কাঁচা রাস্তা দিয়ে জিপটা এগিয়ে যাচ্ছে, নিশীতার মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে বুঝি জিপটা উল্টে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যাবে। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, জিপের হেডলাইটের। আলোতে অল্প কিছুদূর আলোকিত হয়ে তার চারপাশে অন্ধকার যেন আরো এক শ গুণ গাঢ় করে ফেলা হচ্ছে। তারা কোথায় যাচ্ছে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়–অনেক চেষ্টা করেও নিশীতার সেলুলার টেলিফোনে এপসিলনের কথা শোনা যায় নি, তাই আপাতত রাহেলার বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। মহাজাগতিক প্রাণীকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যকবার দেখা গেছে এই এলাকাতেই। কাছাকাছি একটা জলা জায়গা রয়েছে, রিয়াজের ধারণা তার আশপাশেই মহাজাগতিক প্রাণীটি তার আস্তানা তৈরি করেছে।
জিপের মাঝে চারজন নিঃশব্দে বসে আছে, সবার ভিতরেই একটি বিচিত্র অনুভূতি। কী হবে তার অনিশ্চয়তার সাথে সাথে এক ধরনের অস্বাভাবিক অশরীরী আতঙ্ক। শুধুমাত্র রাহেলার বুকের মাঝে কোনো আতঙ্ক নেই, তার বুক খালি করে শিশুটিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে তার সকল বোধশক্তি অসাড় হয়ে গেছে–তার বুকের মাঝে এখন শুধু এক ভয়াবহ শূন্যতা।
জিপটি উঁচু-নিচু সড়ক দিয়ে একটা ভাঙা মসজিদের পাশে এসে দাঁড়াল, এখন কোনদিক দিয়ে যেতে হবে ক্যাপ্টেন মারুফ সেটা যখন বের করার চেষ্টা করছে ঠিক তখন নিশীতার সেলুলার টেলিফোনটি বেজে উঠল নিশীতা দ্রুত কানে লাগাল, হ্যাঁলো।
নিশীতা?
হ্যাঁ।
এইমাত্র একটা হেলিকপ্টার আকাশে উঠেছে। তোমরা কী করছ ফ্রেন্ড লিস্টার তার খবর পেয়েছে। হেলিকপ্টারটা তোমাদের থামানোর চেষ্টা করবে।
কীভাবে থামানোর চেষ্টা করবে?
দুটো রিকয়েললেস রাইফেল আছে। মনে হয় গুলি করে তোমাদের জিপটা উড়িয়ে দেবে।
সর্বনাশ! আমরা তা হলে এখন কী করব?
সেটা তো জানি না।
নিশীতা আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই খুট করে লাইন কেটে গেল।
রাস্তার ওপর একটা বড় গর্তকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কে ফোন করেছে? কী বলেছে?
এপসিলন বলেছে একটা হেলিকপ্টার আসছে আমাদের গুলি করতে।
নিশীতার কথা শেষ হবার আগেই ক্যাপ্টেন মারুফ জিপটাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সবাই নেমে যান।
কোনো কথা না বলে সবাই নেমে পড়ে। জিপের পিছন থেকে নিশীতা আর রিয়াজের ব্যাকপ্যাক দুটো সাবধানে নামিয়ে নেওয়ার পর ক্যাপ্টেন মারুফ বলল, আপনারা রাস্তার ওপর থেকে সরে যান।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, আপনি?
আমিও আসছি। জিপটাকে চালিয়ে রেখে নেমে পড়তে হবে যেন বুঝতে না পারে জিপে কেউ নেই। তা না হলে আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
ঠিক আছে। সাবধানে থাকবেন।
ক্যাপ্টেন মারুফ জিপটা চালিয়ে সামনের দিকে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই অন্যরা দূরে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেল। নিশীতা আর রিয়াজ তাদের ব্যাকপ্যাক দুটো ঘাড়ে তুলে নিয়ে দ্রুত রাস্তা থেকে নিচে নেমে দূরে ঝোঁপঝাড়ের দিকে সরে গেল।
কিছুক্ষণের মাঝেই মূর্তিমান ধ্বংসের মতো তাদের মাথার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারটি দূরে জিপের দিকে এগিয়ে যায়। নিশীতার বুক ধকধক করতে থাকে, গ্রামের কাঁচা সড়ক দিয়ে জিপটি তখনো হোঁচট খেতে খেতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, জিপ থেকে ক্যাপ্টেন মারুফ নেমে গেছে কি না কেউ বুঝতে পারছে না। দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টার থেকে একটা মিসাইল উড়ে গেল জিপের দিকে এবং কিছু বোঝার আগে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো জিপটি ছিন্নভিন্ন হয়ে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল–তারা যদি সময়মতো জিপ থেকে নেমে না পড়ত তা হলে এতক্ষণে তাদের কী অবস্থা হত চিন্তা করে নিশীতা আতঙ্কে শিউরে ওঠে।
রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলল, ক্যাপ্টেন মারুফ সময়মতো নামতে পেরেছে তো?
না নেমে থাকলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে চিন্তাটুকু জোর করে মন থেকে দূর করে সরিয়ে দিয়ে নিশীতা বলল, নিশ্চয়ই পেরেছে।
তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টারটি আবার ঘুরে জ্বলন্ত জিপের কাছে এগিয়ে এসে নিছ হয়ে সেটাকে ঘিরে উড়ে আবার উপরে উঠে দূরে চলে যেতে শুরু করেছে। বেশি দূর না গিয়েই সেটা সামনে কোথায় জানি নেমে পড়ল। রিয়াজ বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, আমার ধারণা হেলিকপ্টারটি যেখানে নেমেছে আমাদেরকেও সেখানে যেতে হবে।
হেলিকপ্টারে করে ফ্রেন্ড লিস্টার মহাজাগতিক প্রাণীটির আস্তানায় গিয়েছে?
ঠিক আস্তানা না হলেও আস্তানার খুব কাছাকাছি।
আমরা কি এখানে ক্যাপ্টেন মারুফের জন্য অপেক্ষা করব নাকি সামনে এগিয়ে যাব?
সামনে এগুতে থাকি। রিয়াজ ব্যাকপ্যাক থেকে তার নাইটভিশন গগলস বের করে দূরে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ঐ তো ক্যাপ্টেন মারুফকে দেখতে পাচ্ছি–এই দিকেই আসছেন।
নিশীতা খুব খুশি হয়ে বলল, যাক বাবা, যা ভয় পেয়েছিলাম!
রাহেলা এই দীর্ঘ সময় একটি কথাও বলে নি, এই প্রথমবার সে শান্ত গলায় বলল, আল্লাহ মেহেরবান।
ক্যাপ্টেন মারুফ চলে আসার পর চারজনের ছোট দলটি আবার অগ্রসর হতে থাকে। কোন দিকে যেতে হবে সেটি রিয়াজ বলে দিতে থাকে। সে একটা ছোট যন্ত্র তার বুকে ঝুলিয়ে নেয় সেখান থেকে একটা হেডফোন বের হয়ে আসছে। দূরে কোথাও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির কিছু তরঙ্গ থেকে সে তার গন্তব্যস্থান বের করে নিতে পারছে। তারা হেঁটে হেঁটে একটার পর একটা গ্রাম পার হয়ে যেতে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম থেকে সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে–এলাকাগুলো একেবারে প্রেতপুরীর মতো নির্জন। কোথাও কোনো জীবন্ত প্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই, মনে হচ্ছে ঝিঁঝি পোকা পর্যন্ত ডাকতে ভুলে গেছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চারজন পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে, তাদের মনে হতে থাকে তারা বুঝি কোনো অশরীরী জগতে চলে এসেছে।
রিয়াজের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা উঁচু জায়গায় উঠে এল। জায়গাটা বড় বড় গাছ দিয়ে আড়াল করা। সেই জংগলের মতো জায়গাটা থেকে বের হতেই তাদের হৃৎস্পন্দন হঠাৎ করে থেমে যায়। তাদের সামনে হঠাৎ করে যে দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠল নিজের চোখে না দেখলে তারা কখনো সেটা বিশ্বাস করত না।
সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের বিশ ফুট উঁচুতে একেবারে নিঃশব্দে একটি মহাকাশযান দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশযানটির সাথে পৃথিবীর কোনো কিছুর মিল নেই। মহাকাশযানটি থেকে কোনো আলো বের হচ্ছে না তবু সেটি দেখা যাচ্ছে, খুব ভালো করে দেখলে মনে হয় এটি বুঝি বিশাল কোনো জীবন্ত প্রাণী; এর সমস্ত শরীরে বিচিত্র এক ধরনের টিউব জালের মতো ছড়িয়ে আছে। সেই স্বচ্ছ টিউব দিয়ে খুব ধীরে ধীরে কিছু গোলাকার জিনিস নড়ছে। মনে হয় পুরো জিনিসটি এক ধরনের আঠালো জিনিসে ডুবে আছে, খুব কান পেতে থাকলে ভিতর থেকে এক ধরনের ভেতা শব্দ শোনা যায়।
মহাকাশযানটির ঠিক নিচে নীল এক ধরনের অশরীরী আলো, সেখানে বিচিত্র কিছু মূর্তি। এই মূর্তিগুলো নিশ্চয়ই এক সময় মানুষ ছিল, মহাজাগতিক প্রাণী এসে তাদের শরীরকে দখল করে নিয়ে ব্যবহার করছে। মানুষগুলো মৃত কিন্তু তাদের দেহ নড়ছে– ব্যাপারটি চিন্তা করলেই সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মানুষগুলোর সবার শরীরই এক রকম। মাথার অংশটি বিচিত্রভাবে ফুলে উঠেছে। সেখান থেকে শুঁড়ের মতো কিলবিলে অংশ বের হয়ে এসেছে, খুব আস্তে আস্তে সেগুলো জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ছে। মানুষগুলোর দেহ একইসাথে যান্ত্রিক এবং জৈবিক। প্রায় পঞ্চাশটি এই ধরনের প্রাণী মহাকাশযানের নিচে খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে। হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় সেখানে বুঝি কোনো এক ধরনের নৃত্যানুষ্ঠান হচ্ছে, এই বিচিত্র প্রাণীগুলোর হাত পা শরীর ড়গুলোর নড়াচড়ার মাঝে এক ধরনের অশরীরী ছন্দ রয়েছে। মনে হচ্ছে তারা বুঝি কোনো প্রেতলোকে চলে এসেছে এবং সেই প্রেতলোকের অশরীরীরা মৃত্যুর অপর পাশে থেকে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পুরো দৃশ্যটি এত অবাস্তব এবং এত অস্বাভাবিক যে তারা চারজন একেবারে পাথরের মতো জমে গেল। দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলতে পারে না–হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সবার আগে সংবিৎ ফিরে পায় রাহেলা, সে চাপা এবং উত্তেজিত গলায় বলে, যাদু! আমার যাদুমণি।
নিশীতা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
ঐ তো। মাঝখানে।
নিশীতা ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেল সত্যিই একেবারে মাঝখানে একটা ছোট পিলারের উপর একটি ছোট শিশু। এত দূর থেকে ভালো করে দেখা যায় না। কিন্তু তবু মনে হয় তার চারপাশের ভয়াবহ ঘূর্তিগুলোর অশরীরী কার্যকলাপের মাঝে শিশুটি নির্বিকারভাবে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে।
রিয়াজ তার পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে বলল, আমরা এখান থেকেই কাজ শুরু করি।
ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কী কাজ?
এই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ।
ক্যাপ্টেন মারুফ চমকে উঠে বলল, আপনি পারবেন?
ফ্রেড লিস্টার যদি পারে তা হলে আমি কেন পারব না? সেই বদমাইশ তো আমার কোডিং ব্যবহার করেই যোগাযোগ করছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় ফ্রেন্ড লিস্টার?
রিয়াজ তার নাইটভিশন গগলসটি ক্যাপ্টেন মারুফকে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে দেখেন, মোটামুটিভাবে ইলেভেন ও ক্লক পজিশন। দু শ মিটার দূরে।
ক্যাপ্টেন মারুফ গগলস চোখে দিয়েই দেখতে পেল অন্যপাশে ফ্রেন্ড লিস্টার এবং আরো কয়েকজন মানুষ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে। সেখানে এক ধরনের ব্যস্ততা। যন্ত্রপাতির মাঝে উবু হয়ে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে তারা কিছু একটা লক্ষ করছে। মানুষগুলোকে দেখে ক্যাপ্টেন মারুফ নিজের ভিতরে এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ অনুভব করে, দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, ধড়িবাজ বদমাইশের দল। আমি যদি তোদের মুণ্ডু ছিঁড়ে না নিই!
রিয়াজ হেসে বলল, মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলার অনেক সময় পাওয়া যাবে, আপাতত আমাকে একটু সাহায্য করুন। এই এ্যান্টেনাটা উঁচু কোনো জায়গায় বসিয়ে দিন।
ক্যাপ্টেন মারুফ গগলসটা খুলে রিয়াজকে সাহায্য করতে করে। কিছুক্ষণের মাঝেই বড় একটা গাছের পিছনে কিছু ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে তাদের যন্ত্রপাতি দাঁড়া হতে থাকে। একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার ছোট আর. এফ. জেনারেটর আর তার কন্ট্রোল সার্কিটের সাথে জুড়ে দেওয়া হল। এ্যান্টেনা থেকে কো–এক্সিয়াল তার এনে কন্ট্রোল সার্কিটের সাথে জুড়ে দেওয়ামাত্রই এমপ্লিফায়ারের সাথে লাগানো দুটি স্পিকার থেকে মানুষের এক ধরনের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল। নিশীতা চমকে উঠে বলল, কে কথা বলছে?
এখনো জানি না। মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে কথা বলার জন্য আমি যে কোডটা তৈরি করেছি এটা সেই কোডের মানবিক অনুবাদ।
মানে?
মানুষেরা যখন একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে তার একটা পদ্ধতি আছে। যে তাষাতেই কথা বলি না কেন তার মূল ব্যাপারটা এক। আমাদের যোগাযোগ মাধ্যমটুকু হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিমত্তা, আমাদের অনুভূতি। কিন্তু এই মহাজাগতিক প্রাণী হচ্ছে অন্যরকম। তারা আমাদের মতো ভাবে না, তাদের যদি অনুভূতি থাকেও সেটা অন্যরকম।
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নেড়ে বলল, আমি বুঝতে পারলাম না।
যেমন মনে করুন আমি আপনার সাথে কথা বলছি–কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কিছু বলে ফেলতে পারি যেটা শুনে আপনি আমার ওপর খুব রেগে উঠতে পারেন। পারেন না?
হ্যাঁ পারি।
কিন্তু ধরা যাক আপনার মস্তিষ্ক অপারেশন করে এমনভাবে আপনাকে পাল্টে দেওয়া হল যে আপনার ভিতরে রাগের অনুভূতিটুকু নেই। তখন কী হবে? আপনাকে আমি যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করতে পারি, আপনি কিছুই মনে করবেন না!
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। তবে কোনো মানুষের রাগ নেই সেটা চিন্তা করা খুব কঠিন, বিশেষ করে আমার পক্ষে!
শুধু রাগ নয়, ধরে নিন তার শুধু যে রাগ নেই তা নয়, তার দুঃখও নেই, আনন্দও নেই, ভালবাসাও নেই, ঘৃণাও নেই, হিংসাও নেই।
তা হলে আছে কী?
মনে করুন তার আছে কোয়াজি ফিলিং।
কোয়াজি ফিলিং সেটা আবার কী?
জানি না। রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, ধরে নেন এমন একটা অনুভূতি যেটা আমাদের নেই, তাই আমরা সেটা বুঝতেও পারি না, কল্পনাও করতে পারি না।
যেটা আপনি জানেন না, যেটা কল্পনা করতে পারেন না সেটা কীভাবে ধরে নেব?
এটাই আমার কোড। এটা যোগাযোগ শুরু করে কিছু তথ্য আদানপ্রদান করে, যেখান থেকে যোগাযোগ করার মতো একটা পর্যায়ে পৌঁছানো যায়। এটা মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ নয়। চতুর্থ পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তার সাথে পঞ্চম পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তার যোগাযোগ।।
নিশীতা এগিয়ে এসে বলল, কিন্তু আপনার যোগাযোগ শুরু করতে তো খুব বেশি সময় নেবে না। তাই না?
না। কারণ ব্যাটা ফ্রেড লিস্টার এই কাজটুকু করে রেখেছে। তাই আমরা এর মাঝে কথা শুনতে শুরু করেছি। এই যে শোন
রিয়াজ এমপ্লিফায়ারের ভলিউম বাড়িয়ে দিতেই সবাই এক ধরনের যান্ত্রিক কথা শুনতে পেল, বিনিময় মূল বিষয় বিনিময় নিষিদ্ধ যোগাযোগ কেন্দ্রীয় বুদ্ধিমত্তা পারস্পরিক বিনিময় মূল শক্তি কেন্দ্রীয় ক্ষমতা শক্তি অপশক্তি
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
এটা ফ্রেন্ড লিস্টারের কথা।
ফ্রেড লিস্টারের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কীলছে আবোলতাবোল?
আসলে সে আবোলতাবোল বলছে না। তার কথা এই মহাজাগতিক প্রাণীর জন্য কোডিং হয়ে যাবার পর আবার আমাদের ভাষায় অনুবাদ করার সময় এ রকম হয়ে যাচ্ছে। রিয়াজ মুখে হাসি এনে বলল, আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড–একটা কথা আছে না?
হ্যাঁ, আছে। কী হয়েছে সেই কথার?
সেটাকে একবার রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে আবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। অনুবাদটি কী হয়েছিল জান?
কী?
ব্লাইন্ড ইডিয়ট। অন্ধ গর্দভ! অন্ধকারে রিয়াজ নিচু স্বরে হাসল, এই ভয়ংকর বিপজ্জনক পরিবেশে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে, তাই প্রয়োজন থেকে বেশি কথা বলছে সে। যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, এখানেও এই ব্যাপার, ফ্রেন্ড লিস্টারের কথা মহাজাগতিক প্রাণীর জন্য কোডিং এবং আনকোডিং করার পর এ রকম জট পাকানো আবোলতাবোল হয়ে যাচ্ছে।
কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না কী বলছে।
কে বলছে বোঝা যাচ্ছে না? শোন আবার
তারা শুনল, বুদ্ধিমত্তা তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম যোগাযোগ কেন্দ্রীয় পারস্পরিক বিনিময় মূল শক্তি বিনিময় ক্ষমতা যোগাযোগ নিষিদ্ধ বিনিময়, পারস্পরিক পাঁচ দুই পাঁচ ছয় তিন সাত পাঁচ ছয় সাত আট…
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সংখ্যাগুলো হচ্ছে পাইয়ের মান–দশমিকের পর দশ হাজার পর্যন্ত। যোগাযোগ করার জন্য এটা ব্যবহার করতে হয়। ফ্রেন্ড লিস্টারের কথায় একটু পরে পরে বলছে বিনিময় পারস্পরিক যোগায়োগ শুনতে পাচ্ছ না?
হ্যাঁ।
তার মানে সে পারস্পরিক বিনিময় করার চেষ্টা করছে। সে কিছু একটা দেবে তার বদলে সে কিছু একটা চায়।
কী দেবে সে?
জানি না।
নিশীতা মনোযোগ দিয়ে স্পিকারের কথাগুলো শুনতে শুনতে বলল, এগুলো যদি ফ্রেড লিস্টারের কথা হয় তা হলে মহাজাগতিক প্রাণীর কথা কোনগুলো?
এখনো শুনতে পাচ্ছি না। আমাকে টিউন করতে হতে পারে।
রিয়াজ তার যন্ত্রপাতি টিউন করতে করতে হঠাৎ চমকে সোজা হয়ে বলল, এই যে শোন।
তারা সবাই শুনল, ভাঙা যান্ত্রিক গলায় কেউ একজন বলছে, নিচু ক্ষুদ্র দুর্বল কম নিচু ক্ষুদ্র ছোট অল্প কম ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর।
কী হল? নিশীতা চোখ বড় বড় করে বলল, গালাগাল করছে নাকি আমাদের?
সেরকমই মনে হচ্ছে। রিয়াজ হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমাদের ফ্রেড লিস্টারের চরিত্রটি ধরে ফেলেছে মনে হচ্ছে।
ফ্রেড লিস্টার আবার বলল, বিনিময় পারস্পরিক বিনিময়।
মহাজাগতিক প্রাণী উত্তর করল, অসম দুর্বল ক্ষুদ্র।
বিনিময় বিনিময় প্রযুক্তি বিনিময়।
দুর্বল ক্ষুদ্র।
বিনিময় শিশু মানব শিশু বিনিময় আমন্ত্রণ মানব শিশু।
রিয়াজ চমকে উঠে বলল, শুনেছ কী বলছে ফ্রেড? সে মানব শিশুকে বিনিময় করতে চাইছে। মানব শিশুর বদলে প্রযুক্তি চাইছে।
নিশীতা হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল বলল, রাহেলা কোথায়?
সবাই উঠে দাঁড়াল, চারপাশে তাকাল, কোথাও রাহেলাকে দেখা যাচ্ছে না। নিশীতা চাপা স্বরে ডাকল, রাহেলা, রাহেলা।
রাহেলা কোনো উত্তর করল না, হঠাৎ রিয়াজ চমকে উঠল, হাত দিয়ে দেখাল, ঐ যে দেখো।
সবাই অবাক হয়ে দেখল রাহেলা সোজা এগিয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের নিচে নীলাভ আলোতে যে অতিপ্রাকৃত জগৎ তৈরি হয়ে আছে সে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে। সেখানে তার শিশু সন্তানকে আটকে রেখেছে–সে তাকে মুক্ত করে আনতে যাচ্ছে।
নিশীতা অবাক হয়ে দেখল রাহেলার মাঝে কোনো আতঙ্ক নেই, কোনো ভয়ভীতি দুর্ভাবনা নেই। কোনো বিভ্রান্তি নেই, দুর্বলতা নেই। সে স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে! কী করতে হবে সে ব্যাপারে সে আশ্চর্যরকম নিশ্চিত, আশ্চর্যরকম আত্মবিশ্বাসী।