ডিকের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন ফার্গুসন। শোনো কেনেডি, চুল্লিটার তাপ বড়িয়ে রেখে যে-কোনো সময় উড়ে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে থেকো-নোঙরটা অবশ্য খুব আঁটো করে জড়ানো আছে, তবু চটপট উড়ে যেতে কোনো অসুবিধে হবে না। জো নিচে মাটিতে বেলুনের তলায় বসে অপেক্ষা করবে। কেবল আমি একাই যাবো সুলতানের কাছে।
আমি যাবো আপনার সঙ্গে, জো বিনীত অথচ দৃঢ় গলায় জানালে।
না, আমি একাই যাবো। উত্তর দিলেন ফার্গুসন, কোনো ভয় নেই। সত্যিই আমাদের চাঁদের ছেলে বলে ভেবেছে ওরা, কাজেই ওদের কুসংস্কারই আমার সহায় হবে। তবে, যে-কোনো বিপদের জন্যেই তৈরি হয়ে থেকো। গিয়েই চটপট চলে আসবো আমি।
দড়ির সিঁড়ি নামিয়ে দেয়া হলো। ওষুধের বাক্স বগলে নিয়ে ফার্গুসন প্রথম নিচে নামলেন, পেছন-পেছন জো নেমে এলো। নিচে মাটিতে এসে বেশ রাজার মতো চাল করে, জমকালো দেমাকি ভঙ্গি করে বসলো জো, কৌতূহলী নরনারী তার চারদিকে সসমে ভিড় করে দাঁড়ালে। এদিকে কানে-তালা-লাগানন অদ্ভুত বাজনা আর বিচিত্র চীৎকারের মধ্যে উল্কি-কাটা শাঁখের-মালা-পরা হাড়ের-গয়না-গায়ে ডাইনি-পূরুতেরা ফার্গুসনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো সুলতানের প্রাসাদের দিকে। সেখানে পৌঁছুতে অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হলো। যখন পৌঁছুলেন, বেলা তখন তিনটে।
প্রাসাদে ঢুকতেই পাতার-ঘাগরা-পরা সুন্দর চেহারার কয়েকজন মেয়ে ফাণ্ডসনকে। সমাদরে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেলো। বিভিন্ন প্যাচালো আকারের মস্ত লম্বা নলচেয় করে তারা তামাক টানছিলো। তাদের মধ্যে দুজন ছিলো পাটরানী : সুলতানের মৃত্যু হলে তাদেরও জ্যান্ত বরণ করে নিতে হবে মৃত্যুকে, কেননা মৃত্যুর পরপারে গিয়ে সুলতানকে সঙ্গ দিতে হবে তো! কারণ তাদের বিশ্বাস, রাজা হলেন অমর, তার জরা নেই, ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই। দলের লোকের মনে কোনোরকমে এই বিশ্বাসটি টিকিয়ে রাখার উপরই রাজার ঐশ্বর্য আর অসীম প্রতিপত্তি নির্ভর করে আছে। তাই তাদের রীতি-নীতির ভেতর একেবারে মরীয়ার মতো অমর সাজবার আয়োজন। সুলতান অমর, তার মৃত্যু নেই, তাই মরে যাবার পরও তার জন্যে দরকার জীবনধারণের সব উপকরণ। তাই তাদের শবাগারগুলো ছোটোখাটো একেকটি প্রাসাদের মতো। বেশ শক্ত করে গাঁথা সেইসব কবর, ভেতরে ঐশ্বর্যের তাক-লাগানো সম্ভার; আশবাবপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, বাসনকোশ, গয়নাগাটি আর সাজগোজের আয়োজন–সোনা তামা আর দামি পাথরের যেন ছড়াছড়ি। এই কবরখানার ভেতরে গুদোম-ঘর, আর তার মধ্যেই থরেথরে তেল, খাদ্য পানীয়, আরো পাঁচ রকমের কত-কী জিনিশ সাজানো। রাজাকে যে-ঘরে কবর দেয়া হয়, তারই আশপাশের ঘরে রাজার চাকরবাকরদেরও জ্যান্ত কবর দেবার ব্যবস্থা–সেই সঙ্গে জীবন্তই পোতা হতো রানীদের কিংবা হয়তো মেরে ফেলে তাদের পরে কবর দেয়া হতো। মোটমাট, মরা রাজার যাতে সেবার কোনো ত্রুটি না-হয়, এই জন্যে মরতে হতো অন্য মানুষদেরও। এই ব্যবস্থা চলে আসছে মিশরে, যুগ থেকে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে। আর মৃত্যুর এই জাঁকজমকের চূড়ান্ত পরিণতি হলো তার বিখ্যাত ও চমকপ্রদ বড় পিরামিড-মৃত্যুর কালো প্রাসাদ যেন আসলে, ফ্যারাওয়ের মৃত শরীরকে যে মমি করে টিকিয়ে রাখবার চেষ্টা তা-ই নয়, তার ওই কবরখানার মধ্যে বেঁচে-থাকার সবরকম আয়োজনও থাকে। বহু যুগের ওপার থেকে এই-যে আঁটো, কঠিন, অনড় নিয়ম চলে আসছে, রানীরা সবাই তা জানে; তারা জানে যে অচিরেই অকালে তাদের মৃত্যু বরণ করতে হবে। কিন্তু এই নিশ্চিত মৃত্যু-সংবাদ জানা সত্ত্বেও সেই ছয় রানী বেশ নির্বিকার খোশ-মেজাজের সঙ্গেই তামাক টেনে যাচ্ছিলো।
খুব গম্ভীর ভাবভঙ্গি দেখালেন ফার্গুসন, আড়ম্বর করে মৃতপ্রায় সুলতানের শয্যার দিকে এগিয়ে গেলেন। সুলতানের বয়স খুব বেশি নয়, অল্পই, বড়ো-জোর হয়তো চল্লিশ হবে, কিন্তু তবু তার সমস্ত শরীরে জীর্ণতার রেখা সুস্পষ্ট : অজ্ঞান অবস্থায় সে পড়ে আছে তার শয্যায়, নিশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না। কিন্তু ভালো করে তাকিয়েই তার চোখের তলার কালিমা দেখে ফার্গুসন অনায়াসেই বুঝতে পারলেন যে বহুদিনের বহু রকমের নেশা ও অত্যাচারে সে তার শরীরের যে-হাল করে এনেছে, তাতে তার আর বাঁচার আশা নেই। মুখে সে-কথা তিনি প্রকাশ করলেন না। বরং নীরবে, কোনো কথা না-বলে, বাক্স থেকে একটি কড়া ওষুধ বার করে কোনোরকমে সুলতানকে খাইয়ে দিলেন। তারই ফলে সুলতান একটু নড়ে-চড়ে উঠলো। একেবারে আসাড়, অবশ, মৃতপ্রায় হয়ে ছিলো সে, হঠাৎ তার মধ্যে প্রাণের চঞ্চল সাড়া দেখে উপস্থিত সকলে উল্লাসে কোলাহল করে উঠলো। ফার্গুসন কিন্তু এর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না, তক্ষুনি প্রাসাদ থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এসে সোজা ভিক্টরিয়ার দিকে ফিরে চললেন।