১০. ডক্টর জিজি শাহনাজের হাতে

ডক্টর জিজি শাহনাজের হাতে একটা ছোট শিশি দিয়ে বলল, এই নাও। শিশিটা হাতে নিয়ে শাহনাজ বলল, এটা কী?

তোমার ভাই। শিশিতে ভরে দিয়েছি। তুমি যেরকম চেয়েছিলে।

শাহনাজ শিশির ভিতর উঁকি দিয়ে দেখল একটা নিখুঁত পুতুলের মতো ইমতিয়াজের ছোট দেহটি ক্যামেরায় ছবি তোলার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে। শাহনাজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া জেগে উঠবে না?

হ্যাঁ, আমরা চলে যাবার সাথে সাথে জেগে উঠবে।

তখনো কি এ রকম ছোট থাকবে?

না, তখন এ রকম ছোট থাকবে না। স্বাভাবিক আকারের হয়ে যাবে।

তোমরা কখন যাবে?

পৃথিবীতে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে, আমরা এখনই যাব।

শাহনাজের বুকে হঠাৎ কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে, সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আবার কবে আসবে?

সময় এবং অবস্থান সম্পর্কে তোমাদের ধারণা এবং আমাদের ধারণা এক নয়। আমরা আবার যদি আসি সেই সময়টা এক মুহূর্ত পরে হতে পারে আবার এক যোজন হতে পারে। কারণ–

শাহনাজ তার মাথা চেপে ধরে বলল, থাক, থাক, অনেক হয়েছে। আবার ঐসব কঠিন কঠিন কথা বোলো না, মাথা গুলিয়ে যায়।

আমি বলতে চাই না, তুমি জিজ্ঞেস কর দেখে আমি বলি।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, আমরা তোমাদের কয়েকটা ছবি তুলতে পারি?

ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, তুলতে পার। কিন্তু তুলে কী লাভ? তোমরা যেটা দেখছ সেটা তোমাদের বোঝার সুবিধার জন্য একটা সহজ রূপ। এটা সত্যি নয়।

তবু এটাই তুলতে চাই।

বেশ। তুলো।

ক্যাপ্টেন ডাবলু তখন শাহনাজের আব্বার ক্যামেরাটা দিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলল। ডক্টর জিজির ছবি, ডক্টর জিজি এবং শাহনাজের ছবি, ডক্টর জিজি এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুর ছবি, শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে ডক্টর জিজির ছবি, শিশির ভিতরে ইমতিয়াজকে হাতে নিয়ে শাহনাজের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছবি তোলা শেষ হবার পর বিদায় নেবার পালা। শাহনাজ একটু ধরা গলায় বলল, ডক্টর জিজি, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকলে কিছু মনে কোরো না।

আমাদের কাছে খারাপ–ভালো বলে কিছু নেই।

ও আচ্ছা! আমার মনেই থাকে না।

ক্যাপ্টেন ডাবল বলল, সাবধানে যেয়ো। গ্যালাক্সিতে কত রকম বিপদআপদ থাকতে পারে, ব্ল্যাকহোল, কোয়াজার নিউট্রন স্টার।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা সাবধানেই যাব।

উপায় থাকলে বলতাম, বাড়ি পৌঁছে একটা ই–মেইল পাঠিয়ে দিও। কিন্তু কোনো উপায় নেই।

না, নেই।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, আরেকবার এলে দেখা না করে যেয়ো না কিন্তু।

যদি তোমরা থাক তোমাদের খুঁজে বের করব। কিন্তু

কিন্তু কী?

তোমাদের কিছু মনে থাকবে না।

মনে থাকবে না? না। কেন?

আমরা যখন নিচুশ্রেণীর কোনো সভ্যতার কাছে যাই তখন চেষ্টা করি সেখানে বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন না করতে। এখানে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলো আবার আগের মতো করে যেতে হবে।

তার মানে?

হাসপাতালের মানুষটি যে জোরে জোরে চিন্তা করছে তাকে ঠিক করে দিতে হবে। মোবারক স্যারের নাক, তার ছাত্রীদের স্মৃতি, ঝিনু মস্তান আর সন্ত্রাসী, আশপাশের লোকজন, তোমার ভাই ইমতিয়াজ, সবার সকল স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে হবে। কারো কিছু মনে থাকবে না।

শাহনাজের মুখে হঠাৎ আতঙ্কের ছায়া পড়ে, তা হলে কি সোমা আপুকে আবার অসুস্থ করে দেবে?

আমাদের নিয়ম অনুযায়ী তা–ই করার কথা ছিল, কিন্তু তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণে তাকে আমরা আর অসুস্থ করব না। সে ভালো হয়ে আছে ভালোই থাকবে।

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, আর আমরা, আমাদের স্মৃতি? আমরাও কি সব ভুলে যাব?

ডক্টর জিজি ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, তোমরা কী চাও? মনে রাখতে চাও?

শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু একসাথে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমরা মনে রাখতে চাই!

বেশ। তা হলে তোমরা মনে রেখো। এই পৃথিবীতে আমরা মাত্র তিনটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।

কী কী জিনিস?

সোমার সুস্থ শরীর। ক্যামেরায় ছবি। আর তোমাদের দুজনের স্মৃতি।

ক্যামেরার ছবিগুলো কি আমরা অন্যদের দেখাতে পারি?

ইচ্ছে হলে দেখিও।

তোমাদের কথা কি অন্যদের বলতে পারি?

ইচ্ছে হলে বোলো৷

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ডক্টর জিজি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ডক্টর জিজি কোনো কথা না বলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনেই জানে ডক্টর জিজির এটি একটি কাল্পনিক রূপ কিন্তু তবুও তার প্রতি গভীর মমতায় তাদের বুকের ভিতর কেমন জানি করে ওঠে। শাহনাজ কিছু একটা বলতে চাইছিল

কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করে একটা ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। বাতাসের ঝাঁপটায় তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, মাথা নিচু করে বসে পড়ে। তারা বুঝতে পারে তীব্র বাতাসে তারা উড়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু বাতাসে শরীর এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে–তারা জানে ডক্টর জিজি গভীর ভালবাসায় তাদেরকে পৃথিবীর মাটিতে নামিয়ে দেবে।

শাহনাজ যখন চোখ খুলে তাকাল তখন তাদের সামনে ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। সে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোরা এখানে কখন এসেছিস?

শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল, এই তো একটু আগে।

ইমতিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, কী একটা ছবি তুলতে এসেছিলাম, মনে করতে পারছি ন্য।

শাহনাজ বলল, মনে হয় এই ঝরনাটার।

ইমতিয়াজ ঘুরে তাকাল, পাহাড়ের উপর থেকে পানির ধারা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটি দেখতে দেখতে বলল, ঝরনার আবার ছবি তোলার আছে? তারপর বিরক্ত মুখে বলল, দে দেখি ক্যামেরাটা, এসেছি যখন একটা ছবি তুলে নিই।

শাহনাজ ক্যামেরাটা এগিয়ে দেয়, হাতে নিয়ে ইমতিয়াজ বিরক্তমুখে বলল, এ কী, একটা ফিল্মও তো বাকি নেই দেখি! কিসের ছবি তুলে ফিল্মটা শেষ করেছিস?

শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল এই তো এইসব জিনিসপত্র!

.

বাসায় এসে তারা আবিষ্কার করল সোমা ফিরে এসেছে। শাহনাজকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, জানিস শাহনাজ আমি ভালো হয়ে গেছি। একেবারে ভালো হয়ে গেছি। ডাক্তাররা খুঁজে কোনো সমস্যাই পায় নি!

ইমতিয়াজ মুখ বাঁকা করে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম সাইকোসেমেটিক। মানসিক রোগ। এখন আমার কথা বিশ্বাস হল?

সোমার আম্মা বললেন, তুমিই ঠিক বলেছ বাবা, আমরা বুঝতে পারি নি!

সোমা খিলখিল করে হেসে বলল, কী মজা দেখেছ, সাইকোসেমেটিক অসুখ হলে কেমন লাগে সেটাও এখন আমি বুঝে গেলাম।

শাহনাজের ক্যামেরার ফিল্মটি ডেভেলপ করে নিয়ে আসার পর সেখানে মহাকাশযান এবং ডক্টর জিজির অনেক ছবি দেখা গেল। শাহনাজ প্রথমে ছবিগুলো দেখাল সোমাকে। সোমা ছবি দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, ওমা! এমন মজার ছবি কোথায় তৈরি করেছিস?

শাহনাজ বলল, আসলে তৈরি করি নি_

সোমা বাধা দিয়ে বলল, বুঝেছি, ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাজ! এইটুকুন ছেলের কী বুদ্ধি কয়দিন আগে আমার একটা ছবির সাথে ডাইনোসরের ছবি জুড়ে দিল। দেখে মনে হয় সত্যি সত্যি ডাইনোসর। কম্পিউটার দিয়ে করে, তাই না?

না, সোমা আপু। এটা সত্যি–

সোমা খিলখিল করে হেসে বলল, তুই যে কী মজা করতে পারিস শাহনাজ, তোকে দেখে অবাক হয়ে যাই! আমারও এ রকম একটা ছবি আছে এলিয়েনের সাথে, কম্পিউটার দিয়ে করা। তোর ছবির এলিয়েনটা দেখ, কেমন জানি বোকা বোকা চেহারা। আমারটা ভয়ঙ্কর দেখতে, এই বড় বড় দাঁত, নাক দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।

শাহনাজ কিছু বলল না, একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।

.

সোমাদের চা–বাগানে প্রায় একমাস সময় কাটিয়ে শাহনাজ ঢাকায় ফিরে এসেছিল। তার কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন ডাবলুর একটা চিঠি এসে হাজির, চিঠিটা শুরু হয়েছে এইভাবে :

প্রিয় পু
        আশা করি তুমি ভালো আছ। আমি ভালো নাই। আমি যার কাছেই ডক্টর জিজির কথা বলি, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমার আব্বু সেদিন আমার সায়েন্স ফিকশানের সব বই বাক্সে তালা মেরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছেন। এইসব ছাইভস্ম পড়ে পড়ে আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লান্টু পর্যন্ত আমার কথা বিশ্বাস করে না, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কী–মজা–হবে আপু আমার যেন মনখারাপ না হয় সেজন্যে ভান করে যে ডক্টর জিজির কথা বিশ্বাস করেছে কিন্তু আসলে করে নাই।
         ডক্টর জিজির কথা বিশ্বাস করানোর জন্য কী করা যায় বুঝতে পারছি না। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে জানাও।

ইতি
        ক্যাপ্টেন ডাবলু
        পুন. তোমাকে শুধু পু ডেকেছি বলে কিছু মনে কর নাই তো?

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে চিঠির উত্তরে কী লিখবে এখনো ভেবে ঠিক করতে পারে নি।