১০. দস্যুদল আমাকে আর টিশাকে

দস্যুদল আমাকে আর টিশাকে কীভাবে রাখবে সেটা নিয়ে আমাদের নানারকম চিন্তা ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের দুজনকে যেভাবে রাখা হলো সেটি আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। মায়ী মায়ী যতক্ষণ ট্রেইলারের ভেতর থাকে ততক্ষণ আমাদের গলায় শিকল বেঁধে তার টেবিলের সাথে বেঁধে রাখে। শুধু তাই না, মায়ী মায়ী মাঝে মাঝেই আমাদের দিকে তাকিয়ে জিবে চুক চুক শব্দ করতে করতে বলে, “তোদের মাথায় কেরেনিয়াল নাই! থাকলে তোদের একজনের মাথায় একটা কুকুরের সিস্টিম আরেকজনের মাথায় খেঁকশিয়ালের সিস্টিম লোড করে রাখতাম। তোরা দিনরাত খামচাখামচি কামড়াকামড়ি করতি-–দেখে কত আনন্দ হতো।”

এ ধরনের একটা কথা বলা হলে উত্তরে কী বলতে হয় আমাদের জানা নেই, তাই আমরা নিঃশব্দে মায়ী মায়ীর দিকে তাকিয়ে থাকি। মায়ী মায়ী আমাদের কখনো নাম ধরে ডাকত না। একজনকে ভাইরাস আরেকজনকে ব্যাকটেরিয়া ডাকত! আমাদের কাজ ছিল তার ফুট ফরমাশ খাটা, হাতের কাছে মায়ী মায়ী একটা লম্বা দড়ি রেখেছিল, কাজকর্মে উনিশ-বিশ হলে সে সেই দড়িটাকে চাবুকের মতো করে আমাদের মারত।

ট্রেইলার থেকে বের হবার সময় মাঝে মাঝে শিকলে বাঁধা অবস্থায় আমাদের দুজনকে পোষা জন্তুর মতো টেনে টেনে নিয়ে যেত। দস্যুদল দৃশ্যটি দেখে খুবই মজা পেত, আমাদের দুজনের দিকে তারা খাবারের টুকরো ছুঁড়ে দিত। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে আমাদের পকেটে জমা করে রাখতাম।

মাঝে মাঝে আমাদের কোনো একটা গাড়ির এক্সেলের সাথে বেঁধে রাখত, আমরা গাড়ির ছায়ায় বসে দস্যুদলকে যেতে-আসতে দেখতাম। রাত্রে ঘুমানোর সময় আমাদের খাঁচার ভেতর ঢুকিয়ে উপরে ঝুলিয়ে রাখত। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, আস্তে আস্তে কেমন জানি অভ্যাস হয়ে গেল।

দস্যুদল এক জায়গায় এক-দুই দিনের বেশি থাকত না, বেশির ভাগ সময়েই তারা রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় থাকত। যখন তাদের কনভয় চলত তখনো তারা আমাদেরকে আঁচায় বন্ধ করে রাখত। আমরা মাটি থেকে অনেক উপরে ঝুলতে ঝুলতে যেতাম, খাঁচাটা ডানে-বামে দুলত, প্রথম প্রথম সেই দুলোনিতে আমরা বমি করে একাকার করে ফেলতাম, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল। শুধু অভ্যাস নয় আমরা

আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণ উপভোগ করতে শুরু করলাম। ছোট খাঁচা থেকে পা বের করে পা ঝুলিয়ে খাঁচার শিক ধরে বসে চারদিক দেখতে দেখতে যেতাম। নিচ থেকে যে জিনিসটাকে খুব কুশ্রী মনে হয়, উপর থেকে সেটাকেই কেন সুন্দর মনে হয় কে জানে।

এর মাঝে একদিন অন্য একটা দস্যুদলের সাথে যুদ্ধ হলো। দুই দলে প্রচণ্ড গোলাগুলি, সবাই গাড়ির আড়ালে থেকে যুদ্ধ করছে, শুধু আমি আর টিশা শূন্যের মাঝে একটা খাঁচায় ঝুলছি। ইচ্ছে করলেই আমাদের দুজনকে গুলি করে মেরে ফেলা দেয়া যায়। কিন্তু কোনো একটা কারণে কেউ আমাদের গুলি করল না। মনে হয় যারা গোলাগুলি করছে তাদের কাছে আমাদের দুজনকে এত অকিঞ্চিৎকর মনে হয়েছে যে আমাদেরকে লক্ষ করে একটা গুলি করাও হয়তো তাদের কাছে গুলির অপচয় বলে মনে করেছে!

মায়ী মায়ীর দস্যুদল কিছুক্ষণের মাঝেই অন্য দস্যুদলটিকে তাড়িয়ে দিল। একজন আহত হয়েছিল বলে দলের সাথে পালিয়ে যেতে পারেনি। তাকে ধরে এনে সবাই মিলে তাকে নানাভাবে পীড়ন করতে শুরু করল। মানুষটি সব রকম অত্যাচার সহ্য করে পাথরের

মতো মুখ করে বসে রইল। তখন কয়েকজন মিলে তাকে মাটিতে উপুড় করে শক্ত করে ধরে রাখল, মায়ী মায়ী এসে তার ক্রেনিয়ালে একটা টিউব ঢুকিয়ে দেয়। মানুষটা যন্ত্রণার একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে থর থর করে কাঁপতে থাকে। ধীরে ধীরে তার কাঁপুনি থেমে যায়, তখন সে উঠে বসে, মানুষের মতো নয়–হাত এবং পায়ে ভর দিয়ে পশুর মতো। মানুষটি কেমন যেন ভয়ে ভয়ে সবার দিকে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে মুখ করে অবিকল একটা কুকুরের মতো করুণ স্বরে ডেকে উঠল। তার সেই কুকুরের ডাক শুনে দস্যুদলের সবাই উচ্চস্বরে হাসতে থাকে–এই বিষয়টা যে এত কৌতুকের ব্যাপার হতে পারে আমি আর টিশা একবারও বুঝতে পারিনি।

কুকুরে পাল্টে যাওয়া মানুষটা চারপায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকে, তারপর তার পায়ের ক্ষতটা কুকুরের মতো চাটতে থাকে। একজন দস্যু এসে তার গলায় একটা শিকল পরিয়ে তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দুজনকে যে কুকুরের মতো মানুষটা খুঁজে বের করেছিল সে কোথা থেকে এসেছিল সেটা আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে যায়।

.

কিছুদিন কেটে যাবার পর কীভাবে কীভাবে জানি আমাকে আর টিশাকে দস্যুদল মোটামুটি গ্রহণ করে নিল। ঠিক কারণটা কী জানি না–মনে হয় আমাদের বয়স কম, পাহাড়ের মতো বড় বড় দস্যুদের ভেতর আমাদের দুজনকে প্রায় খেলনার মতো মনে হয়। কিংবা পোষা কুকুর বিড়ালের উপর যে রকম মায়া পড়ে যায় হয়তো সেরকম আমাদের ওপর একটু মায়া হয়েছে।

দস্যুদল আমাদের গ্রহণ করতে শুরু করেছে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম তারা আমাদের ছোটখাটো জিনিসপত্র শেখাতে শুরু করেছে। একজন মাঝবয়সী দস্যু একদিন আমাদের গুনতে শেখাল–যদিও আমরা দুজন শুধু সাধারণভাবে নয় প্রাইম সংখ্যা ব্যবহার করে গুনতে জানি কিন্তু আমরা সেটা তাকে জানতে দিলাম না এবং খুব আগ্রহ নিয়ে শেখার ভান করলাম। দস্যুটি আমাদের শেখার আগ্রহ দেখে খুশি হলো এবং আমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হয়নি বলে খুব আফসোস করল। আরেক দিন একজন দস্যু আমাদেরকে সৌরজগতের গঠন ব্যাখ্যা করল, বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদের সংখ্যা বলতে গিয়ে সে একটু ভুল করে ফেললেও আমরা সেটা তাকে ধরিয়ে দিলাম না এবং পুরো ব্যাপারটা আগ্রহ নিয়ে শোনার ভান করলাম।

শুধু যে সাধারণ দস্যুরা আমাদের গ্রহণ করল তা নয়, মনে হলো খুব ধীরে ধীর মায়ী মায়ীও আমাদেরকে খানিকটা গ্রহণ করল। আগে কখনোই আমাদের দুজনকে একা তার ট্রেইলারে রেখে যেত না, কিন্তু এখন সে মাঝে মাঝে আমাদের গলায় শেকল দিয়ে টেবিলের সাথে বেঁধে রেখে বাইরে যেতে শুরু করল। তখন একদিন আমরা একটা ভয়ংকর সাহসের কাজ করে ফেলোম।

মায়ী মায়ীর ট্রেইলারে দেয়ালে একটা ছোট বাক্সে সে ক্রেনিয়ালে ঢোকানোর টিউবগুলো রাখে। যখন দরকার হয় সে বাক্সটা খুলে সেখান থেকে এই ক্রেনি-টিউবগুলো বের করে। বাক্সটা খোলার জন্য তার চোখের রেটিনা স্ক্যান করাতে হয়। মাঝে মাঝে যখন স্ক্যানারটা প্রথমবারে কাজ করে না তখন সে আলসেমি করে চোখের রেটিনা স্ক্যান না করিয়ে সরাসরি পাসওয়ার্ড ঢুকিয়ে বাক্সটা খুলে ফেলে। যখন সে পাসওয়ার্ডটি ঢোকায় তখন আমি আর টিশা না দেখার কিংবা না বোঝার ভান করে তার আঙুলের ওঠানামা দেখে পাসওয়ার্ডটি অনুমান করার চেষ্টা করেছি। রেটিনা স্ক্যান করাটি যেন ঠিক করে কাজ না করে আর তাকে যেন বারবার সরাসরি পাসওয়ার্ডটিই ঢোকাতে হয় সে জন্যে আমরা মাঝে মাঝেই রেটিনা স্ক্যানারটি একটু ময়লা করে রাখি। বেশ কয়েকবার মায়ী মায়ীর পাসওয়ার্ড ঢোকানো দেখে আমরা শেষ পর্যন্ত পাসওয়ার্ডটি জেনে গেছি।

একদিন যখন মায়ী মায়ী আমাদের দুজনকে তার টেবিলের সাথে বেঁধে রেখে বাইরে গেল তখন আমি আর টিশা মিলে তার ক্রেনিয়াল টিউবের বাক্সে পাসওয়ার্ড ঢুকিয়ে বাক্সটা খুলে ফেলোম। টিশা

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল, আর আমি দ্রুত ক্রেনিয়াল টিউবের বাক্সটার ভেতরে দেখে নিলাম। ক্রেনি-টিউবগুলো সারি সারি সাজানো আছে, যেদিকটা ক্রেনিয়ালে ঢোকাতে হয় সেদিকে ইলেকট্রিক সংযোগের জন্য ছোট ইন্টারফেস, উল্টো পাশে আলো জ্বলার জন্য ছোট ছোট রঙিন লেজার মডিউল। ছোট টিউবগুলোর উপর ছোট ছোট সংখ্যায় ক্রেনিয়ালের কোড লেখা।

আমি ভেতর থেকে একটা ক্রেনি-টিউব বের করে বাক্সটা আবার বন্ধ করে দিলাম। টিউবটা নিজের কাছে না রেখে ট্রেইলারের এক কোনায় ফেলে রেখে দিলাম। মায়ী মায়ী যদি তার বাক্স খুলে বুঝতে পারে একটা টিউব নেই এবং সেটা নিয়ে হইচই করে তখন খোঁজার ভান করে ট্রেইলারের কোনা থেকে এটা বের করে দেওয়া যাবে। মায়ী মায়ী মনে করবে টিউবগুলো নাড়াচাড়া করার সময় তার অজান্তে একটা নিচে পড়ে গেছে।

পরের কয়েক দিন আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকলাম। মায়ী মায়ী বাক্স খুলে কয়েকবার ক্রেনিয়াল টিউব বের করে ব্যবহার করল, সে বুঝতে পারল না যে আমরা একটা সরিয়ে রেখেছি। তখন একদিন আমরা পকেটে করে টিউবটা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন খাঁচার ভিতরে আমি আর টিশা মিলে ক্রেনি টিউবটা খুলে ভেতরে কী আছে সেটা দেখার চেষ্টা করলাম। এত ছোট একটা টিউব, কোনো রকম টুল ব্যবহার না করে একেবারে খালি হাতে সেটা খুলতে পারব মনে করিনি কিন্তু এটাকে নানাভাবে টানাটানি করতে করতে হঠাৎ টিউবটা খুলে এল। আমাদের কাছে যেটুকু আলো আছে সেটাতে দেখলাম ক্রেনি-টিউবটার মাঝখানে ছোট একটা আইসি, সেখান থেকে মাত্র তিনটা তার বের হয়ে ভেতরে কানেকশন দেওয়া হয়েছে। দুটো নিশ্চিতভাবে একটা নিউক্লিয়ার ব্যাটারিতে গিয়েছে, তৃতীয়টা ক্রেনিয়ালের মাথায়। ছোট একটা স্কু ড্রাইভার দিয়েই আইসিটাকে খুলে আলাদা করে ফেলা যাবে।

আমি টিশার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “টিশা।”

“বলো।”

“আমরা এখন ইচ্ছে করলে পুরো দস্যুদলকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারব।”

টিশা ভুরু কুঁচকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”

“আমরা মায়ী মায়ীর বাক্স থেকে ক্রেনি-টিউবগুলো বের করে যদি ভেতরের আইসিগুলো খুলে ওলটপালট করে দিই তাহলে কী হবে বুঝতে পারছ?”

টিশার মুখটা হাঁ হয়ে গেল, বলল, “যখন মনে করবে সিস্টেম সতের লোড করছে তখন আসলে হয়তো কুকুরের সিস্টেম লোড হয়ে যাবে। তখন ঘেউ ঘেউ করে ছুটে বেড়াবে!”

দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি খুক খুক করে হেসে ফেলোম। বললাম “হ্যাঁ, ওরা কিছু বুঝতেই পারবে না, দুর্ধর্ষ দস্যুদল হয়তো মিনি বিড়াল হয়ে যাবে। এটা করার জন্য দরকার শুধু ছোট একটা স্কু ড্রাইভার! না পেলেও ক্ষতি নেই। এক টুকরো ছোট ধাতব পিনকে ঘষে ঘষে বানিয়ে ফেলতে পারব!”

টিশা বলল, “শুধু একটা সমস্যা।”

“কী সমস্যা?”

“কোন ক্রেনি-টিউব কোন কাজ করে আমরা জানি না। আইসি ওলটপালট করার সময় যদি ভুলভাবে ওলটপালট হয়ে যায় তাহলে দস্যুদল হয়তো জল্লাদের দল হয়ে যাবে! রাক্ষস হয়ে যাবে।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ, আমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল থাকলে আমরা নিজেরাই পরীক্ষা করে বের করে ফেলতে পারতাম!”

আমি ক্রেনি-টিউবটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, উপরে কিছু অক্ষর এবং কিছু সংখ্যা লেখা কিন্তু সেই অক্ষর কিংবা সংখ্যার অর্থ কী আমরা জানি না।

টিশা ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে করতে বলল, “কিছু একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।”

.

আমরা অবশ্যি অনেক চিন্তা করেও কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলাম না, তখন একদিন আমরা আবার খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলোম। শুধু সাহসের না, খুবই বিপজ্জনক একটা কাজ।

আমাকে আর টিশাকে দুপুরবেলা একটা বড় লরির এক্সেলের সাথে বেঁধে এক ড্রাম ঝাঁঝালো গন্ধের সলভেন্ট দিয়ে গেছে। আমরা হাতে গ্লভস পরে সেই সলভেন্ট দিয়ে ইঞ্জিন পরিষ্কার করছি। মাঝে মাঝে কঠোর চেহারার একটা দস্যু এসে দেখে যাচ্ছে আমরা ঠিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি কি না।

হঠাৎ একটা নারী কণ্ঠের কথা শুনলাম, কেউ একজন বলল, “কাজ কেমন চলছে?”

আমরা মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি রিয়ানা নামের মেয়েটি, যে এখন আর রিয়ানা নয়, যার নাম এখন দ্রিমা তিন। শীতের রাতে টিশার গান শুনে যে আমাদের খাঁচার নিচে থমকে দাঁড়িয়েছিল।

আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, “কাজ খুব ভালো চলছে।”

টিশা বলল, “ইঞ্জিনটা প্রায় চকচকে করে ফেলেছি।”

রিয়ানা কিংবা দ্রিমা তিন বলল, “তোমাদের এখানে আনন্দের কিছু নেই।”

আমরা চুপ করে রইলাম কারণ কথাটি সত্যি।

রিয়ানা বলল, “যদি তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল থাকত তাহলে তোমাদের মাথায় বেসিক একটা ক্রেনি-টিউব দিয়ে একটু আনন্দ দেওয়া যেত।”

আমরা এবারও চুপ করে রইলাম, কারণ আমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, বাইরে থেকে আমাদের মাথায় আনন্দ দেবার কোনো উপায় নেই। এই দস্যুদল যখন কোনো কাজ করে না তখন তাদের ক্রেনিয়ালে আনন্দ পাবার নানা ধরনের টিউব লাগিয়ে সময় উপভোগ করে। মানুষগুলোকে দেখলে তখন কেমন জানি অস্বস্তি হয়। প্রচণ্ড আনন্দে তাদের চোখ বন্ধ হয়ে যায়, শরীর কাঁপতে থাকে, মুখ দিয়ে লোল ঝরতে থাকে–এই তীব্র আনন্দটি আমরা কোনো দিন অনুভব করতে পারব না। হয়তো কোনো মাদক খেয়ে এরকম আনন্দ পাওয়া সম্ভব।

রিয়ানা বলল, “তোমরা কাজ করো, আমি যাই।”

তখন হঠাৎ করে টিশা তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের সবার কাছে কি আনন্দ পাবার ক্রেনি-টিউব থাকে?”

“বেসিক টিউবটি সবার আছে। যার সিস্টেম যত বেশি সে তত তীব্র আনন্দের ক্রেনি-টিউব ব্যবহার করতে পারে।”

টিশা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি একটা ক্রেনি-টিউব দেখে বলতে পার এটা কিসের টিউব?”

“না। আমরা পারি না। টিউবের উপর কোড লেখা থাকে, যাদের সিস্টেম তের থেকে বেশি তারা কোড ভেদ করতে পারে।”

টিশা বলল, “ও।”

আমি তখন খুব সাহস এবং মনে হয় ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করে ফেলোম, বললাম, “তোমাকে কি আমরা একটা কথা বলতে পারি?”

“কী কথা?”

“আমাদেরকে মায়ী মায়ী যখন তার ট্রেইলারে বেঁধে রেখেছে তখন মেঝেতে আমরা একটা ক্রেনি-টিউব খুঁজে পেয়েছিলাম।”

রিয়ানার চোখ দুটো একটু বিস্ফারিত হয়ে গেল, এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “তুমি কী বললে?”

কথা যখন শুরু করে দিয়েছি, সেটা শেষ করে ফেলতে হবে, এখন আর পেছানোর উপায় নেই। আমি প্রায় মরিয়া হয়ে বলেই ফেলোম, “তুমি কি এই ক্রেনি-টিউবটি তোমার মাথায় লাগিয়ে বলতে পারবে এটা কিসের টিউব?”

রিয়ানা কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলল না, তারপর ফিসফিস করে বলল, “তুমি যে কথাটা বলেছ সেটা এই দস্যুদলের আর কেউ যেন না শোনে, তাহলে তোমাদের খুব বড় বিপদ হবে। আর এই টিউবটা মায়ী মায়ীকে ফিরিয়ে দিয়ো। তোমরা সিস্টেম সতেরর ক্ষমতা জান না!”

আমি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। রিয়ানা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেঁটে চলে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল, ফিরে এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “দাও ক্রেনি টিউবটি।”

আমি কাঁপা হাতে রিয়ানার হাতে টিউবটি দিলাম। সে মুঠি বন্ধ করে হাতটি পকেটে ঢুকিয়ে চলে গেল।

পরের দুটি দিন রিয়ানা কী করে সেটা নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকলাম। সে যদি মায়ী মায়ীর কাছে আমাদের নিয়ে নালিশ করে দেয় তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে আমরা সেটা চিন্তাও করতে পারি না। রিয়ানা অবশ্যি নালিশ করল না। তৃতীয় দিন তার সাথে আবার আমাদের দেখা হলো। আমি আর টিশা তখন একটা বড় লরির টায়ারের ফাঁকে আটকে থাকা পাথরের টুকরোগুলো পরিষ্কার করছিলাম। রিয়ানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমাদের কাজ করতে দেখল, যখন আশেপাশে কেউ নেই, তখন পকেট থেকে ক্রেনি টিউবটা বের করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”

আমি সেটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি পকেটে ঢুকিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কিসের টিউব?”

“সিস্টেম পনের।”

“তার মানে কী?”

“তার মানে এটা খুবই মূল্যবান। মায়ী মায়ী সিস্টেম সতের। এখানে সিস্টেম পনের মাত্র চারজন।”

রিয়ানা কেমন বিচিত্র দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

আমি বললাম, “ক্রেনিয়াল টিউব আমাদের কোনো কাজে লাগে। তুমি এটা রেখে দিতে চাও? তুমিও সিস্টেম পনের হয়ে যাবে?”

রিয়ানা মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি সিস্টেম পনের হতে চাই। আমি যা তাই থাকতে চাই। সম্ভব হলে আমি একটা নিউট্রাল টিউব আমার মাথায় লাগিয়ে স্বাভাবিক মানুষ হতে চাই।”

দুইদিন পরে আমরা আবার যখন একটা লরির ইঞ্জিন পরিষ্কার করছি তখন আবার রিয়ানার সাথে দেখা হলো। আমি এদিক-সেদিক তাকিয়ে আমার পকেট থেকে দুটি ক্রেনি-টিউব বের করে মুঠি বন্ধ করে তার দিকে হাতটা এগিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে আমাদের সাহস বেড়েছে, মায়ী মায়ী যখন আবার আমাদেরকে ট্রেইলারের ভেতর রেখে বাইরে গেছে, আমরা এবারে তার বাক্স থেকে দুটি ক্রেনি-টিউব সরিয়ে এনেছি।

রিয়ানা জিজ্ঞেস করল, “তোমার হাতে কী?”

আমি মুঠি খুলে তাকে ক্রেনি-টিউব দুটি দেখালাম। রিয়ানা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, কেমন করে আমার হাতে দুটি ক্রেনি-টিউব এসেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করল না। একটা টিউব হাতে নিয়ে তার গায়ে লেখা কোডটা পড়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিচু স্তরের শারীরিক আনন্দ পাবার টিউব।” তারপর দ্বিতীয়টা হাতে নিয়ে তার কোডটা পড়ে আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলল, “এটা সিস্টেম সাত।”

টিশা জিজ্ঞেস করল, “তুমি মাথায় না লাগিয়েই কেমন করে বলে দিচ্ছ?”

“আমি কোড পড়েই বলে দিতে পারি। আমি কোডটা জানি।”

“কেমন করে জানলে?”

“যখন আমার ক্রেনিয়ালে সিস্টেম পনের লাগিয়েছিলাম তখন জেনেছি।” রিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমরা যদি লেখাপড়া জানতে তাহলে আমি তোমাদের কোডটা শিখিয়ে দিতে পারতাম।”

টিশা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “আমরা লেখাপড়া জানি।”

রিয়ানা কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তোমরা যদি আমাকে একটা নিউট্রাল ক্রেনি টিউব এনে দিতে পার তাহলে আমি তোমাদের কোডটা শিখিয়ে দিতে পারি।”

টিশা ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “তুমি যদি আমাদের কোডটা শিখিয়ে দাও তাহলে আমরা তোমাকে একটা নিউট্রাল ক্রেনি টিউব এনে দিতে পারি!”

রিয়ানা বলল, “ঠিক আছে। আমি তোমাদের কোডটা শিখিয়ে দেব।”

রিয়ানা আমাদের কোডটা শিখিয়ে দেওয়ার দুদিন পর আমরা তাকে একটা নিউট্রাল ক্রেনি-টিউব খুঁজে এনে দিলাম। টিউবটা হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমি এখন আবার সত্যিকারের মানুষে হয়ে বেঁচে থাকতে পারব।”

ক্রেনি-টিউবের কোডটি জানার পর হঠাৎ করে আমার আর টিশার ক্ষমতা প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। আমরা এখন ক্রেনি-টিউবের ভেতরের আইসিগুলো ওলটপালট করে দেব। দস্যুদল ভয়ংকর দস্যু হওয়ার জন্য মাথার মাঝে একটা ক্রেনি-টিউব লাগিয়ে নিজের অজান্তেই নিরীহ দুর্বল একজন মানুষে পাল্টে যাবে!

আমি আর টিশা খুব সাবধানে কাজ করতে শুরু করলাম, কিন্তু কোনো কিছু করার আগেই হঠাৎ করে একদিন আবিষ্কার করলাম মায়ী মায়ী আমাদের দুজনকে বিজ্ঞানী লিংলির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

মায়ী মায়ীর ট্রেইলারের বাক্স থেকে এগারটা ক্রেনি-টিউব সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারলাম না।