১০. টেলিফোনের শব্দে চমকে উঠলাম

দশম পরিচ্ছেদ

০১.

হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে চমকে উঠলাম। টেলিফোন বাজতে থাকল, দরজার হাতল ঘোরাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু বাইরে থেকে তালাবন্ধ।

ভয়ানক মজবুত দরজা ভেঙ্গে ফেলার আশা নেই তাছাড়া জানালার কাছে ছুটে গিয়ে পর্দা সরিয়ে নিচের দিকে চাইলাম। না, সেদিক দিয়ে পালাবার কোন পথ নেই।

শোবার ঘরে গিয়ে দেখলাম, এখানেও কোন পথ নেই।

বসবার ঘরে ফিরলাম। টেলিফোনের আওয়াজ আমার নার্ভে আঘাত করছিল।

ঘরের ওপাশে আর একটা দরজা রান্নাঘরের ও বাথরুমের। উপরের জানলা খুব ছোট্ট।

রিসিভারটা তুলে টেবিলে রাখলাম, রিসিভার থেকে একজন পুরুষের ক্ষীণ শব্দ ভেসে এলো।

ডলি? ডলি বলছ? আমি এড। আর, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেবে…।

রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজলাম যদি শক্ত কিছু পাওয়া যায়। যা দিয়ে দরজা ভাঙ্গা যেতে পারে কিন্তু কিছুই পেলাম না।

দরজার কাছে ফিরে এলাম। চাবির গর্তে চোখ রেখে দেখলাম তখনও তালায় চাবি ঢোকানো।

ভুতুড়ে শব্দের মত তখনও রিসিভার থেকে ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে। চেয়ারের উপর থেকে খবরের কাগজ নিয়ে একটা পাতা ছিঁড়ে দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিলাম।

আবার রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে ক্যাবিনেটের ড্রয়ার হাতড়ে একটা সরু প্লায়ার্স পেলাম। সেটা দিয়ে একটু চেষ্টা করতেই চাবিটা দরজার তালা থেকে বেরিয়ে খবরের কাগজের উপর পড়ল।

খুব আস্তে খবরের কাগজের পাতাটা টেনে চাবিটা তুলে নিলাম।

টেলিফোনের কাছে এসেরিসিভারটা যথাস্থানে রেখে দরজার কাছে ফিরে তালায় চাবিটা পরিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম।

স্বল্প আলোকিত প্যাসেজে এসে দেখলাম এলিভেটরের পাশে মুখ নিচু করে ডলোরেস পড়ে। তার কোটটা জড়ো হয়ে এক পাশে পড়ে আছে। মারা না গেলে কেউ এভাবে পড়ে থাকে না। আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল।

বসার ঘরে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

ধীরে ধীরে প্যাসেজে এসে ঝুঁকে ওকে দেখলাম তার মুখ অন্যদিকে ঘোরান। তবু তার চুলে রক্ত দেখলাম।

কাধটা ধরে তাকে চিৎ করে দিলাম।

ডানদিকের কপালে কেউ মারাত্মকভাবে আঘাত করে খুলির হাড় ভেঙ্গে চুর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে।

তার কোটের পকেটে হাত দিলাম পাঁচশো ডলার আর তার সুটকেশ অদৃশ্য হয়েছে।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে সরে এলাম। কারণ কেউ দেখলে ভাববে আমিই তাকে হত্যা করেছি।

একথা মনে হতেই তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।

প্রায় অর্ধেক সিঁড়ি নেমেছি। এমন সময় একজন মহিলাকে উঠে আসতে দেখলাম।

প্রচণ্ড ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক ভাবে নামতে লাগলাম।

সিঁড়িতে স্বল্প আলোতে ভালভাবেই মেয়েটিকে দেখতে পেলাম এবং মেয়েটিও আমাকে দেখল।

সে যুবতী ও সুন্দরী। মলিন ফ্যাকাশে ও একটা মিষ্টি ভাব তার মুখে ছিল, চোখের নিচে কালি। তার কালো কোটের নিচে ফুলকাটা সান্ধ্য পোশাক দেখা যাচ্ছিল। মাথায় একটা লাল রিবন বাঁধা।

সে সোজা উপরে উঠে গেল।

যদি সে চারতলায় যায় তবে ডলোরেসের মৃতদেহে হোঁচট খাবে। তার চীৎকারে পুলিশ এসে পড়ার আগেই পালাতে হবে।

হল ঘরে এসে উপরতলার কোথাও দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম তার ঘর নিশ্চয়ই তিনতলায়। সাবধানে দরজা খুলে রাস্তায় নামলাম। রাস্তা থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে যেখানে বুইকটা রেখেছিলাম সেখানে এলাম।

 ভিতরে এসে ভীষণ খারাপ লাগছিল। ডলোরেসকে মৃত দেখে মনে দুঃখ হচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে মনের দুর্বলতার সঙ্গে লড়াই করতে লাগলাম।

একটা গাড়ির শব্দে ধাতস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি চাবিটা স্টিয়ারিং-এর তালার গর্তে বসালাম।

স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি আমার পাশ কাটিয়ে ম্যাডক্স আর্মসের সামনে এসে দাঁড়াল। স্যুটকেশ হাতে একজন এসে দাঁড়াল।

ড্রাইভারের টাকা মিটিয়ে সে ছুটে দেউড়ির দিকে চলে গেল।  

ট্যাক্সিটাকে চলে যেতে দেখে ইতস্তত করছিলাম, এই লোকটাই কি এড, যে টেলিফোনে কথা বলছিল?

রাস্তায় এসে প্রথমবাঁক নিয়েই ব্রেক কষে পাশের রাস্তায় যেখানে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে সেখানে গাড়িটা দাঁড় করালাম। ভাবলাম লোকটা যদি এড হয় তবে তাকে ভালভাবে না দেখলে সত্যিই বোকামি হবে।

বুইকটা দাঁড় করিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাডক্স অ্যাভিনিউর দিকে হাঁটতে লাগলাম।

ম্যাডক্স আর্মসের প্রায় পঞ্চাশ গজের মধ্যে এসে একটা ছায়া ছায়া জায়গায় লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

স্যুটকেশ হাতে লোকটা পাঁচ-ছয় মিনিট পরে বেরিয়ে এল।

আড়াল থেকে বেরিয়ে তার দিকে এমন ভাবে এগোতে লাগলাম যেন পার্টি থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া দরকার।

আমাকে দেখে স্যুটকেশ হাতে লোকটা ভয়ানক ভাবে চমকে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি ছুটতে লাগল।

আমি পিছু নিলাম কিন্তু সে যাতে বুঝতে না পারে যে আমি তাকে অনুসরণ করছি সেদিকে খেয়াল রাখলাম।

সে চৌমাথায় এসে আমার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিল।

আমি ছুটতে শুরু করলাম সে চোখের আড়াল হওয়ামাত্র। সে একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। সেখানে তিনটে ট্যাক্সি ছিল। প্রথমটায় ঢুকে ড্রাইভারকে বললাম, ঐ ট্যাক্সিটাকে ফলো করুন। যদি ওটাকে চোখের আড়ালে যেতে না দেন তাহলে পাঁচ ডলার বেশি পাবেন। খুব কাছে যাবেন না।

ট্যাক্সির দরজা লাগাবার আগেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।

আমাদের দেখে ফেলার বিশেষ কোন ভয় নেই। ওদের লুকিয়ে পড়ার মত গাড়িও রাস্তায় নেই। আমার বন্ধুকে বলতে শুনলাম ওয়াশিংটন হোটেলে নিয়ে যাবার জন্য।

মত পালটাতেও পারে। কোনমতেই হাতছাড়া করতে চাই না।

ড্রাইভার বলল কোথায় গিয়েছে আলফ্রেড আমাকে বলে দেবে, সবচেয়ে ভাল হয় যদি সোজা ওয়াশিংটন হোটেলে যাই। নইলে লোকটা নিশ্চয়ই আমাদের দেখে ফেলবে।

ঠিক আছে। প্রথমে তবে ওয়াশিংটন হোটেলেই চলুন।

ড্রাইভার গতি বাড়িয়ে দিল। আপনি বুঝি প্রাইভেট ডিটেকটিভ!

হা, বললাম কারণনা বললে অনেক কথা বলতে হয়। এই লোকটাকে হাতছাড়াকরলে আমার চাকরি চলে যাবে।

ঐ লোকটা হাতছাড়া হবে না। আমি আপনাকে ঠিক নিয়ে যাচ্ছি।

পাঁচ মিনিটেরও কম সময় সে হোটেলের পঞ্চাশ গজের মধ্যে গাড়ি থামিয়ে দাঁত বার করে বলল, দেখুন, সে এখনও এসে পৌঁছায়নি। শ্চয়ই এখানে আসবে। আমি কি অপেক্ষা করব?

হা।

সিগারেট বার করে তাকে দিলাম। দুজনেই ধরালাম।

ট্যাক্সির ভিতরেই বসে উইন্ড স্ক্রীনের ভিতর দিয়ে হোটেলের প্রবেশ পথের দিকে লক্ষ্য রাখলাম।

ওয়াশিংটন একটা চতুর্থ শ্রেণীর হোটেল। পাম সিটিতে যে সব ট্রাভেলিং সেলসম্যান আসে তারাই এটা ব্যবহার করে। এর একমাত্র সুবিধা রেল স্টেশনের খুব কাছে।

চুপচাপ বসে পাঁচ মিনিট ধরে ভাবছিলাম তখন ট্যাক্সিটা এসে হোটেলের সামনে দাঁড়াল।

ড্রাইভারকে পয়সা মিটিয়ে স্যুটকেশ হাতে লোকটা হোটেলে ঢুকে গেল।

আমার ড্রাইভার বলল ঐ দেখুন। আপনাকে আর কি বলব?

তাকে পাঁচ ডলার দিয়ে ধন্যব? বললাম। ভিতরে গিয়ে লোকটার সঙ্গে কথা বল।

কোন সাহায্য দরকার?

ঠিক আছে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠেকাঁচের দরজার বাইরে দাঁড়ালাম। স্যুটকেস হাতে লোকটা রাতের কেরানীটার সঙ্গে কথা বলছিল। ছাদ থেকে ঝোলানো আলোর ছটায় তাকে বেশ ভালভাবে দেখলাম।

সে যে শ্রেণীর মানুষ তাতে তার সঙ্গে ডলোরেস বাইরে যাবে আশা করা যায় না। বেঁটে, মোটা বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। কাপড় চোপড় ভয়ংকর ময়লা, নীল স্যটের কনুইগুলো ময়লা লেগে চকচক করছিল। মাথার টুপি ময়লা তেলচিটে। শুধু টাইটা নতুন আনকোরা নীল রঙের চকচকে মাঝখানে হলুদ সুতোয় একটা ঘোড়ার মুখ আঁকা।

সে কেরানীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা ময়লা রুমাল দিয়ে বারবার মুখ মুছছিল। তাকে অত্যন্ত বিচলিত দেখাচ্ছিল।

শেষে কেরানীকে কিছু পয়সা দিতে সে রেজিস্টারটা তার দিকে এগিয়ে দিল। খাতায় সই করে কাউন্টারের উপর থেকে চাবি, স্যুটকেশ তুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে তারপরে কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম।

.

০২.

 ভাবলেশহীন বুড়ো খিটখিটে কেরানীটি আমাকে আসতে দেখল।

কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তাকে ভালভাবে দেখার পর মনে হল, এসব লোককে বাগে আনার একমাত্র পথ ঐ। তার পোশাক দেখে মনে হল সে অত্যন্ত দরিদ্র।

গম্ভীর ভাবে বললাম। যে লোকটা এইমাত্র উপরে গেল আমি তার সম্বন্ধে জানতে চাই।

ওয়ালেট থেকে একটা দশ ডলারের নোট বার করে আঙ্গুলের ফাঁকে নোটটাকে অনেকটা পতাকার মত করে ধরে তার কাছ থেকে ফুট তিনেকের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাউন্টারের উপর হাত রাখলাম।

কেরানীর চোখ আমার হাতের দিকে সরে গেল, মখে অল্প হিংস্রভাব ফুটে উঠল।

আমাদের খদ্দেরদের ব্যাপারে কোন খবর দিই না। আপনি কে মহাশয়?

আমি একজন মানুষ যে দশ ডলার দিয়ে খবর কেনে।

মনে হল সে আমাকে বিচিত্র ধরনের শাসালো মানুষ ভেবেছে।

আপনি নিশ্চয়ই পুলিশের লোক নন বা প্রাইভেট ডিটেকটিভও নন।

আমি কে জানার কোন প্রয়োজন নেই। লোকটার নাম কি?

 তার হাত দুটো এগিয়ে এল। তার হাত আসা মাত্র আমি হাত সরিয়ে নিলাম।

লোকটার নাম কি?

জানি না। তবে নিশ্চয় বলতে পারি খাতায় যা লিখেছে তা নয়।

 খাতাটা এগিয়ে দিতেই পড়লামঃ জন টার্নার সানফ্রান্সিস্কো। খুব ছোট্ট করে বিশ্রীভাবে লেখা।

সে বলল, এ রকম টার্নারের জন্য যদি দশ ডলার করে পাই তবে বেশ বড়লোক হয়ে উঠতে পারি। এ চাকরিটা ছেড়েও দিতে পারি।

সে কি বলেছে যে এত রাতে কেন এসেছে। কিংবা কদিন এখানে থাকবে?

কেরানীটি কাঁধ নাচাল।

যদি টাকা পাই মশায় তবে স্মৃতি শক্তিও জেগে উঠবে।

 কাউন্টারে নোটটা রাখলাম।

এখানেই থাকতে দিন। এর উপর নজর রাখুন।

সে নোটটার উপর ঝুঁকে আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনি কি জানতে চান মশায়?

আমি আবার প্রশ্ন করলাম।

সে বলল যে শেষ ট্রেন ফেল করেছে, কাল ভোরে ট্রেন ধরবে। তাকে সকাল সাতটায় ডেকে দিতে হবে।

ট্রেনে কোথায় যাবে?

কিছুই বলেনি। তবে সানফ্রান্সিস্কো নয়। কাল সকাল সাড়ে সাতটায় সানফ্রান্সিস্কো যাবার কোন ট্রেন নেই। সান ডিয়েগো হতে পারে। সান ডিয়েগো যাবার ট্রেন সকাল সাড়ে সাতটায় ছাড়বে।

ওর রুম নাম্বার কত?

কেরানী নোটটা খুব আস্তে আস্তে তার দিকে টানতে লাগল।

আঠাশ নম্বর ঘর। তবে হঠাৎ কিছু একটা করে বসবেন না। ঘর ভাড় না নিলে কাউকে উপরে যেতে দেওয়া হয় না।

সাতাশ বা উনত্রিশ নম্বর ঘর খালি আছে!

কী বোর্ড থেকে ঝুলে থাকা চাবির সারির দিকে দেখল। নোটের উপর থেকে আঙ্গুলনা সরিয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে উনত্রিশ নম্বর ঘরের চাবিটা ক থেকে বার করে আনল।

চাবিটা আমার সামনে রেখে মাছি ধরবার আগে টিকটিকিরা যেমন জোর ছোটে সেইভাবে দ্রুতগতিতে দশ ডলারের নোটটাকে অদৃশ্য করে দিল।

রাতের জন্য দু ডলার। খারাপ ঘর নয়। অন্তত তার চেয়ে ভাল।

 দু ডলার রেখে চাবিটা নিলাম।

 যদি কোন কারণে ঘুমিয়ে পড়ি। তবে সকাল সাড়ে ছটায় আমাকে ডেকে দেবেন।

 ঠিক আছে। উপর তলায়, দোতলায়। সিঁড়ির মুখে বাঁ দিকে।

 তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে দোতলায় এলাম।

প্যাসেজের আলো অত্যন্ত কম। কার্পেটটা অত্যন্ত নোংরা ও রং ওঠা। বাঁধাকপি ধোয়া জলের গন্ধ ফুটো পাইপ থেকে বেরিয়ে আসা জল এবং আবোয়া জিনিসপত্র প্যাসেজে পড়েছিল। ওয়াশিংটন অবশ্য পাম সিটির প্রথম শ্রেণীর হোটেল নয়।

আঠাশনম্বর ঘরের সামনে এসে কান পেতে রইলাম। কোন শব্দ না পেয়ে উনত্রিশ নম্বর ঘরের দিকে গেলাম। তালা খুলে সুইচ হাতড়ে আলোটা জ্বালালাম।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চারদিকে চাইলাম। একটা খরগোসের বাসস্থান বলা চলে।

একটা বিছানা একটা টয়লেট বেসিন এবং দুটো চেয়ার। বিছানার উপর দিকে দেয়ালে একটা মেয়ের ছবি টাঙ্গানো রয়েছে মেয়েটার দুটো পাখা, পিছনে রেশমের জাল ছড়ানো আছে। সে দু হাতের মুঠো দিয়ে একটা লোহার দরজায় জোরে ঘা মারছে। সম্ভবতঃ মেয়েটি প্রণয়ের প্রতীক। যাকে দরজার ভিতর বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

ঘরে এসে বিছানায় শুলাম।

তখন আমার হাতঘড়িতে তিনটে বাজতে দশ। হঠাৎ মনে হল যেন জঙ্গলে এসে পড়েছি। আজকের শনিবারটা আমার জীবনের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল ও দুর্যোগপূর্ণ দিন। ভাবছিলাম এর পরে কোথায় যাব।

ঘুমোবার লোভ সামলাতে পারছিলাম না এমন সময় টেলিফোনের শব্দ। রিসিভার তুললে যে শব্দটা হয় পাশের ঘর থেকে এল।

শোনার চেষ্টা করলাম।

যে লোকটা হোটেলের রেজিস্টারে টার্নার নাম লিখেছে সে বলল, আমাকে এক বোতল স্কচ ও বরফ পাঠান।

কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর কড়াগলায় সে বলল, আজে বাজে কথা শুনতে চাই না। কোন তর্কাতর্কি না করে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। রিসিভার নামিয়ে রাখল।

বেশ কষ্ট করেই বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে আলো নিভিয়ে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মিনিট দশেক পরে সিঁড়ির উপর পা টেনে টেনে হাঁটার শব্দ পেলাম। একটা পাঁচ ডলারের নোট বার করলাম।

রাতের সেই কেরানীটা করিডর দিয়ে আসছিল হাতে একটা ট্রে, ট্রের উপর এক বোতল হুইস্কি ও এক পাত্র বরফ।

যখন সে পঁচিশ নম্বর ঘরের সামনে এল অমনি আমি তার সামনে এসে পাঁচ ডলারের নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সেই সঙ্গে ট্রে টা তার হাত থেকে নিলাম।

ক্ষুধার্ত বাঘ যেভাবে মাংসের টুকরো ছোঁ মেরে নেয়, সেইভাবে সে পাঁচ ডলারের নোটটা নিল। শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আঠাশ নম্বর ঘরের দিকে চেয়ে চলে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে চেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আঠাশ নম্বর ঘরে টোকা মারলাম।

কে?

রুম সার্ভিস।

দরজায় চাবি ঘোরাতে শুনলাম, কপাটে খুব জোরে চাপ দিলাম সশব্দে দরজা খুলে গেল। টার্নার বা এড যেই হোক টাল খেয়ে ভিতরে সরে গেল। আমি ভিতরে ঢুকলাম।

ষাট বছরেও তার ক্ষমতা অসাধারণ। সঙ্গে সঙ্গে সে পাক খেয়ে বিছানার উপর রাখা কোল্ট ৪৫ পিস্তলটা নিতে ছুটল।

আমি ছুটে গিয়ে বিছানায় তাকে চেপে ধরলাম। তার হাত পিস্তলের ওপর। আমার হাত তার ওপর, কিছুক্ষণ দুজনে বল প্রয়োগ করলাম।

তার মুঠো থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিলাম। সে যখন উঠে বসল একেবারে পিস্তলের মুখে। তার অভিজ্ঞতা যেন আরও বেশি।

বললাম, বিশ্রাম নাও। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সে গম্ভীর ও কাঁপা গলায় বলল, তুমি কে?

আমি কে জানার কোন প্রয়োজন নেই। দরজার বাইরে মদ আছে। যদি নিয়ে আসদুজনে খেয়ে গল্প করা যাবে।

তার প্রয়োজনের তাগিদে সে বিছানা থেকে একরকম ছুটে গিয়ে ট্রেটা এমনভাবে নিয়ে এল যেন তার জীবন এর উপর নির্ভর করছে।

সে যখন গ্লাসে স্কচ ঢালছিল আমি দরজায় চাবি লাগিয়ে দিলাম।

 সে এক চুমুকে স্কচটা শেষ করে আবার পানীয় তৈরি করতে লাগল।

 আস্তে বললাম, আমার কিন্তু বরফ দরকার।

সে গর্জন করে উঠল, তুমি কে? কি চাও?

গলার স্বর দৃঢ় করে বললাম, আমি প্রশ্ন করব এবং তুমি উত্তর দেবে। যখন ডলোরেসকে ঐ অবস্থায় দেখলে তখন কেন পুলিশকে খবর দিলে না।

রক্তশূন্য মুখে সে বলল, ওর কি হয়েছিল তুমি জান?

জানি। তোমাকে ভিতরে ঢুকতে ও বেরিয়ে আসতে দেখেছি। পুলিশকে কেন খবর দাও নি?

তাতে কি লাভ হত?

তোমার নাম কি?

টার্নার। জন টার্নার।

ঠিক আছে তুমি যদি এরকমই চাও বলে ভারী পিস্তলটা তুলে নিলাম। ডিটেকটিভ গল্পে ৪৫ বোরের পিস্তলের কথা শুনেছি কিন্তু এই প্রথম ব্যবহার করছি।

উঠে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াও। আমি পুলিশ ডাকছি।

সে কর্কশ স্বরে বলল, এক মিনিট। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি তাকে ঐ অবস্থায় দেখি। কেউ যেন তার মাথায় জোরে আঘাত করেছিল।

তোমার নাম কি?

এড নাটলে। আমি তার এজেন্ট ছিলাম।

 মনে পড়ল ডলোরেস কোন এক এজেন্টের কথা উল্লেখ করেছিল।

পুলিশকে কেন খবর দাওনি?

 মদের প্রভাবে তার নার্ভ শক্ত হয়ে উঠল, তাতে তোমার কি? সোজাসুজি বল তুমি কে? তুমি পুলিশের লোকনও। খবরের কাগজের লোক নও, প্রাইভেট ডিটেকটিভ হলে অবাক হব না, ঠিক করে বল তুমি কে?

দেখ, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে পুলিশ ডাকব।

সে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে বলল, আমি পুলিশ ডাকতে যাচ্ছিলাম।

 ঠিক আছে, এখন তবে ডাক। ভাবলাম সে হয়তো টেলিফোনের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু সে একটা দোমড়ানো মোড়ানো সিগারেটের বাক্স এনে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল।

আমি তোমাকে চিনি। ধস্তাধস্তিতে হেরে যাবার আগেই তোমাকে চেনা উচিত ছিল। তুমিই তার রেলের ভাড়ার টাকা জুগিয়েছিলে না?

৪৫ পিস্তলটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে তার কাছে এসে একটা গ্লাস তুলে এক টোক খেলাম। মদটা হাতে করেই চেয়ারে বসলাম।

যদি সেই লোকই হই তাতে কি হয়েছে?

আচ্ছা তাহলে তুমি তাকে টাকা দিয়েছিলে?

তুমি আসল কথা এড়িয়ে যাচ্ছ। আমি জানতে চাই, যখন তুমি দেখলে যে তাকে খুন করা হয়েছে। তখন পুলিশ ডাকলে না কেন? তুমি আমাকে সব কিছু খুলে বল, নইলে আমি থানায় গিয়ে সব বলে দেব।

সে ইতস্ততঃ করে বলল, আমি কোন ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে চাই না। তারা হয়ত ভাববে আমিই ওকে খুন করেছি। এই নয় যে আমি তাকে আগে সাবধান করে দিইনি…। সে থেমে মুখ বাঁকাল, আমি কোন কিছুতেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে চাই না।

কিসের জন্যে তাকে সাবধান করেছিলে?

গ্লাসের সবটুকু এক চুমুকে খেয়ে আরও হুইস্কি ঢেলে বলল, জানি না কেন তোমার সঙ্গে কথা বলছি। হয়ত আমি মাতাল তবুও তুমি যদি জানতে চাও তবে বলছি। ঐ পুলিশের লোকটাকে বিয়ে করার জন্য সে পাগল হয়ে উঠেছিল।

 কেন তাকে এই জন্যে সাবধান করেছিলে?

হুইস্কি গিলে নিয়ে আমার দিকে ঘোলাটে চোখে চেয়ে বলল, কারণ লোকটা ভাল ছিল না। ভোলোরেস সে কথা মানতে চায় না। তার নোংরা হাতে গ্লাসটা ঘোরাতে সে গর্জন করে উঠল, আমি যাই বলি সে শুনতে চায় না। আমি যখন বলতাম সে নোংরা ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। ও’ব্রায়ান যে বিলাসে দিন কাটাত সে ভাবে পুলিশের পক্ষে জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়, যদি না সে দুর্নীতিপরায়ণ হয়। ডলোরেস কথা শুনতোনা। ভাবতো বিয়ে করলে বিনোদিনীর জীবন যাপনের আর দরকার হবে না। আর একটু খেয়ে নিল। তারপর বলল, এর পরিণতি হল মাথা ভেঙ্গে মৃত্যু।

ও’ব্রায়ানের দুর্নীতি? চেয়ারের ধারে এসে জিজ্ঞাসা করলাম।

 সে ধূর্তের মত চাইল।

জানি না।

ডলোরেস চলে যেতে চাইছিল?

কারণ কোন আকর্ষণ ছিল না। তার শখ ছিল মেক্সিকো দেখার।

সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। কারণটা কি?

একটু হুইস্কি খেল।

 তুমি কি টাকা দিয়েছিলে?

টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু যে তাকে হত্যা করেছে সে টাকা নিয়ে পালিয়েছে, বললাম।

মনে হচ্ছে মাতাল হয়ে পড়েছি। আমাকে ভাবতে দাও। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, এর অর্থ হচ্ছে সে মৃত, তুমি আগেই জানতে। পাঁচশো ডলারের জন্য সে তোমাকে গেঁথেছিল, এই মাত্র বললে যে তুমি টাকা দিয়েছিলে। আমি এখন আধ-মাতাল, তাহলেও আমি বোকা নই। এমনও হতে পারে যে তুমি তাকে হত্যা করেছিলে। হ্যাঁ..হতে পারে। মনে হয় পুলিশের কাছে খবরটা দেওয়া বৃথা হবে না। আমার চেয়ে তোমার ব্যাপারেই কৌতূহল বেশি হবে। তাকে হত্যা করার আমার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তোমার ছিল।

আমি তাকে হত্যা করিনি, বললাম চোখের দিকে চেয়ে, এবং আমার ধারণা তুমি তাকে হত্যা কর নি। যদি তুমি মনস্থির করে থাক তবে দুজনেই থানায় যাওয়া যাক, পুলিশই ঠিক করবে কে দোষী।

ঠিক আছে, আমি বিশ্বাস করি, সে বলল। মেয়েটা মারা গিয়েছে। কোনমতেই তার জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যেই মরুক না কেন আমার কিছু এসে যায় না। অতীতে বহুব্বার পুলিশের ঝামেলায় পড়েছি। তবে এসব ঝামেলা থেকে সরে দাঁড়ানই বুদ্ধিমানের কাজ। যদি তুমি আমাকে একটু ঘুমোতে দাও ভাল হয়। সকালের ট্রেন ধরতে হবে, শরীরটা খারাপ লাগছে।

একটু পরেই ঘুমাও তুমি কি রসকে চেন? জিজ্ঞাসা করলাম।

আমি কাউকে চিনি না, আমার কথা শোন, যদি বাঁচতে চাও তবে এই শহরের কাউকে চিনতে চাইবে না। এবার কি ঘুমাতে দেবে?

তুমি কি মনে কর রস তাকে হত্যা করেছে?

 বস? রসিকতা করছ? একটা মাছি মারার মত সাহস তার নেই।

 তাহলে কি আর্ট গ্যালগানো তাকে হত্যা করেছে?

মৌচাকে যেন ঢিল পড়ল। একটু চুপ করে ফিস ফিস করে বলল, আমি জানি না কে হত্যা করেছে। এখন বিদায় হও!

মনে হলো বিশেষ কিছু আদায় করা যাবে না। মনে মনে ভাবলাম সকালে একবার চেষ্টা করা যাবে।

যাওয়ার আগে দেখা করব, যেতে যেতে বললাম। সব কিছু জানা হল না, কি বল?

আরে ভুলে যাও, এই নোংরা শহর সম্বন্ধে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার বেরোতে পারলেই বাঁচি।

তাকে দেখছিলাম, মোটেই সুন্দর দেখাচ্ছিল না।

স্বল্প আলোকিত প্যাসেজে বেরিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলাম। নোংরা দুর্গন্ধে ভরা হোটেলে। বাকী রাতটুকু কাটাবার ইচ্ছা ছিল না, এখান থেকে বাংলো এই দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে যাবার মত অবস্থা আমার ছিল না।

ঊনত্রিশ নম্বর ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিয়ে ভাবলাম শরীরের বিশ্রাম দরকার।

সারাদিনের ঘটনাগুলো চিন্তা করছিলাম। নাটলের কাছে যেটুকু জানা গেল বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এতই ক্লান্ত যে দু-এক মিনিটের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।

প্রচণ্ড গুলির আওয়াজে জেগে উঠলাম। সোজা হয়ে বসলাম, হৃৎপিণ্ডটা জোরে কাঁপছিল। অন্ধকারে চেয়ে রইলাম। একটু বাদেই প্যাসেজে মৃদু কিন্তু দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে আলো না জ্বেলেই দরজা খুলে প্যাসেজে উঁকি দিলাম।

নাটলের ঘর থেকে পোড়া বারুদের গন্ধ ভেসে আসছিল। তার ঘরের দরজা আধ ভেজানো। আলো জ্বলছে।

দরজার কাছে গিয়ে ভিতরে দেখলাম।

ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। তার পরনে নোংরা পাজামা। পা দুটো খালি। জামার বুক পকেটের নিচে দলা দলা রক্ত।

এখন আর তার জন্য কেউ কিছুই করতে পারবে না।

সে এখন অন্য জগতে।

নিচে কোন মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেলাম।

আমার নিজেরও তখন ভয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা হচ্ছিল।