো হিংস্র পশুদেরও রেহাই দিত না সে।

একদিন হঠাৎ একদল ক্ষুধার্ত নেকড়ের সামনে পড়ে গেল হোয়াইট ফ্যাং। তীরবেগে ছুটে সে তাদের ফাঁকি দিল তো বটেই, এমন কী বৃত্তাকারে ঘুরে এসে দলের পিছন থেকে একটি নেকড়েকে সকলের অজ্ঞাতসারে মেরে ফেলে খাদ্যের সংস্থান করে নিল সে।

এরই মধ্যে একদিন একটা পাহাড়ের তলায় পুরাতন শত্রু লিপ-লিপের সঙ্গে হোয়াইট ফ্যাং-এর সাক্ষাৎকার ঘটল। নেকড়েশাবকের মতো নিপুণ শিকারি ছিল না লিপ-লিপ, খাদ্যের অভাবে তার দেহ হয়েছিল জীর্ণ শীর্ণ। লড়াই বাধল। উপবাসক্লিষ্ট দেহ নিয়ে পরিমিত আহারে পরিপুষ্ট শক্তিমান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই জিততে পারল না লিপ-লিপ। এক ধাক্কায় তাকে মাটিতে ফেলে গলায় কামড় বসাল হোয়াইট ফ্যাং। ছিন্নকণ্ঠ লিপ-লিপ ছটফট করতে লাগল মৃত্যুশয্যায় শুয়ে। তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে শত্রুর মৃত্যু যন্ত্রণা দেখল হোয়াইট ফ্যাং, তারপর নির্বিকারভাবে আবার পথ চলতে শুরু করল…

একদিন বনের শেষ প্রান্তে নদীর দিকে যে ঢালু জায়গাটা নেমে গেছে। সেইখানে রেড ইন্ডিয়ানদের একটা নতুন বসতি সে আবিষ্কার করল। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সে বুঝতে পারল বসতিটা নতুন হলেও মানুষগুলো নতুন নয়। আস্তানার ভিতর থেকে উপবাসক্লিষ্ট কণ্ঠস্বরের পরিবর্তে ভেসে আসছে আনন্দ ও উল্লাসের ধ্বনি। একটি নারীকণ্ঠ সশব্দে ক্রোধপ্রকাশ করল। হোয়াইট ফ্যাং বুঝল যতই রাগ হোক, পেট ভরা না থাকলে এমন জোর গলায় কেউ রাগ দেখাতে পারে না। সে আরও একটু এগিয়ে এল। সঙ্গেসঙ্গে তার নাসারন্ধে ভেসে এল মাছের গন্ধ! অর্থাৎ মানুষদের আস্তানায় এখন খাদ্যের অভাব নেই। কিছুমাত্র! এইবার নির্ভয়ে গ্রে বিভারের তাঁবুতে প্রবেশ করল হোয়াইট ফ্যাং। গ্রে বিভার সেখানে ছিল না। কিন্তু তার বউ একটা আস্ত টাটকা মাছ দিয়ে পলাতক নেকড়ে শাবককে অভ্যর্থনা জানাল। তাঁবুর ভিতর শুয়ে শুয়ে গ্নে বিভারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল হোয়াইট ফ্যাং।