১০ম অধ্যায়
ঐষীকপর্বাধ্যায়–স্বজনবধে যুধিষ্ঠিরবিলাপ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এ দিকে রজনী প্রভাত হইবামাত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া ঐ রাত্রির সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণনপূর্ব্বক কহিল, “মহারাজ। দ্রুপদতনয়গণ ও দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র রাত্রিকালে বিশ্বস্তচিত্তে শিবিরমধ্যে নিদ্রিত ছিলেন, দুরাত্মা কৃপাচার্য্য, কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামা সেই সুযোগে তাঁহাদিগকে বিনাশ করিয়াছে। ঐ দুরাত্মাদিগের প্রাস, শক্তি ও পরশুপ্রভাবে আমাদের অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, মনুষ্য এককালে নিঃশেষিত হইয়াছে। কুঠারনিকৃত্ত মহাবনের ন্যায় আপনার বিপুল বল বিনষ্ট হইতে আরম্ভ হইলে তুমুল শব্দ শ্রুতিগোচর হইয়াছিল। দুরাত্মারা আপনার শিবিরস্থ সমুদয় প্রাণীর প্রাণ সংহার করিয়াছে, কেবল আমি একাকী অনবহিত কৃতবর্ম্মার হস্ত হইতে অতিকষ্টে মুক্তিলাভ করিয়াছি।”
হে জনমেজয়! কুন্তীতনয় যুধিষ্ঠির দূতমুখে সেই অমঙ্গলবাক্য শ্রবণ করিবামাত্র পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। মহাবীর সাত্যকি, ভীমসেন, অর্জুন, নকুল ও সহদেব তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ধারণ করিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ অতিকষ্টে সংজ্ঞালাভ করিয়া শোকাকুলবাক্যে বিলাপ করিয়া কহিলেন, “হায়! আমরা যে শত্রুগণকে পরাজয় করিলাম, আবার তাহাদিগের সহিতই আমাদিগকে পরাজিত হইতে হইল। কাৰ্য্যগতি দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরও নিতান্ত দূর্জ্ঞেয়। আমরা বিপক্ষগণের গুরু, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, বয়স্য ও অমাত্য প্রভৃতি সকলকে পরাজয় ও বিনাশ করিয়া পরিশেষে পরাজিত হইলাম। দেবপ্রভাবে অনর্থ অর্থের ন্যায় এবং অর্থ অনর্থের ন্যায় বোধ হইয়া থাকে। এক্ষণে আমাদিগের এই জয়লাভ পরাজয় তুল্য এবং বিপক্ষদিগের পরাজয় জয়ের তুল্য হইয়াছে। যে জয় দ্বারা বিপদগ্রস্তের ন্যায় অনুতাপ করিতে হয়, সে জয় কখনই জয় নহে, উহা পরাজয়স্বরূপ। হায়! আমরা যাহাদিগের নিমিত্ত বন্ধু-বান্ধব বিনাশ করিয়া পাপাচার করিলাম, নির্জিত ব্যক্তিগণ আবার সেই জয়লাভপ্রহৃষ্ট পুত্রগণকেই বিনষ্ট করিল। দেখ, কর্ণি ও নালীক যাহার দংষ্ট্রা, খড়্গ যাহার জিহ্বা, কার্মুক যাহার ব্যাদিত বদন ও জ্যা-নিস্বন যাহার গর্জনস্বরূপ প্রতিয়মান হইত, সেই সিংহস্বরূপ সমরোৎসাহী ক্রোধাবিষ্ট কর্ণের হস্ত হইতে যাহারা পরিত্রাণ লাভ করিয়াছিল, তাহারাই আজ প্রমোদবশতঃ নিহত হইল। যাহারা বায়ুবেগগামী তুরঙ্গ-সংযোজিত রথে সমারূঢ়, বিচিত্র শরশরাসনসম্পন্ন, সমরদুর্ম্মদ দ্রোণাচার্য্যের নিকট মুক্তি লাভ করিয়াছিল, আজ সেই রাজপুত্রগণই প্রমাদ প্রযুক্ত কালকবলে প্রবেশ করিল। অতএব মর্ত্যলোকে প্রমাদই মনুষ্যের নিধনের প্রধান কারণ। অনবহিত ব্যক্তি অচিরাৎ অর্থভ্রষ্ট ও অনর্থগ্রস্ত হয় এবং কদাচ বিদ্যা, তপস্যা, শ্রী ও কীৰ্ত্তিলাভে সমর্থ হয় না। দেখ দেবরাজ ইন্দ্র অবহিত হইয়াই সমস্ত শত্রু বিনাশপূর্ব্বক সুখে ইন্দ্রত্ব ভোগ করিতেছেন। সমৃদ্ধিসম্পন্ন বণিকেরা যেমন সাবধানে সমুদ্র সমুত্তীর্ণ হইয়া পরিশেষে প্রমাদ-প্রযুক্ত সামান্য নদীমধ্যে নিমগ্ন হয়, তদ্রূপ শিবিরস্থ রাজবংশীয় মহেন্দ্রতুল্য বীরগণ মহারথদিগের হস্ত হইতে বিমুক্ত হইয়া অনবধানতাবশতঃ ক্ষুদ্র অরাতিহস্তে নিহত হইল। তাঁহারা নিদ্রিতাবস্থায় শক্তহস্তে নিহত হইয়া স্বর্গলোকে গমন করিয়াছে সন্দেহ নাই। হায়! এক্ষণে প্রিয়তমা দ্রৌপদী বৃদ্ধ পিতা এবং ভ্রাতা ও পুত্রগণের নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিবামাত্র জ্ঞানশূন্য ও ভূতলে নিপতিত হইয়া শোকানলে দগ্ধ হইবে। হায়! আজ তাঁহার কি দুর্দ্দশা উপস্থিত হইল।”
রাজা যুধিষ্ঠির এইরূপ বিলাপ করিয়া নকুলকে কহিলেন, ‘মাদ্রীতনয়! তুমি অবিলম্বে মন্দভাগিনী দ্রৌপদীকে তাঁহার মাতৃকুলের সহিত এই স্থানে উপনীত কর।” তখন ধর্ম্মাত্মা নকুল যুধিষ্ঠিরের বচনানুসারে রথারোহণপূর্ব্বক দেবী পাঞ্চালী ও পাঞ্চালরাজের মহিষীগণকে আনয়নার্থ প্রস্থান করিলেন। মাদ্ৰীতনয় প্রস্থান করিলে রাজা যুধিষ্ঠির শোকাদ্দিচিত্তে সুহৃদগণসমভিব্যাহারে রোদন করিতে করিতে সেই ভূতগণ সমাকীর্ণ শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, তাঁহার পুত্রগণ ও বন্ধুবান্ধব সমুদয় রুধিরাক্তকলেবরে ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। তাঁহাদিগের দেহ ছিন্নভিন্ন এবং কলেবর হইতে মস্তক পৃথত হইয়াছে। ধর্ম্মরাজ তাঁহাদের সেই দুরবস্থা দর্শনে যার পর নাই দুঃখিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে অচেতন ও অনুচরগণের সহিত ভূতলে নিপতিত হইলেন।