জোজো আর সন্তু বসে ছিল জঙ্গলের মধ্যে ছোট নদীটার ধারে। ছোট ছোট মাছ আছে নদীতে, মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে।
জোজো জলে হাত ড়ুবিয়ে সেই মাছ ধরার চেষ্টা করছে, একটাও ধরা যাচ্ছে।
এক সময় সে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে সন্তু, এখনও কি কেউ ঝোপের আড়ালে বসে আমাদের ওপর নজর রাখছে?
সন্তু বলল, হতেও পারে। এদের ব্যবস্থাটা বেশ ভাল। আমাদের এরা আটকে রেখেছে বটে, কিন্তু মোটেই বন্দি বন্দি লাগে না। বেশ খোলামেলা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো যায়।
জোজো বলল, তা হলেও এইভাবে কতদিন থাকব? যতই ভাল খেতে দিক। – কাকাবাবু এখান থেকে পালাবার কোনও উপায় বার করছেন না কেন রে?
সন্তু বলল, বোধ হয় এখনও সময় হয়নি।
পেছনে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ হতেই ওরা ফিরে তাকাল।
ঘোড়ায় চেপে তিনজন লোক আসছে। এরা এই দলেরই লোক, মুখ চেনা।
একজন কী একটা ভাষায় কিছু বলল, ওরা বুঝল না। অন্য একজন ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। ঘোড়ায় উঠুন।
সন্তুও ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, চলে যেতে হবে মানে, কোথায় যাব?
সে বলল, এখানকার ডেরা তুলে দিতে হচ্ছে। পুলিশ আসছে।
সন্তু বলল, কাকাবাবু?
লোকটি বলল, তিনিও যাবেন। সবাই চলে যাবে। এখানে কিছু থাকবে না।
ওদের দুজনের কাঁধে রাইফেল, একজনের কোমরে রিভলভার। কথা বলার ভঙ্গিটা রুক্ষ নয়।
সন্তু বলল, ঠিক আছে। আমি আর আমার বন্ধু এক ঘোড়ায় যেতে পারি।
সেই লোকটি বলল, আর ঘোড়া নেই। আপনারা দুজন দুটো ঘোড়ায় উঠুন।
সন্তু আর জোজো ঘোড়ায় চড়ে বসার পর সেই লোকটি বলল, আমাদের ওপর হুকুম আছে, আপনাদের চোখ বেঁধে নিতে হবে।
জোজো বলল, কেন, চোখ বাঁধতে হবে কেন?
লোকটি বলল, সেইরকমই হুকুম।
তর্ক করে লাভ নেই। কালো কাপড় দিয়ে ওদের দুজনের চোখ বেঁধে দেওয়া হল।
ঘোড়াগুলো চলতে শুরু করার পর জোজো জিজ্ঞেস করল, কী রে সন্তু, কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
সন্তু বলল, না, সব অন্ধকার।
জোজো বলল, এরা ডাকাত বলে মনেই হয় না। কোনও ডাকাত আপনিআপনি বলে কথা বলে? সেইজন্যই তো চোখ বাঁধতে রাজি হয়ে গেলাম।
সন্তু বলল, তুই, তুই বললে কী করতি?
জোজো বলল, আমিও তুই বলতাম। একবার কী হয়েছিল জানিস, বাবার সঙ্গে আমাজন নদীর জঙ্গলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন ডাকাত ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে তুলে নিয়ে গেল। এইরকম ভাবে চোখ বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে পালাচ্ছিল। যে ডাকাতটা আমায় ঘোড়ায় তুলেছিল, সে প্রথম থেকেই আমাকে তুই-তুই করছিল। আমিও তাকে তুই বলতে লাগলাম। তাতে সে খুব রেগে গেল। আমি তাকে আরও রাগিয়ে দিচ্ছিলাম।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী ভাষায় কথা হচ্ছিল?
জোজো বলল, স্প্যানিশ ভাষায়। তুই যেমন একটু-একটু হিন্দি জানিস, আমিও তেমনই একটু-একটু স্প্যানিশ জানতাম। মানে, ওখানে গিয়ে শিখে নিয়েছিলাম আর কী! এখন ভুলে গেছি। তারপর শোন না, ডাকাতটা তো রেগে দাঁত কিড়মিড় করছিল। তখন আমি ঘোড়াটাকে একটা রাম চিমটি কাটলাম। ঘোড়াটা অমনই লাফিয়ে উঠল। ঘোড়াটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠতেই ডাকাতটা তাল সামলাতে না পেরে নীচে পড়ে গেল। আমি তখন ঘোড়াটাকে চালিয়ে ভোঁ ভাঁ!
তুই এখন ঘোড়াকে চিমটি কাটবি নাকি?
এদের কাছে যে রাইফেল আছে। গুলি করবে। হ্যাঁ রে সন্তু, এরা বাংলা বোঝে না তো?
মনে হয়, না।
তুই এদের কাছ থেকে একটা রাইফেল কেড়ে নিতে পারবি না?
চোখ বাঁধা অবস্থায় রাইফেল কাড়ব কী করে?
তাও তো বটে। এর আগে তো কক্ষনও চোখ বাঁধেনি। পুলিশের ভয়ে এরা পালাচ্ছে। আমরা যদি তখন চেঁচিয়ে পুলিশ ডাকতাম–
জোজো, পুলিশ কথাটা ওরা বুঝতে পারবে। সব কথা বাংলায় বল।
পু… মানে, ওই কথাটার বাংলা কী?
সরকারি প্রহরী বলতে পারিস।
হ্যাঁ, ইয়ে, মানে, আমাদের উচিত ছিল সরকারি প্রহরীদের সাহায্য নেওয়া।
কাকাবাবু অন্য জায়গায় ছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হল না, আমরা নিজেরা ঠিক করব কী করে?
পাশাপাশি দুটো ঘোড়া চলছে। বোঝাই যায় যে জঙ্গলের পথ, তাই জোরে ছুটতে পারছে না। জোজো আর সন্তু দিব্যি গল্প করতে করতে যেতে লাগল। যারা ওদের নিয়ে যাচ্ছে, তারা বাধাও দিল না, নিজেরাও কিছু বলছে না।
যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, কতটা সময় যে কেটে গেল তা বোঝা যায় না। দু-আড়াই ঘণ্টা তো হবেই। ঝোপঝাড় ভেদ করে যেতে হচ্ছে, ওদের গায়ে লাগছে গাছের ডালপালা।
একটা সময় থামল ঘোড়া। সন্তু জোজোকে নামিয়ে দেওয়া হল। ওরা কিছু বোঝবার আগেই বেঁধে দেওয়া হল ওদের হাত।
জোজো জিজ্ঞেস করল, এ কী, হাত বাঁধলেন কেন! আমরা তো চোখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করিনি!
কেউ উত্তর দিল না। ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনে বোঝা গেল, ওদের দুজনকে রেখে ঘোড়াগুলো দূরে সরে যাচ্ছে।
তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ নেই।
জোজো বলল, এ কী ব্যাপার হল রে সন্তু?
সন্তু বলল, আমাদের নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না।
জোজো বলল, এ জায়গাটাই বা কীরকম?
চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা, জোজো একটু এদিক-ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করতেই গুঁতো খেল একটা গাছে। সে উঃ করে উঠল।
সন্তু হাতদুটো মুখের কাছে এনে বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। খুব শক্ত বাঁধন। নাইলনের দড়িতে দাঁতও বসানো যাচ্ছে না।
সন্তু বলল, জোজো, আগে চোখের বাঁধনটা খোলা দরকার। কাপড়ের গিট খোলা শক্ত হবে না। তুই আমার পেছনে এসে দাঁড়া। আমার বাঁধনটা খোলার চেষ্টা কর।
জোজো বলল, তুই কোথায়?
সন্তু বলল, এই তো এখানে। গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছিস না?
জোজো সন্তুর কাছে আসতে গিয়ে আরও দুবার গাছে গুঁতো খেল। তারপর ধাক্কা খেল সন্তুর সঙ্গে।
সন্তু বলল, এবার আস্তে-আস্তে আমার পেছনে চলে আয়। জোজো পেছনে গিয়ে গিট খোলার চেষ্টা করল।
সন্তু বলল, এ কী রে, তুই আমার কান কামড়ে দিচ্ছিস কেন?
জোজো হেসে ফেলে বলল, দুর ছাই, কোনটা কান আর কোনটা গিট, বুঝব কী করে!
জোজো আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও পারল না।
সন্তু অস্থির হয়ে বলল, তোর দ্বারা কিছু হয় না। তুই আমার সামনে আয়, আমি তোরটা খুলে দিচ্ছি।
এই সময় বেশ কাছেই গুলির আওয়াজ হল পরপর দুবার। ওরা চমকে গিয়ে থেমে গেল। এরপর মনে হল যেন একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
জোজো বলল, কারা যেন আসছে।
সন্তু বলল, আসুক। তুই এসে দাঁড়া, তাড়াতাড়ি কর, তোর বাঁধনটা খুলে দিই, তারপর তুই দেখে দেখে…
সে সময় আর পাওয়া গেল না। কাছেই একটা গাড়ি থামল, তার থেকে কয়েকটি লোক নেমে দৌড়ে ওদের ঘিরে দাঁড়াল।
প্রথমে একজন কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, সে ভাষা বোঝা গেল না।
সন্তু বলল, প্লিজ স্পিক ইন ইংলিশ। অর ইন হিন্দি।
জোজো বলল, অথবা বাংলায়। এবার একজন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল। তোমরা কে? প্রশ্ন শুনেই সন্তু বুঝতে পারল, এরা ডাকাত নয়।
সে বলল, আগে আমাদের বাঁধন খুলে দিন, সব বুঝিয়ে বলছি! লোকগুলো ওদের শুধু চোখের বাঁধন খুলে দিল, হাত খুলল না।
সন্তু দেখল, ওরা চারজন লোক। তিনজন খাকি হাফপ্যান্ট ও হাফশার্ট পরা। আর একজন ফুলপ্যান্ট। এরা ফরেস্ট গার্ড, একজন অফিসার।
সন্তু বলল, বিক্রম ওসমানের নাম জানেন নিশ্চয়ই। আমাদের আটকে রেখেছিল। হঠাৎ এখানে কেন ছেড়ে দিয়ে গেল জানি না।
জোজো বলল, বিক্রম ওসমান সাঙ্ঘাতিক ডাকাত। চন্দনগাছ কেটে বিক্রি করে, মানুষ খুন করে।
ফরেস্ট গার্ডরা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল। তাদের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে।
অফিসারটি বললেন তারা তোমাদের ধরে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দিল কেন?
জোজো বলল, সেটা তো আমরাও বুঝতে পারছি না।
সন্তু বলল, আমাদের কাকাবাবু এখনও ওদের সঙ্গে আছেন। নিশ্চয়ই তাঁকে ছাড়েনি।
একজন গার্ড অফিসারটিকে কী যেন বলল। অফিসারটি সন্তুকে বললেন, কাছেই আমাদের বনবিভাগের চেক পোস্ট। সেখানে চলো, তারপর তোমাদের সব কথা ভাল করে শুনব।
সন্তু বলল, কিন্তু কাকাবাবু… ওখানে রয়ে গেছেন, তাঁকে খুঁজতে যেতে হবে। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?
অফিসারটি বললেন, তাকে খুঁজতে বিক্রম ওসমানের ডেরায় যাব? মাথা খারাপ নাকি? আমরা এই কজন গিয়ে মরব নাকি? পুলিশবাহিনীকেই বিক্রম ওসমান গ্রাহ্য করে না। আমাদের কাছে তো তেমন কিছু অস্ত্রই নেই। ওদের কাছে সাব মেশিনগান পর্যন্ত আছে।
সন্তু বলল, আপনারা সাহায্য করবেন না? তা হলে আমরা দুজনেই আবার ফিরে যাব!
অফিসারটি মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু! তা চলবে না। আমরা তোমাদের দুজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। তারপর তারা যা ভাল বোঝে করবে। আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই।
সন্তু চিৎকার করে বলল, কাকাবাবুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই যাব না। আপনাদের সাহায্যের কোনও দরকার নেই।
সে দৌড়ে জঙ্গলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই দুজন গার্ড ছুটে গিয়ে তাকে। চেপে ধরল। হাত বাঁধা অবস্থায় সন্তু ধস্তাধস্তি করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না।
ওদের দুজনকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল একটা জিপ গাড়িতে।
জোজো বলল, সন্তু, আমরা শুধু দুজনে ফিরে গিয়ে কিছুই করতে পারব না। পুলিশের কাছে সব জানিয়েই দেখা যাক না!
সন্তু তবু রাগে ফুসছে, আর কামড়ে কামড়ে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে।
চেকপোস্টের কাছে একটুখানি থেমে জিপটা আবার ছুটল। কিছুক্ষণ পরে শেষ হয়ে গেল জঙ্গল। একটা থানায় সন্তু আর জোজোকে জমা করে দিয়ে গেল বন বিভাগের লোকেরা।
থানাটা বেশ ছোট। সন্তুদের সব কথা শুনে সেখানকার দারোগা বললেন, আমরা ওই জঙ্গলে ঢুকতে পারব না। কিছুদিন আগেই আমাদের একজন কনস্টেবল খুন হয়েছেন ওই ডাকাতদের হাতে। তোমাদের আমরা শহরে পৌঁছে দিচ্ছি।
ওঠা হল আর একটা জিপে। তারপর আরও দু ঘণ্টা পরে সেই জিপ শহরে পৌঁছল। সন্তু-জোজো দুজনেই চিনতে পারল, সেই শহরটা কালিকট।
এই পুলিশের গাড়িটা ওদের নিয়ে এল বড় একটা থানায়। এখনও দুজনের হাত বাঁধা। পাঁচ-ছদিন ধরে একই পোশাক পরে আছে বলে সেগুলো একেবারে ননাংরা হয়ে আছে। মাথার চুলে চিরুনি পড়েনি এই কদিন। ওদের অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
প্রথমে এই থানার একজন পুলিশ ওদের ঘটনা শুনল সংক্ষেপে। তারপর সে নিয়ে গেল বড় অফিসারের ঘরে।
সেখানে অফিসারের সামনে আর একজন লোক বসা। তাকে দেখে সন্তু আর জোজো দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, অমলদা?
অমল দারুণ অবাক হয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, এ কী অবস্থা হয়েছে তোমাদের! আমি হঠাৎ কয়েকদিন ছুটি পেয়ে ভাবলাম এখানে এসে পড়ে তোমাদের চমকে দেব! কিন্তু তোমাদের পাত্তাই পাই না। কোনও হোটেল কিছু বলতে পারে না। শেষকালে একটা হোটেলে গিয়ে শুনলাম, তোমরা সেখানে উঠেছিলে। কিন্তু জিনিসপত্র সব ফেলে রেখে কোথাও উধাও হয়ে গেছ! তারপর এলাম এই থানায়। ইনি মিস্টার রফিক আলম, এঁর কাছে শুনলাম, কাকাবাবু এখানে এসেছিলেন। ভাস্কো দা গামার ভূত দেখার কথা কী যেন বলেছিলেন। আসলে কী হয়েছিল বলো তো?
রফিক আলম বললেন, আহা আগে ওদের বসতে দিন। মুখ শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ জলটলও খায়নি।
জোজো ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে!
এর মধ্যেই থানার সব জায়গায় রটে গেছে যে, বিক্রম ওসমানের খপ্পর থেকে কোনওরকমে পালিয়ে এসেছে দুটি হাত বাঁধা ছেলে। বাঘের মুখ থেকেও কেউ কখনও নিস্তার পেতে পারে, কিন্তু বিক্রম ওসমানের গ্রাস থেকে কেউ এমনি এমনি ছাড়া পেয়েছে, এটা আগে কক্ষনও শোনা যায়নি।
অনেকে ভিড় করে দেখতে এল ওদের। যেন দারুণ দুই বীরপুরুষ। একজন একটা ছুরি এনে ওদের হাতের বাঁধন কেটে দিল।
জোজো দারুণ জমিয়ে ঘটনাটা বলতে শুরু করল।
সন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, অমলদা, সবটা বলতে অনেক সময় লাগবে। আসল কথা হল, কাকাবাবু এখনও ওদের ওখানে রয়ে গেছেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য আমাদের এক্ষুনি ওখানে ফিরে যাওয়ার দরকার।
অমল বলল, এই তো আলমসাহেব রয়েছেন। ইনি নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন।
আলমসাহেব আস্তে আস্তে দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, আমরা কী সাহায্য করব? ওই জঙ্গল আমার থানার এলাকার মধ্যে পড়ে না। এখান থেকে অনেক দূরে।
অমল বলল, সে কী মশাই! একজন মানুষ এত বিপদে পড়েছে শুনেও আপনারা কোনও সাহায্য করবেন না? এটাই তো পুলিশের কাজ।
আলম বললেন, বিক্রম ওসমানের দলের বিরুদ্ধে পুলিশ অনেকবার অনেক অভিযান চালিয়েও কিছু করতে পারেনি। ওরা জঙ্গলের ঘাঁতঘোঁত সব জানে। জঙ্গলে ঢুকলে ওদের গুলিতেই পুলিশ মারা পড়ে।
সন্তু বলল, তার মানে কী, কাকাবাবু ওদের কাছেই আটকে থাকবেন? ওরা যদি…
আলম বললেন, বিক্রম ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলে বড় বড় কর্তাদের, এমনকী চিফ মিনিস্টারেরও অনুমতি লাগে। আমি হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠাব, তারপর দেখা যাক ওঁরা কী বলেন। দু-তিনদিনের আগে কিছু হবে না।
সন্তু আঁতকে উঠে বলল, দু-তিনদিন! তার মধ্যে কত কিছু ঘটে যেতে পারে!
আলম চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, আমার আর তো কিছু করার নেই!
সন্তুদের দিকে চেয়ে অমল বলল, চলো, এখন আমরা হোটেলে যাই। তোমাদের একটু বিশ্রাম দরকার। এক্ষুনি তো কিছু করা যাচ্ছে না। ভেবেচিন্তে একটা কিছু উপায় বার করতে হবে।
জোজো এর মধ্যেই ঘুমে ঢুলে পড়ছিল। তাকে টেনে তোলা হল।
ওরা ফিরে এল আগেকার হোটেলে। কাকাবাবুদের সব জিনিসপত্র বার করে নিয়ে সে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। আর একটা বড় ঘর অবশ্য পাওয়া গেল।
অমল বলল, তোমরা স্নানটান করে পোশাক পালটে নাও, ততক্ষণে আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।
জোজো স্নান করতে গেল, সন্তু বসে রইল মুখ নিচু করে। অমল ফিরে এসে দেখল, সন্তু একই ভাবে বসে আছে।
অমল বলল, আগে কিছু খেয়ে নাও সন্তু। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।
সন্তু বলল, আমি কিছু খাব না। কাকাবাবু ওদের হাতে আটকা পড়ে আছেন। আমরা রয়েছি এখানে, এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।
অমল বলল, বিক্রম ওসমানের খবর প্রায়ই কাগজে বেরোয়। সাঙ্ঘাতিক লোক। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও ওদের ধরতে পারেনি। এত বড় জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যে কখন লুকিয়ে থাকে!
সন্তু বলল, ওরা আমাদের দূরে পাঠিয়ে দিল কেন? নিশ্চয়ই এবার কাকাবাবুর ওপর অত্যাচার করবে।
জোজো বলল, পুলিশ যদি ধরতে না পারে, তা হলে মিলিটারি লাগাতে হবে। যদি পাঁচশোজন আর্মি একসঙ্গে জঙ্গলটা সার্চ করে
অমল বলল, আর্মি তো ভারত সরকারের। এখানকার পুলিশ তো কোনও সাহায্যই করতে চাইল না। আমাদের কথায় তো আর্মি নামবে না। একটা উপায় বার করা যেতে পারে। পুরো ঘটনাটা আগে আমাকে বলো তো!
জোজো মহা উৎসাহে বলতে শুরু করল! সন্তু মাঝে মাঝে তাকে থামিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্ত করতে লাগল অনেকটা।
সব শুনে অমল বলল, অনেক বড় বড় বিপদ থেকে কাকাবাবু বেরিয়ে আসেন, সেইজন্য আমাদের খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। আবার এটাও ঠিক, বিক্রম ওসমানের মতন হিংস্র লোকের পাল্লায় তো কাকাবাবু আগে পড়েননি! একটা কাজ করা যেতে পারে, বড় বড় খবরের কাগজে খবরটা ছাপিয়ে দিলে সরকারের টনক নড়বে। মুম্বইয়ের কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমার চেনা আছে। তাদের আমি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।
সন্তু বলল, কাকাবাবু কিন্তু খবরের কাগজ-টাগজে নিজের নাম ছাপা পছন্দ করেন না।
অমল বলল, কাকাবাবু পছন্দ না করলে কী হবে, এইটাই একমাত্র উপায়। কাগজে বেরুলে পুলিশ অ্যাকশন নিতে বাধ্য হবে।
জোজো বলল, আরে সন্তু, বুঝতে পারছিস না! এটা পাবলিসিটির যুগ! কাগজে বেরলেই কাজ হবে।
অমল টেলিফোনের কাছে বসল। কিন্তু এখান থেকে মুম্বইয়ের লাইন পাওয়া মুশকিল। বারবার চেষ্টা করেও বিরক্ত হয়ে অমল টেলিফোনটা একবার বেশ জোরে রেখে দিতেই দরজায় ঠক ঠক শব্দ হল।
দরজাটা খোলার পর সন্তু যাকে দেখল, তাকে একেবারেই আশা করেনি। সন্তু অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
পুলিশ অফিসার রফিক আলম। মুখোনা গম্ভীর। তিনি ভেতরে এসে বললেন, আমি কোনও খারাপ খবরও আনিনি, ভাল খবরও আনিনি। পুলিশ হিসেবেও আসিনি। আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।
অমল বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন, বসুন!
আলম বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরীকে বিক্রম ওসমান ধরে রেখেছে শুনেও আমি কোনও সাহায্য করতে পারব না বলেছি। তা শুনে নিশ্চয়ই আপনারা আমাকে খুব বাজে লোক ভেবেছেন। সত্যিই বিশ্বাস করুন, একাজ আমার এক্তিয়ারের বাইরে। আমাদের থানার কোনও ক্ষমতা নেই।
অমল বলল, কিন্তু রাজা রায়চৌধুরী এই কালিকটেই ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আপনারা তাঁর খোঁজ করার দায়িত্ব নেবেন না কেন?
আলম বললেন, ওই যে মোহন সিং না কে, ফিলমের লোক, সে যদি ধরে রাখত, তা হলে আমি নিশ্চয়ই পুলিশ পার্টি পাঠাতাম। কিন্তু বিক্রম ওসমানকে নিয়ে এখানকার দু-তিনটে রাজ্য ব্যতিব্যস্ত। সে মুখ্যমন্ত্রীদেরও হুমকি দেয়। সাধারণ পুলিশ তার চুলও ছুঁতে পারবে না!
সন্তু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, বাঃ! সে যাকে-তাকে ধরে রাখবে, আর পুলিশ কিছুই করবে না, এমন কথা কখনও শুনিনি!
আলম সন্তুর চোখের দিকে কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি খুব তেজি ছেলে! আমি এখানে কেন এসেছি, সেটা বলি?
অমল বলল, হ্যাঁ, বলুন, বলুন!
আলম সন্তুর দিকেই তাকিয়ে থেকে বললেন, বিক্রম ওসমানের ডেরাটা তুমি চিনিয়ে দিতে পারবে? আমি একা সেখানে যেতে চাই। বিক্রম ওসমানের সঙ্গে আমার নিজস্ব একটা ব্যাপার আছে।
অমল অবাক হয়ে বলল, আপনি একা যাবেন?
আলম বললেন, হ্যাঁ। থানায় কিছু বলিনি। কারণ, আমার ধারণা, প্রত্যেক থানাতেই ওই লোকটার কিছু গুপ্তচর আছে। কিছু পুলিশকে ও নিয়মিত টাকা দেয়। আমরা যখনই কোনও অ্যাকশন নেওয়ার কথা ঠিক করি, তখনই কেউ না কেউ আগে থেকে ওকে খবরটা পৌঁছে দেয়। সেইজন্য ওকে ধরা যায় না।
অমল বলল, কিন্তু আপনি একা গিয়ে কী করবেন?
আলম বললেন, আমি একবার তার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। তারপর যা হওয়ার তা হবে। তোমরা কি আমাকে জায়গাটা চিনিয়ে দিতে পারবে?
জোজো বলল, সে নাকি বারবার জায়গা বদলায়। পুলিশ এসেছে শুনেই তো আগের জায়গাটা ছাড়তে হল। সেই পুলিশ কারা?
আলম বললেন, তা আমি জানি না। ওরকম অনেক খেলা চলে। আগের জায়গাটা দেখিয়ে দিলেই চলবে। ও নিশ্চয়ই ওখানে আবার ফিরে আসবে।
জোজো বলল, আমাদের চোখ বেঁধে এনেছিল। জঙ্গলের রাস্তাটা তো আমরা চিনতে পারব না।
সন্তু বলল, যেখানে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে গেলে নিশ্চয়ই ঘোড়া চলার পথের একটা চিহ্ন পাওয়া যাবে। অনেক গাছের ডালপালা ভেঙেছে।
আলম সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে? তুমি শুধু দূর থেকে আমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দেবে। তারপর আর তোমাকে থাকতে হবে না।
সন্তু বলল, নিশ্চয়ই! চলুন, কখন যাবেন?
আলম বললেন, সন্ধে হয়ে গেছে। এখন যাত্রা করে কোনও লাভ নেই। কাল ভোরের আলো ফুটতেনা-ফুটতেই—
অমল বলল, সন্তু একা যাবে নাকি? আমিও যেতে চাই। এরকম অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ তো জীবনে পাব না। তাতে যদি আমার প্রাণটা চলে যায়, কুছ পরোয়া নেই!
জোজো বলল, আর আমি বুঝি একা একা এই হোটেলে বসে থাকব? তা হলে পরে সন্তু আমায় ভীরু, কাপুরুষ, কাওয়ার্ড কত কী বলবে। কাকাবাবু আর কখনও আমাকে সঙ্গে নেবেন না। আমিও যাব!