১০. ঝড়ের কবলে বোম্বেটেরা

১০. ঝড়ের কবলে বোম্বেটেরা

কী ভীষণ ঝড়তুফান আর কী তার ক্রুদ্ধ উচ্ছ্বাস! আরো দিনকতক মিছেমিছি দেরি হ’য়ে যেতে চলেছে তাহ’লে! রকম দেখে মনে হয় এই ঝড় বুঝি এ-মাসের শেষ অব্দি এমনি ফুঁসেই চলবে! তবে ঝড় থাকুক বা না-থাকুক, মাসকাবারের সঙ্গে-সঙ্গেই সের্‌সান্তেকে যেমন ক’রে হোক সমুদ্রে পাড়ি দিতেই হবে। যা-ই হোক, একটা জাহাজ যখন স্টটেন আইল্যাণ্ডের তীরে এসে আছড়ে পড়লো তখন একবার সরেজমিন তদন্ত ক’রেই দেখা যাক কোনো মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যায় কি না—মনে-মনে ভাবলে কন্‌গ্রে।

আগের দিন যখন সূর্য ধীরে-ধীরে দিগন্তের নিচে ডুবে যাচ্ছিলো, তখন লণ্ঠনঘর থেকে বারদরিয়ায় একটি জাহাজকে ঝড়ের পাল্লায় প’ড়ে নাকানিচোবানি খেতে দেখেছিলো সের্‌সান্তে। তক্ষুনি সে কন্‌গ্রেকে ডেকে এনে দেখিয়েছিলো। যতক্ষণ-না অন্ধকার জমাট বেঁধে নিরেট হ’য়ে গেলো, ততক্ষণ জাহাজটির দিকে তাকিয়ে থেকে দুজনেই বুঝতে পেরেছিলো যে সান হুয়ান অন্তরীপ আর পয়েন্ট সেভারেলের মাঝখানে কোথাও সেটার সলিল সমাধি জুটবে। বাতিঘরের লণ্ঠনের আলো জ্বেলে তারা জাহাজটাকে রক্ষা করতে পারতো অবশ্য, কিন্তু তা ক’রে তাদের কী লাভ? বরং জাহাজটা তীরে আছড়ে প’ড়ে চুরমার হয়ে গেলে কিছু দামি জিনিশপত্তর হাতিয়ে নেবার মওকা এসে যাবে।

কন্‌গ্রে আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা একটা নৌকোয় ক’রে ভাঙা জাহাজটার খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। অকুস্থলে গিয়ে পৌঁছুতে তাদের খুব-একটা দেরি হ’লো না। তাদের চ্যাঁচামেচি আর হুল্লোড়ে বাস্‌কেথ আর জন ডেভিসের আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটে গেলো। বাস্‌কেথ খুব সাবধানে গুহার মুখে এসে দাঁড়ালে। জন ডেভিসও পায়ে-পায়ে তাকে অনুসরণ করে এলো। দুজনে মস্ত-একটা পাথরের আড়াল থেকে সাবধানে বোম্বেটেদের পানে তাকালো।

জলদস্যুরা তখন বাকেথের ছোট্ট গুহাটা থেকে দুশো গজও দূরে নেই। আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে সহজেই তাদের দেখা যাচ্ছিলো। বোম্বেটেদের মধ্যে বাস্‌কেথ যাকে-যাকে চিনতো, জন ডেভিসকে তাদের পরিচয় দিতে লাগলো—’হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ-যে-লোকটা জাহাজের ভাঙা মাস্তলটার পাশে দাঁড়িয়ে—তার নাম হ’লো কন্‌গ্রে। যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, সে-ই হ’লো এদের সর্দার।’

–’আর যার সঙ্গে তার এত দহরম-মহরম? ঐ যে, যার সঙ্গে ও কথা বলছে?

—’ও সের্‌সান্তে, কন্‌গ্রের ডানহাত। আমি লণ্ঠনঘর থেকে স্পষ্ট দেখেছি, ঐ বদমায়েশটাই ফিলিপ আর মরিসকে খুন করেছে।’

দাঁতে দাঁত চেপে জন ডেভিস বললে, ‘একবার যদি এই খুনেগুলোকে হাতের কাছে পাই—’

প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেলো। বোম্বেটেরা তন্নতন্ন ক’রে সেনচুরির মালপত্তর খুঁজেছে। যে-সব জিনিশ কন্‌গ্রে দরকারি ব’লে মনে করলে, সব সে নৌকোয় তুলতে হুকুম করলে।

ডেভিস ক্রুদ্ধ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে বললে, শয়তানগুলো যদি সোনারুপো বা ঐ-রকম কোনো দামি জিনিশের খোঁজ করে, তবে অষ্টরম্ভা পাবে।’

সঙ্গে-সঙ্গে বাকেথের টিপ্পনী : ‘তা-ই বোধহয় এরা চায়। ঐ অষ্টরম্ভা।’ ডেভিস বললে, ‘এদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এরা কোনো নিরাপদ এলাকায় কেটে পড়তে চাচ্ছে। তবে সে-সুযোগ এদের কপালে আছে কি না তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।’

-’যদি আবহাওয়া অন্তত আর-কয়েকটা দিন খারাপ থাকে—’

-‘কিংবা আমরা যদি কোনো উপায় খুঁজে পাই…’ জন ডেভিস তার কথাটা আর শেষ করলে না।

কিন্তু উপায়টা কী? কী ক’রে সান্তা ফে ফিরে না-আসা অব্দি বোম্বেটেদের এ-দ্বীপে আটকে রাখা যাবে?

জলদস্যুরা তখন ভাঙা জাহাজটাকে ঘুরে-ঘুরে দেখছে। প্রায় ঘণ্টা দুই ধ’রে খোঁজাখুঁজি চললো। তারপর সের্‌সান্তে তার আরেক শাগরেদকে নিয়ে কুড়ুল হাতে এসে হাজির : জাহাজটাকে তারা আরো ভেঙেচুরে ফেলতে শুরু করলে।

–’কী ব্যাপার?’ অবাক হ’য়ে বাস্‌কেথ বললে, ‘এমনিতেই কি জাহাজটা চুরমার হ’য়ে যায়নি? একে তো আর কোনোদিনই সারানো যেতো না। তবে মিছেমিছি এটাকে আরো ভেঙে ফেলে কী লাভ? ‘

—’আমি বুঝতে পেরেছি ওরা কী করতে চাচ্ছে,’ ডেভিস বললে, ‘সেনচুরি নামে কোনো জাহাজ যে কোনোদিন অ্যাটলান্টিকে পাড়ি দিয়েছিলো, তার কোনো চিহ্নই ওরা রাখতে চায় না। চিহ্ন-টিহ্ন সব বেমালুম লোপাট ক’রে দিতে চাচ্ছে।

জন ডেভিস ঠিকই ধরেছিলো। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সের্‌সান্তে কাপ্তেনের কামরা থেকে একটি মার্কিন জাতীয় পতাকা নিয়ে বাইরে এলো আর ছিঁড়ে হাজার টুকরো ক’রে উড়িয়ে দিলে সব তারা আর ডোরা।

—’বদমায়েশ!’ প্রায় চেঁচিয়েই উঠছিলো জন ডেভিস। শয়তানটা আমার জাতীয় পতাকাকে ছিঁড়ে ফেলেছে।’

রেগে, সে প্রায় ছুটেই যায় বুঝি যেদিকে। বাস্‌কেথ কোনোরকমে ধ’রে বেঁধে তুইয়েবুইয়ে তাকে থামালে। ডেভিস গোড়ায় বেজায় চ’টে গিয়েছিলো, তবে একটু ভেবে নিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ তুমি ঠিকই করেছো। হুট ক’রে আবেগের বশে কিছু করা যাবে না। কিন্তু বদমায়েশগুলোকে সজুত করতে না-পারলে আমার আশা মিটবে না। এদের কুকুরের মতো গুলি ক’রে মারবার জন্যে আমার হাত দুটো নিশপিশ করছে!

বাস্‌কেথ চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললে, ‘এ-তুফান খুব শিগগির থামবে ব’লে মনে হচ্ছে না। আর যদিও-বা হাওয়ার বেগ একটু ক’মেও যায়, সমুদ্র কিন্তু আরো কয়েকদিন এমনি রাগে ফুঁসতে থাকবে। কাজেই এরা যে দিন কয়েকের মধ্যে রওনা হ’তে পারবে না, সে আমি বাজি ধরে বলতে পারি।’

——তোমার আন্দাজটাই ঠিক। তবে তুমিই তো বলেছো, সামনের মাসের গোড়ার দিকে ছাড়া সান্তা-ফের এখানে পৌঁছুবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ‘

–’সে-যে আরো আগে আসবে না, তা কে বলতে পারে।’

–’জিশুর দোহাই, তা-ই যেন হয়।’

–’আমার তো মনে হয় তা-ই হবে। সান্তা-ফে নির্ধারিত তারিখের আগেই এসে পৌঁছুবে। প্রথমবার চালু হবার পর বাতিঘর কেমন কাজকর্ম করেছে, সে-সম্বন্ধে একটা কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। তাছাড়া, কোনো জাহাজ‍ই ফিরে গিয়ে এটা নিশ্চয়ই বলবে না যে তারা বারদরিয়া থেকে বাতিঘরের আলো দেখেছে। কাজেই বাতিঘর আলো জ্বালায়নি কেন, সে-কথা জানতেই হয়তো সান্তা-ফে আগেই এসে পৌঁছুবে।’

ঝড় যে শিগগিরি থামবে না, সেটা আকাশবাতাসের দশা থেকে আন্দাজ করা যায়। কিন্তু চার-পাঁচদিনের তুলকালাম ঝড়ের পর ঝড়তুফানের চোট হয়তো কিছুটা ক’মেই যাবে। তুফান একটু কমলেই বোম্বেটেরা হয়তো সে-সুযোগ আর হেলায় হারাতে দেবে না। চারটের সময় কন্‌গ্রে তার দলবল সমেত নৌকা-বোঝাই মাল নিয়ে বাতিঘরের দিকে ফিরে গেলো। সন্ধ্যার সময় ঝড় আরো-ভয়ংকর হ’য়ে উঠলো। এবারে কিছু-কিছু বৃষ্টিও শুরু হ’য়ে গেলো।

বাস্‌কেথ আর জন ডেভিস বৃষ্টির জন্যে গুহা থেকে বেরুতে পারেনি। বৃষ্টির সঙ্গে তাল রেখে কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছিলো। গুহার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে হাত-পা সেঁকেছিলো তারা। গুহার একেবারে শেষ কোনায় আগুন জ্বালানো হয়েছিলো ব’লে তার আলো বাইরে যাবার সম্ভাবনা ছিলো না। সুতরাং তাদের ভয় করবার কিছুই ছিলো না। রাতটা আরো ভয়ানক হ’য়ে উঠেছিলো। সমুদ্র খ্যাপার মতো তীরে আছড়ে পড়ছে, অনেক দূর অব্দি ঢেউ এসে পড়ছে ডাঙায়। সমুদ্র যতই ভয়ংকর হোক না কেন এখানে, সচরাচর এতটা ভয়ংকর রূপ কিন্তু ধরে না।

ডেভিস ক্ষুব্ধ স্বরে বললে—’ঈশ্বর করুন, এই ঝড়ে বোম্বেটেদের জাহাজ যেন চুরমার হ’য়ে যায়।’

সারা রাত ধ’রে অশান্ত সমুদ্রে পাগলা ঝড়ের মাতন চললো। সমুদ্র যেন দুরন্ত আক্রোশে গর্জে উঠছে। আর ঢেউগুলো সেনচুরির ভাঙা টুকরোগুলোকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো কে জানে। পরদিনও সমুদ্র এমনি ভয়ংকর রইলো। ভাগ্যিশ বাকেথের খাবারদাবার কম ছিলো না, তাই রক্ষা। সেনচুরি থেকে জোগাড় করা খাবারদাবারে দু-মাস তাদের হেসে খেলেই কেটে যাবে। তার মধ্যেই সান্তা ফে এসে স্টটেন আইল্যাণ্ডে এসে নোঙর ফেলবে।

‘ঈশ্বর করুন ঝড় যেন একই সঙ্গে দু-রকম হয়, হঠাৎ ঝড়ের জন্যে বোম্বেটেরা যাতে রওনা হ’তে না-পারে, আবার ঝড় যেন এমন ভীষণ না-হয় যাতে সান্তা-ফে তীরে ভিড়তে না-পারে।’ বাস্‌কেথ তার অদ্ভুত তত্ত্ব শোনালে। ডেভিস উত্তর দিলে—’বাতাস যদি আমার কথা শুনতো, তাহ’লে অবশ্য অনায়াসেই তা করা যেতো।’

—দুর্ভাগ্যবশত ঈশ্বর ছাড়া এই অলৌকিক কাণ্ড আর কে করবে?’

—’পাপের শাস্তি ঈশ্বরই দেবেন,’ ডেভিস তার বিশ্বাস জানালে।

দুজনেরই মনের মধ্যে সারাক্ষণ প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছিলো।

একুশে আর বাইশে ফেব্রুয়ারিও আবহাওয়া একই রকম ভয়ংকর রইলো।

আকাশে আগের মতই কালো-কালো মেঘের গুরু-গুরু আওয়াজ, আগের মতোই দুরন্ত সমুদ্রে ঢেউ উত্তাল হ’য়ে আছে। হাওয়া যেন তীব্র ক্রোধে রী-রী করছে, হাওয়ার সঙ্গে তাল রেখেই চলেছে মেঘের দাপাদাপি, সমুদ্র উথালপাথাল হ’য়ে আছে।

তেইশে ফেব্রুয়ারি অবশ্য সামান্য উন্নতি দেখা গেলো। তবে সত্যি-বলতে তাকে ঠিক উন্নতি বলা চলে না। সমুদ্র আগের মতোই ফুঁসছে, আকাশকে ঘিরে আছে যেন নিরেট কালো মেঘ, হাওয়া তেমনি খেপে আছে। শুধু বৃষ্টিটা থেমেছে।

এই তিন দিন এক সেকেণ্ডের জন্যেও ডেভিস আর বাস্‌কেথ গুহা থেকে বেরুতে পারেনি। তেইশে ফেব্রুয়ারি বৃষ্টি পড়ছে না দেখে তারা সত্যি-সত্যি কী হচ্ছে সরেজমিন তদন্ত করে দেখবার জন্যে গুহা থেকে বেরুলো। কিছু দূর এসে ডেভিস হঠাৎ মাটিতে গেঁথে-থাকা কী-একটা জিনিশে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। উঠে তাকিয়ে দ্যাখে, ধাতু নির্মিত একটা বাক্স, তার গায়ে সেনচুরির নাম খোদাই করা। বাক্সটা গোলা-বারুদে বোঝাই।

ডেভিস যেন লাফিয়ে উঠলো—’এগুলোকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। একবার যদি বোম্বেটেদের জাহাজে এ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়—’

-’একটা-কিছু উপায় ভেবে বার করতেই হবে।’ বাস্‌কেথ বললে—’ফেরবার পথে এটাকে ব’য়ে নিয়ে যেতে হবে গুহায়।’

তারা তীর ধরেই এগুচ্ছিলো। বেশ কিছুদূর এগিয়ে তারা যখন ফেরবার উপক্রম করছে, তখন হঠাৎ বাস্‌কেথ চেঁচিয়ে উঠলো—’ওটা কী? ‘

দূরে কালো-মতো কী-একটা দেখা যাচ্ছিলো। দুজনে তার দিকে ছুটে গেলো। একটা কামান! তার গায়েও সেনচুরির নাম খোদাই করা।

——’এ-যে তোমার সম্পত্তি, ডেভিস!’

——’হ্যাঁ, এই কামান ছুঁড়েই আমরা সংকেত করতুম। কিন্তু এখন এটা আমাদের কী কাজে লাগবে?’

——’তা কী জানি! তবে কিছু গোলাবারুদও যখন পাওয়া গেছে, কামানটিকে হয়তো তখন কাজে লাগাবার সুযোগও একটা জুটে যাবে!’

——’আমার কিন্তু তা মনে হয় না।’

-–’কেন? আর-কিছু না-হোক কামান ছুঁড়ে রাত্তিরে কোনো বিপন্ন জাহাজকে তো হুঁশিয়ার ক’রে দিতে পারবো।’

ডেভিসের মনে কিন্তু অন্যরকম একটা ভাবনা খেলে যাচ্ছিলো তখন। সে শুধু জিগেস করলে–’এই কি তোমার ইচ্ছে?’

——হ্যাঁ, ডেভিস। এবং সেটা কোনো খারাপ প্রস্তাবও নয়। অবশ্য কামানের আওয়াজে বোম্বেটেরা আমাদের খোঁজ করতে শুরু করবে-আর তাতে তাদের হাতে আমাদের মৃত্যুও হ’তে পারে। কিন্তু তাই ব’লে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করবো না?’

—’আমার মনে হয় দায়িত্ব পালনের আরো-একটি পন্থা আছে।’ ডেভিস এ-কথা বললে বটে, কিন্তু পন্থাটা কি সে-কথা সে খুলে বললে না।

আর-কোনো কথা না-বলে দুজনে মিলে কামানটা গুহার দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলো। কঠিন কাজ, কিন্তু নাছোড় লেগে থেকে এই ঠাণ্ডাতেও ঘেমে নেয়ে গিয়ে তারা কিন্তু শেষ অব্দি কাজটা করতে পারলে। কামানটা নিয়ে যাবার পর গোলাবারুদের বাক্সটাও তারা গুহায় নিয়ে গেলো। এ নিয়ে বলা সহজ, মনে হয় চট করেই বুঝি হ’য়ে গেছে, কিন্তু আসলে অনেকক্ষণ ধ’রে গলদঘর্ম হ’তে হয়েছিলো তাদের। একটু বিশ্রাম ক’রে তারা যখন খেতে বসলো, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

তারা খেতে বসেছে-কি-বসেনি, সের্‌সান্তে আর ভার্গাস আবহাওয়ার অবস্থা দেখবার জন্যে সেখানকার টিলাটায় এসে হাজির। আকাশ আর সমুদ্রের দিকে ভালো ক’রে তাকিয়ে তারা বুঝতে পারলো যে বৃষ্টি ধরে এলেও জাহাজের নোঙর তোলা এখনও খুব বিপজ্জনকই আছে। আধঘণ্টাটাক পরে তারা ফিরে পেলো।

–’হুম, শ্রীমানেরা ফিরে গেছেন!’ বাস্‌কেথ বললে—’দিন কয়েক বাদে ফের যদি তারা আবহাওয়ার হালচাল জানতে এখানে আসে, আমি তবে তাদের স্বয়ং রাজা সলোমনের রত্নখনিটাই দান ক’রে ফেলবো।’

ডেভিস কিন্তু শুধু তার মাথা ঝাঁকালে। তার কেবলই মনে হচ্ছিলো, দিন দু-একের মধ্যেই ঝড় থেমে যাবে। সমুদ্র যদি পুরোপুরি শান্তও না-হয়, অন্তত পাড়ি জমাবার মতো অবস্থা হ’য়ে উঠবে তখন

সন্ধের পর গুহায় ফিরে কিছু বিস্কুট চিবিয়েই কোনোরকমে তারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করলে। তার পরই বাস্‌কেথ শোবার উদ্‌যোগ করতে লাগলো।

হঠাৎ ডেভিস বললে—’শোবার আগে আমার একটা প্রস্তাব শোনো।’

–‘কী?‘

——তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছো। সুতরাং তুমি যা অনুমোদন করবে না তা আমি কখনও করবো না। আমার মাথায় একটা ফন্দি এসেছে। সব শুনে বিবেচনা করে দেখে তারপরই তোমার মত দিয়ো। তবে এ-কথা ভেবো না তোমার মত না-পেলে আমি ক্ষুণ্ণ হবো।’

—’ভনিতা বাদ দাও, ডেভিস। কী বলতে চাও, স্পষ্ট ক’রে বলো।’

—’আবহাওয়া তো শিগগিরই বদলে যাবে। ঝড় থামবে, সমুদ্রও শান্ত হ’য়ে উঠবে। আমার তো মনে হয় দু-তিন দিনের মধ্যেই বোম্বেটেরা নোঙর তুলবে।’

ক্ষুব্ধ স্বরে বাস্‌কেথ বললে,—’সন্ধেবেলায় আকাশ দেখে তো তা-ই মনে হ’লো। কিন্তু আমরা যে নিরুপায়

ডেভিস বললে—দু-তিন দিনের মধ্যেই স্কুনারটা গিয়ে বারদরিয়ায় পড়বে তারপর যত জোরে পারে জাহাজ চালিয়ে পশ্চিমে উধাও হ’য়ে যাবে। আর কখনোই তার কোনো চিহ্নই দেখা যাবে না। তোমার সঙ্গীসাথীদের, আমার সঙ্গীসাথীদের মৃত্যুর কোনো বদলাই নেয়া যাবে না—সেনচুরির এই দুর্দশারও প্রতিশোধ নেয়া যাবে না।’

ডেভিস আরো বললে—’শুধু-একটা পথই খোলা আছে আমাদের সামনে। দ্বীপ থেকে বোম্বেটেরা যাতে কেটে পড়তে না পারে, তাদের যাত্রায় আমরা যদি বাধা দিতে চাই, তাহ’লে তার একমাত্র উপায় হলো তাদের স্কুনারটাকে কোনোরকমে ভেঙে-চুরে দেয়া। তা সম্ভব না-হ’লে নিদেনপক্ষে এমন-কোনো ক্ষতি করা যাতে তাদের যাত্রা বিঘ্নিত হয়, সান্তা ফে আসা অব্দি তাদের দ্বীপে আটকে থাকতে হয়।’ একটু থেমে দম নিয়ে সে আবার বললে— ‘আমাদের কামান আছে, গোলাবারুদ আছে। এই কামান আর গোলাবারুদ কি বৃথা যাবে? কোনো কাজেই লাগবে না? যে ক’রেই হোক কামানটাকে ঐ টিলার ওপর নিয়ে গিয়ে গোলা ভ’রে রাখতে হবে। তারপর যখন—’ বলতে-বলতে ডেভিস রীতিমতো উত্তেজিত হ’য়ে উঠলো—তারপর যখন বোম্বেটেদের জাহাজ টিলার কাছ দিয়ে যাবে, সেটাকে তাগ ক’রে গোলা ছুঁড়বো। হয়তো তাতে জাহাজটা পুরোপুরি ধ্বংস হবে না’, কিন্তু লম্বা পথ পাড়ি দেবার মতো অবস্থাও তার থাকবে না। আবার সেটাকে মেরামত করতে না-পারলে তারা সাগরপাড়ি দিতে পারবে না। আবার তাকে এই দ্বীপেই নোঙর ফেলতে হবে, মালপত্র নামিয়ে নিতে হবে, তারপর মেরামতের কাজে হাত দিতে হবে। কম ক’রেও তাতে দুটো হপ্তা লেগে যাবে। আর সেই ফাঁকে সান্তা ফে এসে পৌঁছুবে, তারপর…’

ডেভিস থেমে গেলো। বাস্‌কেথ তার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে চাপ দিলে। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন স্বরে বললে——যে-ক’রেই হোক, আমাদের এ-কাজ করতেই হবে।’

বাইরে তখন হাওয়া শোঁ-শোঁ ক’রে গরজাচ্ছে। আর সমুদ্রের মত্ত ঢেউগুলো প্রচণ্ড জোরে তীরে আছড়ে পড়ছে।