১০. কাটুস্কা ঘর থেকে বের হতে গিয়ে

কাটুস্কা ঘর থেকে বের হতে গিয়ে থেমে গেল, তার বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। এ রকম সময় কখনো তার বাবা বাসায় থাকে না, আজকে বাসায় আছে কেন কে জানে। সে বাবার ঘরে উঁকি দিল, বাবা টেবিলের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, বসার ভঙ্গিটা কেমন যেন বিষণ্ণ। কাটুঙ্কা মৃদু গলায় ডাকল, বাবা।

রিওন মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, কে, কাটুস্কা?

হ্যাঁ, বাবা।

কী খবর, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

নগরকেন্দ্রে, বাবা। আজকে নূতন কনসার্ট এসেছে, তার সঙ্গে নূতন জলনৃত্য।

জলনৃত্য?

হ্যাঁ, বাবা। বিজ্ঞাপন দেখ নি? নূতন এক ধরনের জলজ প্রাণীর খেলা, খুব নাকি উত্তেজনাপূর্ণ।

রিওনকে হঠাৎ কেমন জানি ক্লান্ত দেখায়। কাটুস্কা দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, বাবা, তোমার শরীর ভালো আছে?

হ্যাঁ, মা। আমার শরীর ভালো আছে।

তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

হ্যাঁ। আমি আসলে একটু ক্লান্ত।

কেন, বাবা, তুমি তো কখনো ক্লান্ত হও না। এখন কেন ক্লান্ত হয়েছ?

রিওন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি না কেন। হঠাৎ করে কেন জানি ক্লান্তি লাগছে। সবকিছু নিয়ে এক ধরনের ক্লান্তি। গলার স্বর পাল্টে রিওন বলল, বুঝলি কাটুস্কা, পৃথিবীটা খুব জটিল। মনে হয় এখানে বেঁচে থাকাটা আরো জটিল।

কাটুস্কা একটু অবাক হয়ে বলল, কেন, বাবা? তুমি এ রকম কথা কেন বলছ?

জীবনটা ঠিক করে চালিয়েছি কি না মাঝে মাঝে খুব সন্দেহ হয়। সবকিছু ঠিক করে করার পরও কোথায় কোথায় জানি গোলমাল হয়ে যায়।

কাটুস্কা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রিওন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাটুস্কা।

কী বাবা।

আজকের কনসার্টে তোমার কি যেতেই হবে?

কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, তুমি একথা কেন জিজ্ঞেস করছ?

না গেলে হয় না?

তুমি তো কখনো আমাকে কিছু করতে নিষেধ কর না। আজকে কেন নিষেধ করছ?

রিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে-

কী মনে হচ্ছে?

রিওন হঠাৎ করে থেমে গেল, বলল, না, কিছু না।

বল বাবা-, কাটুস্কা বলল, কী বলতে চাইছিলে, বল।

না কিছু না। তুমি যেখানে যাচ্ছিলে যাও। উপভোগ করে এস।

কাটুস্কা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। তার ভেতরে কী যেন খচখচ করছে, ঠিক কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা কোথাও যেন ভুল হয়ে গেছে, কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে কেউ সেটা ধরতে পারছে না।

.

নগরকেন্দ্রে কমবয়সী ছেলেমেয়েরা এসে ভিড় করেছে। কাটুস্কা তার বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে বের করল। এক কোনায় দলবেঁধে দাঁড়িয়ে হইচই করছিল, কাটুস্কাকে দেখে সবাই হইচই করে উঠল। মাজুর বলল, কী খবর, কাটুস্কা, তোমার মুখ এত গম্ভীর কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কনসার্ট শুনতে আস নি, তুমি বুঝি কারো মৃত্যুসভায় এসেছ!

খুব মজার একটা কথা বলেছে এ রকম ভঙ্গি করে সবাই হিহি করে হাসতে থাকে। কাটুস্কা বলল, কনসার্ট এখনো শুরু হয় নি। যখন শুরু হবে তখন হয়তো এটাকে শোকসভার মতোই মনে হবে।

দ্রীমান মুখ গভীর করে বলল, না না। তুমি কী বলছ, কাটুস্কা? আমরা কত ইউনিট খরচ করে টিকিট করেছি দেখেছ? এতগুলো ইউনিট নিয়ে ভালো কিছু দেখাবেই।

সবাই স্টেজের দিকে তাকাল, সেখানে বিশাল একটা অ্যাকুরিয়াম, তার ভেতর ভয়ঙ্করদর্শন দুটি হাঙর মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঙিন আলোতে পুরো অ্যাকুরিয়ামটি আলোকিত, পুরো অ্যাকুরিয়ামটিকে একটা অলৌকিক প্রেক্ষাগৃহের মতো মনে হয়।

ক্রানা বুকের মধ্যে আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে বলল, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। কখন শুরু হবে কনসার্ট?

কিছুক্ষণের মাঝেই কনসার্টটা শুরু হয়ে গেল। অ্যাকুরিয়ামটা ঘিরে গায়কেরা মাথা কঁকিয়ে গান গাইতে শুরু করে। তাদের শরীরে লাগানো নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র শরীরের তালের সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র সঙ্গীতের ধ্বনি তৈরি করতে শুরু করেছে। বাতাসে মিষ্টি এক ধরনের গন্ধ, নিশ্চিতভাবেই সেখানে স্নায়ু উত্তেজক এক ধরনের গ্যাস ছাড়া হচ্ছে, যারা উপস্থিত তারা ধীরে ধীরে উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে। সঙ্গীতের তালে তালে তাদের দেহ নড়তে থাকে, মাথা দুলতে থাকে। তারা একজন আরেকজনকে জাপটে ধরে নাচতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে। তারুণ্যের উদ্দাম আনন্দ যেন সব বাধা ভেঙে ফেলবে! এভাবে কতক্ষণ চলেছে কেউ জানে না হঠাৎ করে সকল সঙ্গীত বন্ধ হয়ে যায়। নগরকেন্দ্রের ভেতর কোথাও এতটুকু শব্দ নেই।

সবাই অবাক হয়ে দেখল মঞ্চের ঠিক মাঝখানে স্বল্পবসনা একটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা ঝাঁকিয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সে চিৎকার করে বলল, এখন তোমাদের সামনে আসছে এ সময়ের সবচেয়ে উত্তেজনাময় মুহূর্ত।

সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। মেয়েটি দুই হাত তুলে সবাইকে থামার জন্য ইঙ্গিত করে বলল, স্টেজে এই বিশাল অ্যাকুরিয়ামে রয়েছে দুটি ক্ষুধার্ত হাঙর। গত এক সপ্তাহ তাদের অভুক্ত রাখা হয়েছে। এই অভুক্ত হাঙর দুটির মতো হিংস্র প্রাণী এখন পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তাদের সামনে এখন কোন জীবন্ত প্রাণী এলে এক মুহূর্তে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে এই ক্ষুধার্ত, ক্রুদ্ধ এবং হিংস্র হাঙর মাছ। তোমরা কেউ কি এই দুটি হাঙর মাছের মুখোমুখি হতে চাও?

নগরকেন্দ্রের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, না?

আমি জানি তোমরা এই ক্রুদ্ধ, ক্ষুধার্ত এবং হিংস্র হাঙর মাছের সামনে যেতে চাও না। মেয়েটি চিৎকার করে বলল, কিন্তু এই হিংস্র হাঙর মাছের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে একটি জলজ প্রাণী। বিস্ময়কর এক জলপ্রাণী দেখতে অনেকটা মানুষের মতো কিন্তু সেটি মানুষ নয়। এই হাঙর মাছের মতোই হিংস্র এই জলজ প্রাণী মানুষের মতো দেখতে এই নির্বোধ, বীভৎস হিংস্র প্রাণীটি কি হাঙর মাছের সামনে টিকে থাকতে পারবে? দুটি হাঙর মাছ কতক্ষণে তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে? তোমাদের ভেতরে কার সাহস আছে সেই দৃশ্য দেখার?

শত শত ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, আমার! আমার সাহস আছে। আমার।

এস। সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই এই ভয়ঙ্কর খেলায়। দেখ, উপভোগ কর! যাদের স্নায় দুর্বল তারা চোখ বন্ধ করে রেখ। তা না হলে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য তোমাদের দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাড়া করে বেড়াবে! ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে তোমরা জেগে উঠবে প্রতি রাতে। তাই সাবধান!

বিকট এক ধরনের যন্ত্রসঙ্গীত বাজতে থাকে, মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আসে, শুধু দেখা যায় বিশাল অ্যাকুরিয়ামে ভয়ঙ্করদর্শন দুটি হাঙর মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মঞ্চের এক কোনায় একটা স্পটলাইট এসে পড়ল এবং সবাই দেখল সেখানে বিচিত্র একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তিটির শরীরটুকু ছোপ ছোপ রঙিন, মুখে ভয়ঙ্করদর্শন একটি মুখোশ, সেই মুখোশে কৃর এক ধরনের দৃষ্টি। মূর্তিটির দুই হাত শেকল দিয়ে বাধা, সুগঠিত পেশিবহুল শরীর। কোমর থেকে ছোট এক টুকরো কাপড় ঝুলছে, এ ছাড়া শরীরে কোনো পোশাক নেই।

মূর্তিটি দেখে কাটুস্কা চমকে ওঠে। কয়দিন আগে তার সঙ্গে দেখা হওয়া জলমানবটির কথা তার মনে পড়ে যায়। তার শরীরও ছিল পেশিবহুল সুগঠিত, সে ছিল অসম্ভব সুদর্শন। এর মুখটি মুখোশ দিয়ে ঢাকা, এই মুখোশের আড়ালে যে মুখটি লুকিয়ে আছে সেটি কি নিহন নামের সেই তরুণটির? কিন্তু সেটা তো হতে পারে না। তার বাবার সঙ্গে কথা বলে কাটুস্কা তো নিহন নামের সেই সুদর্শন জলমানবটিকে হেলিকপ্টারে করে তার এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। এটি নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্রাণী। অন্য কোনো জলমানব।

নগরকেন্দ্রের শত শত ছেলেমেয়ে চিৎকার করতে থাকে, হত্যা কর। হত্যা কর। হত্যা কর

কাটুস্কা অবাক হয়ে দেখে, মনে হয় নগরকেন্দ্রের সবাই বুঝি উন্মাদ হয়ে গেছে। হাত নেড়ে তারা উন্মত্তের মতো চিৎকার করছে, হত্যা কর। হত্যা কর। হত্যা কর

দুই পাশ থেকে দুজন মানুষ এসে মুখোশ পরা মূর্তিটিকে ধরে তার হাতের শেকলটা খুলে দেয়, তারপর তাকে ঠেলে ছোট একটা খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। খাঁচাটাকে একটা ক্রেন দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে তুলে নেয়া হয়, তারপর খুব সাবধানে অ্যাকুরিয়ামের উপর এনে স্থির করা হয়। কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে হঠাৎ করে খাঁচার তলাটুকু খুলে যাবে আর এই মুখোশ পরা মূর্তিটি অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে পড়বে। নগরকেন্দ্রের শত শত ছেলেমেয়ে হঠাৎ চুপ করে যায়। যে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি তারা দেখতে যাচ্ছে তার জন্য সবার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা এসে ভর করেছে। তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়, নিজের অজান্তেই তাদের শরীর শক্ত হয়ে আসে।

মূর্তিটিকে নিয়ে খাঁচাটি অ্যাকুরিয়ামের ওপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গীত দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং হঠাৎ সেটি থেমে যায়। বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হল এবং হঠাৎ করে মূর্তিটির পায়ের নিচে থেকে পাটাতনটি সরে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেটি পানির ভেতরে পড়ে যায়।

সবাই রুদ্ধ নিঃশ্বাসে দেখতে পেল মূর্তিটি পানির নিচে ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এক হাত দিয়ে পায়ে বেঁধে রাখা একটা ছোরা হাতে নিয়ে অন্য হাতে নিজের মুখোশটা খুলে ফেলেছে, কাটুস্কা তখন মূর্তিটি চিনতে পারল, সে যা ভেবেছিল তা-ই! মানুষটি নিহন।

কাটুস্কা চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়, না। না। না।

নগরকেন্দ্রে পিনপতন স্তব্ধতা, তার মধ্যে কাটুস্কার চিৎকার শুনে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল। সবাই দেখল একজন তরুণী না, না, না- বলে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, তারপর শত শত দর্শকের ভেতর দিয়ে স্টেজের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে নিহন তার কিছু জানে না। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাঙর মাই দুটির দিকে। সে জানে হাঙর মাছ দুটি তার উপস্থিতির কথা টের পেয়েছে, তার শরীর থেকে তৈরি হওয়া অতি সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সিগন্যালকে লক্ষ করে এখন হাঙর মাছ দুটি ছুটে আসবে। সমুদ্রের সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী, এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ নয়।

নিহন সাবধানে পিছিয়ে আসে, অ্যাকুরিয়ামের শক্ত প্লেক্সিগ্নাসের দেয়ালের সঙ্গে নিজের শরীরটা লাগিয়ে সে অপেক্ষা করে। পেছনে প্লেক্সিগ্লাসের দেয়াল, হাঙর মাছ ছুটে এসে তাকে আক্রমণ করতে পারবে না, দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকি নেবে না হাঙর মাছ। চেষ্টা করবে ওপর থেকে নিচে তাকে টেনে নিতে। অত্যন্ত দ্রুত তাকে সরে যেতে হবে, এক মুহূর্ত সময় পাবে হাঙরের বুকে ধারালো চাকুটা বসিয়ে দেওয়ার, ঠিক জায়গায় বসাতে পারলে মুহূর্তে তার পুরো তলদেশ দুই ভাগ হয়ে যাবে।

সামনে ভেসে থাকা হাঙর মাছটি আক্রমণ করল। উপস্থিত দর্শকেরা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তীব্র গতিতে একটি হাঙর মাছ ছুটে আসছে-একটা হটোপুটি এবং হঠাৎ করে একটা রক্তের ধারা। পানিটুকু লাল হয়ে গেছে, সবাই নিশ্চিত হয়ে ছিল যে মূর্তিটির শরীরের একটা অংশ খাবলে নিয়ে গেছে এই হাঙর মাছ। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখল, মূর্তিটি অক্ষত হয়ে ভেসে আছে, হাঙর মাছটির বুক থেকে নিচের পুরো অংশটুকু দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। রক্তের একটি ধারা ছড়াতে ছড়াতে হাঙর মাছটি নিচে নেমে যাচ্ছে।

উপস্থিত শত শত ছেলেমেয়ের বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি বের হয়ে আসে। নিজের অজান্তেই তারা আনন্দধ্বনি করে ওঠে। এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তারা সামনে তাকিয়ে থাকে। বিশাল অ্যাকুরিয়ামে একজন তরুণ পানির নিচে নিঃশ্বাস না নিয়ে দীর্ঘ সময় ডুবে আছে, সেটিও তারা ভুলে যায়। নিজের অজান্তেই তাদের মনে হতে থাকে এই বিস্ময়কর তরুণটির অসাধ্য কিছু নেই।

কাটুস্কা চিৎকার করতে করতে স্টেজের দিকে ছুটে যেতে থাকে, কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী তাকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কাটুস্কা একটা ঝটকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে সে স্টেজের দিকে ছুটে যেতে থাকে। সবাই সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, দেখে, পানির নিচে ডুবে থাকা বিচিত্র মানুষটি আবার প্লেক্সিগ্লাসের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দ্বিতীয় হাঙর মাছটির জন্য অপেক্ষা করছে। একটু আগে যে মূর্তিটির উদ্দেশে সবাই চিৎকার করে বলেছে হত্যা কর, হত্যা কর, হত্যা কর হঠাৎ করে সবার ভালবাসা সেই মানুষটির জন্য। সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে এই বিস্ময়কর তরুণটি কখন দ্বিতীয় হাঙর মাছটিকেও তার বুক থেকে নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলবে।

হাঙর মাছটি তার লেজ ঝাপটা দিয়ে ঘুরে যায়, তারপর তীব্র গতিতে ছুটে আসতে থাকে নিহনের দিকে। একটা হুটোপুটি হয়, কে কী করছে বোঝা যায় না। হাঙর মাছটি ঘুরে যায়, যেখানে মানুষটি ছিল সেখানে সে নেই। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখে হাঙরের পিঠে সে চেপে বসেছে হাতের ধারালো চাকু দিয়ে মাছটির মাথায় আঘাত করছে। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা বইছে-আর ছটফট করতে করতে হাঙর মাছটি অ্যাকুরিয়ামের তলদেশে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

নিহন এবার হাঙর মাছটিকে ছেড়ে পানির ওপর ভেসে ওঠে। বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নেয়। হলঘরে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে চিৎকার করছে, তার মাঝে সে অবাক হয়ে দেখল একজন তরুণী অ্যাকুরিয়ামের ওপর উঠে এসেছে। নিহন তরুণীটিকে চিনতে পারে, তরুণীটি কাটুস্কা। এই তরুণীটি তাকে মুক্ত করে দিতে চেয়েছিল।

নিহন অবাক হয়ে দেখে, মেয়েটি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চিৎকার করতে করতে নিহনকে জাপটে ধরে তাকে টেনে উপরে তুলতে চেষ্টা করছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু মানুষের চিৎকারে সে কী বলছে, শোনা যাচ্ছে না। কাটুস্কাকে ঘিরে অনেক নিরাপত্তাকর্মী, তাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করছে, পারছে না।

নিহন পানি থেকে বের হয়ে আসে, এক হাতে কাটুঙ্কাকে জাপটে ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। অন্য হাতে ধারালো চাকুটা ধরে রেখে সে শান্ত গলায় নিরাপত্তাকর্মীদের বলল, সবাই সরে যাও।

নিরাপত্তাকর্মীরা কাটুস্কাকে ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথে সরে গেল। চোখের কোনা দিয়ে সবাইকে লক্ষ করতে করতে নিহন কাটুস্কার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল, ভালো আছ, কাটুঙ্কা।

কাটুস্কা হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। নিহনকে আঁকড়ে ধরে বলে, আমি বুঝি নি, তোমাকে এভাবে এখানে আনবে। আমি বুঝি নি। আমি দুঃখিত, নিহন। আমি খুব দুঃখিত।

তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই, কাটুস্কা। আমি জানি কী হয়েছে?

 নিহন দেখতে পায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের ঘিরে ফেলছে। নিহন শান্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এক হাতে শক্ত করে কাটুঙ্কাকে ধরে রেখেছে অন্য হাতে ধারালো একটা চাকু। থরথর করে কাঁপছে কাটুস্কা। মেয়েটি আকুল হয়ে কাঁদছে। কেন কাঁদছে নিহন জানে না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, সে মেয়েটিকে এদের হাত থেকে রক্ষা করবে।