জ্ঞানলাভের সোপানশ্রেণী
আমেরিকায় বেদান্ত-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা।
জ্ঞনমার্গের সাধকের সর্বপ্রথম আবশ্যক—শম ও দম। এই দুইটির ব্যাখ্যা একসঙ্গেই করা যাইতে পারে। ইহাদের অর্থ ইন্দ্রিয়গুলিকে বহির্মুখী হইতে না দিয়া স্ব স্ব কেন্দ্রে সংস্থাপিত করা। আমি প্রথম তোমাদের বলিব ‘ইন্দ্রিয়’ শব্দের অর্থ কি। ধর, চোখগুলি রহিয়াছে; এই চোখগুলি দর্শনেন্দ্রিয় নয়, ইহারা দর্শনক্রিয়ার যন্ত্রমাত্র। যখন দর্শনেন্দ্রিয় না থাকে , তখন চক্ষু থাকিলেও দেখিতে পারি না। কিন্তু দর্শনেন্দ্রিয় রহিয়াছে, দর্শণের যন্ত্র চক্ষুও রহিয়াছে, কিন্তু যতক্ষণ মন এই দুইটির সহিত সংযুক্ত না হইবে, ততক্ষণ দর্শনক্রিয়া হয় না। সুতরাং প্রত্যেক প্রত্যক্ষব্যাপারে তিনটি বস্তু আবশ্যক—প্রথমতঃ বাহ্য করণাবলী, তারপর অন্তরিন্দ্রিয়সমূহ এবং সর্বশেষে মন। ইহাদের যে-কোন একটি না থাকিলে কোন প্রকার প্রত্যক্ষ্য হইবে না। সুতরাং দেখা যাইতেছে মন, বাহ্য ও আভ্যন্তর দুইটি করণ-সহায়ে কাজ করে। যখন আমি কোন কিছু দেখি, আমার মন বাহির হইয়া যায় এবং বাহ্য বস্তুর আকার ধারণ করে। কিন্তু মনে কর আমি চোখ বুজিয়া ভাবিতে আরম্ভ করিলাম; মন তখন বাহিরে যায় না; ইহা ভিতরেই সক্রিয় থাকে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয়-গুলি সক্রিয় থাকে। যখন আমি তোমাদের দিকে তাকাই এবং তোমাদের সঙ্গে কথা বলি, তখন ইন্দ্রিয় ও উহাদের যন্ত্রসমূহ উভয়ই কার্যরত থাকে। যখন আমি চোখ বুজিয়া ভাবিতে আরম্ভ করি, তখন ইন্দ্রিয়গুলি সক্রিয় থাকে, কিন্তু ইহাদের যন্ত্রগুলি সক্রিয় থাকে না। এই ইন্দ্রিয়গুলির ক্রিয়া ব্যতীত কোন চিন্তা বা মনন-ক্রিয়া হয় না। তোমরা লক্ষ্য করিবে, তোমাদের কেহই কোন প্রতীকের সাহায্য ছাড়া চিন্তা করিতে পার না। অন্ধলোককেও কোন একটি আকারের মাধ্যমে চিন্তা করিতে হয়। দর্শনেন্দ্রিয় ও শ্রবেণেন্দ্রিয় সাধারণতঃ অত্যন্ত সক্রিয়। তোমাদের অবশ্য মনে রাখিতে হইবে যে, ‘ইন্দ্রিয়’ শব্দের অর্থ মস্তিষ্ক-স্থিত স্নায়ুকেন্দ্র। চক্ষু ও কর্ণ দর্শন ও শ্রবণের যন্ত্রমাত্র; ইন্দ্রিয়গুলি রহিয়াছে ভিতরে। ইন্দ্রিয়গুলি যদি কোন কারণে নষ্ট হইয়া যায়, তাহা হইলে চক্ষুকর্ণ থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখিতে বা শুনিতে পাইব না। সুতরাং মনকে সংযত করিবার জন্য আমাদিগকে প্রথম এই ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করিতে হইবে। বাহ্য ও আন্তর বিষয়ে মনের গতি-রোধ করা এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে স্ব স্ব স্থানে স্থপন করা—ইহাই হইল শম ও দম শব্দের অর্থ। মন বা অন্তরিন্দ্রিয়-সংযম হইল শম এবং চক্ষুরাদি বহিরিন্দ্রিয়ের সংযম দম।
তারপর আবশ্যক—উপরতি। ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলি সম্বন্ধে চিন্তা না করা কে ‘উপরতি’ বলা হয়। ইন্দিয়ের বিষয় চিন্তা করিতে করিতেই আমাদের অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়—যাহা দেখিয়াছি, শুনিয়াছি, যাহা দেখিব বা শুনিব, যাহা খাইয়াছি, খাইতেছি বা খাইব, যে যে স্থানে বাস করিয়াছি ইত্যাদি বিষয়েই আমাদের চিন্তা। আমারা প্রায় সব সময়ই ইহাদের সম্বন্ধে চিন্তা করি অথবা কথা বলি। যিনি বেদান্তী হইতে ইচ্ছুক তাঁহাকে এই অভ্যাস অতি অবশ্যই পরিত্যাগ করিতে হইবে।
পরবর্তী সাধন হইল তিতিক্ষা দার্শনিক জীবন দুঃসাধ্য সাধন!—এই সাধনটি সর্বাধিক দুষ্কর। অন্যায়ের প্রতিরোধ না করা সহিষ্ণুতার চরম আদর্শ; তিতিক্ষা ইহা হইতে কোন অংশে ন্যূন নহে। বিষয়টি একটু পরিষ্কারভাবে বোঝানো দরকার। বাহ্যত অন্যায়ের প্রতিরোধ না করিতে পারি কিন্তু তজ্জন্য অন্তরে দুঃখবোধ হইতে পারে। আমরা অত্যন্ত বিষণ্ণ বোধ করিতে পারি। কোন ব্যক্তি আমার প্রতিঅত্যন্ত রূঢ় বাক্য প্রয়োগ করিতে পারে, তজ্জন্য বাহ্যতঃ তাহাকে ঘৃণা না করিতে পারি, তাহার কথার প্রত্যুত্তর না দিতে পারে এবং নিজেকে সংযত করিয়া আপাততঃ ক্রোধ প্রকাশ করিতে না পারি, তথাপি আমার অন্তরে ক্রোধ ও ঘৃণা থাকিতে পারে এবং আমি ঐ লোকটির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করিতে পারি। ইহা আদর্শ অপ্রতিরোধ নয়। এই আদর্শানুসারে আমার মনেও কোন ঘৃণা অথবা ক্রোধের ভাব থাকা উচিত নয়, এমন কি প্রতিরোধের চিন্তাও নয়; আমার মন এত স্থির ও শান্ত থাকিবে যেন কিছুই ঘটে নাই। যখনই আমি সেই অবস্থায় উপনীত হই, তখনই অপ্রতিরোধ-অবস্থা প্রাপ্ত হই; ইহার পূর্বে নয়। দুঃখ প্রতিরোধ করিবার অথবা দূর করিবার চিন্তামাত্র না করিয়া, মনের মধ্যে কোন প্রকার দুঃখময় অনুভূতি অথবা অনুশোচনা না রাখিয়া সর্ববিধ দুঃখের যে সহন—তাহাই তিতিক্ষা। মনে কর, অশুভের প্রতিরোধ করিলাম, ফলে গুরুতর অনিষ্টপাত হইল। আমার যদি তিতিক্ষা থাকে, তাহা হইলে অশুভ প্রতিরোধ না করার জন্য আমার অনুশোচনা বোধ করা উচিত নয়। সেই অবস্থায় উন্নীত হইলে বলা যায়, মন তিতিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হইল। ভারতবাসীরা এই তিতিক্ষা অভ্যাস করিবার জন্য অসাধারণ কর্ম করিয়া থাকেন। তাঁহারা কিছু গ্রাহ্য না করিয়া অত্যুগ্র শীত ও উষ্ণ সহ্য করেন; তাঁহারা তুষারও গ্রাহ্য করেন না, কেন না দেহ সম্বন্ধে তাঁহাদের কোনই চিন্তা থাকে না। দেহের ভাবনা দেহই করে, ইহা যেন একটি বাহিরের জিনিস।
অতঃপর যে সাধনের প্রয়োজন, তাহা শ্রদ্ধা। ধর্ম ও ঈশ্বরে প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকা দরকার। যতক্ষণ এই বিশ্বাস না হয়, ততক্ষণ কেহ জ্ঞানী হইবার উচ্চআশা পোষণ করিতে পারে না। একসময় একজন মহাপুরুষ আমাকে বলিয়াছিলেন যে, এই জগতে দুই কোটি লোকের মধ্যে একজনও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘মনে কর, এই ঘরে একটি চোর রহিয়াছে এবং সে জানিতে পারিল, পাশের ঘরে রাশীকৃত সোনা আছে; ঘর দুইটের মাঝে একটি খুব পাতলা পরদা রহিয়াছে। আচ্ছা, সেই চোরটির কি অবস্থা হইবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘চোরটি একেবারে ঘুমাইতে পারিবে না; তাহার মস্তিষ্ক সক্রিয়ভাবে সেই সোনা হস্তগত করিবার উপায় উদ্ভাবন করিতে থাকিবে এবং তাহার অন্য কোন চিন্তা থাকিবে না।’ তদুত্তরে তিনি বলেন,’তুমি কি বিশ্বাস কর, কোন মানুষ ঈশ্বরবিশ্বাসী হইয়া ঈশ্বরকে লাভ করিবার জন্য পাগল হইয়া যাইবে না? যদি কোন লোক আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, এক অসীম অনন্ত আনন্দের আকর রহিয়াছে এবং তাহা লাভ করা যায়, তাহা হইলে উহা লাভ করিবার চেষ্টায় সে কি পাগল হইবে না?’ ঈশ্বরে দৃঢ় বিশ্বাস এবং তাঁহাকে লাভ করিবার জন্য অনুরূপ আগ্রহকেই বলে ‘শ্রদ্ধা’।
তারপর সমাধান, অর্থাৎ মন ঈশ্বরে একাগ্র করিবার নিয়ত অভ্যাস। কো কিছুই এক দিনে সম্পন্ন হয় না। ধর্ম একটি বটিকার আকারে গিলিয়া ফেলা যায় না। ইহার জন্য প্রতিনিয়ত কঠোর অনুশীলনের দরকার। কেবল ধীর ও নিয়ত অভ্যাস দ্বারা মনকে জয় করা যায়।
তারপর মুকুক্ষুত্ব—মুক্তিলাভের তীব্র ইচ্ছা। তোমাদের মধ্যে যাহারা এড্উইন আর্নল্ডের ‘Light of Asia’ (এশিয়ার আলো) নামক গ্রন্থ পড়িয়াছ, বুদ্ধের প্রথম উপদেশের অনুবাদ নিশ্চয়ই তাহাদের মনে আছে। সেখানে বুদ্ধ বলিয়াছেন :
‘তোমরা নিজেদের জন্যই দুঃখভোগ করিয়া থাকো; অন্য কেহই তোমাদিগকে দুঃখ ভোগ করিতে বাধ্য করে না। তুমি জীবনধারণ কর, মৃত্যুমুখে পতিত হও, জীবন-মৃত্যুর চক্রে বিঘূর্ণিত হইয়া দুঃখের শলাকা, অশ্রুর বেষ্টনী এবং অসারতার মধ্যবিন্দুকে আলিঙ্গন কর—ইহাতে অন্য কেহই তোমাকে ধরিয়া রাখে না।’
আমাদের যাবতীয় দুঃখ আমরা নিজেরাই বাছিয়া লইয়াছি। ইহাই আমাদের প্রকৃতি। একজন বৃদ্ধ চৈনিক ষাট বৎসর কারারুদ্ধ ছিল; কোন নূতন সম্রাটের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে তাহাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারগার হইতে বাহির হইয়া সে চীৎকার করিয়া বলিল, ‘আমি আর বাঁচিতে পারিব না।’ তাহাকে আবার সেই বিভীষিকাপূর্ণ রুদ্ধ কারগৃহে যাইতে হইবে। সে আলোক সহ্য করিতে পারে নাই। সে রাজকর্মচারিগণকে বলিল, ‘তোমরা আমাকে মারিয়া ফেলো অথবা কারাগারে পাঠাইয়া দাও।’ তাহাকে কারাগারেই পাঠানো হইল। মানুষ মাত্রেরই ঠিক এইরূপ অবস্থা। আমরা উদ্দামগতিতে সর্বপ্রকার দুঃখের পিছনে ছুটি, দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করিতে আমরা অনিচ্ছুক। প্রতিদিন আমরা সুখের পশ্চাতে ধাবিত হই, নাগাল পাইবার পূর্বেই দেখি, উহা বিলীন হইয়া গিয়াছে, আঙুলের ফাঁক দিয়া গলিয়া পড়িয়া গিয়াছে। তবুও আমারা উন্মত্তভাবে সুখান্বেষণ হইতে বিরত হই না, বরং আগাইয়া চলি। এমন মোহান্ধ নির্বোধ আমরা!
ভারতবর্ষের কোন কোন তেলের কলে বা ঘানিতে বলদ ব্যবহার করা হয়। বলদগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া তৈলবীজ পেষণ করে। বলদের কাঁধে একটি জোয়াল আছে। একটুকরা কাঠ জোয়াল হইতে লম্বমান থাকে এবং ইহার সঙ্গে এক গোছা খড় বাঁধা থাকে। বলদের চোখ-দুইটি এমনভাবে বাঁধিয়া দেওয়া হয় যে, সে কেবল সম্মুখের দিকে তাকাইতে পারে; সুতরাং খড়টুকুর নাগাল পাইবার জন্য সে আপন গলদেশ বাড়াইয়া দেয়, এইরূপ করিতে গিয়া সে কাষ্ঠখণ্ডটিকেই খানিকটা সরাইয়া দেয়। সে আবার চেষ্টা করে, কিন্তু ফল হয় একই। এই ভাবে বার বার চেষ্টা চলিতে থাকে। বলদটি কখনই খড়ের নাগাল পায় না, কিন্তু ইহা পাইবার আশায় বার বার ঘুরিয়া যায় এবং এইভাবেই সে তৈলবীজ পেষণ করে। তুমি ও আমি প্রকৃতির দাসরূপে, সম্পদের দাসরূপে, স্ত্রীপূত্র-পরিজনের দাসরূপে জন্মিয়াছি; এবং আমরা এইভাবেই একটি কল্পিত অবাস্তব তৃণগুচ্ছের পশ্চাতে ধাবিত হইয়া অসংখ্য জীবন অতিক্রম করিতেছি, অথচ যাহা আমরা আকাঙ্ক্ষা করি, তাহা পাই না। ভালবাসাই আমাদের মহান্ স্বপ্ন; আমরা সকলেই ভালবাসিবার জন্য এবং ভালবাসা পাইবার জন্য চলিয়াছি; আমরা সকলেই সুখী হইবার জন্য চলিতেছি, কখনই দুঃখের সম্মুখীন হই না; কিন্তু যতই আমরা সুখের দিকে অগ্রসর হই, সুখ ততই আমাদের নিকট হইতে দুরে সরিয়া যায়। এইভাবেই জগৎ চলিয়াছে, সমাজ চলিয়াছে। আমরা অজ্ঞানান্ধ, বিষয়ের দাস; অজ্ঞাতসারেই আমাদিগকে বিষয়াসক্তির মূল্য দিতে হয়। তোমরা নিজেদের জীবন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ কর, দেখিবে তাহাতে সুখের মাত্রা কত অল্প এবং জগৎ-প্রপঞ্চের পশ্চাৎ ধাবিত হইয়া বাস্ববিক পক্ষে কত অল্পই লাভ করিয়াছ।
সোলন ও ক্রিসাসের (Solon and Croesus) কথা তোমাদের মনে আছে তো? রাজা সেই মহান্ জ্ঞানী-পুরুষকে বলিলেন, ‘এশিয়া-মাইনর খুব সুখের স্থান।’ সোলন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সবচেয়ে সুখী কে? বিশেষ সুখী একটি লোকও তো আমি দেখি নাই।’ ক্রিসাস বলিলেন, ‘ইহা একেবারে বাজে কথা! জগতে আমিই সর্বাপেক্ষা সুখী।’ সোলন তখন বলিলেন, ‘মহাশয়, আপনার জীবনের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন; হঠাৎ কোন সিদ্ধান্ত করিবেন না।’ এই কথা বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন। কালক্রমে সেই নৃপতি পারসীকদের হস্তে পরাজিত হণ এবং তাহারা জীবন্ত অবস্থায় তাঁহাকে পোড়াইয়া ফেলিবার নির্দেশ দিল। চিতা প্রস্তুত; ক্রিসাস ইহা দেখিবামাত্র চীৎকার করিয়া ডাকিলেন, ‘সোলন! সোলন!!’ তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কাহার কথা বলিতেছেন?’ উত্তরে তিনি সোলনের বিষয়টি বিবৃত করিলেন। পারস্য-সম্রাটের মনে লাগিল; তিনি ক্রিসাসের জীবন রক্ষা করিলেন।
আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনকাহিনী এইরূপ। আমাদের উপর প্রকৃতির এইরূপই প্রবল প্রভাব। ইহা বার বার পদাঘাত করিয়া আমাদিগকে দূরে নিক্ষেপ করিতেছে, তবু আমরা অদম্য উত্তেজনা-বশে ইহাকেই অনুসরণ করিতেছি। নৈরাশ্যের পর নৈরাশ্য সত্ত্বেও আমরা সর্বদা অন্তরে আশা পোষণ করিতেছি। এই কুহকিনী আশা আমাদিগকে পাগল করিয়া তোলে; আমরা সর্বক্ষণ সুখের আশা করিতেছি।
প্রাচীন ভারতে একজন মহান্ নৃপতি ছিলেন। তাঁহাকে একদিন চারিটি প্রশ্ন করা হয়; ইহাদের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল: ‘জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর বস্তু কি?’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘আশা’। সত্য, ইহাই সর্বাপেক্ষা বিস্ময়জনক বস্তু। দিবারাত্র আমরা দেখিতে পাই, আমাদের চারিদেকে মানুষ মরিতেছে; তথাপি আমরা মনে করি, আমরা মরিব না। আমরা কখনও মনে করি না যে, আমরা মরিব অথবা দুঃখকষ্ট পাইব। প্রত্যেকেই মনে করে, সে জীবনে সাফল্য লাভ করিবেই—সর্বপ্রকার নৈরাশ্য, বিপর্যয় ও তর্ক-যুক্তি উপেক্ষা করিয়াও সে অন্তরে আশা পোষণ করে। এ জগতে কেহই যথার্থ সুখী নয়। ধর, কোন ব্যক্তি ধনবান্, তাহার প্রচুর খাদ্যদ্রব্য রহিয়াছে; কিন্তু তাহার পরিপাক-শক্তির গোলমাল থাকিলে সে খাইতে পারে না। আর একজনের ভাল পরিপাক-শক্তি আছে, এবং সে সামুদ্রিক পক্ষী ‘কর্মোর্যান্ট’ (Cormorant)-এর মতো হজম করিতে পারে, কিন্তু মুখে দিবার মতো কোন খাদ্যই তাহার নাই। কেহ আবার ধনী, কিন্তু নিঃসন্তান। কেহ আবার দরিদ্র—ক্ষুধায় কাতর, কিন্তু তাহার একপাল ছেলেমেয়ে, তাহাদের লইয়া কি যে করিবে, সে বুঝিতে পারে না। এইরূপ হয় কেন? সুখ ও দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। যে সুখকে গ্রহণ করে তাহাকে দুঃখও গ্রহণ করিতে হয়। আমাদের সকলের এইরূপ ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, আমরা দুঃখকে বাদ দিয়া সুখ লাভ করিতে পারি। এই ধারণা আমাদিগকে এমনই পাইয়া বসিয়াছে যে, আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করিতে পারি না।
আমি যখন বস্টনে ছিলাম, একজন যুবক আমার কাছে আসে। সে আমাকে একটুকরা কাগজ দিল; ইহার উপর সে একটি নাম ও ঠিকানা লিখিল। নীচে লেখা ছিল : ‘যদি পাইবার উপায় তোমার জানা থাকে, তবে জগতের যাবতীয় ঐশ্বর্য ও সুখ তোমারই। আমার কাছে আসিলে বলিয়া দিব, কি ভাবে তাহা লাভ করা যায়। ইহার জন্য পাঁচ ডলার দিতে হইবে।’ সে আমাকে কাগজখানি দিয়া বলিল, ‘এ-সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?’ আমি বলিলাম, ‘ইহা ছাপিবার জন্য তুমি অর্থের ব্যবস্থা কর না কেন? ইহা ছাপিবার জন্য তোমার যথেষ্ট অর্থ নাই।’ সে আমার কথা বুঝিতে পারিল না। কোন প্রকার কষ্ট স্বীকার না করিয়া সে প্রচুর সুখ ও অর্থ লাভ করিতে পারিবে—এই ধারণায় সে ছিল মশগুল। মানুষ দুইটি চরম সীমার দিকে ছুটিতেছে : একটি চূড়ান্ত শুভবাদ—যাহাতে সবকিছুই শুভ, সুন্দর ও গোলাপী বলিয়া মনে হয়। অপরটি চূড়ান্ত দুঃখবাদ—যাহাতে সবকিছুই তাহার নিকট বিরোধী বলিয়া প্রতীত হয়। অধিকাংশ লোকের মস্তিষ্ক কমবেশী অপরিণত। দশ লক্ষের মধ্যে একজনের মস্তিষ্ক সুপরিণত দেখা যায়। বাকী যাহারা, তাহারা—হয় অদ্ভুত খেয়ালী অথবা বাতিকগ্রস্ত।
স্বভাবতই আমরা সর্ববিষয়ে চূড়ান্ত সীমার দিকে ধাবিত হই। যখন আমরা সুস্থ থাকি ও আমাদের বয়স অল্প, তখন আমরা মনে করি—জগতের সমস্ত ধন আমদের করায়ত্ত হইবে; কিন্তু পরে বয়স বাড়িলে সমাজ যখন আমাদিগকে ফুটবলের মতো চারিদিকে আঘাতে জর্জরিত করে, তখন এক কোণে বসিয়া বিরক্তির অস্ফুট শব্দ উচ্চরণপূর্বক আমরা অপরকে নিরুৎসাহ করিয়া দিই। অল্প লোকেই জানে যে, সুখের সঙ্গে দুঃখ আসে, এবং দুঃখের সঙ্গে আসে সুখ। দুঃখ যেমন বিরক্তিকর, সুখও তাই; সুখ দুঃখের যমজ ভ্রাতা। মানুষ দুঃখের পশ্চাতে ছুটিবে— ইহা তাহার মর্যাদার পক্ষে হানিকর; আবর সে সুখের পশ্চাতে ধাবিত হইবে—ইহাও সমভাবে অসম্মানজনক। যাহাদের বিচারবুদ্ধি সাম্যে স্থিত, তাহারা উভয়কেই পরিত্যাগ করিবে। মানুষ যাহাতে অপরের দ্বারা যন্ত্রবৎ চালিত না হয়, সেই চেষ্টা করিবে না কেন? এই মাত্র আমাদের চাবুক মারা হইল: যখনই কাঁদিতে আরম্ভ করিলাম, প্রকৃতি আমাদের একটি ডলার দিয়া দিল। আবার চাবুক খাইলাম, আবার কাঁদিতে লাগিলাম—প্রকৃতি তখন আমাদিগকে একখণ্ড পিষ্টক দিল; সঙ্গে সঙ্গেই আবার আমরা হাসিতে লাগিলাম।
জ্ঞানের সাধক চান মুক্তি। তিনি দেখেন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলি সব অসার, এবং সুখ-দুঃখের অন্ত নাই, জগতে কত ধনীই না নূতন নূতন সুখ লাভ করিতে চায়! সব সুখই পুরাতন হইয়া গিয়াছে; এখন তাহারা মুহূর্তের স্নায়বিক উত্তেজনার জন্য নূতন সুখ চায়। দেখিতে পাইতেছ না—প্রতিদিন তাহারা কতই হাস্যাস্পদ বস্তু আবিষ্কার করিতেছে? তারপর লক্ষ্য করিয়াছ, ইহার কিরূপ প্রতিক্রিয়া আসে? অধিকাংশ লোক মেষপালের মতো। দলের প্রথমটি নর্দমায় পড়িলে বাকী সবগুলি তাহাকে অনুসরণ করিয়া বিপন্ন হয়। ঠিক এই ভাবেই সমাজের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাহা করে, অন্য সকলে নিজেদের কাজের পরিণাম না ভাবিয়াই তাহা করিতে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি পার্থিব বস্তুর অসারতা উপলব্ধি করিতে আরম্ভ করে, সে অনুভব করে এইভাবে তাহার পক্ষে প্রকৃতির ক্রীড়নক হওয়া অথবা প্রকৃতির দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত নয়; ইহা দাসত্ব। কোন ব্যক্তিকে কয়েকটি মধুর কথা বলিলে সে তৃপ্তির হাসি হাসিতে থাকে; কিন্তু কয়েকটি কর্কশ কথা শুনিলে সে কাঁদিতে থাকে। সে এক মুঠা অন্ন, একটু শ্বাস-প্রশ্বাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, দেশপ্রেম, দেশ, নাম ও যশের দাস। এই ভাবে সে দাসত্বের মধ্যে বাস করে এবং দাসত্ব-হেতু তাহার প্রকৃত স্বরূপ চাপা পড়িয়া যায়। তুমি যাহাকে মানুষ বলো, সে একটি ক্রীতদাস। এই সব দাসত্ব মর্মে মর্মে অনুভব করিলেই মুক্ত হইবার ইচ্ছা জাগে, মুক্তির একটি উদ্রগ্র বাসনা আসে। একখণ্ড জ্বলন্ত কয়লা একজনের মাথায় স্থপিত হইলে ইহা দূরে ফেলিয়া দিবার জন্য সে কিরূপ চেষ্টা করে! যে-ব্যক্তি সত্য সত্যই বুঝিতে পার যে, সে প্রকৃতির ক্রীতদাস—তাহার মুক্তির সংগ্রামও এইরূপ হইবে।
আমরা এইমাত্র দেখিলাম—মুমুক্ষুত্ব অর্থাৎ মুক্তির ইচ্ছা কি। সাধনার পরবর্তী সোপানটিও খুব শক্ত। ইহা হইল—নিত্যানিত্য-বিবেক অর্থাৎ সত্য ও অসত্য, নিত্য ও অনিত্যের বিচার। কেবল ঈশ্বরই নিত্য, আর সব কিছুই অনিত্য। সব কিছুই মরে—দেবদূত, মানুষ, জীবজন্তু সব মরে, পৃথিবী সূর্য চন্দ্র তারকা সব ধ্বংস হইয়া যায়। প্রতিটি বস্তু প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হইতেছে। অদ্যকার পর্বতগুলি অতীতে মহাসাগর ছিল; আগামী কাল তাহারা মহাসাগরে পরিণত হইবে। প্রত্যেক বস্তুই প্রবাহাকারে চলিতেছে। সমগ্র বিশ্বই পরিবর্তনের একটি পিণ্ড। কিন্তু এক অপরিণামী বস্তু আছেন, তিনিই ঈশ্বর। আমরা যতই ঈশ্বরের নিকটবর্তী হই, পরিবর্তন আমাদের তত কম হইবে, প্রকৃতি তত কম আমাদের উপর ক্রিয়া করিবে। আমরা যখন তাঁহার সান্নিধ্য লাভ করিব, তাঁহার সঙ্গে একত্ব অনুভব করিব, তখনই আমরা প্রকৃতিকে জয় করিব, জগৎপ্রপঞ্চের উপর প্রভুত্ব করিব; আর আমাদের উপর তাহাদের কোন প্রভাব থাকিবে না।
দেখিতে পাইতেছ, যদি সত্য সত্যই আমরা উপরি-উক্ত শমদমাদি সাধনে প্রতিষ্ঠিত হই, তাহা হইলে আমাদের অন্য কিছুর প্রয়োজনই হয় না। সমস্ত জ্ঞান আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে। আত্মার মধ্যে সমস্ত পূর্ণতা পূর্ব হইতেই রহিয়াছে; কিন্তু এই পূর্ণতা প্রকৃতি দ্বারা আবৃত। প্রকৃতি আপন এক একটি স্তরে আত্মার এই শুদ্ধ রূপকে আবৃত করিতেছে। এই অবস্থায় আমাদের কি করিতে হইবে? প্রকৃতপক্ষে আমরা মোটেই আত্মার উৎকর্ষ সাধন করি না। কোন অপূর্ণ বস্তু কি পূর্ণ বস্তুর উৎকর্ষ সাধন করিতে পারে? আমরা শুধু আবরণটিকে সরাইয়া লই। তখন আত্মা নিত্য-শুদ্ধ বুদ্ধ-মুক্ত স্বরূপে প্রকাশিত হন।
এখন প্রশ্ন : এইসব সাধনের এত প্রয়োজন কি? কারণ আধ্যাত্মিকতা কর্ন বা চক্ষু বা মস্তিষ্ক দ্বারা লাভ করা যায় না। শাস্ত্রপাঠেও আধ্যাত্মিকতা লাভ করা যায় না। জগতে যত গ্রন্থ আছে, সবই আমরা পড়িয়া ফেলিতে পারি, তবু ধর্ম বা ঈশ্বর-বিষয়ে কিছুই জানিতে না পারি। সমগ্র জীবন আমরা ধর্মের কথা বলিতে পারি; তাহাতেও আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি নাও হইতে পারে। আমরা পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মণীষা হইতে পারি, তথাপি একেবারেই ঈশ্বরের নিকট পৌঁছিতে না পারি। পক্ষান্তরে অত্যধিক বুদ্ধি-বৃত্তির অনুশীলনের ফলে কিরূপ অধ্যাত্মবিমুখ অধার্মিক সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা কি তোমারা দেখিতে পাও না? ইহা তোমাদের পাশ্চাত্য সভ্যতার একটি দোষ যে, তোমরা কেবল বুদ্ধির উন্মেষকারী শিক্ষার পশ্চাতে ধাবিত; হৃদয়বৃত্তির দিকে তোমরা দৃষ্টি দাও না। বুদ্ধিবৃত্তি শুধু মানুষকে দশগুণ অধিক স্বার্থপর করিয়া তোলে; ইহাই তোমাদের ধ্বংসের কারণ হইবে। হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইলে হৃদয়কেই মানিবে, কেন না মস্তিষ্কের একটি মাত্র বৃত্তি—বিতর্ক; ইহার মধ্যেই মস্তিষ্ক কাজ করে, ইহার বাহিরে যাইতে পারে না। হৃদয় মানুষকে উচ্চতম স্তরে লইয়া যায়; মস্তিষ্ক কখনও সেই স্তরে পৌঁছিতে পারে না। ইহা বুদ্ধিবৃত্তিকে অতিক্রম করিয়া বোধির স্তরে উপনীত হয়। বুদ্ধি কখনও প্রেরণাবোধ সৃষ্টি করিতে পারে না। কেবল হৃদয় যখন প্রজ্ঞালোকে আলোকিত হয়, তখনই উহা প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়। হৃদয়হীন বুদ্ধিসর্বস্ব মানুষ কখনও প্রেরণা লাভ করিতে পারে না। প্রেমিক পুরুষের মধ্যেই হৃদয়ের বাণী শোনা যায়। বুদ্ধি অপেক্ষা হৃদয় উন্নত যন্ত্র আবিষ্কার করে—সেই যন্ত্র হইল অনুপ্রেরণার যন্ত্র। বুদ্ধি যেমন জ্ঞানের যন্ত্র, হৃদয় তেমনি প্রেরণার যন্ত্র। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত স্তরে ইহা বুদ্ধি অপেক্ষা অনেকটা দুর্বল। জ্ঞানহীন ব্যক্তি কিছুই জানে না, কিন্তু তাহার প্রকৃতি কিছুটা আবেগপ্রবণ। তাহাকে একজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের সহিত তুলনা কর—অধ্যাপকটির কি অদ্ভুত ক্ষমতা! কিন্তু তিনি তাঁহার বুদ্ধি দ্বারা সীমাবদ্ধ; এবং একই সময়ে তিনি একটি শয়তান ও প্রখরবুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন লোক হইতে পারেন, কিন্তু হৃদয়বান্ ব্যক্তি কখনও শয়তান হইতে পারে না। আবেগে পূর্ণ কোন ব্যক্তি কখনও শয়তান হয় না। ঠিক ঠিক অনুশীলন করিলে হৃদয়বৃত্তির পরিবর্তন হয় এবং ইহা বুদ্ধিবৃত্তিকে অতিক্রম করিয়া অনুপ্রেরণায় রূপান্তরিত হইবে। সর্বশেষে মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি অতিক্রম করিতে হইব। মানুষের জ্ঞান, যুক্তি, অনুভব, বুদ্ধি ও হৃদয়বৃত্তির শক্তি—এ সবই জগদ্রূপ দুগ্ধমন্থনে ব্যস্ত। দীর্ঘকালব্যাপী মন্থনের পর আসে মাখন; এবং ঈশ্বরই সেই মাখন। যাঁহারা হৃদয়বান্ তাঁহারা ঐ মাখনই লাভ করেন এবং বুদ্ধিজীবীর জন্য পড়িয়া থাকে শুধু ঘোলা বা মাখন-তোলা দুধ।
এগুলিই হৃদয়ের প্রস্তুতি—সেই প্রেম, হৃদয়ের সেই গভীর সহানুভূতির প্রস্তুতি। ভগবানের নিকট পৌঁছিবার জন্য শিক্ষিত অথবা পণ্ডিত হইবার একেবারেই প্রয়োজন নাই। জনৈক মহাপুরুষ একবার আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘অপরকে বধ করিবার জন্য ঢাল-তরবারির প্রয়োজন, কিন্তু নিজেকে বধ করিবার জন্য একটি সূচই যথেষ্ট। সুতরাং অপরকে শিক্ষা দিবার জন্য প্রচুর বুদ্ধি ও জ্ঞানের যতটুকু প্রয়োজন, তোমার আত্মবিকাশের জন্য ততটা নয়।’ তুমি কি পবিত্র? তুমি যদি পবিত্র হও, তাহা হইলে তুমি ঈশ্বরের নিকট পৌঁছিবে। ‘যাহাদের হৃদয় পবিত্র, তাহারা ধন্য; কেন না তাহারা ঈশ্বরকে দর্শন করিবে।’ তুমি যদি পবিত্র না হও, অথচ সকল বিজ্ঞান তোমার অধিগত হয়, তাহা হইলে তাহা মোটেই তোমার সহায়ক হইবে না। যে-সকল গ্রন্থ তুমি পড়, তাহাতে ডুবিয়া থাকিতে পারো; কিন্তু তাহা তোমার বিশেষ কাজে লাগিবে না। হৃদয়ই লক্ষে পৌঁছিতে পারে। হৃদয়ের পথ অনুসরণ কর। পবিত্র হৃদয়ের দৃষ্টি বুদ্ধির বাহিরে প্রসারিত। ইহা একটি বিশেষ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়; যে-সকল বিষয় কখনও বুদ্ধিবৃত্তির গম্য নয়, তাহা এই হৃদয় উপলব্ধি করে। যখনই নির্মল হৃদয় ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন সর্বাবস্থাতেই নির্মল হৃদয়ের পক্ষ অবলম্বন করিবে, যদিও তুমি মনে কর, হৃদয় যাহা করিতেছে তাহা অযৌক্তিক। যখন তোমার হৃদয় অপরের উপকার করিতে ইচ্ছুক, তখন তোমার বুদ্ধিবৃত্তি হয়তো তোমাকে বলিবে, এইরূপ করা সুবিবেচনার পরিচায়ক নয়; এই অবস্থায় কিন্তু হৃদয়কেই মানিয়া চলিবে। তাহা হইলে দেখিতে পাইবে, বুদ্ধিকে অনুসরণ করিয়া তোমার যতটুকু ভ্রান্তি হইয়া থাকে, তাহা অপেক্ষা ভ্রান্তির পরিমাণ তোমার অল্পই হইতেছে। শ্রেষ্ঠ দর্পণরূপ পবিত্র হৃদয়ে সত্য প্রতিফলিত হয়, সুতরাং এই-সকল যমনিয়মাদির অভ্যাস হৃদয়ের পবিত্রতা সম্পাদনের জন্যই। যখনই চিত্ত শুদ্ধ হয়, মুহূর্তের মধ্যেই সকল তত্ত্ব, সকল সত্য আপন ভাস্বর মহিমায় প্রকাশিত হয়। তুমি যদি যথেষ্ট পরিমাণে পবিত্রহৃদয় হও, তাহা হইলে বিশ্বের সর্ববিধ সত্য তোমার অন্তরে প্রকাশিত হইবে। যাঁহারা কখনও দূরবীক্ষণযন্ত্র, অণুবীক্ষণযন্ত্র অথবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার দেখেন নাই, তাঁহারাই যুগ-যুগান্ত পূর্বে পরমাণু সম্বন্ধে, অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব সম্বন্ধে এবং মানুষের অতি সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্বন্ধে মহাসত্যসমূহ আবিষ্কার করিয়াছিলেন। তাঁহারা এই-সকল বিষয় কিরূপে জানিয়াছিলেন? হৃদয়বৃত্তির সাহায্যেই জানিয়াছিলেন। তাঁহারা হৃদয়কে নির্মল করিয়াছিলেন। বর্তমানেও আমরা ইহা করিতে পারি—পথ আমাদের জন্য প্রশস্তই রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন নয়, হৃদয়বৃত্তির অনুশীলনই বিশ্বের দুঃখ-দৈন্য হ্রাস করিতে পারে।
———-
১ Sermon on the Mount, St. Matt. V. S.
বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনের দ্বারা শত শত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইয়াছে; ফল দাঁড়াইয়াছে যে, মুষ্টিমেয় লোক বহু লোককে ক্রীতদাসে পরিণত করিয়াছে। এই টুকুই উপকার হইয়াছে! অগণিত কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি হইয়াছে; আর অর্থ থাকুক বা না থাকুক, প্রত্যেক দরিদ্র ব্যক্তি সেই-সকল অভাব পরিতৃপ্ত করিতে চায়। না পারিলেও সে সংগ্রাম করিতে থাকে; পরিশেষে সংগ্রামের মধ্যেই তাহার মৃত্যু হয়। এই তো পরিণতি! সুতরাং জীবনের দুঃখদৈন্যের সমস্যা-সমাধান বুদ্ধির পথে সম্ভব নয়; হৃদয়ের মধ্য দিয়াই তাহা সম্ভব যদি এই-সব প্রভূত চেষ্টা মানুষকে আরও পবিত্র শান্ত সহনশীল করিতে প্রযুক্ত হইত, তাহা হইলে এই বিশ্বের সুখ বর্তমানের সুখ অপেক্ষা সহস্রগুন বেশী হইত। তাই বলি, সর্বদা হৃদয়বৃত্তির অনুশীলন কর। হৃদয়ের মধ্য দিয়াই ঈশ্বর কথা বলেন; বুদ্ধিবৃত্তির মধ্য দিয়া তুমি কথা বলিয়া থাকো।
তোমাদের মনে আছে, ওল্ড টেষ্টামেন্টে (Old Testament) মুশাকে বলা হইয়াছিল, ‘তোমার পা হইতে জুতা খুলিয়া ফেলো, কারণ যেখানে তুমি দাঁড়াইয়া আছ, তাহা পবিত্র ভূমি।’ ঐরূপ সশ্রদ্ধ মনোভাব লইয়া আমাদিগকে সর্বদা ধর্মানুশীলনে অগ্রসর হইতে হইবে। যে-ব্যক্তি পবিত্র হৃদয় ও শ্রদ্ধালু মনোভাব লইযা আসেন, তাঁহার হৃদয় খুলিয়া যাইবে; অনুভূতির দ্বার তাঁহার জন্য উদ্ঘাটিত হইবে এবং তিনি সত্যদর্শন করিবেন।
যদি শুধু বুদ্ধিবৃত্তি লইয়া উপস্থিত হও, তোমার কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিরই অনুশীলন হইবে, কিছুটা তাত্ত্বিক বিচার হইবে, কিন্তু সত্যে উপনীত হইবে না। সত্যের এমন একটি রূপ আছে যে, যে তাহা দেখিতে পায়, সে দৃঢ়প্রত্যয় হইয়া যায়। সূর্যকে দেখাইবার জন্য কোন আলোক-বর্তিকার প্রয়োজন হয় না; সূর্য স্বয়ম্প্রকাশ। সত্যের যদি প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে সেই প্রমাণকে কে প্রমাণিত করিবে? সত্যের সাক্ষিরূপে যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই সাক্ষীর আবার সাক্ষী কোথায়? আমাদিগকে শ্রদ্ধা ও প্রেমের সহিত ধর্মের দিকে অগ্রসর হইতে হইবে; তাহা হইলেই আমাদের হৃদয় জগরিত হইয়া বলিবে, ‘ইহা সত্য, এবং ইহা অসত্য।’
ধর্মের ক্ষেত্র আমাদের ইন্দ্রিযের অতীত, এমন কি আমাদর চেতনারও ঊর্ধ্বে। আমরা ঈশ্বরকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিতে পারি না। কেহই চক্ষুর দ্বারা ঈশ্বর দর্শন করেন নাই, কখনও দর্শন করিবেন না। কাহারও চেতনার মধ্যে ঈশ্বর নাই। আমি ঈশ্বর-সচেতন নই, তুমিও নও, কেহই নয়। ঈশ্বর কোথায়? ধর্মের ক্ষেত্র কোথায়? ইহা ইন্দ্রিয়ের অতীত, ইহা চেতনার উর্ধ্বে। আমরা যে-সকল অগণিত স্তরে কাজ করিয়া থাকি, চেতনা শুধু তাহাদের অন্যতম। তোমাকে চেতনার ক্ষেত্র অতিক্রম করিতে হইবে, ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে যাইতে হইবে; তোমাকে নিজ কেন্দ্রের—স্বরূপের নিকট হইতে নিকটতর ভূমিতে উপনীত হইতে হইবে। আর যতই তুমি এইরূপ করিতে থাকিবে, ততই ঈশ্বরের নিকটবর্তী হইবে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ কি?—প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার। এই প্রাচীরের অস্তিত্ব-বিষয়ে প্রমাণ—ইহা আমি প্রত্যক্ষ করি। সহস্র সহস্র ব্যক্তি এই ভাবে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ অনুভব করিয়াছেন এবং যাঁহারাই তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিতে ইচ্ছুক, তাঁহাদেরই নিকট তিনি প্রত্যক্ষ হইবে। কিন্তু এই অনুভূতি মোটেই ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি নয়। ইহা অতীন্দ্রিয়—অতিচেতন। সুতরাং নিজেদের অতীন্দ্রিয়-লোকে উন্নীত করিবার জন্য এইসব যমনিয়মাদির অনুশীলন অত্যাবশ্যক। সর্বপ্রকার অতীত কর্ম এবং বন্ধন আমাদিগকে নিম্নে টানিয়া লইতেছে। এই-সকল প্রস্তুতি আমাদিগকে পবিত্র ও বন্ধনমুক্ত করিবে। বন্ধনগুলি আপনা হইতেই ছিন্ন হইয়া যাইবে এবং যে ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষের স্তরে আমরা বদ্ধ হইয়া আছি, তাহার ঊর্ধ্বে উন্নীত হইব। তখনই আমরা এমন সব বস্তু দেখিব শুনিব এবং অনুভব করিব, যাহা মানুষ জগ্রৎ স্বপ্ন ও সুষুপ্তিরূপ তিনটি সাধারণ স্তরে দেখে না, শোনে না বা অনুভব করে না। তখন আমরা যেন একটা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলিব। লোকে আমাদের ভাষা বুঝিতে পারিবে না; কারণ তাহারা তো ইন্দ্রিয়ের বিষয় ছাড়া অন্য কিছু জানে না। যথার্থ ধর্ম সম্পূর্ণভাবে অতীন্দ্রিয় রাজ্যের। জগতের প্রত্যেক প্রাণীর ইন্দ্রিয়গুলিকে অতিক্রম করিবার সহজাত শক্তি রহিয়াছে। ক্ষুদ্র কীট পর্যন্ত একদিন ইন্দ্রিয়গুলি অতিক্রম করিয়া ঈশ্বরের নিকট উপনীত হইবে। কোন জীবনই ব্যর্থ হইবে না; জগতে ব্যর্থতা বলিয়া কিছু নাই। শতবার মানুষ নিজেকে আঘাত করিবে; সহস্রবার হোঁচট খাইবে, কিন্তু পরিণামে নিজে অনুভব করিবে, সে ঈশ্বর। আমরা জানি, সোজাসুজি কোন অগ্রগতি হয় না। প্রত্যেক জীবাত্মা যেন বৃত্তাকারে চলিতেছে; তাহাকে এই বৃত্ত পূর্ণ করিতে হইবে। কোন জীবাত্মাই চিরতরে নিম্নগামী হইতে পারে না।
এমন এক সময় আসিবে, যখন তাহাকে ঊর্ধ্বগামী হইতেই হইবে। কাহারও বিনাশ নাই। আমরা সকলেই একটি সাধারণ কেন্দ্র হইতে অভিক্ষিপ্ত; এই কেন্দ্রই ঈশ্বর। ঈশ্বর যে-সকল জীব সৃষ্টি করিয়াছেন—তাহারা উচ্চতমই হউক বা নীচতমই হউক—সকলেই সর্ব জীবনের জনক ঈশ্বরের নিকট ফিরিয়া আসিবে। ‘যাঁহা হইতে সকল প্রাণী জাত, যাঁহাতে সকলে অবস্থিত এবং যাঁহার নিকট সকলেই প্রত্যাবৃত্ত হয়, তিনিই ঈশ্বর।’১
———-
১ তৈত্তি. উপ. ৩/১