১০. কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা

১০.

কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপর কর্নেলের হাসি শোনা গেল। শর্মা যেন হাসি- শুনেই খেপে গেলেন। গর্জন করে উঠলেন সুনীথ ব্যানার্জি! অশনি দাশগুপ্ত এবং রুবি চ্যাটার্জিকে হত্যার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হল।

সুনীথ পালটা চেঁচিয়ে উঠল-ডোন্ট টক অ্যাবসার্ড! যা-তা বলবেন না–আমি খুনী নই।

কর্নেল ওর কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বললেন–আহা সুনীথবাবু! উত্তেজিত হয়ে কোন লাভ নেই। আইনের কাজ আইন করবে।

দুজন অফিসার সুনীথের কলার খামচে ধরলেন দুদিক থেকে। সুনীথ বলল–ছাড়ুন। আমি যাচ্ছি।

শর্মা কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন কর্নেল সরকার এবং তাঁর তরুণ বন্ধুটিকেও থানায় যেতে হবে। আবার স্টেটমেন্ট দরকার হয়ে পড়ল।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বলল–অবশ্যই। এস জয়ন্ত।

 শর্মা হুকুম দিলেন–এঁদের আলাদা গড়িতে থানায় নিয়ে চলুন।

 বাইরে করিডোরে জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল–অভ্র ছেলেটা সব ফাঁস করেছে।

কর্নেল চোখের ইশারায় বললেন–চুপ!..

নিজে লাউঞ্জে কর্নেল সঙ্গের অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন–একটুখানি ফোন করতে চাই মিঃ….

ক্ষমা করবেন স্যার। নিষেধ আছে। স্টেটমেন্ট দেওয়ার পর যা খুশি করতে পারেন। তার আগে কিছু না।

হেসে জয়ন্তকে বললেন–চল জয়ন্ত। আগে বিবৃতিটা ঝটপট সেরে দিয়ে আসি….

আলাদা একটা প্রাইভেট গাড়িতে দুজনকে তোলা হল এবং সুনীথকে নিয়ে প্রিজনভ্যান আগে আগে চলল। সবে সন্ধ্যা হয়েছে। রাস্তায় সবাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। মোহনপুরে এমন চমকপ্রদ ঘটনা কখনও ঘটেনি।….।

থানায় বসে থাকতে থাকতে মিঃ শর্মা দলবল নিয়ে এসে পড়লেন। প্রথমে জয়ন্তকে ডেকে নিয়ে যওয়া হল পাশের ঘরে।

নাম ধাম পেশা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব দিতে হল। তারপর মিঃ শর্মা প্রশ্ন করলেন–হোটেল নন্দনে সুনীথ ব্যানার্জির ঘরে আপনারা গেলেন কেন?

জয়ন্ত একটু ভেবে নিয়ে বলল–আমি আমার যাওয়ার কারণটা বলতে পারি।

—বেশ, তাই বলুন।

—কর্নেল ডাকলেন, তাই গেলুম। এছাড়া আমার যাওয়ার কোন কারণ ছিল না।

মিঃ শর্মা একটু চটে গেলেন। বললেন কাবাডিয়াদের কারখানায় কেন গিয়েছিলেন?

-কর্নেল নিয়ে গেলেন, তাই।

আরও চটে মিঃ শর্মা বললেন–আপনার কোন উদ্দেশ্য ছিল না?

–না। কর্নেল বললেন, তাই গেলুম।

–কিন্তু আপনি ওদের বলেছেন, খবরের কাগজ থেকে এসেছেন প্রডাকশান সম্পর্কে তথ্য জানতে। আপনার পরিচিতিপত্র দেখিয়ে ঢোকার সুযোগ করেছেন!

–সেটা নিশ্চয় বে-আইনি কিছু নয়। আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার এতে কি আপনার সন্দেহ আছে মিঃ শর্মা? তাহলে এই দেখুন আমার আইডেন্টিটি কার্ড!…বলে জয়ন্ত তার বুক-পকেটে হাত ভরল। সেই সঙ্গে আবার বলল-ও-সিকে আমাদের কর্তৃপক্ষের লেখা চিঠির কপিও আছে সঙ্গে। ওসিকেও জিগ্যেস করুন।

ও-সি ভদ্রলোক রোগা টিঙটিঙে লোক। খাড়া লম্বা নাক। নাকের ডগায় নস্যির ছোপ। নাকিস্বরে বললেন–দ্যাটস রাইট, মিঃ শর্মা।

মিঃ শৰ্মা নরম হয়ে গেলেন। আপোষের সুরে বললেন বেশ জয়ন্তবাবু, আপনার এক কলিগের হত্যাকাণ্ডে আপনার সহযোগিতা আমরা আশা করতে পারি। সে জন্যেই আপনাকে গুটিকতক প্রশ্ন করব।

–অবশ্যই। কী প্রশ্ন করবেন, করুন না।

কর্নেলের সঙ্গে সুনীথবাবুর কী কথা হচ্ছিল?

–সেটা ওঁদেরই জিগ্যেস করুন। আমি কান দিইনি।

–মিঃ শর্মা দমে গেলেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন–সুনীথবাবুর মুখে দীপঙ্কর সেন বলে কোন নাম শুনেছেন কি জয়ন্তবাবু?

জয়ন্ত গোঁ ধরে বলল–আমি একেবারে কাই দিইনি। অন্য কথা ভাবছিলুম।

কী কথা?

যা মনে আসছিল।

 –হোপলেস মশাই! এ আপনার অসহযোগী মনোভাব?

কী মুশকিল! যা জানিনে, তা কেমন করে বলব?…বলে জয়ন্ত একটু ঝুঁকে গেল। চাপা গলায় বলল–কেন? অশনির স্লিপে লেখা কথাগুলো আপনার কাছে ওবেলা উল্লেখ করিনি? স্লিপটা আপনাকে দিইনি? এবার বলুন, কোথায় আমার অসহযোগী মনোভাব দেখছেন তাহলে?

মিঃ শর্মা একটু হেসে বললেন ঠিক আছে। বুঝতে পারছি, কর্নেল আপনার শিক্ষাগুরু। আপনি ওঁর আদেশেই চলেছেন। তখন যে সিপটা দিলেন, সত্যি বলতে কী–তা আমাদের এতটুকু কাজে লাগেনি। ফ্রি ও নিশ্চয় কর্নেলের পরামর্শে আমাদের ভুল পথে চালানোর জন্যে দিয়েছিলেন।

জয়ন্ত বলল–মোটেও না। নিজের বুদ্ধিতেই ওটা দিয়েছিলুম।

–অশনিবাবুর স্লিপে নতুন কোন তথ্য মেলেনি।

–তাহলে আমি কী করতে পারি বলুন?

 মিঃ শর্মা গুম হয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবার পর বললেন ঠিক আছে। আপনি পাশের ঘরে যান। অনুগ্রহ করে আপনার কর্নেল সায়েবকে আসতে বলুন।

জয়ন্ত চলে গেল। দেখল, কর্নেল চোখ বুজে একা বসে অনবরত টাক চুলকোচ্ছেন। জয়ন্ত বলল কর্নেল মিঃ শৰ্মা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কর্নেল ঘরে ঢুকে বললেন–গুডনাইট মিঃ শর্মা। গুড নাইট জেন্টলমেন।

মিঃ শর্মা বললেন বসুন কর্নেল সরকার।

কর্নেল বসলেন। মিঃ শর্মার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন–প্রশ্ন করুন।

কাবাডিয়া-লাখোটিয়া কারখানায় গেলেন কেন? এবারও নিশ্চয় পাখির খোঁজে নয়?

না। স্রেফ অনুসন্ধিৎসা।

 কী সম্পর্কে?

–ওঁদের প্রডাকশান!

 –আপনি সেখানে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ঢুকেছিলেন!

কর্নেল প্রতিবাদের সুরে বললেন–মোটেও না মিঃ শর্মা! স্ট্যানলি ডেভিস আমার পেননেম। ওই নামে আমি বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখি। দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। লনডন টাইমসের সম্পাদকের চিঠিও দেখাতে পারি।

কী বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন?

—সব বিষয়ে। অপরাধতত্ত্ব, পক্ষীতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব কী নয় বলুন?

কাবাডিয়াদের প্রকশান নিয়েও লিখতে চেয়েছেন এবার? বলে মিঃ শর্মা জোরে হেসে উঠলেন।

কর্নেল সিরিয়াস হয়ে বললেন–অবশ্যই। পশ্চিমী প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাচ্যদেশীয় ফসল সম্পর্কে আমার আগ্রহ আছে। কাবাডিয়ারা ইলেকট্রনিকস্ উৎপাদন করেন এবং পশ্চিমেই রফতানি করেন। ভারতের এ অগ্রগতি বিস্ময়কর নয় কি? এবং এই রফতানির ফলে উৎপাদনকারীর আত্মবিশ্বাস কী ভাবে বাড়ছে–এটা আধুনিক উন্নতিশীল দেশের হিউম্যান সাইকলজির ক্ষেত্রে নতুন ব্যাপার। আমি যন্ত্রসভ্যতা ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখতে চেয়েছি। তাই…

মিঃ শর্মা আরও জোরে হাসলেন। আপনার খ্যাতির কারণ এবার বুঝতে পেরেছি। যাক গে, কর্নেল সরকার, হোটেল নন্দনে সুনাথবাবুর সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল বলুন?

–উনি কলকাতা সদর দফতরে থাকেন। টোটাল এক্সপোর্ট সম্পর্কে….

 বাধা দিয়ে মিঃ শর্মা ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন–ওঃ! কর্নেল সরকার। আমি ও ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করিনি! রুবি চ্যাটার্জি এবং গার্গী সম্পর্কে কী কথা হয়েছে, বলবেন কি?

–কে রুবি চ্যাটার্জি? গার্গীই বা কে?

 মিঃ শর্মা সাবধান হলেন। বললেন–চেনেন না?

–ওদের সত্যিই আমি চিনিনে।

নামও শোনেননি?

–শুনেছি।

কার কাছে?

–আপনার কাছে।

 ক্ষুব্ধ মিঃ শর্মা দ্রুত একশিট সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন–আপনি নিজের হাতে কারখানা এবং হোটেলে যাওয়ার ব্যাপারটা লিখে সই করে দিন।

কর্নেল মৃদু হেসে লিখতে শুরু করলেন। কয়েক লাইন লেখার পর নাম সই করে কাগজটা মিঃ শর্মার দিকে এগিয়ে দিলেন।

মিঃ শর্মা কাগজটায় চোখ বুলিয়ে চমকে উঠলেন। এ কী লিখেছেন কর্নেল সরকার?

অফিসাররা সবাই ঝুঁকে পড়লেন কাগজের দিকে। কাগজে লেখা আছে? মোহনপুরে একটি মোটর গ্যারেজের মালিক চমনলাল হাতির ঘরে প্রচুর গাঁজা চরস আফিং মজুত রয়েছে। যারা এইসব মাদকদ্রব্য সম্পর্কে আগ্রহী, তারা তৎপর হোন। বিলম্বে হতাশ হবেন।….

মিঃ শর্মা খেপে গিয়ে বললেন কর্নেল সরকার, আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। এরকম রসিকতার অর্থ কী? চমনলাল ধার্মিক মানুষ। আপনার চেয়ে বয়স বেশি। অজস্র জনহিতকর কাজ করেছেন মোহনপুরে। কত জায়গায় মন্দির গড়ে দিয়েছেন। চিরকুমার এক সাধুসন্তের মতো মানুষ সম্পর্কে আপনার এই কলঙ্ক রটনা আমাদের ভুল পথে চালানোর অপচেষ্টা মাত্র। চমনলালজীর বিরুদ্ধে এতটুকু কোন অভিযোগ আমাদের রেকর্ডে নেই।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–ওটা একটা তথ্য। আপনি আসলে কিছু তথ্য আদায় করতে চেয়েছেন আমার কাছে–যে তথ্য এই হত্যারহস্যের চাবিকাঠি বলে আপনার বিশ্বাস। আপনার আরও বিশ্বাস যে, আমি সেই তথ্য যেভাবে হোক, জানি। তাই স্টেটমেন্টের ছলে আমাকে জানাতে বাধ্য করেছেন এখানে। যাই হোক, তথ্য গোপন করা আইনত অপরাধ। তাই তথ্য আপনাদের দিলুম এবং আমার স্টেটমেন্টের বদলে এটাই আপনার খুবই কাজে লাগবে মিঃ শর্মা। আচ্ছা, চলি। আবার দেখা হবে!…

বলে কাঁধ ঝুঁকিয়ে বাও করে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। ওঁরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।…

.

থানা থেকে বেরিয়ে কর্নেল ও জয়ন্ত রিকশা করল। সত্যভবনের দিকে চলল। পথে জয়ন্ত বলল–মিঃ শর্মা নিশ্চয় কোথাও জোর আটকে গেছেন। তাই আপনাকে নিয়ে ওঁর মাথাব্যথা।

কর্নেল বললেন–তুমি ঠিকই ধরেছ, জয়ন্ত। তবে এবার ওঁদের হাতে শেষ চাবিটি দিয়ে এলুম। এর পরও যদি ওঁরা অভ্র আর সুনীথকে নিয়ে পড়ে থাকেন, বুঝব শর্মার ঘিলু বিলকুল ফেঁসে গেছে।

–আমার বড্ড রাগ হচ্ছে কর্নেল। সুনীথকে কথার মাঝখানে এসে অ্যারেস্ট করে ফেললেন ওঁরা, বাকি ব্যাপারটা জানা গেল না। একটু পরে আসতে পারতেন শর্মা!

কর্নেল হাসলেন। রুবির বিছানার তলায় যেসব কাগজপত্র পেয়েছে, তার সূত্র ধরেই ওঁরা সুনীথকে পাকড়াও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকড়াও ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল আমার জন্য।

-কীভাবে বলুন তো?

–নিশ্চয় আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়েছিল।

জয়ন্ত শিউরে উঠে পিছনটা দেখতে দেখতে বলল বলেন কী! তাহলে এখনও নিশ্চয় ফলো করা হচ্ছে?

হতেও পারে। তবে আমরা এখন সত্যভবনে ফিরছি।

আলোর টিপপরা নিচু উপত্যকা বাঁদিকে রেখে রিকশা ঘুরল পশ্চিমে। এবার চড়াই। রিকশোওলা নেমে রিকশার হ্যান্ডেল ধরে ঠেলতে থাকল। তখন কর্নেল বললেন–এখানেই নেমে পড়া যাক্, জয়ন্ত।

রিকশোওলা ব্যস্তভাবে বলল–নেহী সাব। ঠিকসে বইঠকে রহিয়ে। হাম হুছ দেগা। হরদম তো এহি রাস্তাপর আতা ঔর যাতা! ইয়ে হামরা প্রেকটিস হো গেয়া!

কর্নেল মানিব্যাগ বের করে বললেন–রোখো ভেইয়া। ভাড়া সত্যভবনকে যেতনা হ্যায়, দে দেতা। তকলিফকা ক্যা জরুরত?

রিকশাওলা খুশি হল। দুজনে নামলেন। বখশিস-সহ ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে থাকলেন। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টে আলো আছে। জনহীন রাস্তা। মাঝে মাঝে একটা করে গাড়ি বা ট্রাক আসছে যাচ্ছে। ছড়ানো-ছিটানো বাংলো ধাঁচের বাড়ি দুধারে। গাছপালা ঝোঁপঝাড় প্রচুর। একখানে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন– পোড়োবাংলোর ভূত দেখতে ঢুকবে নাকি জয়ন্ত?

জয়ন্ত বলল–ওরে বাবা! প্রাণ থাকতে নয়।

তাহলে তুমি সত্যভবনে গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করো। আমি আসছি।

–সে কী? ..বলে জয়ন্ত পিছন দিকটা দেখে নিল। ফের বলল-ওখানে ঢুকবেন এবং নিশ্চয় পুলিশ নজর রেখেছে, গিয়ে আপনাকে পাকড়াও করবে।

কর্নেল হেসে বললেন–যে দুজন লোক সাইকেল চেপে পিছনে আসছিল– ওই দেখ, তারা ফিরে যাচ্ছে। আমরা সত্যভবনে যাচ্ছি দেখেই ফলো করার দরকার মনে করল না।

উঁচু জায়গা থেকে নিচে বাঁকের দিকে দুজন সাইকেল আরোহীকে দেখা যাচ্ছিল। ওরা এদিকে আর ঘুরল না। বাঁকে উঁচু পাথরটার আড়ালে মিলিয়ে গেল।

দেখে নিয়ে জয়ন্ত বলল–তাহলে ভুতুড়ে বাংলোয় সত্যি ঢুকতে চান? কী হবে ঢুকে? পুলিশ তো সব সূত্র ঝেটিয়ে নিয়ে চলে গেছে।

কর্নেল বললেন–আসতে চাও তো এস, সময় নষ্ট করো না।

অগত্যা জয়ন্ত ওঁর সঙ্গ ধরল। গেট খুলে কর্নেল যেন ইচ্ছে করেই জুতোর আওয়াজ দিয়ে হাঁটতে থাকলেন। রাস্তার আলো আবছাভাবে পড়েছিল জংলা লনে। বারান্দায় অন্ধকার। শুকনো পাতায় ফের আওয়াজ উঠল হাঁটার। কর্নেল হাসলেন। তারপর অকারণ গলা চড়িয়ে বললেন-জয়ন্ত, যদি সত্যি, ভূতটুত থাকে এখানে, ভয় পেও না। ভূতের পিছনে দৌড়ে যেও না। ভূতের কাজ ভূত করুক, আমাদের কাজ আমরা করব।

বারান্দার পুবদিক ঘুরে উত্তরে গেলেন দুজনে। তারপর পকেট থেকে টর্চ বের করলেন কর্নেল। জ্বেলে দরজাটা দেখে নিলেন। সম্ভবত গুলশই নতুন তালা এঁটে দিয়েছে। কর্নেল বললেন, হুম! একটা অনুমান ভুল হল। ভূত ভদ্রলোক তালাটা ভাঙেনি দেখছি। অথচ ভেঙে ঢোকাই উচিত ছিল।

কর্নেল বারান্দার মেঝে আলো ফেলে হাঁটু দুমড়ে বসলেন এবং কিছু দেখতে। থাকলেন গভীর মনোযোগে। তারপর বারান্দা ধরে পশ্চিমে এগোলেন একই ভঙ্গিতে। জয়ন্ত অস্ফুট স্বরে বলল–কী ব্যাপার?

হঠাৎ কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–হ্যাঁ, এই জানালা দিয়েই ভূত ঢুকেছে।

খড়খড়ি ধরে এক টান দিতেই খুলে গেল। টর্চের আলোয় দেখে কর্নেল বললে–অনেক মেহনত করতে হয়েছে ভূতকে। তিনটে মরচে ধরা রড কেটে ঢুকতে হয়েছে। না ঢুকে উপায় ছিল না। রাক্ষসের মতো ভূতেরও প্রাণভোমরা আছে কি না! দৈবাৎ সেই প্রাণভোমরা এই পোড়োবাংলোয় সাত তাড়াতাড়ি ফেলে যেতে হয়েছিল।

জয়ন্ত হাঁ করে শুনছিল। বলল–আপনি সুস্থ তো? জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন মনে হচ্ছে।

কর্নেল ওকে ইশারায় থামতে বলে কান পেতে কী যেন শুনলেন। তারপর টর্চ নিভিয়ে আচমকা জয়ন্তকে ধরে হ্যাঁচকা টানে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও বসে পড়লেন। অমনি মাথার ওপর দিয়ে আওয়াজ হল হিস্।

কর্নেল সাবধানে জয়ন্তকে টেনে একটু তফাতে সরে গেলে শুকনো পাতার আওয়াজ হল। সঙ্গে সঙ্গে আবার হিস্ শব্দ।

কর্নেল আবার জুতোর আওয়াজ দিলেন। দৌড়ে গেলে যেমন আওয়াজ ওঠে, ঠিক তেমনি। পরক্ষণে ফের হিস্ শব্দ শোনা গেল।

কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন–পালাবার পথ নেই ব্রাদার!

অমনি আবার হিস্ শব্দ। একটু বিরতি। তারপর জানালা গলিয়ে কেউ ধুড়মুড় করে পড়ল। কর্নেল একলাফে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। লোকটা মেঝেয় পড়ে গেল। ধস্তাধস্তি হতে থাকল। তখন জয়ন্তও এসে তলার লোকটাকে ধরে ফেলল।

কর্নেল তার হাঁটুর চাপ ওর বুকে রেখে টর্চ জ্বেলে মুখটা একবার দেখে নিলেন। তারপর বললেন–পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমার হাতে রিভলভার। আছে দেখতে পাচ্ছেন তো? যদিও আপনার মতো সাইলেন্সার লাগানো নেই। জয়ন্ত, আমার টর্চ নাও।

জয়ন্ত দেখল, কখন কর্নেল রিভলভার বের করেছেন। সে টর্চটা নিয়ে বলল–আমি ছেড়ে দিলে এ ব্যাটা গুলির ভয় করবে বলে মনে হয় না কর্নেল। অতএব ছাড়ব না।

ওর কথায় কান না দিয়ে কর্নেল লোকটার কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করালেন। কর্নেলের বিপুল ওজনের চাপে লোকটা ইতিমধ্যে ঘায়েল হয়েছিল। কর্নেল বললেন–ওর রিভলভারটা সাবধানে রুমালে মুড়ে তুলে নাও, জয়ন্ত। ওই দেখ, থামের কাছে পড়ে রয়েছে। অশনিবাবুকে ওটা দিয়েই খুন করা হয়েছে।

জয়ন্ত রিভলভারটা সেইভাবে তুলে নিল। তারপর বলল–এ ব্যাটাকে দেখে তো বড়সায়েব গোছের কেউ বলে মনে হচ্ছে।

কর্নেল হাসলেন শুধু। তারপর কলার ধরে টেনে লোকটাকে বললেন– আসুন। না না। আমিই সেই প্রখ্যাত বুড়ো ঘুঘু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার হাত থেকে কেউ আজ পর্যন্ত পালাতে পারেনি। অতএব সে চেষ্টা করবেন না। এ বুড়োর হাড় অনেকগুলো যুদ্ধের আঁচ খেয়ে আরও মজবুত হয়েছে। সেটুকু আশাকরি টের পেয়ে গেছেন। অতএব ভাল ছেলের মতো সঙ্গে আসুন।….

গেটের বাইরে গিয়ে জয়ন্ত বলল–এ তাহলে সেই দীপঙ্কর সেন?

কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। না। তাকে আমরা যথাস্থানে যথাসময়ে পেয়ে যাব। আপাতত জয়ন্ত, আমি একে নিয়ে যাচ্ছি সত্যভবনে। তুমি এগিয়ে গিয়ে ওখান থেকে প্রথমে পুলিশ সুপার মুকেশ সিংকে, তারপর ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার মিঃ শর্মাকে ফোন করো। বলো, হত্যাকারীকে নিয়ে প্রখ্যাত বুড়ো ঘুঘু তাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।…

সত্যভবনে এসে মিঃ শর্মা হাঁ করে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন– দীপঙ্কর সেন। তাই না? একে কীভাবে খুঁজে পেলেন?

কর্নেল বললেন–না মিঃ শর্মা। ইতিপূর্বে শ্রীমান জয়ন্তও তাই ভেবেছে। ইনি দীপঙ্কর সেন নন, তা প্রথমেই এঁর বয়স দেখে আন্দাজ করা উচিত ছিল ইনি। পঞ্চাশোত্তর এবং দীপঙ্কর সেন–যে কিনা গার্গী বা রুবির মতো তরুণীর প্রণয় ভিখারী, সে নিশ্চয় এখনও যুবক পদবাচ্য।

তবে কে এই ভদ্রলোক?

–অশনি ও রুবির হত্যাকারী। এবং দীপঙ্কর সেনেরই গুরু। দীপঙ্কর সেনকে আমরা আগামীকাল কলকাতার ডক এরিয়ায় পেয়ে যাব যথা সময়ে। আপনি এখান থেকে গিয়ে রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে দিন কলকাতায়। লালবাজারে জানান : আগামীকাল সন্ধ্যায় দীপঙ্কর সেন নামে দয়াময়ী ট্রেডিংস-এর সাব এজেন্ট ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে প্যাকিংয়ের কাজ তদারক করবেন। আগে থেকে ওৎ পেতে থাকলে হাতেনাতে ধরা যাবে! খুব সাবধানে কাজটা করা চাই।

মিঃ শর্মা বিরস মুখে বললেন–হুম। কিন্তু এ ভদ্রলোক?

দয়াময়ী ট্রেডিংস-এর প্রোপ্রাইটার রবীন মৈত্র!

 –হোয়াট! লাফিয়ে উঠলেন মিঃ শর্মা। তারপর ফের বললেন ইমপসিবল।

 –কী ইমপসিবল মিঃ শর্মা?

–উনি কীভাবে এবং কেন খুন করলেন অশনিবাবু বা…।

–এক মিনিট, মিঃ শর্মা। কর্নেল শান্তভাবে বললেন। ..এই রুমালে জড়ানো অটোমেটিক সাইলেন্সর লাগানো রিভলভারটা ফোরেন্সিকে পাঠান। এতে ছটা গুলি থাকে। দুটো অশনিবাবুর দেহে নিশ্চয় পেয়েছেন। বাকি চারটে একটু আগে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরে ভদ্রলোককে মিছেমিছি খরচ করাতে পেরেছি। আগের রাতে ঢুকতে সাহস করেননি বাংলোয়। সুনীথকে দূর থেকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছিলেন এবং সুনীথের সঙ্গে অভ্র ছিল। তাই সে রাতে আর চেষ্টা করেননি।

–হুম! বুঝলুম। কিন্তু এখন উনি পোডবাংলোয় ঢুকেছেন, কীভাবে জানলেন?

–দূর থেকে একটু আলো জানলার ফাঁকে দেখেছিলুম। আজ দুপুরে রুবির লাশ আবিষ্কারের সময় স্ট্রিকনিনের একটা শিশি পেয়েছিলুম খাটের তলায়। অর্ধেকটা ব্যবহার করা। সেটা লুকিয়ে ফেলেছিলুম সঙ্গে সঙ্গে! শিশির গায়ের লেবেলে ছিল কলকাতার সতীশ ফার্মাসিউটিকালস্-এর নাম। স্ট্রিকনিন নিষিদ্ধ ড্রাগ। শুধু বড় বড় ল্যাবরেটরিতে সাপ্লাই করার নিয়ম আছে। কলকাতার দয়াময়ী ট্রেডিংস-এর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে জেনেছিলুম–ওদের ওই ওষুধের কারবারও আছে। সতীশ মৈত্র রবীনবাবুর বাবার নাম। ওটাই ওদের অরিজিনাল কারবার। এই হল এক নম্বর সূত্র। দুনম্বর সূত্রও পেয়েছিলুম। একটা দলাপাকানো কাগজ। কাগজটা খুলে দেখি, কলকাতায় সুনীথবাবু রবীন মৈত্রকে দিতে রুবিকে যে ফক চিঠি লেখেন, ওটা সেটাই। অমনি সব পরিষ্কার হয়ে যায়। চিঠিটা যদি দীপঙ্করের চেলারা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে– রবীন মৈত্রের হাতে গেল কীভাবে?

শর্মা বললেন–কেন? দীপঙ্করই বিষ যোগাড় করতে পারত মৈত্রদের দোকান থেকে। চিঠিটা দীপঙ্কর ফেলেনি, তাই বা কীভাবে জানলেন?

কর্নেল বললেন বলছি। সুনীথ ভুল দেখেছিল। মৈত্রের গুপ্ত অস্তিত্ব টেরই পায়নি। এদিকে দীপঙ্কর গার্গীর সঙ্গে বটতলায় গিয়ে আচমকা অশনির আবির্ভাব এবং তার খুন হয়ে যাওয়ায় ভড়কে গিয়েছিল। সে গার্গীকে চমনলালের ধর্মশালায় রেখে তক্ষুনি চম্পট দেয়। কারণ স্বয়ং কর্তার আবির্ভাবে সে বুঝতে পেরেছিল, তার কাজ শেষ। রবীন মৈত্রের নির্দেশেই আসলে সে মোহনপুরে এসেছিল গার্গীকে নিয়ে। সুনীথ ভেবেছিল, রবীন তার হিতৈষী বন্ধু। তাই তাকে জানিয়ে ভুল করেছিল সে। গার্গীও মারা পড়ত। দীপঙ্কর চলে যাবার পর ডবল ক্রসের ফঁদটা গার্গী টের পায়। তারপর প্রাণের ভয়ে দিশেহারা হয়ে এক পরিচিত বন্ধুর বাড়ি আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে রেল কলোনিতে বাবার বন্ধু জগমোহনের কাছে যায়। তারপর বাবার সঙ্গে কলকাতা চলে গেছে। গার্গীর বাবা একসময় এখানে ছিলেন। অনেকেই এখানে তার চেনা।

–তাহলে রুবি কার সঙ্গে মদ খেল পোডড়া বাংলোয়?

–এই রবীন মৈত্রের সঙ্গে। নির্বোধ মেয়ে বলা যায়। গেল দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে, পেল স্বয়ং মৈত্রকে। মৈত্র নিশ্চয় জেরা করে বা যেভাবে হোক ওর পেট থেকে কথা আদায় করে ফেলল। তাই না মৈত্রসায়েব?

রবীন মৈত্র লাল চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না।

-খুব সরল মেয়ে রুবি। নিশ্চয় চিঠি ছিনতাই প্রসঙ্গ তুলেছিল। পার্টি ছেড়ে হঠাৎ মোহনপুরে কেন এল মৈত্র, সেসব নিয়েও প্রশ্ন করেছিল। তারপর ঘুঘু মৈত্র টের পায় সব। রুবির ধারণা হয়েছিল, মৈত্র সুনীথের হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু। এবং সুনীথকে ব্ল্যাকমেলারের হাত থেকে বাঁচতে সেও সাহায্য করছে। তাই সব। বলে ফেলেছিল। তখন কোন ছলে মৈত্র ওর সঙ্গে পোড়ো বাংলোয় গিয়ে মদ খেতে প্ররোচিত করে এবং যে বিষ গার্গীকে হত্যার জন্যে এনেছিল, তা রুবিকে দেয়। পরে সুনীথ এসে রুবির মৃতদেহ আবিষ্কার করে। অক্ষম ক্রোধে ফুলে ওঠে। বেরিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। সেই সময় তারকবাবুকে দেখতে পায়। সঙ্গে এক যুবক। অভ্র। অভ্রকে সে পুলিশের গোয়েন্দা ভেবে বসে! সে তাকে পোড়ো বাংলোয় নিয়ে গিয়ে কেটে পড়ে–যাতে শিগগির মৃতদেহটা পুলিশের নজরে পড়ে এবং কিনারা হয়। নয়তো ওই পোড়ো বাংলোয় মৃতদেহের খবর জানতে বিস্তর দেরি হত। কে যেত ওখানে? সুনীথই বা কোন মুখে পুলিশের কাছে যাবে? যেতে হলে তার উপস্থিতির হাজার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে নিজের এ ব্যাপারে জড়িত থাকার তথ্যও ফাস হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই নয় কি?

মিঃ শর্মা বললেন–অদ্ভুত কেস! ডাবলক্রস যাকে বলে।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন–একজাক্টলি ডাবল ক্রস। সুনীথ মৈত্রের সাহায্য নিল–অথচ মৈত্রই সব কাজের গোড়া। একেই বলে, ভূতের ভয়ে চড়লুম গাছে ভূত বলে পেলুম কাছে! অফ কোর্স একটা বাঙালি প্রবাদ।…

.

দুদিন পরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ইলিয়ট রোডে তার ফ্ল্যাটে বসে চন্দনপুর-অন-সিতে তোলা ফোটোর সঙ্গে একটা প্রকাণ্ড বইয়ের পাতা খুলে বিবরণ মেলাচ্ছেন এবং জয়ন্ত চৌধুরী সোফায় হেলান দিয়ে কফি খাচ্ছে, ষষ্ঠীচরণ এসে বলল–একটি মেয়ে দেখা করতে চায়।

কর্নেল বললেন নিয়ে আয়। জয়ন্ত, গার্গী রায় সম্ভবত।

জয়ন্ত সোজা হয়ে বসল। একটু পরে গার্গী চুকল। নমস্কার করে বলল আপনি আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন কাল। আমি ছিলুম না।

কর্নেল বললেন–বস গার্গী। ইয়ে, তুমি বলছি কিছু মনে করো না।

না না। আমি আপনার মেয়ের মতো।

–তোমার বাবা ফার্স্ট জুন এসেছিলেন আমার কাছে। আমার দুর্ভাগ্য, ছিলুম না। তাহলে অন্তত রুবিকে বাঁচাতে পারতুম। যাক্ গে, তোমার কাছে গিয়েছিলুম বিশেষ দরকারে, জাস্ট একটা কথা জানতে।

বলুন।

–যে সই-বিহীন চিঠিটা তোমার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল, ওটা কি তোমার ভাই দীপুর?

গার্গী হাসল। হ্যাঁ। কীভাবে জানলেন?

কাল তোমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তাই মনে হল।

–আমি ফিরে আসার পর দীপু ব্যাপারটা জানাল। কী দুষ্টু ছেলে! ওটা সে লিখেছিল কদিন আগে। পরীক্ষার রেজাল্ট সম্পর্কে ভয় ছিল তো? মতলব ছিল, চিঠিটা লিখে কদিন বেপাত্তা হয়ে কাটোয়ায় পিসির বাড়ি কাটাবে। রেজাল্ট বেরুলে সব দেখে তখন ফিরবে।

কর্নেল শুধু হাসলেন। জয়ন্ত বলল–আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন না কর্নেল!

–সরি। গার্গী, ইনি জয়ন্ত চৌধুরী…

–ওঁকে চিনি। অশনি একদিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।

 জয়ন্ত জিভ কেটে বলল–ও হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলুম।

গার্গী বলল কর্নেল, দয়াময়ীর চাকরি ছেড়ে দিয়েছি ফিরে এসে।

কর্নেল বললেন–ভাল করেছ। সুনীথকে বলেছি, তোমার একটা ব্যবস্থা ওখানেই হয়ে যাবে।

গার্গী একটু রাঙা হল। তারপর বলল–সুনীথ এখন তো ওর স্ত্রীর ব্যাপারে বড় বিব্রত। এ কেসে ভোরাও জড়িয়ে পড়ার ভয় করছে। ওর মানসিক অবস্থা ভাল নয়।

কর্নেল বললেন–আমি চেষ্টা করেছি, যাতে ভোরা রাজসাক্ষী হয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারে। দীপঙ্কর আর মৈত্র তো আসামী। ওদের কথার মূল্য আইনত গ্রাহ্য হবে না। সেই যা বাঁচোয়া। তাছাড়া ভোরার ব্যাপারে নিউজপেপার কাটিং ইত্যাদি সব দীপঙ্করের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। চেষ্টা করছি, যাতে ওগুলো আদালতে না ওঠে। ভোরা তো বর্তমান কেসে কোনভাবে জড়িত নয়। যা অভিযোগ ওঠার–তা ওর অতীত এবং বিদেশের কার্যকলাপ নিয়ে।

সে সময় ফোন বাজল। কর্নেল ফোন ধরে বললেন–হ্যালো! কর্নেল সরকার বলছি। কে? কী ব্যাপার?…সে কী? খুব দুঃখিত মিঃ গুপ্ত! …ঠিক আছে। যাবখন রাখছি।

জয়ন্ত বলল, কী ব্যাপার?

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিষণ্ণভাবে বললেন, লালবাজার থেকে মিঃ গুপ্ত জানালেন, আজ ভোরে সুনীত ব্যানার্জির স্ত্রী তোরা সুইসাইড করেছে।

গার্গী ও জয়ন্ত চমকে উঠে পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর গার্গী বলল, আমি আসি কর্নেল! মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। বেচারি ভোরা শেষে সুইসাইড করে ফেলল!

কর্নেল বললেন, গার্গী! আমার মনে হচ্ছে, সুনীতের কাছে তোমার এখনই যাওয়া দরকার। ওর পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেবার মতো আর তো কেউ নেই।

গার্গী চলে গেল।

কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বললেন, এক আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্রের সম্ভবত শেষ স্থানীয় অনুচরটি পৃথিবী থেকে সরে গেল। মৈত্র বা দীপঙ্কর ঠিক মাফিয়া দলের লোক নয়। ওরা একটা সাধারণ পৃথক গোষ্ঠী। জয়ন্ত! এবার আমার অন্তত এটুকু সান্ত্বনা যে, গার্গী তার তিন প্রেমিকের মধ্যে খাঁটি একজনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে। তবে হ্যাঁ–এ জন্য তিনটি মানুষকে জীবন দিতে হল!…