১০. কর্ণদেবের কাহিনি
অনেকক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভাঙল বল্লভ, কুসীদজীবী উত্তানপাদের হঠাৎ সুমতি হওয়ার কারণটা এতক্ষণে বুঝালাম।
কর্ণদেব নীরব।
বল্লভ আবার বলল, কিন্তু তোমার সত্য পরিচয় উত্তানপাদকে জানিয়ে ভালো করনি। রাজপুরুষের কাছে সে যদি সব কথা বলে দেয় তবে তুমি বিপদে পড়বে। কর্ণদেব! আজ রাত্রেই যদি সে কভবর্মার কাছে গিয়ে তোমার সত্য পরিচয় জানিয়ে দেয়, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ষীদল এসে তোমাকে বন্দি করবে।
কর্ণদেব হাসল, বল্লভ! পরন্তপের ন্যায় দুর্দান্ত দস্যুর সঙ্গে যে ব্যক্তি দিনের পর দিন অতিবাহিত করে তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে, তাকে নির্বোধ ভাবা উচিত নয়। মনুষ্যচরিত্রে আমার অভিজ্ঞতা আছে। উত্তানপাদ আমার নামে অভিযোগ করতে সাহস পাবে না। বিশ্বাসঘাতকতা করলে পরন্তপের প্রতিহিংসা থেকে রাজশক্তি যে তাকে রক্ষা করতে পারবে না, সেকথা আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া আপনার গৃহে আমি যে রাত্রিযাপন করছি সেই সংবাদও তার জানা নেই। অতএব উত্তানপাদ সম্পর্কে আপনার ভীতি অমূলক।
বল্লভের ভ্রু কুঞ্চিত হল, হঠাৎ সম্বোধনের পরিবর্তন ঘটল কেন?
কর্ণদেব মাথা নত করল, ক্রোধের বশে তুমি বলে অন্যায় করেছিলাম। মার্জনা করবেন।
বল্লভের ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, তোমার প্রস্তাবটা এবার শুনতে চাই। কিন্তু তার আগে জানতে চাই ব্রাহ্মণসন্তান কেমন করে দস্যুর বিশ্বস্ত অনুচরে পরিণত হল।
কর্ণদেব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর মাথা তুলে বাতায়নপথে অন্ধকার আকাশের দিকে দুই চোখের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে গভীরস্বরে আত্মকাহিনি শুরু করল, মহারাজ রুদ্রদমনের রাজ্যে এক ক্ষুদ্র গ্রামে আমার পিতা অধ্যাপনার কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন। আমার জননীও বিবিধ শাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করে পিতার যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠেছিলেন। আমি ছিলাম তাদের একমাত্র সন্তান। সুতরাং পিতা ও মাতা উভয়েই আমার শিক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আমি মেধাবী ছাত্র ছিলাম। মাত্র দশ বৎসর বয়সেই আমি বিভিন্ন শাস্ত্র ও গণিতবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলাম। পিতার আশা ছিল তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও শিক্ষাদানের মহৎ কার্যে ব্রতী হব। কিন্তু মাতার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম– মহারাজ রুদ্রদমনের সভাপণ্ডিত হয়ে রাজসভা অলঙ্কৃত করব, এই ছিল তার বাসনা। আমার নিজস্ব মতামত তখনও গঠিত হয়নি। তবে বিদ্যার্জনের আগ্রহ প্রবল ছিল বলে আমি প্রাণপণে বিভিন্ন শাস্ত্র আয়ত্ত করতে সচেষ্ট ছিলাম। ওইভাবে চললে পরবর্তীকালে আমি পিতার আশা পূর্ণ করতাম, অথবা মাতার সন্তোষবিধানে সমর্থ হতাম বলা কঠিন, কিন্তু অকস্মাৎ এক দুর্ঘটনার ফলে আমরা জীবনের গতি পরিবর্তিত হল। মাত্র তিনদিনের জ্বরে আমার পিতৃদেব দেহত্যাগ করলেন। শিশুপুত্রকে নিয়ে আমার জননী অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন। আশ্রয়গ্রহণ করা যায় এমন কোনো আত্মীয়স্বজন নিকটে ছিল না। আমার মাতুলালয় ছিল কৌশাম্বী রাজ্যে। তাদের সঙ্গে আমার পিতার সদ্ভাব না থাকায় মাতার সঙ্গেও তাঁর ভ্রাতা বা পিতা-মাতার যোগযোগ ছিল না। তথাপি নিরুপায় হয়েই আমাকে নিয়ে মাতা দূর কৌশাম্বী রাজ্যে মাতুলালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে মনস্থ করলেন। সেইসময় গ্রামের শ্রেষ্ঠী গণপৎ মাকে নিষেধ করে জানালেন, পিতার অবর্তমানে তিনিই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। শ্ৰেষ্ঠী একসময়ে পিতার ছাত্র ছিলেন– গুরুপত্নী ও নাবালক গুরুপুত্রের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করলেন। পূর্বেই বলেছি আমার মাতা বিদুষী ছিলেন। পিতার অবর্তমানে মাতা স্বয়ং আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষা সম্পূর্ণ করে রাজসভায় কার্যগ্রহণ করে মাতার দুঃখ দূর করব। কিন্তু বিধি প্রতিকুল— পিতৃবিয়োগের এক বৎসর পরেই অকস্মাৎ দারুণ বিসুচিকা রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার জননী মৃত্যুবরণ করলেন। মাত্র দ্বাদশ বৎসর বয়সেই আমি পিতৃমাতৃহারা অনাথ বালকে পরিণত হলাম। গণপৎ নামে যে-শ্ৰেষ্ঠী আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি আমাকে নানাভাবে প্রবোধ দিয়ে বললেন কর্তব্যে অবহেলা অনুচিত, অতএব আমি যেন বিদ্যাভ্যাসে বিরত না হই। আমি শোক সংবরণ করে পুনরায় অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করতে সচেষ্ট হলাম। নিকটবর্তী এক গ্রামের জনৈক আচার্য আমার প্রতি সহানুভূতি-পরবশ হয়ে আমাকে অধ্যয়নে সাহায্য করতে সম্মত হলেন। কিন্তু ভাগ্য যার প্রতিকূল তার পক্ষে নিশ্চিত জীবনযাপন সম্ভব নয়। হঠাৎ এক রাত্রে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো শ্ৰেষ্ঠী গণপতের প্রাসাদে হানা দিল একদল দস্যু। বেতনভোগী প্রহরীদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে দস্যুদলের অভিযান সম্পূর্ণ সফল হল না, কিন্তু কিছু মূল্যবান রত্নালঙ্কার ও স্বর্ণ লণ্ঠন করে তারা পলায়ন করতে সমর্থ হল। সেই যুদ্ধে দুটি দস্য নিহত হয়েছিল। আমাদের পক্ষেও হতাহত হয়েছিল কয়েকজন প্রহরী। মঘবা নামে অষ্টাদশ বর্ষীয় কিশোর-প্রহরী সেই যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে সকলকে চমৎকৃত করে দিয়েছিল। শ্ৰেষ্ঠী পত্নী সর্বসমক্ষেই বললেন, কেবল পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের কি সার্থকতা আছে? গৃহকর্তার সর্বনাশ উপস্থিত হলেও যে-ব্যক্তি নিশ্চেষ্ট থাকে, তাকে গৃহ হতে দূর করে দেওয়াই কর্তব্য।
স্পষ্টভাবে আমার নাম উল্লেখ না করলেও সকলেই বুঝল আমাকে কটাক্ষ করেই শ্রেষ্ঠীপত্নী ওইকথা বলেছেন।
বিশেষত কিশোর মঘবা যখন আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে সহাস্যে দন্তবিকাশ করল, তখন অতিশয় অপমানিত বোধ করলাম। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম শাস্ত্রের চাইতে শস্ত্রের ক্ষমতা অনেক বেশি। গৃহের দাসদাসী, গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ প্রভৃতি সকলেই মঘবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি বলে অনেকেই আমার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করল। শ্রেষ্ঠী অবশ্য আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু মঘবাকে তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রশংসা জানালেন এবং আমার প্রতি কটাক্ষ করে শ্রেষ্ঠীপত্নীর মন্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করলেন না।
পরের দিন প্রভাতেই আমি গৃহত্যাগ করলাম। কি করব, কোথায় যাব কিছুই স্থির করিনি— লোকালয় ছেড়ে বনপথে ভ্রমণ করতে করতে ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে একসময়ে তৃণশয্যায় লুণ্ঠিত হয়ে পড়লাম। ক্রমশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। বনে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে মনে করে স্থির করলাম একটি বৃক্ষে আরোহণ করে রাত্রি যাপন করব। কিন্তু মনের ইচ্ছা কার্যে পরিণত করার আগেই সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের ন্যায় আমার সম্মুখে আবির্ভূত হল এক প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র! আমি সভয়ে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করলাম। ব্যাঘ্র আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করল। অকস্মাৎ মনুষ্যকণ্ঠের এক তীব্র চিৎকার আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। তাকিয়ে দেখলাম এক দীর্ঘকায় অসিধারী পুরুষ বনপথের উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। হিংস্র শাপদ তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে অসিধারী পুরুষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল এবং ভীষণ গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তরবারির প্রচণ্ড আঘাতে তার গ্রীবা থেকে ছিটকে পড়ল তপ্ত রক্তের ধারা। মরণাহত পশু দারুণ আক্রোশে আবার ঝাঁপ দিল শত্রুর দিকে। আবার ব্যর্থ হল নখদন্তের নিশানা, কিন্তু শাণিত তরবার পুনরায় শ্বাপদের রক্তপান করল। উপর্যুপরি কয়েকবার আঘাতের পর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল নরখাদকের মৃতদেহ। আমি সবিস্ময়ে দেখলাম অসিধারী পুরুষের অসি পর পর তিনবারই অব্যর্থ সন্ধানে স্কন্ধের দুইপাশে আঘাত করে ব্যাঘের মুণ্ডকে প্রায় দেহচ্যুত করে দিয়েছে।
ব্যাঘ্রের হন্তারক এগিয়ে এসে নিহত শ্বাপদের দেহে তরবারি ঘর্ষণ করে অস্ত্র থেকে শোণিতচিহ্ন লুপ্ত করে ফেলল। তারপর নিষ্কলঙ্ক অসি কোষবদ্ধ করে আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হল।
কিছুক্ষণ আমাকে স্থিরদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে ওই ব্যক্তি বলল, বালক! এই অঞ্চলে কোনো মানুষ একাকী ভ্রমণ করে না। নরখাদক ব্যাঘ্ৰ অধ্যুষিত এই অরণ্যে তুমি সন্ধ্যাকালে কেন এসেছ? বোধহয় তোমার পথ ভুল হয়েছ। তুমি কোথায় যেতে চাও?
আগন্তুকের কণ্ঠস্বর গভীর, কিন্তু স্নেহের স্পর্শে কোমল। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম তার ঊর্ধ্ব-অঙ্গে পীতাভ আঙরাখা, নিম্ন-অঙ্গ আগুলফ আচ্ছাদিত যোদ্ধৃসুলভ শ্বেতবস্ত্রে। আবরণের ভিতর থেকেও তার স্কন্ধ ও বক্ষের স্ফীত মাংসপেশী চোখে পড়ে। আবরণ-মুক্ত দুই বাহু দৃঢ় পেশীবদ্ধ এবং শুষ্ক ক্ষত চিহ্নে চিহ্নিত। তীক্ষ্ণ নাসা, পরিপূর্ণ ওষ্ঠাধর, মাংসহীন কঠিন চোয়াল, আর কুঞ্চিত কেশদামের নীচে অপ্রশস্ত ললাটের উপর এক জোড়া রোম জ্বর তলায় জ্বলছে এক জোড়া প্রখর চক্ষু! সব মিলিয়ে মানুষটিকে সুপুরুষ হয়তো বলা যায় না, তবে তার চেহারার মধ্যে যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কোমলে কঠিনে মেশা সেই আশ্চর্য সৌন্দর্যকে অনুভব করা যায়, ভাষায় সাহায্যে ব্যক্ত করা যায় না।
আগন্তুক আবার কোমল-গম্ভীর স্বরে বলল, বালক, ভয় নেই। ব্যাঘ্র নিহত হয়েছে। বলল, তুমি কোথায় যাবে? আমি স্বয়ং তোমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে আসব।
বললাম, জানি না। এই পৃথিবীতে আমার যাওয়ার কোনো স্থান নেই।
আগন্তুকের তীব্র দৃষ্টি তীব্রতর হল, সে প্রশ্ন করল, সে কি! তোমার কি কেউ নেই?
আমি তখন সংক্ষেপে আমার ইতিহাস ব্যক্ত করে বললাম, তুমি আমাকে আশ্রয় দাও! আমি ভোমার কাছে অস্ত্র চালনার শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই।
আগন্তুক সকৌতুকে বলল, বিনিময়ে তুমি আমাকে কি দেবে?
বললাম, আমার আনুগত্য।
মর্মভেদী দৃষ্টি মেলে আগন্তুক আমার চোখের দিকে চাইল। তারপর গভীর স্বরে বলল, বেশ। এই কথাই রইল। যদি শিখতে চাও তবে এমন করেই শেখাব যে, হাতের তরবারি তোমার ইচ্ছাপূরণ করবে আজ্ঞাবাহী ভৃত্যের মতো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে বিনা প্রতিবাদে সর্বদা আমার আদেশ পালন করবে?
বললাম, না, এমন প্রতিজ্ঞা করতে পারব না। কিন্তু শপথ করে বলছি কখনো তোমার বিরুদ্ধাচরণ করব না।
আগন্তুক বলল, তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মুখের গঠনে বোঝা যায় তুমি উচ্চবংশের সন্তান। আশা করি প্রতিশ্রুতি তোমার মনে থাকবে?
বললাম, যদি তোমার কাছে অস্ত্রশিক্ষায় সুযোগ পাই, তবে আমরণ কৃতজ্ঞ থাকব।
আগন্তুক বলল, আমি দীর্ঘকাল অস্ত্র চালনা করেছি। মানুষের শরীর দেখে তার সম্ভাবনা বুঝতে পারি। তোমার দেহের গঠন দেখে বুঝতে পারছি নিয়মিত অনুশীলন করলে তুমি নিপুণ যোদ্ধা হতে পারবে। আমি তোমাকে সযত্নে সর্বপ্রকার রণবিদ্যায় শিক্ষিত করব। এখন বলো, তোমার নাম কি?
নাম জানিয়ে আমি আমার প্রাণদাতার পরিচয় জানতে চাইলাম। আগন্তুক মৃদু হেসে বলল, আমার নাম পরন্তপ।
আমি সচমকে বললাম, দস্যু পরন্তপ!
আগন্তুক স্মিতমুখে বলল, লোকে আমার নামের আগে ওই বিশেষণটি প্রয়োগ করে বটে। বালক! তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
বললাম, না, তুমি আমার প্রাণদাতা, তোমাকে ভয় করব কেন? তাছাড়া শুনেছি পরন্তপ অকারণে নরহত্যা করে না।
আগন্তুক বলল, ঠিক শুনেছ। শোনো বালক, তোমাকে দেখে আমার হৃদয়ে স্নেহের সঞ্চার হয়েছে। আমি স্বহস্তে কোনো ব্যক্তিকে অস্ত্রশিক্ষা দিই না। প্রয়োজনে অস্ত্রবিদ মানুষের সাহায্য নিয়ে থাকি, প্রয়োজন শেষ হলেই ওই সকল মানুষের সাহচর্য ত্যাগ করি। কিন্তু তোমাকে আমি মনের মতন করে শিক্ষা দেব। বালক! তুমি হবে আমার বিশ্বস্ত অনুচর।
বললাম, আমি চিরকাল তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্রধারণ করব। কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজন না হলে দুস্যদলের অভিযানে যোগ দেব না।
পরন্ত সহাস্যে বলল, তথাস্তু।
তারপর কেটে গেল কয়েকটি বৎসর। অস্ত্র চালনায় আমি অতিশয় নিপুণ হয়ে উঠলাম। বিশেষ করে তরবারি চালনায় আমার গুরুকেও ছাড়িয়ে গেলাম। কিন্তু একটি বিষয়ে আমি কিছুতেই তার সমকক্ষ হতে পারিনি।
কর্ণদেব একটু থামতেই বল্লভ প্রশ্ন করল, কোন্ বিষয়ে তুমি তার সমকক্ষ নও?
-বহুদূর থেকে অব্যর্থ সন্ধানে ছুরিকা নিক্ষেপ করে লক্ষ্যভেদ করতে পারে পর্যুপ। দীর্ঘকাল অনুশীলন করেও ঐ বিদ্যাটি আমি আয়ত্ত করতে পারিনি! পরন্তপের কাছে শুনেছি শৈশব থেকেই ক্রমাগত অনুশীলননের ফলে সে ছুরিকা নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত।
এখন জানলাম ব্রাহ্মণ সন্তান কেমন করে দস্যুর অনুচরে পরিণত হল। এবার বলো কি তোমার প্রস্তাব?
বলছি। কিন্তু আত্মকাহিনি যখন শুরু করেছি, তখন আরও কয়েকটা কথা বলতে চাই। বিশেষ করে জল্লাদ নামে যে মানুষটি আজ আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল তার সম্পর্কেও কয়েকটা কথা আপনার জানা দরকার। ওই সঙ্গে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করব। ঘটনাটি অতি তুচ্ছ হলেও পরবর্তীকালে ওই ঘটনার জন্যই আমার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। প্রথমে ওই ঘটনার কথা বলছি, পরে জল্লাদের কথা বলব। পরস্পর বিচ্ছিন্ন ওই দুটি ঘটনার ফলেই আজ আমি প্রাণ হারাতে বসেছিলাম।
পরন্তপের কাছে প্রায় তিন বৎসর শিক্ষাগ্রহণ করার পর আমি যখন অস্ত্রচালনায় বিশেষ করে তরবারি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছি, সেই সময় এক অলস মধ্যাহ্নে কিঞ্চিৎ মাধ্বীপানের উদ্দেশে নিকটবর্তী এক গ্রামের পানশালায় গমন করলাম। প্রসঙ্গত জানাচ্ছি, বনের মধ্যে পরন্তপের একটি স্থায়ী বাসগৃহ ছিল, কিন্তু আমি ছাড়া দলের কেউ ওই গৃহের সন্ধান জানত না। আমি ছিলাম তার সর্বপেক্ষা বিশ্বস্ত সহচর, একান্ত স্নেহের পাত্র। দলের কোনো কোনো ব্যক্তি আমাকে ঈর্ষা করত। কিন্তু প্রকাশ্য কলহে অবতীর্ণ হতে কেউ সাহস পেত না! কারণ, বন্ধুভাবে অসিক্রীড়া করার সময়েই তারা আমার ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছিল একাধিকবার। তাছাড়া, পরন্তপ সম্পর্কে নিদারুণ ভীতি তাদের প্রকাশ্য শত্রুতা থেকে নিরস্ত করেছিল। পরন্তপ আমাকে ভালোবাসত তার সন্তানের মতো। দেশের মানুষ তাকে ঘৃণা করতে পারে, কিন্তু আমি তার যে পরিচয় পেয়েছি
বাধা দিয়ে বল্লভ বলল, অপ্রয়োজনীয় আলোচনার সময় নেই। তোমার কথা বলো। পরন্তপের কথা শুনতে চাই না।
-ঠিক! ঠিক! হঠাৎ ভাবপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। এই আকস্মিক দুর্বলতার জন্য ক্ষমা করবেন। যে দুস্য সমগ্র দেশে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে, তার সম্পর্কে আপনার ন্যায় সৎ নাগরিকের অনীহা থাকা নিতান্তই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমি জানি পরন্তপ শুধু নরঘাতক দুস্য নয়, তার নিজস্ব জীবন-দর্শন আছে। নিজের আত্মার কাছে সে নিষ্কলুষ, ভাবের ঘরে চুরি সে কখনো করে না। যাই হোক তার প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার আমার কথাই বলছি, ধৈর্য ধরে শুনুন।
পানশালায় গিয়ে দেখলাম কয়েকটি গ্রাম্য যুবক শীতল পানীয় ও খাদ্য সহযোগে অবসর বিনোদন করছে। আমি কারও দিকে দৃকপাত না করে এক পাত্র মাধ্বী ও কিছু শূল্য মাংস নিয়ে পানাহার শুরু করলাম। হঠাৎ সেইস্থানে এক দরিদ্র ব্যক্তি এসে বিপণির অধিকারীর কাছে কিছু খাদ্য ও পানীয় চাইল। অধিকারী জানাল এটা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। অতএব উপযুক্ত মূল্য না পেলে সে খাদ্য বা পানীয় দিতে অপারগ। লোকটি সর্বস্ব গণনা করে দেখল তার কাছে মাত্র এক পাত্র মাধ্বীর মূল্য আছে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে বলল, বহুদুর থেকে আসছি। আরও কয়েকটি গ্রামের পরে আমার মাতুলের গৃহ। সেখানে উপস্থিত হলে আমার কোনো অসুবিধা থাকবে না। কিন্তু এখন ক্ষুৎপিপাসায় আমি নিতান্ত কাতর, পথ চলার ক্ষমতা আর নেই! আচ্ছা, এই অর্থের বিনিময়ে এক পাত্র মাধ্বী দাও। আশা করি মাধ্বী পান করে কিছুটা সতেজ হব এবং বাকি পথ অতিক্রম করতে সমর্থ হব। তবে ঋণস্বরূপ যদি কিছু খাদ্য দাও, তবে ফেরার সময়ে আমি মূল্য শোধ করে দেব অঙ্গীকার করছি।
অধিকারী বলল, তুমি অপরিচিত। তোমার অঙ্গীকারের মূল্য কি?
গ্রাম্য যুবকদের মধ্যে একজন সহাস্যে মন্তব্য করল, এটা তোমার মাতুলালয় বা শ্বশুরালয় নয়। নগদ অর্থ দিতে না পারলে সোজা পথ দেখ।
খাদ্যসম্ভারের দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লোকটি বলল, তাহলে আমাকে একপাত্র মাধ্বীই দাও। সুরার প্রভাবে হয়তো ক্লান্তি দূর হতে পারে।
আমার কাছে প্রচুর অর্থ ছিল। দস্যুদের লুণ্ঠন-অভিযানে আমি যোগ দিতাম না বটে, কিন্তু অর্থাভাব আমার ছিল না। স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা মিলিয়ে বেশ কিছু অর্থ পরন্তপ আমার কাছে রেখে দিয়েছিল এবং সেই অর্থ প্রয়োজনবশে ব্যয় করার অনুমতিও আমার ছিল। অর্থব্যয় করার জন্য কোনো কৈফিয়ত আমি দিতাম না, বা সেও কৈফিয়ত চাইত না। সুতরাং আমার কাছে সর্বদাই কিছু না কিছু অর্থ তো থাকতই, এমনকি কখনো কখনো মূল্যবান রত্নাদিও থাকত। ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে তৃপ্ত করার জন্য সেই অর্থ থেকে কিছু ব্যয় করতে মনস্থ করলাম। অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ওর ইচ্ছামতো খাদ্য দাও। মূল্য আমি দেব।
আমার আদেশ পালিত হল। লোকটি আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দক্ষিণ হস্তের সদ্ব্যবহার শুরু করল। কিয়ৎকাল পরে তৃপ্ত হয়ে সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্থান করল। আমার এবং তার খাদ্য ও পানীয়ের মূল্য অধিকারীকে দিয়ে আমিও স্থানত্যাগ করতে উদ্যত হলাম। হঠাৎ উপবিষ্ট গ্রাম্য তরুণদের মধ্যে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, মহাশয়! আপনার ন্যায় দাতাকর্ণ এই দেশে বিরল। তা আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ কৃপা প্রদর্শন করুন। আমরাও ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। অধিকারীকে বলে আমাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করুন।
ওই তরুণটি বোধহয় দলের নায়ক। তার কথা শুনে সকলের মুখেই ব্যঙ্গের চাপা হাসি ফুটল। আমি বুঝলাম আমকে নিয়ে তারা একটু মজা লুঠতে চায়। সম্ভবত তারা ভেবেছিল এক নিঃসঙ্গ কিশোর অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে একদল তরুণের সঙ্গে কলহে প্রবৃত্ত হতে সাহসী হবে না। আমাকে তারা ইচ্ছামতো লাঞ্ছিত করতে পারবে। তাদের ভ্রম-সংশোধন করতে উদ্যোগী হলাম, বললাম, মহাশয়! পিতামাতা আমার নাম রেখেছিলেন কর্ণদেব। দাতাকর্ণ নামে আমাকে কেউ অভিহিত করে না। কিন্তু আপনার কথাবার্তার ধারা দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, আপনার কর্ণের সঙ্গে আমার হস্তের যোগাযোগ ঘটতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
ক্রুদ্ধ গর্জন করে তরুণটি কাষ্ঠাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গীদের মুখেও ফুটল ক্রোধের আভাস। আমি তাকিয়ে দেখলাম সবসুদ্ধ সেখানে রয়েছে পাঁচটি গ্রাম্য তরুণ। দ্রুত চিন্তা করে বুঝে নিলাম এই পাঁচজন যদি একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলেও তাদের হতাহত করে আমি বেরিয়ে যেতে পারব। অধিকাংশ মানুষই তখন গ্রামের বাইরে, যারা গ্রামে আছে তারাও দিবানিদ্রায় মগ্ন গোলমাল শুনে সকলে সমবেত হওয়ার আগেই এই পাঁচটি তরুণকে ধৃষ্টতার দণ্ড দিয়ে গ্রামত্যাগ করতে আমার অসুবিধা হবে না।
কলহের জন্য প্রস্তুত হয়ে বললাম, আপনাদের আচরণে যদি আমি ধৈর্যচ্যুত হই, তাহলে সেটা আপনাদের পক্ষে নিতান্ত দুঃখের কারণ হবে। অতএব, অনুমতি করুন– আমি অন্যত্র গমন করি।
যে-তরুণটি আমাকে দাতাকর্ণ নামে বিদ্রূপ করেছিল, সে একলাফে আমার সামনে এসে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ওরে বর্বর! এই গ্রাম থেকে অত সহজে তুই যেতে পারবি না। আমাদের গ্রামে এসে আমাদেরই বিদ্রূপ করিস তোর এত স্পর্ধা!
আমি সহজভাবে বললাম, স্পর্ধা তো আপনাদেরই দেখছি। পথ ছাড়ুন। নচেৎ শাস্তি পেতে হবে।
তরুণটি সহসা আমার মুখ লক্ষ্য করে মুষ্ঠাঘাত করল। প্রস্তুত ছিলাম, একহাতে আঘাত প্রতিহত করে অপর হাতে তার কর্ণমূলে সজোরে আঘাত করতেই সে সশব্দে ভূমিশয্যা গ্রহণ করল। পরন্তপের কাছে হাতাহাতি যুদ্ধের তালিম নেওয়ার পর এমনভাবে নিজের বিদ্যা ও শক্তিপরীক্ষার সুযোগ আগে কখনও ঘটেনি বিদ্যুৎবেগে হাত ও পায়ের সদ্ব্যবহার করতে করতে পিছু হটে আমি পানাগারের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। পাঁচটি তরুণই তখন অল্পবিস্তর আহত, দুজনের আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। হঠাৎ তাদের দলপতি ভূমিপৃষ্ঠ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং দ্রুতবেগে বিপণির ভিতর একটি কক্ষে প্রবেশ করল মুহূর্তপরে সে যখন আবার ঘরের বাইরে আত্মপ্রকাশ করল, তখন তার হাতে রয়েছে একটি লৌহদণ্ড!
আমার বস্ত্রের অভ্যন্তরে ছিল সুদীর্ঘ ছুরিকা। বিপদ বুঝে আমি গোপন স্থান থেকে ছুরিকা টেনে নিয়ে রুখে দাঁড়ালাম। বল্লভ! আপনি দেখেছেন অসিধারী কিঞ্জলকে আমি ছুরিকার সাহায্যে পরাস্ত করেছি- রণবিদ্যায় অনভিজ্ঞ গ্রাম্য তরুণ লৌহদণ্ড নিয়ে আমার কি করতে পারে? কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাকে ছুরিকাহত করে আমি তার হাত থেকে লৌহদণ্ড ছিনিয়ে নিলাম। আঘাত মারাত্মক হয়নি, কিন্তু আহত তরুণ রক্তাক্ত স্কন্ধদেশ চেপে ধরে ছটফট করতে লাগল– তার চারটি সঙ্গী ও পানাগারের অধিকারী সভয়ে চিৎকার করে গ্রামবাসীদের সাহায্য চাইতে শুরু করল। একহাতে লৌহদণ্ড আর অন্যহাতে ছুরিকা তুলে গ্রামের পথে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে ঘোষণা করলাম, আমার সম্মুখে যে আসবে, তাকেই আমি হত্যা করব।
আমি নিশ্চয়ই সেদিন নিরাপদে গ্রামের সীমানা অতিক্রম করতে পারতাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য– হঠাৎ সেইসময় গ্রামের ভিতর উপস্থিত হল একদল অশ্বারোহী সীমান্তরক্ষী। আমি বন্দি হলাম। দেশের আইন-অনুসারে আমার বিচার হল গ্রাম-পঞ্চায়েতের সভায়। সব শুনে গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাতব্বররা স্থির করলেন আমার বয়স কম, অতএব বেত্রাঘাত করে আমাকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে।
ক্রোধে আমার রক্ত ফুটতে লাগল– প্রকাশ্য সভায় বেত্রাঘাত! এই অপমান অসহ্য।
সভামধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, এই কি পঞ্চায়েতের বিচার? আমি ভিন্ গাঁয়ের মানুষ; এই গ্রামের তরুণরা আমাকে অপমান করেছে। আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম সেই অপরাধে তারা দলবেঁধে আমাকে আক্রমণ করল! আমি নিরুপায় হয়ে ছুরিকার সাহায্যে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছি সেইজন্য প্রকাশ্য সভায় বেত্রাঘাত? আমিও জানিয়ে দিচ্ছি আমার দেহে যে ব্যক্তি বেত্রাঘাত করবে, তাকে আমি হত্যা করব। আজ আমি বেত্ৰাহত হয়ে ফিরে যাব বটে, কিন্তু একদিন ফিরে আসব সেদিন আঘাতকারীকে তো হত্যা করবই, গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাতব্বর ব্যক্তিরাও আমার কবল থেকে নিস্তার পাবেন না। আমার মনের দর্পণে আপনাদের সকলের প্রতিকৃতি স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হয়ে গেছে কারুকেই আমি ভুলব না।
সেই মুহূর্তে পরন্তপ এবং কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সত্যই সেই গ্রামে হানা দেওয়ার সঙ্কল্প করেছিলাম। নিঃসঙ্গ এক কিশোরের স্পর্ধিত বাক্যে সমবেত গ্রামবাসী স্তম্ভিত হয়ে গেল, তারপরই জনতার ভিতর জাগল ক্রুদ্ধ কোলাহল।
পক্ককেশ গ্রামপ্রধান উঠে বললেন, বালক! তোমার স্পর্ধা অসহ্য। এখনই তোমাকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করা হবে।
আমি হেসে উঠে বললাম, পরিণাম স্মরণ রাখবেন। ডাকুন, দেখি কে আমার দেহে কশাঘাত করে?… মনে রেখো ভাই যে-ব্যক্তি আমার দেহে বেত্রাঘাত করবে, আজ থেকে দ্বাদশ দিবসের মধ্যেই আমার তরবারি তার বক্ষে বিদ্ধ হবে।
গ্রাম-প্রধানের আহ্বানে এক বলিষ্ঠ পুরুষ কশাহস্তে এগিয়ে এল, কিন্তু আমার কথা শুনে আর আমর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে আতঙ্কের সঞ্চার হল সে ইতস্তত করতে লাগল।
সহসা জনতার ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ, বিনীতভাবে পঞ্চায়েতকে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন, এখানে অবশ্য আমার কিছু বলার অধিকার নেই। আমি এই গ্রামে এসেছি আমার আত্মীয়ের গৃহে অবসর যাপন করতে। তবে আপনারা যদি অধিকার দেন তাহলে আমি কয়েকটি কথা বলতে পারি।
জনতার ভিতর জাগল গুঞ্জনধ্বনি। গ্রাম-পঞ্চায়েতের বিচারকরা উপবিষ্ট অবস্থা থেকে হঠাৎ দণ্ডায়মান হয়ে শশব্যস্তে বলে উঠলেন, বিলক্ষণ! বিলক্ষণ! আপনি গ্রামের মানুষ না হলেও আপনার পদধূলি পেয়ে গ্রামবাসী কৃতার্থ। বলুন, আপনার কি বক্তব্য?
মানুষটি এগিয়ে এসে সভার মধ্যস্থলে দাঁড়ালেন, তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, আমি সমস্ত ঘটনাই শুনেছি। একটিমাত্র কিশোরের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি তরুণ সমবেতভাবে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদেরই আগে শাস্তি হওয়া উচিত। আরও লজ্জার কথা সকলে মিলেও এই কিশোরটিকে পরাস্ত করতে পারেনি। বরং তার হাতে মার খেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেছে। সীমান্তরক্ষীর দল হঠাৎ অকুস্থলে উপস্থিত না হলে এই কিশোর ওদের লাঞ্ছিত করে পলায়ন করতে সমর্থ হতো। কী লজ্জা!
আমার বিরুদ্ধে যারা কলহে প্রবৃত্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করল, ওর হাতে অস্ত্র ছিল যে!
আমি বক্তার দিকে তাকালাম– সে ওই তরুণদের দলপতি। তার কাঁধের উপর জড়ানো ছিল কাপড়ের আবরণ, কাপড়ে শুষ্ক রক্তের চিহ্ন।
সেই রক্তচিহ্নিত স্থান দেখিয়ে সে বলল, দেখুন, ও আমার স্কন্ধে ছুরিকাঘাত করেছে। আমরা নিরস্ত্র অবস্থায় কি করতে পারি?
মধ্যবয়স্ক পুরুষ আমার দিকে ফিরলেন, একথা সত্য?
বললাম, সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমি একাকী ওদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র অবস্থায় লড়াই করেছিলাম এবং ওদের বিধ্বস্ত করে পানাগারের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ওদের মধ্যে কেউ তখন আমার সম্মুখে আসতে ভরসা পায়নি। হঠাৎ এই তরুণটি পানাগারের ভিতর থেকে একটি লৌহদণ্ড নিয়ে আমাকে আক্রমণ করল। বাধ্য হয়ে আমি তখন ছুরিকা ব্যবহার করেছি।
প্রশ্নকর্তা জ্বলন্ত নেত্রে তরুণের দিকে তাকালেন। সে মাথা নত করে মাটির দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল। প্রশ্নকর্তা কাঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি প্রথম থেকে সব শুনেছি। এই দুর্ঘটনার জন্য তোমরাই দায়ী।
কলহে জড়িত আরও চারটি তরুণ সেইখানেই দাঁড়িয়েছিল, তিনি এবার তাদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন, ওকে ব্যঙ্গ করে তোমরাই প্রথম কলহ শুরু করেছ। তারপর দল বেঁধে ওকে আক্রমণ করলে। কিছুতেই যখন সুবিধা করতে পারলে না, তখন পাঁচ-পাঁচটি তরুণ বয়ঃকনিষ্ঠ এই কিশোরের হাতে মার খেয়ে লৌহদণ্ড নিয়ে তাকে আক্রমণ করলে। ও যদি আত্মরক্ষার জন্য ছুরিকা ব্যবহার করে থাকে তাতে দোষ কি? তোমরা অতিশয় নির্লজ্জ, ভীরু, কাপুরুষ। তোমরা দেশের তরুণ সমাজের কলঙ্ক।
এই প্রচণ্ড ভৎর্সনার প্রতিবাদে কেউ একটি কথাও বলল না। পঞ্চায়েতের বিচারকমণ্ডলী, জনতা এবং কলহে জড়িত পাঁচটি তরুণ সম্পূর্ণ নির্বাক।
মধ্যবয়স্ক পুরুষ এইবার গ্রাম-পঞ্চায়েতেকে সম্বোধন করে বললেন, ভদ্রমহোদয়গণ, আমি পঞ্চায়েতের কেউ নই। এখানে কথা বলার অধিকারও আমার নেই। কিন্তু আপনারা আমাকে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার অধিকার দিয়েছেন বলেই বলছি আমার বিচারে এই দুর্ঘটনার জন্য গ্রামের পাঁচটি তরুণ-ই দায়ী- এই কিশোরের অপরাধ বিশেষ গুরুতর নয়। পরকে শাসন করার আগে ঘরকে শাসন করলেই ভালো করবেন। আমার বক্তব্য আপনারা শুনলেন, এখন যথাকৰ্তব্য করুন।
পঞ্চায়েতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বয়স্ক মানুষটি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নহুষ শর্মা। আপনি শ্রাবন্তী রাজ্যের রাজধানীতে প্রধান বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত। এই গ্রামে আপনার শ্বশুরালয়; সেই সুবাদে আপনি গ্রামের জামাতা। এই কিশোর এবং পাঁচটি তরুণের বিচার আপনি করুন। গ্রাম-পঞ্চায়েত আপনাকে সেই অধিকার দিচ্ছে। পঞ্চায়েতের মুখপাত্র হয়ে আমি বলছি আপনার বিচার বুদ্ধির উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে।
নহুষ শর্মা মাথা নত করে পঞ্চায়েতকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, মহাশয় পুলোম যা বললেন আশা করি তাতে আপনাদের সম্মতি আছে।
জনতা সোৎসাহে জানাল নহুষ শর্মার উপর তাদের আস্থার অভাব নেই।
নহুষ শর্মা তখন বললেন, গ্রামবাসী এবং পঞ্চায়েতের আদেশ অনুসারে আমি কিশোর ও পাঁচটি তরুণের বিচারের ভার গ্রহণ করেছি। শোনো! তোমরা পাঁচটি তরুণই এই কিশোরের হাতে অল্পবিস্তর প্রহার লাভ করেছ, তাই তোমাদের আর শাস্তি দিতে চাই না। আশা করি এই শিক্ষা তোমাদের মনে থাকবে এবং ভবিষ্যতে দলে ভারি হয়ে কারও উপর অত্যাচার করতে যাবে না… আর কিশোর, তোমার অপরাধ তত গুরুতর নয়। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে।
বললাম, বলুন। কি প্রশ্ন?
নহুষ শর্মার দুই চোখের দৃষ্টি আমার মুখের উপর পড়ল, একটু আগেই বিচারসভার সম্মুখে তুমি তোমার নাম জানিয়েছ। কর্ণদেব! তোমার দেব উপাধি থেকে বুঝতে পারছি তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও তুমি মল্লযুদ্ধ ও মুষ্টিযুদ্ধে এমন দক্ষতা অর্জন করেছ যে, তোমার চাইতে বয়সে বড়ো পাঁচটি বলিষ্ঠ তরুণকে তুমি হাতাহাতি যুদ্ধে পরাস্ত করতে সমর্থ। ব্রাহ্মণ সন্তানের এমন ক্ষত্রিয়ের মতো আচরণ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছে। তাছাড়া আরও একটা কথা- তোমার বস্ত্রের ভিতর লোকচক্ষুর অগোচরে তুমি শাণিত ছুরিকা বহন করেছিলে। তোমার আচরণ ব্রাহ্মণ জনোচিত নয়। তুমি কি সত্যই ব্রাহ্মণ সন্তান?
আমি আঙরাখার ভিতর থেকে উপবীত সূত্র দেখিয়ে বললাম, আমার বাক্যে যদি বিশ্বাস না হয় তবে এই সূত্র দেখুন। মল্লযুদ্ধ, অসিক্রীড়া প্রভৃতি পুরুষোচিত ক্রীড়াকলাপ আমার ভালো লাগে, তাই বাল্যকাল থেকেই অনুশীলন করে ওই সকল রণবিদ্যায় কিঞ্চিৎ পারদর্শিতা লাভ করেছি। সঙ্গে ছুরিকা রাখার কারণ আছে। আমার সঙ্গে কিছু অর্থ রয়েছে। স্ব-অপহারক দুস্যতস্কর কর্তৃক হঠাৎ আক্রান্ত হলে ধনপ্রাণ রক্ষার জন্য ছুরিকা বহন করছি। যতদূর জানি, দেশের আইনে ব্রাহ্মণ সন্তানের পক্ষে শাস্ত্রচর্চা বা অস্ত্রবহন নিষিদ্ধ নয়। প্রবাদ আছে- যে ব্যক্তি রন্ধন করিতে পারে, সে কেশের পরিচর্যাতেও সমর্থ! অতএব শাস্ত্রচর্চার সঙ্গে শস্ত্রচর্চা করতেই বা বাধা কিসের?
নহুষ শর্মার মুখে হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, কিশোর! তুমি বাপটু বটে। তোমার বাচনভঙ্গি থেকে বোঝা যায় তুমি শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। শাস্ত্র ও শস্ত্র সম্পর্কে তোমার বক্তব্য মেনে নিলেও তোমার কৈফিয়ত সম্পূর্ণ সন্তোষজনক নয়। তুমি কোথায় থাকো? সঙ্গে অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে কোথায় গমন করেছিলে?… এইসব প্রশ্ন করলে তার উত্তর সন্তোষজনক হবে কি না জানি না তবে এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে আমি মস্তিষ্ককে বিব্রত করতে ইচ্ছুক নই। রাজকার্য ছেড়ে কয়েকদিন বিশ্রামলাভের আশায় এখানে আমার শ্বশুরালয়ে এসেছি, তোমাকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটবে। তবে তোমার সম্পর্কে আমার কৌতূহল রইল। ভবিষ্যতে যদি তোমাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত দেখি, তাহলে হয়তো এত সহজে নিষ্কৃতি পাবে না। আরও একটা কথা বেত্রাঘাতের সম্ভাবনায় উত্তেজিত হয়ে তুমি যেভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের সঙ্কল্প ঘোষণা করেছিল, সেটাও খুব উদ্বেগজনক। আমি ওই ধরনের কথা পছন্দ করি না।
বললাম, মহাশয়! এক অসহায় কিশোরের নিষ্ফল ক্রোধের উক্তি কি আপনি ক্ষমা করতে পারেন না?
নহুষ শর্মা বললেন, পারি। কিন্তু তোমার কথার মধ্যে এমন এক ভয়ংকর সঙ্কল্পের আভাস ছিল, যাকে নিষ্ফল বাগাড়ম্বর বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাই হোক, তোমার সুন্দর মুখশ্রী ও বাচনভঙ্গি আমার মনে স্নেহের উদ্রেক করেছে তোমার কার্যকলাপ সমর্থন করতে না পারলেও তোমার বীরত্ব ও তেজস্বিতা আমায় মুগ্ধ করেছে সেইজন্য এবং আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটবে বলে তোমার সম্পর্কে বিশেষ অনুসন্ধান না করেই তোমাকে আজ অব্যাহতি দিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো, ভবিষ্যতে যদি এই ধরনের কোনো ঘটনায় তোমাকে জড়িত দেখতে পাই, তাহলে তুমি সহজে নিষ্কৃতি পাবে না। এখন তুমি যেতে পারো।
বল্লভ! কাল অপরাহ্নে নহুষ শর্মার দরবারে রত্নাকরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হলে আমার বিপদ হত। অনুসন্ধানের ফলে হয়তো পরন্তপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গোপন থাকত না। আর কিছু না হোক– নহুষ শর্মা সন্দেহবশে বেশ কিছুদিন আমাকে বন্দি করে রাখতেন। এখন যদি সাতটা দিনও আমি বন্দি থাকি তাহলে আমরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব…।
বাধা দিয়ে বল্লভ বলল, তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে? অর্থাৎ দস্যুদলের ক্ষতি হবে?
কর্ণদেব ক্ষুব্ধস্বরে বলল, আমি দস্যুদলের অন্তর্ভুক্ত নই। পূর্বেই বলেছি আমি পরন্তপের বিশ্বস্ত অনুচর। আমরা অর্থাৎ আমি আর পরন্তপ ক্ষতিগ্রস্ত হব। তাছাড়া আমি যদি নিষ্ক্রিয়ভাবে কয়েকটা দিন বন্দিশালায় থাকি, তবে হয়তো আরও একটি মানুষের অপমৃত্যু ঘটতে পারে।
বটে! বটে! আমার কৌতূহল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই মানুষটি কে? কার অপমৃত্যুর সম্ভাবনায় তুমি উৎকণ্ঠিত?
–ধীরে, বল্লভ, ধীরে! সব কথাই যথাসময়ে বলব। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন আমি নেকড়েবাহিনীর দুর্বৃত্তদের সম্মুখীন হয়েছিলাম? দুর্বৃত্তদের তরবারির চাইতে নহুষ শর্মা আমার পক্ষে অনেক বেশি বিপজ্জনক!
-বুঝলাম। কিন্তু জল্লাদের ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। তোমার সঙ্গে তার যে কথাবার্তা হয়েছিল তাতে বুঝেছিলাম পূর্বে তোমার সঙ্গে তার বিবাদ হয়েছিল। সেই বিবাদ শুধু বাকযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তোমার অস্ত্রাঘাতে সে একটি চক্ষুও হারিয়েছিল। সুযোগ বুঝে কাল সে নেকড়েবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমার সঙ্গে জল্লাদের শত্রুতা হল কেন?
–সেই কথাই তো বলতে চাইছি। আপনি আমাকে বলতে দিচ্ছেন কই?
–দুঃখিত। এই আমি মৌনব্রত অবলম্বন করলাম। এবার জল্লাদের কাহিনি বলো।
কর্ণদেব আবার আত্মকাহিনি শুরু করল, আপনাকে বলেছি পরন্তপের অনুচর হলেও আমি সক্রিয়ভাবে কখনও হত্যা বা লুণ্ঠনকার্যে যোগ দিইনি–তবে কখনো কখনো দলপতির দেহরক্ষী হয়ে দস্যুদের সঙ্গে অকুস্থলে গিয়েছি বটে। ওই সময় জল্লাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার স্বভাবচরিত্র আমার ভালো লাগেনি। সেও আমাকে পছন্দ করত না। কিন্তু দৈবক্রমে হঠাৎ একবার তার সঙ্গে যোগ দিয়ে দস্যুবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ঘটনাটা কি করে ঘটল সেই কথাই বলছি।
এক নির্ধারিত তারিখে সদ্যবিহাহিতা এক বন্ধু যখন স্বামীর সঙ্গে পতিগৃহে যাবে, সেই সময়ে পথিমধ্যে সেই দম্পতির উপর হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল পরন্তপ। কিন্তু সমবেত দস্যুদলের ভিতর থেকে একটি দুর্বিনীত দস্যু হঠাৎ কথায় কথায় পরন্তপকে অপমান করে। ক্রুদ্ধ পরন্তপ তৎক্ষণাৎ তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানায়। যুদ্ধে সেই দস্যুর মৃত্যু ঘটে। পরন্তপও প্রতিদ্বন্দ্বীর অসিতে আহত হয়। আঘাত খুব মারাত্মক না হলেও আমি তাকে অভিযানে যোগ দিতে নিষেধ করি। সদ্যবিবাহিতা সালঙ্কারা বধূ ও তার স্বামীর সঙ্গে অস্ত্রধারী প্রহরীদের অবস্থান স্বাভাবিক- যদি যুদ্ধ বাধে এবং পরন্তপের আহত স্থানে যদি অস্ত্রাঘাত হয়, তাহলে রক্তপাতের ফলে তার প্রাণবিপন্ন হতে পারে মনে করেই আমি নিষেধ করেছিলাম। পরন্তপ প্রথমে আমার কথায় কান দেয়নি, কিন্তু আমি যখন ক্রোধপ্রকাশ করে জানালাম, আমার কথা না শুনলে তার সাহচর্য ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ যাত্রা করব, তখন সে ভীত হল। পরন্তপ জানত আমি বৃথা বাগাড়ম্বর করি না। আমাকে সে পুত্ৰাধিক স্নেহ করে, তাই আমার নিরুদ্দেশ যাত্রার সঙ্কল্প শুনে অভিযানে যোগ দেওয়ার অভিসন্ধি ত্যাগ করল। তখন জল্লাদের নেতৃত্বে সমবেত দস্যুদল নির্দিষ্ট স্থানে হানা দিতে প্রস্তুত হল। দলপতির প্রতিনিধি হয়ে আমিও দস্যুদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কারণ, লুষ্ঠিত দ্রব্যে দলপতির প্রাপ্য অংশ বুঝে নেওয়ার মতো বিশ্বস্ত দ্বিতীয় কোনো অনুচর পরন্তপের ছিল না।
আমরা জানতাম সন্ধ্যার প্রাক্কালে বর তার নিজস্ব গ্রামে পৌঁছাবে। সেখানে গিয়ে তাদের আক্রমণ করা খুবই কঠিন। তাই প্রকাশ্য দিবালোকেই তাদের উপর চড়াও হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে যাওয়ার পথে প্রখর সূর্যালোকে দুস্যর আক্রমণের সম্ভাবনা কেউ চিন্তাই করতে পারেনি। তাই বনের ভিতর গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যখন অতর্কিতে আক্রমণ করলাম, তখন দম্পতির সঙ্গে যে সশস্ত্র প্রহরীর দল ছিল, তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই অধিকাংশ প্রহরী দস্যুদের অস্ত্রাঘাতে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যায় শায়িত হল, বাকি সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে বাঁচল। বর ও বধু পালাতে পারেনি। তাদের সঙ্গে যে পেটিকায় স্বর্ণলঙ্কার ও মণিমুক্তা ছিল, সেই পেটিকাটি অবিলম্বে অধিকার করল জল্লাদ। তারপর বধুর গায়ে হাত দিয়ে তার অলঙ্কার খুলে নিতে সচেষ্ট হল। স্বামী এতক্ষণ নিরুপায় হয়ে চুপ করে ছিল, কিন্তু সদ্যবিবাহিতা পত্নীর দেহে দস্যুর হাত পড়তেই সে আর আত্মসংবরণ করতে পারল না- সক্রোধে ধাক্কা দিয়ে জল্লাদকে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল, সাবধান! গায়ে হাত দিও না। অলঙ্কার আমি খুলে দিচ্ছি।
জল্লাদ হিংস্রভাবে দন্তবিকাশ করে বলল, তোর এত স্পর্ধা! আমার গায়ে হাত! ওই হাত আমি তোর দেহ থেকে খুলে নেব।
তরবারি তুলে সে এগিয়ে এল, সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে বধূ তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, না, না, ওকে হত্যা করো না। যথাসর্বস্ব খুলে দিচ্ছি।
কর্কশ হাস্যে চারিদিক কাঁপয়ে জল্লাদ বলল, সুন্দরি! তোমার যথাসর্বস্ব তত আমরা গ্রহণ করবই। কিন্তু যে-হাত দিয়ে তোমার স্বামী আমাকে আঘাত করেছে, সেই হাতটিও যে আমার চাই।
বধূ আকুল স্বরে কেঁদে উঠে বলল, দয়া করো। ওগো, দয়া করো। ওকে হত্যা করো না।
নির্মম কণ্ঠে হেসে উঠে জল্লাদ বলল, না, না, ওকে আমি হত্যা করতে চাই না। হাতটিকে কেটে নিয়ে তোমার স্বামীকে আবার তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব।
রমণী উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে ফেটে পড়ল। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, বলে উঠলাম, জল্লাদ! তুমি সার্থকনামা পুরুষ। কিন্তু আমি তোমাকে এদের উপর অত্যাচার করতে দেব না। লুষ্ঠিত দ্রব্য নিয়ে এখান থেকে প্রস্থান করে। পরে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দলপতির অংশ আমি তোমার কাছ থেকে বুঝে নেব। এই নারীর অঙ্গে যে অলঙ্কার আছে তাতে হাত দেওয়ারও প্রয়োজন নেই।
খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জল্লাদ বলল, বালক! দলপতির অংশ তুই বুঝে নিতে এসেছিস, সেটা তোকে বুঝিয়ে দেব। কিন্তু তুই অনধিকারর্চা করিস কেন? এই নারীর অলঙ্কার এখন দলের সম্পত্তি। আর ওই যে পুরুষ আমাকে অপমান করেছে, ওকে আমি উচিত শাস্তি দেব। অধিক বাক্যব্যয় করলে তুইও নিষ্কৃতি পাবি না।
দারুণ ক্রোধে আমার দেহের রক্ত মাথায় উঠে গেল, মনে হল আমার ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে যেন অজস্র অগ্নিশিখা নৃত্য করছে দ্রুতপদে এগিয়ে এসে জল্লাদের মুখে সজোরে মুষ্টাঘাত করলাম।
রক্তাক্ত মুখে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর। ক্ষণমধ্যে আত্মসংবরণ করে উঠে দাঁড়াল। তারপরই ভীষণ চিৎকার করে তরবারি হাতে আমাকে আক্রমণ করল। আমি প্রস্তুত ছিলাম। চকিতে অসি কোষমুক্ত করে তাকে বাধা দিলাম। দস্যুরা সরে দাঁড়িয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য রণাঙ্গন প্রশস্ত করে দিল।
পরন্তপের কাছে দীর্ঘকাল অনুশীলনের ফলে অসি চালনায় আমি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলাম। জল্লাদের আঘাত কয়েকবার প্রতিহত করে আমি বিদ্যুৎবেগে প্রতি-আক্রমণ করলাম। কোনোরকমে সরে গিয়ে সে প্রাণ বাঁচাল বটে কিন্তু আমার অসির অগ্রভাগ তার একটি চক্ষুকে মুখের উপর থেকে লুপ্ত করে দিল। আর্তনাদ করে সে মাটির উপর বসে পড়ল। ইচ্ছা করলে সেই মুহূর্তে তাকে বধ করতে পারতাম। কিন্তু অসহায় শত্রুকে হত্যা করতে প্রবৃত্তি হল না। যে-কোনো সাধারণ মানুষ ওই অবস্থায় পড়লে অচেতন হয়ে পড়ত- তবে জল্লাদের কথা স্বতন্ত্র, সে হচ্ছে অমানুষিক মানুষ কয়েক মুহূর্ত পরে তরবারি তুলে নিয়ে সে আবার আমাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল।
আমিও তখন তাকে বধ করতে কৃতসঙ্কল্প, তরবারি আন্দোলিত করে চরম আঘাত হানতে যাব সহসা আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল পরিচিত কণ্ঠস্বর, ক্ষান্ত হও! এসব কি হচ্ছে?
সচমকে মুখ তুলে দেখলাম অশ্বপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছে পরন্তপ। তার মস্তক আবৃত করে অবস্থান করছে বিরাট উষ্ণীষ এবং উষ্ণীষ-সংলগ্ন বস্ত্রের তলায় অদৃশ্য হয়েছে মুখের নিম্নভাগ। সমস্ত মুখের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয় রোমশ জ্বর নীচে একজোড়া জ্বলন্ত চক্ষু!
পরন্তপ আবার হাঁক দিল, এসব কি কাণ্ড? নিজেদের মধ্যে হানাহানি কেন?
একজন দস্যু সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করল।
পরন্তপ জল্লাদের দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে বলল, তোমার নিষ্ঠুর স্বভাবের জন্য অনেকবার তোমাকে আমি তিরস্কার করেছি, সাবধান করে দিয়েছি। তোমার হাতে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারিনি, তাই ছুটে এসেছি। অনর্থক নিষ্ঠুরতা আর নির্যাতন বিশেষ করে নারী-নির্যাতন আমি পছন্দ করি না; আমার দলে এই ধরনের ঘটনা কখনই ঘটতে দেব না। জল্লাদ। তোমার মতো মানুষের স্থান আমার দলে হবে না- যাও! দূর হও!
আমার দিকে একটিমাত্র চক্ষের অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জল্লাদ বলল, কর্ণদেব! আজ তুমি বেঁচে গেলে! কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। পরন্তপের অসি তোমাকে সর্বদা রক্ষা করতে পারবে না।
আমি অট্টহাস্য করে বললাম, অপরের অসির সাহায্যে যে আমার প্রয়োজন হয় না, একথা কি এখনও বুঝতে পারোনি? জল্লাদ! পুনরায় তোমার সাক্ষাৎলাভের জন্য আমিও উদগ্রীব হয়ে রইলাম।
বল্লভ! এই হল জল্লাদের সঙ্গে আমার কলহের পূর্ব-ইতিহাস! পাঁচটি গ্রাম্য তরুণের সঙ্গে আমার বিরোধের ঘটনা আপনাকে আগেই বলেছি। এখন জল্লাদের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বযুদ্ধের কাহিনিও শুনলেন। দুটি ঘটনা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যোগসুত্র না থাকলেও ওই দুটি ঘটনার জন্যই আমার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। প্রথম ঘটনার ফলে নহুষ শর্মার সঙ্গে আমার যে-ভাবে পরিচয় ঘটেছিল, তাতে পরবর্তীকালে সশস্ত্র সংঘর্ষে আমার অস্ত্রচালনায় দক্ষতার সংবাদ শুনলে তিনি আমার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতেন। তার ভয়ে বিচারালয়ে না গিয়ে নেকড়েবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইলাম এবং তার ফলে জল্লাদের কবলে পড়লাম। আপনি না থাকলে আমার আজ রক্ষা ছিল না। পাষণ্ড জল্লাদ যে রাজধানীতেই আশ্রয় গ্রহণ করেছে সে কথা আমি জানতাম না।
বল্লভ বলল, ওর কিছু কিছু কুকীর্তির কথা আমার কানেও এসেছে। কিঞ্জলের সঙ্গে ওর সখ্য আছে। তবে ও নেকড়েবাহিনীর কেউ নয়।
কর্ণদেব বলল, জল্লাদ সাময়িকভাবে সমাজবিরোধী কয়েকটি দুৰ্বত্তের সাহায্য নিতে পারে বটে, কিন্তু বৃহৎ দল গঠন করে দস্যুবৃত্তি করা সম্ভব নয়।
-কেন?
-ওইরকম হিংস্র আর স্বার্থপর মানুষ বৃহৎ দল গঠন করতে পারে না। দলপতির চরিত্রে বহুবিধ গুণ থাকা প্রয়োজন। শুধু অসিচালনা করতে জানলে দলপতি হওয়া যায় না।
স্বীকার করছি, দস্যুদল এবং তাদের নায়ক সম্পর্কে আমার ধারণা নিতান্তই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই প্রসঙ্গ বন্ধ করে প্রয়োজনীয় কথা বলো- আমাকে তোমার প্রস্তাব জানাও।
-তাহলে ধরে নিতে পারি আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আর ইতিহাস আপনার মনে ঘৃণার উদ্রেক করেনি?
আদৌ নয়। এখন আমি তোমার প্রস্তাব শুনতে চাই।
–তবে শুনুন। এই রাজ্যের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত বনভূমির মধ্যে শল্য নামে এক দস্যু-দলপতিকে বন্দি করেছে তার দলভুক্ত কয়েকজন দস্যু। শল্য আমাদের দলপতি পরন্তপের মতো অমিতব্যয়ী নয়। সে প্রভূত ধনসম্পদ সঞ্চয় করে লুকিয়ে রেখেছে এই রাজ্যের উত্তরাংশে অবস্থিত পর্বতবেষ্টিত অরণ্যের কোনো এক গোপন স্থানে। তার দলের দস্যুরা ওই অর্থ আত্মসাৎ করতে চায়। পরন্তপ চাইছে শল্যকে উদ্ধার করতে। শলোর মুখ থেকে ওই ধন-সম্পদের সন্ধান সে নিশ্চয়ই পাবে। তখন…।
বাধা দিয়ে বল্লভ বলল, শল্য যে পরন্তপকে ওই অর্থের সন্ধান দেবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? সে তো দলের লোককেই গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধান বলে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে।
কর্ণদেব হাসল, না। শল্য জানে তার দলের লোকেরা যখন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তখন অর্থের সন্ধান পেলেও তাকে তারা জীবিত রাখবে না। কারণ, জীবিত থাকলে শল্য পরবর্তীকালে প্রতিহিংসা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু পরন্তপ যদি শল্যকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করতে পারে, তবে কৃতজ্ঞ শল্য তাকে সম্পদের অর্ধেক দিতে আপত্তি করবে না।
–আমার ধারণা অন্যরকম। শল্য জানে ধন-রত্নের সন্ধান পেলেই তার দলভুক্ত দস্যুরা তাকে হত্যা করবে। পরন্তপও যে তার গুপ্তধনের সন্ধান পেলে তাকে হত্যা করবে না একথা শল্য কেন বিশ্বাস করবে? আমি নিজেও মনে করি অর্থের সন্ধান পেলে পরন্তপ কে হত্যা করে সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করতে সচেষ্ট হবে।
আপনি সেকথা মনে করলেও শল্য নিশ্চয়ই পরন্তপের কথা বিশ্বাস করবে। দস্যুমহলে সকলেই জানে পরন্তপ কখনো বিশ্বাসভঙ্গ করে না। শল্য একসময়ে পরন্তপের অধীনে দস্যুবৃত্তি করেছে, অতএব পরন্তপের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অবহিত। প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি পেলে শল্য নিশ্চয়ই পরন্তপকে সম্পদের অর্ধাংশ ছেড়ে দিতে সম্মত হবে। সর্বনাশ উপস্থিত হলে বুদ্ধিমান ব্যক্তি অর্ধাংশ ত্যাগ করে থাকেন। শল্য নির্বোধ নয়।
-কর্ণদেব! পরন্তপ সম্পর্কে তোমার উচ্চ ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু আমি বলব এই দস্যু অতিশয় অর্থলোলুপ। সে বহুকাল ধরে দস্যুবৃত্তি করছে। তার কাছে নিশ্চয়ই যথেষ্ট ধনরত্ন সঞ্চিত আছে। তার মাথার উপর এখন বিপদের খঙ্গ রাজদরবার থেকে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। এখন যে কোনো দিনই দেবরাজ বাসবের রোষে ললাটে বা বক্ষে শায়কচিহ্ন নিয়ে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। রুদ্রদমনের রাজ্যে এই ঘটনাই ঘটেছে বারংবার। এমন অবস্থায় তার যথাসম্ভব শীঘ্র এই রাজ্য ত্যাগ করা উচিত। তা না করে সে আরও অর্থ সংগ্রহ করতে সচেষ্ট। এই ব্যক্তিকে অতিশয় অর্থগৃধু মনে করাই স্বাভাবিক নয় কি?
-না। পরন্তপ কখনো সঞ্চয় করে না। হাতে বেশ কিছু অর্থ এলেই সে কৌশাম্বী, উজ্জয়িনী, কৌশল প্রভৃতি রাজ্যে গিয়ে বিলাস ব্যসনে দিন অতিবাহিত করে। সে অতিশয় মূল্যবান বসনভূষণ ব্যবহার করতে ভালোবাসে। কিন্তু এই রাজ্যে মহার্ঘ্য বসন-ভূষণে সজ্জিত হলে গুপ্তচরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে বলে সে শ্রাবন্তী রাজ্যে খুব সাধারণ অবস্থায় দিন যাপন করে। অন্য রাজ্যে ইচ্ছামতো অর্থব্যয় করে বিলাসী ব্যক্তির ন্যায় দিন যাপন করলেও পরদেশী ধনীর প্রতি কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে না। সঞ্চিত সম্পদ যখন শেষ হয়ে আসে, তখনই সে আবার দস্যুবৃত্তি করতে উদ্যোগী হয়। এখন যে তার জীবন বিপন্ন, সে বিষয়ে সে সম্পূর্ণ সচেতন। তাই শল্যের ধনভাণ্ডার থেকে বেশ কিছু ধনরত্ন হস্তগত করে সে দেশত্যাগের সঙ্কল্প করেছে। আমাকে সে যথেষ্ট অর্থ দিয়ে যাবে। ওই অর্থ পেলে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে আমি বাকি জীবনটা সৎভাবে কাটিয়ে দিতে পারব। আমি পরন্তপের সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইনি, কিন্তু সে বলেছে তার সাহচর্য আর আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। তার সনির্বন্ধ অনুরোধে আমি সাময়িকভাবে তার সাহচর্য ত্যাগ করে এই রাজ্যে বসবাস করতে সম্মত হয়েছি। পরন্তপ একথাও জানিয়েছে যে, ভবিষ্যতে সে দুস্যবৃত্তি ত্যাগ করে ভালোভাবে জীবন যাপন করতে চায়। গুপ্তধনের কিয়দংশ তার হস্তগত হলে সে ভিন্ন রাজ্যে গিয়ে ওই অর্থ দিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করবে। কিংবা হয়তো অপর রাজ্যে রাজসেনা দলে যোগ দিতে পারে। যে-কোনো রাজ্যের সেনাবাহিনী তার মতো নিপুণ শস্ত্রবিদকে সাদরে গ্রহণ করবে। তবে আমার মনে হয় পরন্তপের ন্যায় স্বাধীনচেতা ব্যক্তির পক্ষে সৈন্যদলের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। বোধহয় শেষ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যেই সে আত্মনিয়াগ করবে।
বল্লভ বলল, সাধু সঙ্কল্প। কিন্তু এইসব ব্যাপারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোথায়?
-বলছি। শল্যকে যারা বন্দি করেছে সেই দস্যুদল সংখ্যায় দশ-বারো জন হবে। পরন্তপ একদল অনুচর নিয়ে তাদের হাত থেকে শল্যকে ছিনিয়ে আনতে পারে বটে, কিন্তু তাহলে ঐ অনুচরদের মধ্যে সমস্ত সম্পদ বণ্টন করতে হবে। অতগুলি লোকের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হলে ব্যক্তিগত অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। অল্প কয়েকজনের মধ্যে ভাগ হলে প্রত্যেকই অধিক পরিমাণে ধনরত্ন হস্তগত করতে পারবে। তাছাড়া, শল্যকে উদ্ধার করলেই সমস্যার শেষ হল না। আরও সমস্যা আছে। শল্যের ধনভাণ্ডার যেখানে লুকানো আছে, সেই স্থানটি ভীষ্মক নামক অনার্য জাতির রাজ্যের অন্তর্গত। ভীষ্মক জাতির রাজা মূলক আমাদের রাজা রুদ্রদমনের অন্তরঙ্গ বান্ধব। বল্লভ! তুমি জানো এই রাজ্যের সকল সীমানাতেই অবস্থান করছে দুর্ধর্য সীমান্তরক্ষীর দল। কিন্তু উত্তরের কোশাম্বী ও রুদ্রদমনের রাজ্য শ্রাবন্তীর মাঝখানে সীমান্তরক্ষীর অস্তিত্ব নেই। কারণ, অনার্যরাজ মূলকের অধীনে দুরন্ত ভীষ্মক জাতি ওই সীমান্ত অঞ্চল পাহারা দেয়। তাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে দুই-চারজন সতর্ক মানুষ কোনোক্রমে ওই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করতে পারে; কিন্তু অধিকসংখ্যক মানুষের পক্ষে অনার্য প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ওই এলাকায় চলাফেরা করা অসম্ভব। সেই জন্যই পরন্তপ চাইছে তিনটি দুর্ধর্ষ মানুষ যাদের বিশ্বাস করা যায়। আমাকে বাদ দিলে আরও দুটি মানুষের প্রয়োজন। অনেক চিন্তা করে পরন্তপ স্থির করেছে মল্লবীর জয়দ্রথ আর তীরন্দাজ শায়নই হবে আমাদের উপযুক্ত সঙ্গী। এরা দুজনেই শ্রাবন্তী রাজ্যে অল্পবিস্তর খ্যাতিলাভ করেছে। জয়দ্রথের দৈহিক শক্তি প্রচণ্ড; শায়ন অসি ও ধনুবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত। আপনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে জয়দ্রথকে আর প্রয়োজন হবে না। বাকি রইল শায়ন। গতকাল শায়নের গৃহে তার দ্বার বাহির থেকে অর্গলবদ্ধ দেখে এসেছি। শুনেছি দূরে কোথাও গেলে তার গৃহদ্বারে লিখিত লিপি থেকে সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু শায়নের গৃহদ্বারে কাল কোনোও লিপি আমার চোখে পড়েনি। তাই রাত্রি প্রভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার গৃহে গমন করব। আশা করছি—
-আশা করছ তাকে পাবে? হ্যাঁ, আমারও মনে হয় প্রত্যূষে গেলে তার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। শায়নের খ্যাতি আমারও কানে এসেছে। নিকটে বা দুরে অরণ্যসন্নিহিত কোনো গ্রামে যদি নরখাদক শ্বাপদের আর্বিভাব হয়, অথবা মদমত্ত হস্তী বা বন্য মহিষ যদি উপদ্রব করতে থাকে– তবে সেই অঞ্চলের মানুষ অর্থের বিনিময়ে শায়নের সাহায্য নেয়। সে অত্যন্ত সাহসী ও অস্ত্রচালনায় নিপুণ। বিশেষত ধনুর্বাণে তার লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা নাকি বিস্ময়কর।… হ্যাঁ, এই অভিযানের পক্ষে শায়ন উপযুক্ত সঙ্গী বটে। কিন্তু সে কি দস্যুদের হাতে হাত মিলাতে রাজি হবে?
কর্ণদেব ঈষৎ চিন্তিতভাবে বলল, জানি না। তবে আমরা তো তাকে দুস্যবৃত্তি করতে বলছি না। এই ধরনের মানুষ তীব্র উত্তেজনার মধ্যে দিনযাপন করতে ভালোবাসে। তাই মনে হয় সে রাজি হতেও পারে। কিন্তু বল্লভ, আপনি কি আমাদের দলে যোগ দিতে সম্মত?
–হ্যাঁ। একটি মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করে যদি সারাজীবন নিশ্চিন্তে বসে থাকার মতো পর্যাপ্ত অর্থ পাই, তাহলে আপত্তি করব কেন? অর্থের পরিমাণ তো যথেষ্ট হবে বলেই মনে হয়।
–নিশ্চয়! সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। দস্যুদের অভিযানের ফলে যে অর্থ পাওয়া যায়, সেই লুণ্ঠিত সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করে পরন্তপ স্বয়ং, বাকি অর্ধেক সমভাবে বণ্টন করা হয় লুণ্ঠনে যোগদানকারী দুস্যদের মধ্যে। কিন্তু শল্যের ধনভাণ্ডার থেকে যে ধন আমদের হাতে আসবে, তা সমান চারভাগে বিভক্ত হবে। বলুন আপনার আর কিছু জানার আছে?
—আর একটি কথা জানতে চাই। কবে যাত্রা করতে হবে?
–দুই-চার দিনের মধ্যেই। শল্যের উপর বিদ্রোহী দুস্যরা অত্যাচার শুরু করেছে। অত্যাচারের মাত্রা বর্ধিত হলে হয় সে মারা পড়বে, নয়তো ধনভাণ্ডারের সন্ধান জানিয়ে দিতে বাধ্য হবে। অতএব যা কিছু করার তা সত্বর করতে হবে। তবে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী আমি নই। আগামীকাল সন্ধ্যার প্রাক্কালে পরন্তপের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হবে; সেখানেই সে আপনার সম্বন্ধে তার মতামত আপনাকেই জানিয়ে দেবে।
বল্লভের ভ্রূকুঞ্চিত হল, ওঃ! তা কোথায় দেখা হবে? তুমি এসে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাবে তো?
কর্ণদেব বলল, না। এই নগরীর উত্তরদিকে অরণ্য যেখানে শুরু হয়েছে, সেই অরণ্য ও জনপদের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি পুরাতন বটবৃক্ষ। জনশ্রুতি আছে, বিশাল ওই বৃক্ষের ছায়ায় নাকি পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের সময়ে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করেছিলেন। সেই বট বক্ষের
বল্লভ বলে উঠল, জানি শ্রাবন্তীর রাজধানী ও নিকটবর্তী গ্রামের সকল বাসিন্দাই ওই বৃক্ষ সম্পর্কে অবহিত। ওই বটবৃক্ষের তলায় আগামী কাল সায়াহ্নে পরন্তপ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে?
-যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
–তুমিও থাকবে তো?
নিশ্চয়ই। আপনারা পরস্পরের অপরিচিত, আমি না থাকলে চলবে কেন? বল্লভ! ওই দেখুন, বাতায়নপথে পূর্বাকাশে ঊষার আভাস দেখা যায়। আমি এখনই শায়নের গৃহ অভিমুখে যাত্রা করব। বিলম্ব হলে তাকে পাব না।… এটা ধরুন। এই অর্থ দিয়ে কুসীদজীবী উত্তানপাদের কবল থেকে আপনার বসতবাটী উদ্ধার করুন।
-কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি এই অভিযানে না যাই? যদি পরন্তপের বিচারে আমি অযোগ্য প্রতিপন্ন হই? তা হলে? এই অর্থ তা হলে কবে এবং কখন তোমাকে প্রত্যার্পণ করতে হবে?
–পরন্তপের বিচারে আপনার অমনোনীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তবু সেরকম ঘটনা যদি ঘটে, তা হলেও আপনার চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি আপনাকে ঋণস্বরূপ এই অর্থ দিলাম। যখন পারবেন, যতদিনে পারবেন, ঋণশোধ করবেন। এ বিষয়ে কোনো শর্ত রইল না।
কর্ণদেব! পৃথিবীতে তোমার মতো মানুষও আছে, আবার কুসীদজীবী উত্তানপাদের মতো মানুষও আছে!
-বল্লভ! অনুমতি করুন, এবার বিদায় গ্রহণ করি। একটু দাঁড়াও, বল্লভ এগিয়ে এসে কর্ণদেবের দুই কাঁধে হাত রেখে তার মুখের উপর দৃষ্টি স্থাপম করল, কর্ণদেব! ক্রোধের বশে আমাকে তুমি সম্বোধন করেছিলে, স্নেহের বশে কি ওই সম্বোধনে ফিরে যাওয়া যায় না?
বল্লভ!আবেগরুদ্ধ স্বরে কর্ণদেব বলল, পিতামাতার মৃত্যুর পর একটি দুর্ধর্ষ মানুষ আমাকে ভালবেসেছে, কিন্তু আর কেউ আমার প্রতি এতটুকু স্নেহ বা সহানুভূতি প্রদর্শন করেনি। তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ একথা আমি কোনোদিনই ভুলব না। আজ থেকে তোমাকে আমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতোই মনে করব।
কর্ণদেব!আ স্বরে বলল, মতো কেন, আজ হতে আমি সত্যই তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা হলাম। আচ্ছা ভাই এস। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে।
–নিশ্চয়।
.
১১. অসি ও শায়ক
বল্লভের গৃহ থেকে বহির্গত হয়ে কর্ণদেব যখন রাজপথে পদার্পণ করল নগরী তখনও নিদ্রামগ্ন। অন্ধকারকে বিতাড়িত করে পৃথিবীর বুকে আলোর আবির্ভাব ঘটেছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ নাগরিকই এখনও শয্যা ত্যাগ করেনি। পথের ধারে কয়েকটি গৃহ থেকে শিশুর ক্রন্দন ও নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বর কর্ণদেবের শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল, কৃচিৎ দুই একটি পথিকের দেখাও সে পেল কিন্তু জনজীবনের কোলাহলে কর্মব্যস্ত রাজধানীর জাগরণের যে বেশ বিলম্ব আছে, সে কথা সহজেই বুঝল কর্ণদেব।
নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে সবেগে পদচালনা করতে করতে পথের দুইদিকে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে কর্ণদেব দেখল রাজধানীর মধ্যস্থলে অবস্থিত প্রস্তর ও কাষ্ঠ-সংযোগে নির্মিত বৃহৎ অট্টালিকার প্রাচুর্য এই অঞ্চলে নেই। ছোটো ছোটো কাঠের বাড়ির সংখ্যাই বেশি। মাঝে মাঝে দই-একটি পাষাণ-গহ চোখে পড়লেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। এই দিক দিয়ে কর্ণদেব নগরে প্রবেশ করেনি, তবু তার মনে হল নগরীর উপকণ্ঠে যেদিক থেকে সে রাজধানীতে প্রবেশ করেছিল, সেখানকার ঘরবাড়ির চেহারাও এই ধরনের। তখনও পর্যন্ত রাজধানীর মধ্যস্থলে বিরাজমান সুবৃহৎ অট্টালিকা ও স্নানাগারসমূহ তার চোখে পড়েনি। এখন সে বুঝল রাজধানীর মধ্যভাগে আশ্রয় গ্রহণ করেছে ধনী ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়, উপকণ্ঠে বাস করে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তার চোখে পড়ল শ্যামল প্রান্তর ও বৃক্ষের আধিক্য কাষ্ঠনির্মিত গৃহের পরিবর্তে দেখা দিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পর্ণকুটির। কর্ণদেব জানে, এখানে বাস করে অতি দরিদ্র কিছু শ্রমজীবী অথবা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা শবরশ্রেণির কয়েকজন মানুষ যারা শবরপল্লীর নিয়ম ও সামাজিক বিধি মেনে নেয়নি, কিন্তু মৃগয়ালব্ধ পশুমাংস ও চর্ম বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে।
এখান থেকেই শুরু হয়েছে অরণ্যের রাজত্ব। বনপথ ধরে এগিয়ে চলল কর্ণদেব। বল্লভের নির্দেশ অনুসারে আরও একটু অগ্রসর হতেই পূর্ব-পরিচিত পথের দেখা পেল সে। কর্ণদেব উল্লসিত হয়ে উঠল– আর বেশিদূর নয়, শায়নের গৃহের নিকটেই সে এসে পড়েছে দ্বিগুণ বেগে পা চার্লিয়ে দিল সে।
আচম্বিতে চাবুকের মতো কি একটা বস্তু তার দেহের উপর আছড়ে পড়ল, পরক্ষণেই প্রবল আকর্ষণে মাটির উপর ছিটকে পড়ল কর্ণদেব সঙ্গে সঙ্গে তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল এক প্রচণ্ড অট্টহাস্য!
আঘাতের বেগ সামলে কর্ণদেব দেখল, তার দুই হাতকে দেহের সঙ্গে আবদ্ধ করে অবস্থান করছে একটি দড়ির ফাঁস!
কোনোমতে উঠে বসে সে দেখল অদূরবর্তী একটি ঝোপের আড়াল থেকে হাসিমুখে আত্মপ্রকাশ করল জল্লাদ! তার সঙ্গে আরও দুটি অপরিচিত মানুষের সাক্ষাৎ পেল কৰ্ণদেব। অপরিচিত দুই ব্যক্তির মধ্যে একজনের হাতে ছিল দড়ির ফাঁসের অপর প্রান্ত।
উপবিষ্ট কর্ণদেবের সামনে এসে কটিতে দুই হাত স্থাপন করে জল্লাদ হাসিমুখে বলল, কর্ণদেব! খুব আশ্চর্য হয়ে গেছ, তাই না?
কর্ণদেব উত্তর দিল না। জল্লাদ হৃষ্টস্বরে বলতে লাগল, কাল আমার অনুচর দুটি তোমাকে অলক্ষ্যে অনুসরণ করেছিল। বল্লভের গৃহে প্রবেশ করতেই আমাকে একজন যথাস্থানে গিয়ে তোমার সংবাদ দিয়েছে, অপর ব্যক্তি পাহারা দিয়েছে সারারাত ধরে। সংবাদ পেয়ে আমি বল্লভের গৃহের নিকটে উপস্থিত হলাম। প্রত্যূষে তুমি গৃহত্যাগ করে পথে বহির্গত হতেই অলক্ষ্যে তোমাকে অনুসরণ করলাম। এই পথে সকাল-সন্ধ্যায় আমি প্রায়ই শিকারের সন্ধানে অপেক্ষা করি। পথচলতি দলছাড়া পথিকের অর্থ গ্রহণ করে তার মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিই। তোমার আশেপাশে এমন অনেক হতভাগ্য মানুষের দেহই মাটির তলায় লুকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার শরীরটাও ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটির তলায় আত্মগোপন করবে। কর্ণদেব! তুমি নীরব কেন? একবার নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা চাও, হয়তো আমি তোমায় ক্ষমা করতে পারি।
কর্ণদেবের ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা। সে কথা বলল না। জল্লাদ বলল, এত ভোরে এই পথে লোকসমাগম হয় না। মধ্যাহ্নের কিছু পূর্বে লোক চলাচল শুরু হয়, সন্ধ্যার প্রাক্কালে আবার পথিকের সংখ্যা বিরল হয়ে পড়ে। অতএব, হঠাৎ মানুষজন এসে পড়ে তোমার প্রাণরক্ষা করবে এমন সম্ভাবনাও নেই। তোমার মতো দুই-একজন পথিক অবশ্য কখনো কখনো অসময়ে এই পথে ভ্রমণ করে তবে দৈবাৎ সেরকম কোনো পথিকের আবির্ভাব ঘটলেও তোমার প্রাণরক্ষার আশা নেই;- তোমার সঙ্গে সেই পথিকও যমালয়ে প্রেরিত হবে।… কর্ণদেব! তুমি নীরব যে!.. নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা করো, হয়তো তোমাকে ছেড়ে দিতেও পারি।… এখনও নীরব! তোমার মৃত্যু দেখছি অনিবার্য… আচ্ছা! প্রথমে তোমার একটি চক্ষুকে উৎপাটিত করব, দেখি, তোমার কণ্ঠ কেমন নীরব থাকে—
জল্লাদ এগিয়ে আসতেই তার এক সঙ্গী বাধা দিয়ে বলল, জল্লাদ! অধিক বিলম্ব করা বিপজ্জনক। অনেক সময় ধনুর্বাণধারী শবরগণ দলবদ্ধ হয়ে মৃগয়াল মাংস বিক্রয় করার জন্য এই পথে প্রত্যূষেই নগরীতে প্রবেশ করে- দৈবাৎ তাদের একটি দল যদি এসে পড়ে তাহলে এই ব্যক্তিকে ফেলে পলায়ন করতে আমরা বাধ্য হব।
জল্লাদ ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তার সঙ্গীর দিকে ফিরল, মূঢ়! তুই চুপ কর। যদি ভীত হয়ে থাকিস, তবে স্থানান্তরে গমন কর।
অপর সঙ্গীটি বলে উঠল, এই কিশোরের কাছে মহামূল্য রত্ন ও স্বর্ণমুদ্রা আছে। কাল রাত্রে কুসীদজীবী উত্তানপাদকে এই কিশোর একটি রত্ন দেখিয়েছে। ওর সঙ্গে ওই কুসীদজীবীর কথাবার্তা শুনে বুঝেছি এর কাছে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রাও আছে। জল্লাদ! সেসব কথা তোমাকে বলেছি। এখন যদি একে হত্যা করতে চাও, তবে সত্বর সেই কার্য সমাপ্ত করো। এই কিশোরের মৃতদেহ মৃত্তিকার গর্ভে স্থাপন করে ওর ধনরত্ন নিয়ে আমাদের যথাসম্ভব শীঘ্র এই স্থান পরিত্যাগ করা উচিত। বিলম্বে সত্যই বিপদ ঘটতে পারে।
জল্লাদ তার দুই সঙ্গীর মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, তবে আগে দেখি এর বস্ত্রের মধ্যে কত স্বর্ণমুদ্রা আর কোন্ মহামূল্য রত্ন লুক্কায়িত আছে।
সে নত হয়ে কর্ণদেবের আঙরাখার ভিতর হাত দেওয়ার উপক্রম করল। তৎক্ষণাৎ হাত বাঁধা অবস্থাতেই মাটির উপর শুয়ে পড়ল কর্ণদেব এবং সজোরে পদাঘাত করল জল্লাদের পায়ে। অতর্কিত আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে জল্লাদ ভূমিশয্যায় ছিটকে পড়ল সশব্দে! যে ব্যক্তি বন্ধনরঙ্কু ধরে দাঁড়িয়েছিল, সে সজোরে দড়িতে টান মারল– দড়ির ফাঁস আরও শক্ত হয়ে কর্ণদেবের দুই হাত চেপে ধরল দেহের সঙ্গে।
সগর্জনে উঠে দাঁড়িয়ে জল্লাদ অসি কোষমুক্ত করল, পামর! আগে তোক হত্যা করব। তারপর তোর সর্বস্ব গ্রহণ করব।
প্রভাত সূর্যের আলোতে ঝকমক জ্বলে উঠল শূন্যে আন্দোলিত তরবারি নিজের অজ্ঞাতসারেই দুই চোখ মুদে ফেলল কর্ণদেব। কিন্তু দেহের উপর অস্ত্রাঘাতের যাতনা অনুভব করার পরিবর্তে তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল জল্লাদের কাতর আর্তনাদ এবং কঠিন মাটির উপর তরবারির ঝনৎকার শব্দ!
সচমকে দুই চোখ খুলে সে আশ্চর্য হয়ে দেখল জল্লাদের দক্ষিণ বাহু ভেদ করে থর থর কাঁপছে একটি তীর, আর বাঁ হাত দিয়ে আহত ডান হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করছে জল্লাদ।
জল্লাদ ও তার দুই সঙ্গীর ভীত দৃষ্টি অনুসরণ করে কর্ণদেব দেখল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ধনুর্বাণধারী এক ব্যক্তি। প্রথম তীরে জল্লাদকে বিদ্ধ করেই সে আর একটি তীর ধনুকে লাগিয়ে নিয়েছে। আগন্তুক শুধু ধনুর্বাণধারী নয়, তার কটিদেশে রয়েছে সুদীর্ঘ তরবারি।
আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল কর্ণদেব– এই ব্যক্তি তো তার অপরিচিত নয়! রাজধানীর বিপণিতে প্রথমেই যে লোকটির সঙ্গে তার অসি নিয়ে কলহ হয়, এ সেই লোক।
আগন্তুক এগিয়ে এসে কর্ণদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠল, আরে! তুমি!… তোমাকে দেখছি ভারি বিপদে ফেলে দিয়েছে এরা!
জল্লাদ তার একটিমাত্র চক্ষুর জ্বলন্ত দৃষ্টি আগন্তুকের উপর নিক্ষেপ করে বলল, আমাদের ব্যক্তিগত কলহে তুমি হস্তক্ষেপ করছ কেন?
আগন্তুক সহাস্যে বলল, একজনকে দড়ির ফঁসে বন্দি করে যখন আততায়ী তাকে বধ করতে উদ্যত হয়, তখন সেটাকে আর ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে আমি উপেক্ষা করতে পারি না। ওটা হত্যাকাণ্ড! আর, চোখের সামনে হত্যাকাণ্ড ঘটার উপক্রম হলে আমি সাধ্যমতো বাধা দিয়ে থাকি।
ক্ষতমুখ থেকে সবলে তীরটিকে উৎপাটিত করল জল্লাদ। ফিনকি দিয়ে তপ্ত রক্তধারা ছুটে এসে তার সর্বাঙ্গ সিক্ত করে দিল। সেদিকে ক্রুক্ষেপ না করে জল্লাদ বলল, শোনো! এই কিশোরের কাছে প্রচুর ধনসম্পদ আছে। এসো! ওকে হত্যা করে ওই সম্পদ আমরা ভাগ করে নিই।
আগন্তুকের চোখে এক মুহূর্তের জন্য ক্রোধের আগুন দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল, সে তরল স্বরে বলল, আমি তোমাদের মতো পরস্ব অপহারক দস্যু নই। তাহলে ব্যক্তিগত কলহ নয়– দস্যুবৃত্তি!
এতক্ষণে মৌনব্রত ভঙ্গ করে কথা বলল কৰ্ণদেব, না, নিছক দস্যুবৃত্তি নয়। ওই এক চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আমার পূর্বশত্রুতা ছিল। আমি এই পথে ভ্রমণ করছিলাম, অকস্মাৎ অন্তরাল থেকে দড়ির ফাঁসি নিক্ষেপ করে ওরা আমাকে বন্দি করেছে। তারপর যা ঘটেছে, তা তোমার অজ্ঞাত নয়।
শ্লেষতিক্ত স্বরে আগন্তুক বলল, এই বালককে হত্যা করতে তোমরা তিনজনেও অপারগ! তাই অতর্কিতে তাকে রজ্জতে আবদ্ধ করে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলে?
কেউ উত্তর দিল না।
আগন্তুক আবার বলল, আমি অবশ্য অসিচালনায় এই কিশোরের নৈপুণ্য দেখেছি, কিন্তু রক্তধারায় সেই দক্ষতার পরীক্ষা হয়নি। এইবার দেখব যুদ্ধে এই কিশোরের পারদর্শিতা কেমন।
আততায়ী দড়ির প্রান্ত ছেড়ে দিলেও কর্ণদেবের দুই হাত আর দেহকে বেষ্টন করে তখনও অবস্থান করছিল নাগপাশের মতো দড়ির ফাস।
আচম্বিতে জাগল ধনুকের টঙ্কারধ্বনি- জ্যামুক্ত শর সবেগে কর্ণদেবের ডান হাতের উপরিভাগে বন্ধনরকে দংশন করে ভূমিতে বিদ্ধ হল। সকলে সবিস্ময়ে দেখল শাণিত তিরের ফলা হাত ঘেঁষে দড়ির বাঁধন কেটে দিয়েছে, কিন্তু কর্ণদেবের হাত সম্পূর্ণ অক্ষত! ধনুর্বিদ্যার এমন আশ্চর্য উদারহণ দেখে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল!
নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল আগন্তুকের কণ্ঠস্বর, কিশোর! তুমি বন্ধন-মুক্ত। কাল বিপণিতে যে অসি লাভ করেছে, সেই অসির ধার পরীক্ষা করার সময় উপস্থিত।
মুহূর্তের মধ্যে খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়ে কর্ণদেব গর্জে উঠল, জল্লাদ! অসি গ্রহণ করো। এইবার দেখব তোমার বীরত্ব।
জল্লাদ বলল, আমার দক্ষিণ বাহু বাণাঘাতে বিদীর্ণ। আমি এখন অসি ধারণে অসমর্থ।
কর্ণদেব বলল, সেজন্য আমি দায়ী নই। যাই হোক, তোমার বামবাহু অক্ষত, ওই হাতেই অসি নিয়ে আমার সম্মুখীন হও। আমিও বামহস্তে তরবারি ধারণ করছি।
জল্লাদ বিপন্ন হয়ে বলল, আমি তোমার মতো দুই হাতে তরবারি চালনায় অভ্যস্ত হইনি।
আগন্তুক ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, কিন্তু গুপ্তঘাতকের ন্যায় অতর্কিতে নরহত্যা করতে অভ্যস্ত হয়েছ। এই কিশোর তোমাকে যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে। এখনই যদি তরবারি নিয়ে তুমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ না হও, তবে আমার বাণ তোমার বাহু ছেড়ে বক্ষে বিদ্ধ হবে।
নিরুপায় জল্লাদ বাঁ হাতে কোষ থেকে অসি আকষর্ণ করল।
কর্ণদেব বলল, জল্লাদ। প্রস্তুত হও, এই আমি আক্রমণ করলাম।
অপটু বামহস্তে তরবারি তুলে জল্লাদ আত্মরক্ষার চেষ্টা করল। অসির সঙ্গে অসির সংঘাতে কয়েকবার ঝনৎকার শব্দ উঠল, তারপরই কর্ণদেবের তরবারি আমূল বিদ্ধ হল জল্লাদের বক্ষে।
রক্তাক্ত তরবারির শূন্যে নাচিয়ে জল্লাদের দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে বলল, এই দুই দস্যুকে নিয়ে কি করা যায়?
দুর্বৃত্তদের দিকে ধনুর্বাণের নিশানা উদ্যত রেখে দাঁড়িয়েছিল আগন্তুক, কর্ণদেবের প্রশ্নের উত্তরে বলল, এরা পরস্ব-অপহারক দস্যু।নরহত্যায় এদের দ্বিধা নেই কিছুমাত্র। সুযোগ পেলেই এরা তোমাকে হত্যা করত।
জানি, কর্ণদেব বলল, এদের অসিযুদ্ধে হত্যা করতে আমার বিশেষ অসুবিধা হবে না। তবে, হাতে সময় নেই– অতএব এদের মুক্তি দেওয়াই ভালো।
আগন্তুক হাসল, কিশোর! ঋণ, অগ্নি আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাছাড়া তোমার অসিচালনায় নৈপুণ্য আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম না। জল্লাদ নামে যে দুর্বত্তকে তুমি এখনই হত্যা করলে, সে বামহস্তে অসি চালনা করতে অভ্যস্ত ছিল না– তবে তোমার রণকৌশল দেখে বুঝলাম তুমি বামহস্তে অসিচালনায় অভ্যস্ত। অপটু শত্রুকে তুমি হত্যা করেছ অতি সহজেই। অতএব ওই যুদ্ধে তোমার ক্ষমতার যথার্থ পরীক্ষা হয়নি। এই দুই দুৰ্বত্তের সঙ্গে একে একে উপর্যুপরি যুদ্ধ করে যদি জয় লাভ করতে পারো, তবে বুঝব তোমার ক্ষমতা আছে।
কর্ণদেব বলল, আমার ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার জন্য নরহত্যা করতে হবে?
আগন্তুক বলল, এদের আমি মানুষ বলেই গণ্য করি না। এরা নরখাদক হিংস্র শ্বাপদের মতো বধ্য। তবে তুমি যদি ভীত হয়ে থাকো, সে কথা স্বতন্ত্র।
কর্ণদেব বলল, আমি ভীত নই। এরা নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত নির্বোধ দস্যু। অসি চালনার সূক্ষ্ম কলাকৌশল এরা কখনো শিক্ষা করেনি। এদের হত্যা করতে কতক্ষণ?… তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে এরা আমার শত্রুতাচারণ করতে পারে বটে। তোমার সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করা অনুচিত।
জল্লাদের দুই সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কর্ণদেব বলল, আমি তোমাদের হত্যা করব। তোমরা মিলিতভাবে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো- দেখ, যদি বাঁচতে পারো।
বামহস্তে ছুরিকা আর দক্ষিণ হস্তে তরবারি নিয়ে এগিয়ে গেল কৰ্ণদেব। অপর পক্ষে দুই দুর্বৃত্ত কটি থেকে তরবারি টেনে নিয়ে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য।
ধনুর্বাণধারী আগন্তুক হাঁক দিল, দুই-এর বিরুদ্ধে এক!… চমৎকার! কিশোর! নিজের ক্ষমতার উপর তোমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে দেখছি। আশা করি তোমার এই সাহস বৃথা দুঃসাহস বলে প্রমাণিত হবে না।
তীব্র ধাতব শব্দে ঝংকার তুলে তিনটি তরবারি মিলিত হল, পরক্ষণেই বিদ্যুৎ ঝলকের ন্যায় কিশোরের বাঁ হাতের ছুরি একটি শত্রুর রক্তপান করতে পিছিয়ে এসে আর্তনাদ করে আহত দস্যু বারেক নিজের ক্ষতস্থান দর্শন করে বেপরোয়া আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ততক্ষণে কর্ণদেবের তরবারি অপর দুর্বত্তের স্কন্ধদেশে দংশন করেছে নিষ্ঠুর পুলকে।
দুই দস্যুই বুঝলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বয়সে নবীন হলেও অসিচালনায় সাতিশয় দক্ষ। তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল। কিন্তু যুদ্ধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই অস্ত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন দুই দুৰ্বত্তের রক্তাক্ত মৃতদেহ ধরণীকে আলিঙ্গন করল। রক্তাক্ত অসির শোণিতধারা শত্রুর পরিধেয় বসনে বিলুপ্ত করে নিষ্কলঙ্ক অসিকে পুনরায় কোষবদ্ধ করল কর্ণদেব।
বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে এতক্ষণ যুদ্ধ দেখছিল ধনুর্বাণধারী আগন্তুক, এইবার সে বলে উঠল, সাধু! সাধু! অসি চালনার এমন কৌশল খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু এই দুটি অনডান অসি ধরতেই শেখেনি। এরা তোমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।
জ্বলন্ত চক্ষে কর্ণদেবকে নিরীক্ষণ করতে করতে সে বলল, তোমার ন্যায় প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণেও সুখ আছে।
কর্ণদেব সহাস্যে বলল, কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমি অনিচ্ছুক।
আগন্তুক গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার এবং তোমার গুরুর পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম মনে আছে? তুমি রূঢ় ভাষায় আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে।
কর্ণদেব বলল, অন্যায় করেছিলাম। আমার নাম কর্ণদেব। অস্ত্রগুরুর নাম বলতে পারব না। গুরুর নিষেধ।
আগন্তুক হতাশকণ্ঠে বলল, আমি আশা করেছিলাম তুমি উদ্ধত ভঙ্গিতে পুনরায় আমাকে রূঢ় উত্তর দেবে। কিন্তু অন্যায় স্বীকার করেই তুমি বিভ্রাটের সৃষ্টি করেছ।
বিস্মিত স্বরে কর্ণদেব বলল, কিন্তু আমি তো সত্যই অন্যায় করেছিলাম। সেই স্বীকারোক্তিতে বিভ্রাটের কি হল?
আগন্তুক পূর্ববৎ হতাশ ভঙ্গিতে বলল, তুমি রূঢ় উত্তর দিলে আমি অপমানিত বোধ করে তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে পারতাম। কিন্তু অন্যায় স্বীকার করেই তুমি সব মাটি করে দিয়েছ।
কৌতুক-উচ্ছল স্বরে কর্ণদেব বলল, আমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করার জন্য তুমি এত উৎসুক কেন?
আগন্তুক বলল, আমি আর্যাবর্তের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছি। কোথাও আমার সমকক্ষ ধনুর্ধর বা অসিযোদ্ধার সাক্ষাৎ পাইনি। তোমার অসি চালনার কৌশল দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল এতদিনে বুঝি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ পেলাম। কিন্তু তুমি আমাকে হতাশ করলে!
-অস্ত্র চালনায় দক্ষতা প্রদর্শন করে যদি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাও, কর্ণদেব বলল, তবে বোধহয় তোমাকে সেই সুযোগ আমি দিতে পারব।
আগন্তুক সাগ্রহে প্রশ্ন করল, কবে? কোথায়? কখন?
ধীরে, বন্ধু, ধীরে। স্মরণ রেখো আমি বোধহয় বলেছি। তিরন্দাজ শায়নের গৃহে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি। যদি তার দেখা পাই, তাহলে তোমাকে খুশি করতে পারব না। আর যদি তার সাক্ষাৎ না পাই
বাধা দিয়ে আগন্তুক বলে উঠল, তিরন্দাজ শায়নের গৃহে তার সাক্ষাৎ তুমি পাবে না।
কর্ণদেবের ভ্রু কুঞ্চিত হল, কেন?
–সে গৃহে নেই।
-তুমি কি করে জানলে সে গৃহে নেই? তুমি তো তার গৃহের বিপরীত দিক থেকে অর্থাৎ রাজধানী থেকে আসছ!
–এই মুহূর্তে সে কোথায় আমি জানি।
কোথায়?
–তোমার সম্মুখে।
স্তম্ভিত নেত্রে কিছুক্ষণ আগন্তুকের মুখের দিকে চেয়ে রইল কর্ণদেব, তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, তুমিই শায়ন?… হ্যাঁ, তাই হবে। বাহুকে অক্ষত রেখে বাহুর উপরজড়িত রঞ্জুকে যে শরাঘাতে ছিন্ন করতে পারে, এমন তিরন্দাজ শায়ন ভিন্ন আর কে আছে?
শায়ন হাসিমুখে বলল, কর্ণদেব! এবার বলো, অস্ত্রচালনায় আমার দক্ষতা প্রদর্শন করার উপযুক্ত ক্ষেত্র কোথায় আছে? সেখানে গেলে আমি কি উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দীর সাক্ষাৎ পাব?
–তোমার সমকক্ষ তিরন্দাজ শ্রাবস্তী রাজ্যে আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু অসিচালনায় তোমারই মতো নিপুণ আর একটি মানুষের সাক্ষাৎ তুমি নিশ্চয়ই পাবে।
–ভালো। সমকক্ষ অসিযোদ্ধার সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করতে আমি সর্বদাই ইচ্ছুক।
–উঁহু। সেই দক্ষ অসিযোদ্ধা তোমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় না, বন্ধুত্ব করতে চায়।
–বন্ধুত্ব চায়? যে আমাকে চোখেও দেখে নি, সে আমার বন্ধুত্ব চাইছে কেন?
–এক কঠিন কার্যে সিদ্ধিলাভ করার জন্য তোমার ন্যায় নিপুণ অসিযোদ্ধা এবং লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত তিরন্দাজের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন মনে করেই তোমার কাছে আমাকে প্রেরণ করেছে আমার অস্ত্রগুরু। তিরন্দাজ শায়নের নাম শ্রাবস্তী রাজ্যে লোকের মুখে মুখে ফেরে। সুতরাং আমার গুরুর কানেও তোমার নাম গেছে।
-তোমার গুরু! যার কাছে তুমি অসিচালনা শিক্ষা করেছ?
–হ্যাঁ।
সাধু! সাধু! আমি তার সঙ্গে দেখা করতে উগ্রীব। কোথায় তিনি?
–বলছি। কিন্তু তার আগে বলো– রাজধানীতে যখন তোমার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, তখন তোমার কটিতে তরবারি থাকলেও পৃষ্ঠে ধনুর্বাণ ছিল অনুপস্থিত। এখন দেখছি, ধনুর্বাণ তোমার অঙ্গশোভা বৃদ্ধি করছে। এই ধনুক আর শরপূর্ণ তূণীর কি তাহলে তুমি রাজধানী থেকে ক্রয় করেছ?
-আরে না, না। রাজধানীতে বন্ধুগৃহে একটি দিন ও একটি রাত অতিবাহিত করতে গিয়েছিলাম। রাজপথে ধনুর্বাণ নিয়ে চলাফেরা করে কেবল সৈনিক ও মাংস ব্যবসায়ী শবর। আমি শবরও নই, সৈনিকও নই, অনর্থক লোকের কৌতূহলী চক্ষুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই না– তাই বন্ধুগৃহে ধনুর্বাণ রেখেই রাজপথে ভ্রমণ করছিলাম। এখন গৃহে ফিরে যাচ্ছি, তাই সঙ্গের ধনুর্বাণ আবার অঙ্গে উঠেছে।
তুমি বুঝি প্রায়ই রাজধানীতে গিয়ে কালক্ষেপ করো?
–গুরুত্বপূর্ণ কার্যে প্রাণসংশয় ঘটার সম্ভাবনা থাকলে বন্ধুগৃহে যাই এবং রাজধানীতে বিবিধ আমোদ-প্রমোদে আত্মাকে তৃপ্ত করে গৃহে এসে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করি– তারপর যথাস্থানে গমন করি কর্তব্য পালন করতে।
-তাহলে বর্তমানে প্রাণসংশয় ঘটার মতো কোনো বিপজ্জনক কার্যে তুমি যোগ দিতে যাচ্ছ?
-হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে তোমার বক্তব্য শুনতে চাই। তোমার গুরু এক কঠিন কার্যে আমাকে নিয়োগ করতে ইচ্ছুক হয়েছেন শুনে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠেছি। সত্বর আমার কৌতূহল নিবারণ করো।
–তার আগে তোমার কাছে আমি মাত্র একটি প্রতিশ্রুতি চাই।
–কি প্রতিশ্রুতি?
–প্রতিজ্ঞা করো, আমার প্রস্তাবে সম্মত না হলেও কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে এই বিষয়ে কিছু বলবে না।
-কর্ণদেব! আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমার প্রস্তাব আমার মুখ থেকে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির কর্ণগোচর হবে না। এখন বলল, কি তোমার প্রস্তাব?
অতঃপর কর্ণদেব শায়নকে যা বলল সেইসব কথা আমরা পূর্বেই তার মুখ থেকে বল্লভের গৃহে শুনেছি। এখানে পুনরুক্তি অনাবশ্যক। সব কথা শুনে শায়ন কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করল, তারপর বলল, তাহলে পরন্তপই তোমার অস্ত্রশিক্ষার গুরু?… ভাল; দস্যু পরন্তপ যে দক্ষ যোদ্ধা সেই তথ্য আমার অবিদিত নয়। দস্যুবৃত্তিকে আমি সমর্থন করি না কিন্তু যে কাজে পরন্তপ আমার সাহায্য প্রার্থী, সেই কাজে তাকে সাহায্য করতে আমার আপত্তি নেই। বিশেষত অর্থের প্রয়োজন কার না আছে? আমি তোমার প্রস্তাবে সম্মত। কর্ণদেব! বলল- কবে, কোথায়, কখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে?
-যে বটবৃক্ষের তলদেশে পঞ্চপাণ্ডব আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে, সেই বৃক্ষের তলায় আজ সন্ধ্যার প্রাক্কালে পরন্তপের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হতে পারে।
-আজ সন্ধ্যার প্রাক্কালে? অসম্ভব।
অসম্ভব? কেন?
এখান থেকে তিন চার ক্রোশ দূরে এক গ্রামে সিংহের উপদ্রব শুরু হয়েছে। বহু গো-মহিষ ও মানুষ ওই সিংহের কবলে প্রাণ হারিয়েছে। সপ্তাহকাল পূর্বে প্রতিনিধি স্বরূপ কয়েকজন ব্যক্তি এসে আমার সাহায্য প্রার্থনা করে। সিংহটিকে হত্যা করতে পারলে তারা আমাকে দশটি স্বর্ণমুদ্রা পারিশ্রমিক দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছে। অগ্রিম মূল্যস্বরূপ তিনটি স্বর্ণমুদ্রা তারা আমাকে দিয়ে গেছে। আজ দ্বিপ্রহরের মধ্যেই তাদের গ্রামে আমার পৌঁছনোর কথা। ওই নরমাংসলোপ খাপদকে বধ না করে আমি এখন অন্যত্র গমন করতে পারি না।
–এইখান থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে গমন করলে বোধহয় ওই গ্রামে পৌঁছনো যায়। ঐ গ্রামের কিছু আগে বোধ হয় একটি বৃহৎ পর্বতের অস্তিত্ব আছে?
-হ্যাঁ, তুমি ওই গ্রামে গিয়েছে?
তা গিয়েছি বটে। শায়ন! তুমি স্বচ্ছন্দে সন্ধ্যাকালে পরন্তপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারো। ওই সিংহ আর জীবিত নেই।
–সিংহ জীবিত নেই? তুমি কি করে জানলে?
–ঠিক দুই দিন আগে মধ্যাহ্নকালে তরবারির আঘাতে পশুরাজের মৃত্যু ঘটেছে।
তরবারির আঘাতে সিংহকে হত্যা করল কে! আর সে সংবাদ তুমিই বা জানলে কি করে?
–শোনো বলছি। রাজধানীতে আসার জন্য বনপথ অতিক্রম করে চলতে চলতে সিংহের অত্যাচারে সন্ত্রস্ত গ্রামটির মধ্যে এসে পড়েছিলাম। গ্রামবাসী আমাকে নিকটেই নরখাদক সিংহের অস্তিত্ব জানিয়ে সাবধান করে দেয়। নিকটবর্তী পর্বত দেখিয়ে তারা বলে সিংহ নাকি ওই পর্বতেরই এক গুহাতে বাস করে– অতএব উক্ত গিরিপথে ভ্রমণ না করে অন্য পথে ঘুরে যাওয়াই আমার পক্ষে নিরাপদ পন্থা বলে তারা মতপ্রকাশ করে। আমি তাদের সঙ্গে বিতর্কে ব্যাপৃত না হয়ে তাদের কথাতেই সায় দিলাম। কিন্তু কার্যত ওই পর্বতের গিরিপথ ধরেই অগ্রসর হলাম। কারণ, অন্য পথে ঘুরে গেলে রাজধানীতে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সিংহের ভয়ে বিলম্ব করতে আমার অহঙ্কারে বাধল। তাছাড়া প্রখর দিবালোকে সিংহ হয়তো আক্রমণ করতে সাহসী হবে না একথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু মধ্যাহ্নের তীব্র সূর্যালোকের মধ্যেই নরখাদক আমাকে আক্রমণ করল। বোধ হয় গ্রামের লোক অত্যন্ত সতর্ক থাকার ফলে পশুরাজ গ্রাম থেকে মাংসের খাজনা আদায় করতে পারেনি, তাই ক্ষুধার্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল শিকারের জন্য। যে কারণেই হোক, প্রকাশ্য দিবালোকেই সিংহ আমাকে আক্রমণ করল। তরবারির দ্রুত সঞ্চালনে শ্বাপদের আক্রমণ ব্যর্থ করলাম। আহত ও ক্রুদ্ধ সিংহ পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আমাকে নখদন্তের আলিঙ্গনে বন্দি করতে সচেষ্ট হল। আমি সজোরে আঘাত হানলাম- তরবারি আমূল প্রবেশ করল সিংহের বক্ষে। আমার তরবারি বক্ষে ধারণ করে মরণাহত পশুরাজ ছিটকে পড়ল পর্বতের তলদেশে। আমি তাড়াতাড়ি পদচালনা করে পৌঁছলাম রাজধানীতে। শায়ন! সেই জন্যই তুমি আমার কটিবন্ধে শূন্যগর্ভ অসিকোষ দেখতে পেয়েছিলে।
শায়ন এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় কর্ণদেবের কাহিনি শুনছিল, এইবার সজোরে তার স্কন্ধে চপেটাঘাত করে বলে উঠল, সাধু! সাধু! কর্ণদেব আজ সন্ধ্যায় আমি নিশ্চিত ওই বটবৃক্ষের তলায় উপস্থিত থাকছি। কিন্তু এখন আমার গৃহে কিছুক্ষণের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করতে তোমার আপত্তি আছে কি? গৃহে তণ্ডুল ও মৃগমাংস আছে। তাতে হয়তো…
বাধা দিয়ে কর্ণদেব বলল, না। পরন্তপ আমার জন্য উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করছে। তাকে সমস্ত সংবাদ অবিলম্বে জানানো প্রয়োজন। আরও একটা কথা–
-বলো।
–বল্লভের কথা তোমাকে আগেই বলেছি। সন্ধ্যাকালে তাকেও তুমি পূর্বোক্ত স্থানে দেখতে পাবে। আশা করি বল্লভকে সঙ্গী হিসাবে নিতে তোমার আপত্তি হবে না।
–কি যে বোল। গেরুয়াধারী বল্লভের প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির খ্যাতি আমার কানেও এসেছে। অবশ্য বল্লভ সম্পর্কে খুব বেশি অবহিত নই। কারণ, বল্লভ কিছুটা প্রচারবিমুখ। এমন একটি মানুষকে বিপজ্জনক পথে সঙ্গীরূপে পেলে খুশি হব।
-তবে এখন বিদায় গ্রহণ করছি। সন্ধ্যাকালে পুনরায় দেখা দেখা হবে।
-হ্যাঁ। সন্ধ্যাকালে দেখা হবে। তোমার অস্ত্রগুরু পরন্তপের সঙ্গেও আশা করি সাক্ষাৎ হবে?
–বলাই বাহুল্য।