১০. কম্পিউটার মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে

কম্পিউটার মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে জন তিষার দিকে তাকাল, হাত দিয়ে, সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে বলল, “আমাদের কেন মিশরীয় সভ্যতার উপর রিপোর্ট লিখতে হবে?”

জনের সাথে সাথে থেকে তাদের ক্লাশের অনেকেই এখন সাইন। ল্যাংগুয়েজ অনেকখানি বুঝতে পারে, যখন বুঝতে পারে না তখন জন ফিস ফিস করে তার আধা যান্ত্রিক আধা মানবিক গলায় বুঝিয়ে দেয়। এবারে অবশ্যি তার বুঝিয়ে দিতে হল না, জন কী বলতে চেয়েছে তিষা সাইন ল্যাংগুয়েজ থেকে সেটা বুঝে গেল। হেসে বলল, “কোর্সটা ইতিহাসের তাই মিশরীয় সভ্যতার উপর লিখতে হবে। কম্পিউটারের কোর্স হলে কম্পিউটারের উপর লিখতে হত। গাড়ীর কোর্স হলে গাড়ীর উপর লিখতে হত।”

জন হাত দিয়ে বলল, “সরাসরি কেটে এনে রিপোর্টে বসিয়ে দিলে সমস্যা কী? নিজের মতো করে লিখতে হবে কেন? আমি কী গুগল থেকে বেশী জানি?”

তিষা হাসল, বলল, “সেটা ভুল বলনি! কিন্তু গ্রেডটা তো গুগলকে দেয়া হয় না, গ্রেড দেয় তোমাকে!”

জন হতাশার ভঙ্গী করে আবার মনিটরে চোখ দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মিশরের ফেরাউন রামেসিসের কাহিনী পড়তে থাকে।

এরকম সময় মিশকা ঘরে এসে ঢুকে, সে কাছে এসে তিষাকে ধরে দুই পায়ে দাঁড়াল। তিষা মিশকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “কী খবর মিশকা? জীবনটা কী রকম মনে হচ্ছে?”

মিশকা ফিক করে হেসে তিষার হাতে হাত বুলিয়ে দেয়। তার ভঙ্গী দেখে মনে হয় সে বুঝি তিষার কথাটা বুঝতে পেরেছে। তিষা বলল, “মিশকা। তুমিই ভালো আছ তোমার মিশরীয় সভ্যতার উপর রিপোর্ট এনিম্যান লিখতে হচ্ছে না!”

মিশকা আবার ফিক করে হেসে উঠল। জন মিশকার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “কী সুন্দর হাসে দেখেছ?”

মিশকা জনের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় সেও বুঝি সাইন ল্যাংগুয়েজ বোঝার চেষ্টা করছে, তারপর জনের কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত বুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। জন আদর করে মিশকার চুল এলোমেলো করে দিয়ে তিষাকে বলল, “আমি কখনো জানতাম না মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী হাসতে পারে।”

তিষা বলল, “হয়তো এটা মানুষ।”

জন মাথা নাড়ল, বলল, “না। এটা মানুষ না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেছে। এর জিনেটিক কোডিং মানুষের থেকে ভিন্ন।”

“কতোটুকু ভিন্ন? তার চেয়ে বড় কথা কতোটুকু ভিন্ন হলে তুমি বলবে এটা মানুষ না?”

জন হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, “আমি জানি না। আমি এনিম্যান ডিজাইন করি নাই।”

তিষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশকার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তা ছাড়া এই যে এর মুখের হাসি, তুমি কী মনে কর এটা সত্যি? হয়তো এটা সত্যি না।”

জন হাত তুলে তিষাকে থামাল, বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, মনে আছে তুমি তোমার ব্লগে এটা লিখেছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“তারপর অন্যেরা কী লিখেছে দেখ নাই।”

“দেখেছি। অন্যেরা বলেছে এটা ঠিক না, তাদের এনিম্যান কখনো ভয় পায় না, দুঃখ পায় না। বলেছে এনিম্যানের ভয় পাবার, দুঃখ পাবার, মনে কষ্ট পাবার ক্ষমতা নেই।”

“কাজেই কেস ক্লোজড। তুমি এটা নিয়ে মাথা ঘামিও না।”

তিষা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”

“কী মনে হয়?”

“আমার মনে হয় এই যে অন্যেরা যা লিখেছে সেগুলো আসলে সত্যি না। যারা এনিম্যান তৈরী করেছে তারা চায় না আসল কথাটা বের হয়ে আসুক। তারা সবকিছু গোপন রাখতে চায়।”

জন হা হা করে হাসল, বলল, “তুমি আজকাল মনে হয় খুব বেশী ডিটেকটিভ বই পড়ছ!”

তিষা হাসল না। বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”

“কী?”

“আমার মনে হয় আমি যদি কোনোভাবে মিশকার সাথে কথা বলতে পারতাম তাহলে জিজ্ঞেস করতাম, বল দেখি মিশকা তোমার মনে কোনো গোপন দুঃখ আছে কী না!”

জনের মনে হল কথাটা খুব পছন্দ হল, সে আরো জোরে হা হা করে। হাসতে লাগল। মিশকা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর সেও, খিল খিল করে হাসতে লাগল।

.

দুইদিন পর বিকেল বেলা তিষা স্কুলে তার আম্মুর জন্যে অপেক্ষা করছে তখন তার টেলিফোন বেজে উঠল, তার আম্মুই ফোন করেছেন। তিষা ফোন ধরল, “হ্যালো আম্মু। তুমি কোথায়?”

“আর বলিস না। সেফওয়ে থেকে বাজার করে গাড়ীতে উঠেছি, দেখি গাড়ী কেমন যেন ঘসটে ঘসটে যাচ্ছে আর থপ থপ শব্দ!”

তিষা অবাক হয়ে বলল, “থপ থপ শব্দ?”

“হ্যাঁ, গাড়ী থামিয়ে দেখি সামনের ডান দিকের চাকায় কোনো বাতাস নাই। চাকা পাংচার।”

“এখন?”

“গাড়ী পার্কিং লটে রেখে তোর আব্বুকে ফোন করেছি!”

তিষা হতাশ ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “এই দেশের ক্লাশ ফাইভের বাচ্চাও গাড়ীর চাকা পালটাতে পারে, আর তুমি এখনো মনে হয় জান না। তোমার গাড়ীর চাকা কয়টা!”

আম্মু বললেন, “ঢং করবি না। আমি মরি নিজের যন্ত্রণায় আর ইনি এসেছেন জ্ঞান দিতে।”

“তুমি যদি চাকা বদলানো শিখে নিতে তাহলে আর নিজের যন্ত্রণায় মরতে হত না। যাই হোক আমি কী করব? তোমার জন্যে অপেক্ষা করব নাকী বাসায় চলে যাব?”

“আমার মনে হয় দেরী হবে। তোর আব্বু সেই বেসমন্ট থেকে আসবে, এসে আমার উপর একটু মেজাজ করবে তারপর চাকা বদলাবে তারপর আবার মেজাজ করবে তারপর পাংচার চাকা ঠিক করতে দিবে মনে হয় কয়েকঘন্টার ধাক্কা। তুই কোনোভাবে চলে যা–”

“ঠিক আছে আম্মু।”

“তুই কীভাবে যাবি?”

“বাসে চলে যাব না হলে কেউ নামিয়ে দেবে। জনের কতো বড় গাড়ী দেখ নাই?”

“ঠিক আছে।”

তিষা জনকে খুঁজে বের করে বলল, “জন। তুমি যদি আমাকে দশ ডলার দাও তাহলে তোমাকে আমি একটা খুবই স্পেশাল কাজ করার সুযোগ দিব।”

“কী স্পেশাল কাজ?”

“আমার আম্মু তার গাড়ী নিয়ে আটকা পড়েছে, আমি তোমাকে আমায় বাসায় নামিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ দেব।”

জন হা হা করে হেসে কুর্নিস করার ভঙ্গী করে মাথা নিচু করে বলল, “প্রিন্সেস তিষা! আপনাকে বাসায় নামিয়ে দেবার জন্যে আমি দশ ডলার কেন দশ হাজার ডলার দিতে প্রস্তুত।”

তিশা বলল, “আজকে স্পেশাল সেল, তাই তোমার জন্যে ফ্রী! চল।”

একটু পরেই দেখা গেল জনের বিশাল গাড়ীতে জনের পাশে বসে তিষা তার বাসায় রওনা দিয়েছে। জন কয়েক মিনিট গাড়ী চালিয়েই তার ভ্রূ কুঁচকে একটা গালি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল। তিষা বলল, “কী হয়েছে?”

জন কানে শুনতে পায় না, মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ভঙ্গী দেখে কথা বুঝতে পারে তাই সে তিষার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। জন গাড়ীর গতি হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিয়ে আবার হঠাৎ করে কমিয়ে এনে কিছু একটা পরীক্ষা করল। তিষা জনের কাঁধ স্পর্শ করতেই সে ঘুরে তিষার দিকে তাকাল। তিষা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

জন স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে বলে সাইন ল্যাংগুয়েজে না বলে তার নিজস্ব অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, “কিছু একটা গোলমাল লাগছে। গাড়ীটা ঠিক ব্যবহার করছে না।”

তিষা হেসে ফেলল, বলল, “গাড়ী কী মানুষ নাকী! গাড়ী আবার ঠিক আর ভুল ব্যবহার করবে কেমন করে?”

জন বলল, “মানুষকে কেউ বিশ্বাস করে না। গাড়ীকে করতে হয়।”

জন দক্ষ হাতে গাড়ীটা চালিয়ে নিতে থাকে। তাদের স্কুলটা ছোটখাটো একটা উপত্যকার মাঝে, শহরে যেতে হলে আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে পাহাড়ী একটা এলাকায় উঠতে হয়। সেখান থেকে ঢালু বেয়ে নিচে নেমে একটা খাড়া পাথরের ঢালের পাশে দিয়ে যেতে হয়। জায়গাটা একটু বিপদজনক তবে জনের জন্যে এটি কোনো সমস্যা নয়। এই পথে সে

এতোবার গাড়ী চালিয়েছে যে সে আক্ষরিক অর্থেই চোখ বন্ধ করে এখানে গাড়ী চালিয়ে যেতে পারে।

পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নামার সময় হঠাৎ জন চিৎকার করে একটা গালি দিল, গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, তিষা চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে?”

“ব্রেক ফেল করেছে।”

তিষা আতংকিত হয়ে দেখে জন বারবার ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে আর প্রতিবার প্যাডেল একেবারে নিচে নেমে যাচ্ছে কিন্তু গাড়ী থামছে না, ব্রেক একেবারেই কাজ করছে না।

পাহাড়ী ঢালু বেয়ে নামতে নামতে গাড়ীর বেগ বেড়ে যাচ্ছে জন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার মাঝে হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ বেড়ে গেল–শুধু যে ব্রেক কাজ করছে না, গাড়ীর ইঞ্জিন দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করছে। গাড়ী সোজা ছুটে যাচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে খাড়া ঢালটায় এসে রাস্তার পাশের হালকা রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে কয়েকশ ফুট নিচে পাথরের উপর ছিটকে পড়বে। পৃথিবীর কোনো শক্তি এখন তাদের থামাতে পারবে না।

জন হঠাৎ আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল। স্টিয়ারিং হুইলটা শক্ত করে তার বিচিত্র যান্ত্রিক উচ্চারণে বলল, “তিষা।”

“হ্যাঁ।”

“হ্যান্ডব্রেকটা দুই হাত দিয়ে ধর।”

তিষা কাঁপা হাতে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা দুই হাতে ধরল।

জন শান্ত গলায় বলল, “যখন আমি বলব তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেকটা টানবে।”

“ঠিক আছে।”

“যদি গাড়ী থামাতে না পারি দুজনেই মরে যাব।”

তিষা কোনো কথা বলল না। জন বলল, “আমি দুঃখিত তিষা। আমি খুব দুঃখিত। এটা হওয়ার কথা ছিল না।”

তিষা কোনো কথা না বলে সমস্ত শক্তি দিয়ে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা ধরে রাখল, জন যখন বলবে সে টেনে ধরবে।

খাড়া ঢালটাতে নেমে রেলিংটাতে প্রচণ্ড বেগে আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তে জন সমস্ত শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে স্টিয়ারিং হুইল পুরোটা ঘুরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “এখন।”

গাড়ীটা ঘুরছে, কোন দিকে ঘুরছে সে জানে না, বিকট ঘর্ষণের শব্দ হচ্ছে তার সাথে টায়ার পোড়া গন্ধ, ধোঁয়ায় গাড়ী ভরে গেল। সিট বেল্ট তার বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসেছে, তার মনে হল তবু বুঝি সে ছিটকে বের হয়ে যাবে, সে সবকিছু ভুলে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে ধরল।

তারপর কী হল সে জানে না। গাড়ীটা কয় পাক ঘুরেছে সেটাও জানে।, কোথায় ধাক্কা খেয়েছে তাও জানে না, কিন্তু হঠাৎ করে টের পেল গাড়ীটা থেমে গেছে। জন তার বিচিত্র উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছ?”

তিশা বলল, “মনে হয়।”

“তাহলে নেমে যাও।”

তিষা পোড়া একটা গন্ধ টের পেলো কোথা থেকে জানি ধুয়া বের হচ্ছে। হাত দিয়ে দরজার হ্যাঁন্ডেলটা টান দিয়ে সে দরজা খুলে বের হয়ে এল। কপালের কাছে হাত দিতেই ভিজে চটচটে একটা অনুভূতি হল। হাত চোখের সামনে এনে দেখে রক্ত, কপালের কাছে কোথাও কেটে গেছে।

গাড়ীর অন্য পাশ থেকে জন নেমে আসে, তার নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিষার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “আমরা বেঁচে গেছি।”

তিষা ফিস ফিস করে বলল, “থ্যাংকু জন। শুধু মাত্র তোমার জন্যে বেঁচে গেছি।” রাস্তার পাশে তখন বেশ কয়েকটা গাড়ী এসে থেমেছে, সেখান থেকে লোকজন নেমে তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। এতক্ষণ তারা দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের ক্লান্তি এসে তাদের উপর ভর করে। প্রথমে তিষা তারপর জন রাস্তার পাশে এসে বসে পড়ল। তিষা জনের ঘাড়ে মাথা রেখে ফিস ফিস করে বলল, “কী হয়েছিল জন?”

জন বিড় বিড় করে বলল, “কেউ একজন আমাদেরকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল!”

তিষা কথাটা শুনতে পেল না, তাই জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ?”

জন তিষার মুখের দিকে তাকাল, মুখের মাঝে বয়সের তুলনায় বেমানান একটা নির্দোষ সারল্য, তার হঠাৎ করে তার জন্যে এক ধরণের বিচিত্র মায়া হল। বলল, “ব্রেক ফেল করেছিল।”

“কেন?”

“জানি না তিষা। আমি জানি না।”