দশ – একটি সান্ধ্য অভিযান
দেখতে দেখতে বড়ো গাছগুলোর সব পাতা ঝরে যায়। ধুলোউড়ির মাঠে শূন্য খেত থেকে ধুলো ওড়া শুরু হয়। এবং কর্ণসুবর্ণ টিলার ওপর মাঝে মাঝে দেখা যায় স্বাধীনচেতা একটি ঘোড়াকে। ছেলেপুলেরা তাকে তাড়া করে ধরতে পারে না। সে অকুতোভয়ে আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায় এবং রাত্রিযাপন করে। তার দেহ ততদিনে রীতিমতো মেদপুষ্ট ও সতেজ।
সহকারী স্টেশন মাস্টার সুধাময় একদিন সবিস্ময়ে দেখে, বিদ্যুৎশিখার মতো ঝিলিক দিয়ে স্বর্ণলতা ধুলো উড়িয়ে মাঠ চিরে ছুটোছুটি করছে—তার লক্ষ্য সেই পৈতৃক জঙ্গম সম্পত্তি।
সুধাময়ের হাসি পায়। ডিসট্যান্ট সিগনালের কাছে দাঁড়িয়ে সে স্বর্ণর উড়ন্ত চুল দেখে ভাবে, এ নারীর মধ্যে প্রচণ্ড আদিমতা আছে, এবং মনে মনে একটু উদ্বিগ্ন হয়। এ কাকে সে ভালোবাসছে মনে মনে গোপনে! প্রণয়ের বিপুল চাপা আবেগ নিয়ে তার দিন কাটে তো রাত কাটে না। তা কি বোঝে স্বর্ণ? যেন বোঝে, যেন বা বোঝে না। চটুল হালকা কথায় উচ্ছ্বসিতা স্বর্ণ কখনও হয়ে ওঠে যেন আত্মসমর্পণে তৈরি, কখনও তীব্র হুইসল দিয়ে মেল ট্রেনের মতন স্টেশন ছেড়ে যায়। সুধাময়ের মনে হয়, এই উপমাটাই ঠিক। এ সুন্দর সবুজ বন্য ট্রেন তার মতন ছোট্ট ভদ্র স্টেশনের জন্য নির্দিষ্ট নয়।
‘চৈতক’ হ্রেষাধ্বনি করে দূরের দিকে পালিয়ে যায়। তার দোদুল্যমান পুচ্ছদেশে শেষ মাঘের দিনাবসান প্রতিবিম্বিত হতে থাকে কিছু বর্ণচাঞ্চল্যে। উঁচু একটা ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে তাকে নিরীক্ষণ করে স্বর্ণলতা।
তখন সুধাময় লাইন ছেড়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। পিছন থেকে খুব আস্তে সে বলে, ‘ধরতে পারলেন না?’
স্বর্ণ মুখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয় সহকারী স্টেশন মাস্টারকে। কিন্তু কিছু বলে না। চৈতক বাঁজা ডাঙা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে সোজা কোদলা ঘাটের দিকে—যেখানে ইয়াকুব সাধুর তথাকথিত ‘আশ্রমটা’ চোখে পড়ছে। কয়েকটা গাছের ফাঁকে একটা কুঁড়ে ঘর। সেখানে কোথাও হামাগুড়ি দিচ্ছে হয়তো একটা বাউরিশিশু।
সুধাময় পাশে এসে চমকায়। ‘কী ব্যাপার! আপনি…’ অবশ্য হাসতে হাসতে সে বলে।…’আপনি তো ভারী ছেলেমানুষ! একটা ঘোড়ার জন্যে কান্নাকাটি করে নাকি কেউ?’
স্বর্ণ ধরা গলায় বলে, ‘খুব দরকার ওকে—অথচ নেমকহারামটা কিছুতেই আর হাতের নাগালে আসতে চায় না। রাখালগুলোকে প্রতিদিন এককাঠা করে চাল দিয়ে যাচ্ছি, কেউ ধরতে পারছে না। কজনকে লাথি মেরেছিল—খুব চোট লেগেছে।’
সুধাময় ওকে সান্ত্বনা দিতে চায়।…’হ্যাঁ—মায়ামমতা তো স্বাভাবিক। কদ্দিন থেকে আছে! তবে কী—জন্তু—জানোয়ারের ব্যাপার। ওরা ওইরকমই।’
স্বর্ণ ঠোঁট কামড়ায়। তারপর বলে, ‘খুব দরকার ঘোড়াটা। না—বাবার কথা ভেবে নয়, নিজের জন্যে।’
সুধাময় প্রশ্ন করে, ‘নিজের জন্যে? সে কি! আপনি কি ঘোড়ায় চেপে বেড়াবেন?’
‘হুঁ। দু’একটা কল পাব মনে হচ্ছে।’…স্বর্ণ গম্ভীর মুখে বলে—চোখ দুটো ভিজে থেকে গেছে এবং এ মেয়ের যেন ওই অশ্রুসিক্ততাটা বিশেষ ধরনের বিলাস। ওই চোখ নিয়েই সে মৃদু হাসে!…’এতসব কেলেঙ্কারি করে লোকে। অথচ কেউ কেউ তো ওষুধ নিতেও আসছে।’
‘আপনি পারবেন। আমার পায়ের মচকানি ব্যথাটা এক ডোজেই কিন্তু সেরে গিয়েছিল!’…এই বলে সুধাময়—জোরে হাসে।
স্বর্ণ একটু ইতস্তত করে বলে, ‘মাস্টারবাবু, আমার সঙ্গে একটু আসবেন?’
‘নিশ্চয়। কিন্তু কোথায়?’
‘আরেকবার দেখব ভাবছি। হাজার হলেও পোষা জানোয়ার তো! আসুন না!’
সুধাময় দ্রুত পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখে নেয়। তারপর বলে, ‘লোকাল আসবার সময় হয়ে এল। জর্জ ব্যাটাকে কিছু বলে আসিনি—খচে যাবে নাকি!’…
স্বর্ণ নিঃসঙ্কোচে ওর একটা হাত টানে।…’জর্জকে আমি ঠান্ডা করে দেব। ভাববেন না।’
‘কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসছে যে!’
‘আসুক।’…
সুধাময় মনে মনে ওকে মায়াবিনী সম্বোধন করে পা বাড়ায়। আর বস্তুত তখন কী উদ্দাম চাঞ্চল্য তার রক্তে, শিরায় শিরায় কামনাবাসনারা খুব ভদ্র বেশে সান্ধ্য ভ্রমণ শুরু করেছে! আর এই শীতশেষের ঈষদুষ্ণ সন্ধ্যায় নির্জন মাঠে তাকে বাগে পেয়ে যায় দুর্দান্ত প্রেমভালোবাসা। স্বর্ণ তার হাত ছাড়ে না। নরম কালচে মাটি শস্যশূন্য খেতের। কেটে নেওয়া ধানগাছের গুচ্ছ পিছনে ফেলে রেখে গেছে স্মৃতিপুঞ্জের মতন অজস্র ‘মুড়ো’—তার নলে আগের রাতের শিশির সারাদিনের রৌদ্রপাতেও পুরো শুকিয়ে যায়নি, পায়ের আঘাতে ছিটকে পড়েছে প্রেমজ বেদনা থেকে অশ্রুপাতের পতন ফোঁটায় ফোঁটায়! ইতস্তত শামুকের খোল, মৃত কাঁকড়া, কিছু কোমলতম ফার্নজাতীয় উদ্ভিদগুচ্ছ বুক পেতে এই প্রেমিক—প্রেমিকার অস্তিত্ব অনুভব করছে। অসমতল মাঠের উঁচু মোটা আলের ওপর কিছু ঝোপঝাড়, কদাচিৎ দু—একটা গাছ, পাখির ঝাঁক ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে, বেজি ডিঙিয়ে যাচ্ছে সাপের সুপ্রাচীন কোনো খোলস, শেয়াল, কিংবা খেঁকশিয়াল গ্রামীণ কিংবদন্তীর মতন সবরকম সত্যাসত্যের বাইরে থেকে প্রতিভাত হচ্ছে কখনও; এবং দেখতে দেখতে তারা কর্ণসুবর্ণর একটি টিলার ওপর দিয়ে হেঁটে হাত ধরাধরি পেরিয়ে যায়, এবং যেতে যেতে হঠাৎ শোনে বাজখাঁই হাঁক চরণ চৌকিদারের—’হেই! কারা যায়?’ তখন চকিতে হাত ছেড়ে আলাদা হয়।
চরণ লাঠি হাতে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। দেখে বা সব জেনেও একবার নিজেকে জাহির করার ইচ্ছে হয়েছিল তার। স্বর্ণ কিছু বলার আগে সুধাময় সাড়া দেয়—’চৌকিদার নাকি?’
চরণ নমস্কার করতে করতে উঁচু ডাঙা থেকে নেমে ওদের কাছে পৌঁছয়। চরণের বাঁকা হাসিটি এই ধূসরতায় অস্পষ্ট। সে বলে, ‘আজ্ঞে, বেড়াতে বেরিয়েছেন নাকি?’
সুধাময় বলে, ‘না। এনাদের ঘোড়াটা …’
স্বর্ণ ওকে থামিয়ে দেয়।…’চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
চরণ বলে, ‘হু—ঘোড়াটা ওই বাগে যাচ্ছে দেখলাম। তা আপনারা কি ধরতে যাচ্ছেন ডাক্তোরদিদিরা? সে একটা কঠিন কাজ। সেবারে এতগুলো পুলিশদারোগা দৌড়াদৌড়ি করেও হেঁঃ হেঁঃ হেঁঃ…’
স্বর্ণ ধমকে বলে, ‘হেসো না।’
থতমত খেয়ে চরণ বলে, ‘আজ্ঞে হাসিনি।’
ওকে রেখে দুজনে সোজা নাকবরাবর ইয়াকুব সাধুর আখড়ার দিকে হেঁটে চলে। চরণ তখন একলা হয়ে দারোগার হাসি হেসে নেয় এবং আচমকা বিকট চেঁচিয়ে গান গাইতে থাকে। তার চ্যাপটা পায়ের ধাক্কায় ধুলো ওড়ে মেঠো রাস্তায়। সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার বেয়ে নির্বোধ সাপের মতন সেই আঁকাবাঁকা ধুলো কতদূর ওঠার চেষ্টা করে।
একটু পরে আবার স্বর্ণ সুধাময়ের একটা হাত ধরে। ডাকে—’মাস্টারবাবু!’
‘উঁ? বলুন।’
‘আপনার খুব ভয় হল না তো?’
‘ভয়! কেন?’
‘চরণ দেখল।’
সুধাময় জেনেও অকারণ বলে।…’আপনাদের ঘোড়াটা খুঁজতে বেরিয়েছি—তাতে কী?’
‘না মশাই। আমি এমনি করে আপনার হাত ধরে ছিলুম—চরণ দেখল।’
‘বেশ—দেখল, দেখল।’
‘আপনার বদনাম রটলে চাকরিতে ক্ষতি হবে না?’
‘হবে তো হবে।’…বলে মরিয়া সুধাময় পরক্ষণে মাথা দোলায়।…’নাঃ কিছু হবে না।’
স্বর্ণ ওর হাতটা এবার ছেড়ে দেয়।…’না বাবা! আমার এখন রুগিপত্তর দরকার। কালিটালি থেকে দূরে থাকা ভালো। কী বলেন মাস্টারবাবু?’
কেন যেন অভিমানে আহত হয় সুধাময়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সে বলে, ‘লোকেদের ওটা স্বভাব। আপনি যতই দূরে থাকুন, কালির অভাব হবে না। বলুন, আপনি কি বাঁচতে পেরেছেন এত করেও? অমন নির্দোষ মানুষটার অকারণ সাজা হয়ে গেল পর্যন্ত! বিচার, না বিচারের প্রহসন! এই শালা ইংরাজ রাজত্বের আবার বড়াই করে সবাই! ছ্যাঃ ছ্যাঃ!’
‘আচ্ছা মাস্টারবাবু, হেরুর সঙ্গে আমার কেলেঙ্কারির কথা রটল এত।’…স্বর্ণ খুব স্বাভাবিকভাবে বলে।…’আপনি কী ভাবেন?’
সুধাময়ের চোখ জ্বলে ওঠে।…’কী ভাবব?’
‘আপনি কি ভাবেন, বাবা সত্যিসত্যি নির্দোষ?’
‘নিশ্চয় তিনি নির্দোষ।’
‘কিন্তু আমি যেন সত্যি ভালোবাসতুম হেরু বাউরিকে।…’ বলে স্বর্ণ খিল খিল করে হেসে ওঠে।
‘যাঃ!’
‘হুঁ—উ। মাস্টারবাবু, আমার অপমানের শোধ নিয়েছিল যে, তাকে ভালোবাসব না? কী যে বলেন!’
‘ভালোবাসাটা কী স্বর্ণ দেবী?’… সকৌতুকে সুধাময় বলে।
‘অত বুঝিনে। কিন্তু ওই ছোটলোকটাকে দেখলে মনে হয় খুব উৎসাহ পেতুম। ও কাছে থাকলে মনে হত—আমার ভীষণ জোর বেড়ে গেছে।’
‘জানেন? আগে সব সম্রাজ্ঞী বা রানিটানিরা নাকি বাঘ পুষতেন। শখ করে পুষতেন।’
হুঁ। ও ছিল আমার পোষা বাঘ। আজ আফশোস হয়, বাঘটা কাছে থাকলে কত কীসব করে ফেলতুম।’
‘পৃথিবীর ওপর আপনার ভীষণ রাগ, তা জানি। সেটা অন্যায় নয়।’
‘উঁহুঁ—মানুষের ওপর।’
‘একই কথা। কিন্তু কী আর করবেন? আপনি আমি প্রত্যেকে এত অসহায়—যেন একটা অন্ধ শক্তির সামনে কিছু করার থাকে না।’
স্বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর চারদিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলে—’কোথায় এসে পড়লুম? হুঁ—বাঁদিকে। ওই যে ইয়াকুবের ঘর।’
‘কিন্তু ঘোড়াটা কোথায়? অন্ধকার হয়ে এল—আর দেখাই যাবে না।’
‘আসুন তো!’
তখন ইয়াকুব সবে ‘লানটিন’ জ্বেলেছে। দাওয়ায় উপুড় হয়ে পা ছুড়ছে হেরুর বাচ্চাটা—ফরসা ধবধবে রঙ। অবিকল রাঙির মতন। ইয়াকুব আলোটা দোলাচ্ছে তার সামনে। মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করছে। হেরুর ছেলেও সমানে সাড়া দিচ্ছে। উঠোনে দুই মূর্তি দেখে ইয়াকুব দ্রুত ঘুরে গর্জে ওঠে—’কে র্যা?’
স্বর্ণ সাড়া দেয়—’আমি সন্ন্যাসীচাচা। তোমাকে দেখতে এলুম।’
অমনি লন্ঠন রেখে ইয়াকুব শূন্যে ঝাঁপ দেয় এবং সামনে পৌঁছে দুহাত তুলে চেঁচায়—’ওরে আমার মা এসেছে রে! আমার মহামায়া মা এসেছে রে, আমার আঁধার ঘর আলো হয়েছে রে!’
তারপর ক্ষ্যাপা ইয়াকুব সাধু ঢাকের বাজনা জুড়ে দেয়। নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাডাং ড্যাং। উরররর ঢ্যাডাং ঢ্যাডাং ড্যাং।
সুধাময় আমোদ পায়। স্বর্ণ বলে, ‘আদিখ্যেতা রাখো তো বাপু! কথা শোনো।’
ইয়াকুব, আরও বারকতক বাজিয়ে তারপর ঠিক ঢাকির মতনই সমের বোলটি ঝেড়ে করজোড়ে নত হয়।
‘আমাদের ঘোড়াটা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। এইমাত্র এদিকে এসেছে, বুঝলে! তুমি একবার কষ্ট করে দ্যাখো না সন্নেসী চাচা!’
ইয়াকুব বলে, ‘তাই বলুন। আমি ভাবলাম…যাকগে। যাবে কোথায় শালা? এইসা টানের বাণ মারব যে বাপ বাপ বলে দৌড়ে আসবে। ভাববেন না, বসুন মা জগদম্বা।’
বলে সে ব্যস্তভাবে লাফ দিয়ে ঘরে ঢোকে। স্বর্ণ বলে, ‘ও তোমার মন্ত্রতন্ত্রের কাজ নয়। আমরা বসছি—তুমি একবার খুঁজে দ্যাখো। কাছাকাছি কোথাও আছে নিশ্চয়। গঙ্গা পেরিয়ে যেতে তো পারবে না।’
ইয়াকুব সাধু তার জাঁক দেখাতে ছাড়বে না। ঘরের ভিতর অন্ধকারে তার বিকট অংবং আওয়াজ শোনা যায়। স্বর্ণরা এগিয়ে গিয়ে হেরুর ছেলেকে দেখতে থাকে। ছেলেটা এদের দিকে তাকায় না। উপুড় হয়ে আলোটা দেখে, আর হাত পা ছোঁড়ে। রাঙা প্যান্ট—জামা কিনে দিয়েছে ইয়াকুব। গলায় বাহুতে ঝুলিয়ে দিয়েছে সব নানা আকারের কবচ আর সুতোয় বাঁধা শেকড়বাকড়। নাকে সিকনি ঝরছে। লালা পড়ছে প্রচুর। ছেলেটা আলোর উদ্দেশ্যে বলছে—’গ্যাঃ গ্যাঃ গ্যাঃ!’
স্বর্ণ নগ্ন দাওয়ার মাটিতে বসে পড়ে। তারপর আঙুল বাজায়, ঠোঁটে অদ্ভুত শব্দ করে। তখন সে স্বর্ণকে দেখতে পায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ওঠে। স্বর্ণ হাসতে হাসতে বলে, ‘কী হল রে বাবা! পছন্দ হল না বুঝি! তোর মায়ের মতন সুন্দরী নই কি না—তাই!’
সুধাময় মনেমনে এবার বিরক্ত। গোরাংবাবুর মতো স্বর্ণও বড্ড খামখেয়ালি। নিচু—জাতের লোকজন নিয়েই এদের কারবার। তার ওপর এই সন্ধ্যাবেলায় ঘোড়াটোড়ার ব্যাপার—যাকে বলে একেবারে ঘোড়ারোগ!
ইয়াকুব সম্ভবত ঘোড়াটার উদ্দেশ্যে আকর্ষণী মন্ত্র উচ্চারণ করছে ঘরের মধ্যে। হঠাৎ স্বর্ণ চটুল হেসে চাপা গলায় বলে ওঠে, ‘বুঝলেন মাস্টারবাবু! এটি আমার প্রেমিকের পুত্র!’
সুধাময় বোকার মতন হাসে।
‘হু গো, ছোটলোকটার আমার ওপর কী যেন টান ছিল। পায়ের নিচে বসে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। তারপর একবার আঁরোয়া জঙ্গলের মধ্যে….’ স্বর্ণ সতর্কভাবে থেমে যায়।
সুধাময় অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘কী’?
স্বর্ণ হাসিতে ভাঙে।…’সে এক কেলেঙ্কারি। যাকগে। ছেলেটা কিন্তু ভারী সুন্দর—তাই না মাস্টারবাবু?’
সুধাময় অগত্যা বলে, ‘পছন্দ হলে নিয়ে চলুন। মানুষ করবেন।’
‘পাগল!’…বলে স্বর্ণ ইয়াকুবের উদ্দেশ্যে মুখ ঘোরায়।…’ও সন্ন্যাসীচাচা, হল তোমার?’
ইয়াকুব বেরিয়ে আসে।….’চুপচাপ বসে থাকুন মা ত্রিনয়নী। শালা এক্ষুনি এসে পড়বে দেখবেন। যাবে কোথায়? এমন জোর ঝেড়েছি শালাকে…’
স্বর্ণ উঠে দাঁড়ায়।…’তোমার ওসব বুজরুকি শুনতে আমি আসিনি। উঠুন মাস্টারবাবু, আমারই বোকামি!’
‘সবুর!’ বলে ইয়াকুব লাফ দিয়ে উঠোনে নামে। ‘ওই দেখুন, জোসনার ঢেলা লদীর পারে উঠছেন। আর দুদণ্ড সবুর মা জগদম্বা!’
সেও অবশ্য ঠিক। ঝাউবনের ওপাশে চাঁদ উঠেছে। গঙ্গার জলে এবং বালিয়াড়িতে তেলরঙা আলোর ছোপ পড়েছে। এদিকটা অনেকদূর ফাঁকা। ঘোড়াটা দেখতে পাওয়া সম্ভব হবে। স্বর্ণ চাঁদ দেখতে থকে। কুঁড়েঘরটার পিছনে সামান্য দূরে জঙ্গুলে একটা বটগাছ—শ্মশান। আরও কিছু গাছের জটলা নিয়ে সেদিকটা ঘন কালো হয়ে রয়েছে। প্যাঁচা ও শেয়াল ডাকছে মাঝে মাঝে। পারাপারের ঘাটের দিক থেকে শম্ভু ঘেটেলের কাশির আওয়াজ আসছে। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট কিছু কথাবার্তার আভাসও। হাটুরে ব্যবসায়ীরা ফিরে আসছে বেলডাঙা বাজার থেকে।
‘ঘোড়া আসছে।’ ইয়াকুব ফের আশ্বস্ত করে। ‘একটা কথা মা। শুনলাম, ডাক্তারি করতে লেগেছেন বাবার মতন।’
অন্যমনস্ক স্বর্ণ বলে, ‘হুঁ।’
‘আমার পুকড়োটার সর্দিকাশি জ্বরজ্বারি যে ছাড়ছে না রে ত্রিনয়নী!’ করুণস্বরে ইয়াকুব বলে। ‘ওষুধ কতরকম আমি তো দিলাম—কাজ হল না। নিয়ে যাব—দেখবি মা?’
ইয়াকুব তুই সম্বোধন করছে জেনেও স্বর্ণর রাগ হয় না। ছেলেটাকে একবার দেখে নিয়ে সে বলে, ‘যেয়ো। কিন্তু ঠান্ডায় ফেলে রেখেছ কেন? অসুখ তো হবেই।’
ইয়াকুব জানায়, ‘হ্যাঁ—সে ঠিক কথা মা জননী। কিন্তু সারাক্ষণ ছেলে নিয়ে থাকলে যে না খেয়ে মরব!’
ইয়াকুবের তন্ত্রচালনা ভূত ছাড়ানো এবং কবরেজি অংশ বাদ দিলেও নিজের সাধনভজনের ব্যাপার আছে। তারপর সবচেয়ে মুশকিল হয় আচমকা ভর উঠলে। তখন ছেলেটা, জ্বলন্ত উনুনে গিয়ে পড়লেই বিপদ। তবে ইয়াকুবের অধীনে ভূতপ্রেত আছে কিন্তু—তারা সবসময় রক্ষা করে। সত্যি বলতে কী, এইসব সদাসতর্ক অদৃশ্য প্রহরীদের জন্যেই ছেলেটার কোনো ক্ষতি হয়নি আজ অব্দি। যেমন ধরা যাক সেদিনের কাণ্ডটা। কখন ‘শালাব্যাটা’ হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেছে একেবারে গঙ্গার পাড়ে। প্রায় পড়ে যায়—যায় অবস্থা। হঠাৎ কী আজব কাণ্ড দেখুন। সেই সময় বুড়ি ছাগলটা কী কারণে খুটো উপড়ে দৌড়ে আসছে পাশে—দড়িটা সে একেবারে জড়িয়ে গেল ছেলের গায়ে। সেই টানে অনেকখানি দূরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। বেঁচে গেল প্রাণে। কেটে ছড়ে গেল অনেক জায়গায়। এখনও ঘা শুকোয়নি।
মানতে হয়, এটা সত্যি বিস্ময়কর ঘটনা।
আরেকটি ঘটনা। বর্ষার শেষদিকে অনেক রাতে ইয়াকুব বেরিয়েছে গঙ্গার দিকে। উদ্দেশ্য, একটা মড়া আবিষ্কার—তার মুণ্ডুটা ভারী দরকার। ঘরে ছেলে একা ঘুমোচ্ছে। দরজা বাইরে থেকে আটকানো আছে। কিন্তু কীভাবে মড়াখেকো শেয়াল এসে আঁচড়ে কামড়ে ছিটে বাতার দরজা ফাঁক করে ঢুকেছে। তারপর ছেলের পায়ের কাছে যেই না শুঁকতে যাওয়া, অমনি প্রহরী বিশ্বস্ত ‘চ্যাড়া’ (প্রেত) চালের বাতা থেকে তিনটে মড়ার মুণ্ডু দিয়েছে ফেলে। পড়বি তো পড়, শালার পিঠের ওপর। তখন শালা দরজা গলিয়ে পালাতে যাচ্ছে—কিন্তু অত কি সহজ? আটকে গেছে খাঁজে। আধখানা ভিতরে, আধখানা বাইরে—ত্রাহিত্রাহি চ্যাঁচায় হারামজাদা। আর সেই আর্তনাদ শুনে দূরে নিশাচর সাধুর কান চখে ওঠে। সেই দৌড়ে আখড়ায় ফিরে দেখে এই কাণ্ড…
সুধাময় সম্ভ্রমে বলে, ‘শেয়ালটা মারলেন?’
‘নাঃ। মায়ের জীব সব। রক্ষে পেল।’…ইয়াকুব জবাব দেয়। ‘ছেলে আমার নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।’
স্বর্ণ বলে, ‘খুব হয়েছে। আমার দেরি হয়ে গেল এদিকে।’
হঠাৎ ইয়াকুব রহস্যময় হাসে।…’মা কাত্যায়নী, ওই দেখুন আপনার ঘোড়া। হ্যাঁ, ঠাউর করে দেখুন। আমি বুড়োমানুষ—আমারও জোসনাতে দিব্যি নজর চলছে। জোয়ান চোখে আপনারা দেখুন মিথ্যে না সত্যি।’
হ্যাঁ, নিষ্প্রভ চন্দ্রালোকে স্থির ঘোড়াটাকে আবছা দেখা যাচ্ছে। চতুষ্পদ প্রাণীটি সম্ভবত কিছুক্ষণ থেকে বিশ্রাম নিচ্ছে অকুতোভয়ে। একটি ধ্রুপদি সঙ্গীতের মুদ্রিত স্বরলিপির মতন শ্রেণীবদ্ধ, ঋজু এবং প্রতীকচিহ্ন খচিত তার ওই অবস্থিতি। আর সবাই তাকিয়ে—তাকিয়ে মোহিতভাবে তাকে দেখতে থাকল। মনে হল এখন তার পশ্চাদ্ধাবন পাপ—পবিত্রতাবিনাশী, এবং ঈশ্বরও ক্ষমা করবে না কোনো মৃদুতম হস্তক্ষেপ।
আর সেই স্তব্ধতার মধ্যে থেকে প্রথমে মুখ খোলে সহকারী স্টেশনমাস্টার। …’কী বদমাইশি! একে কয়েদ করতে চেয়েছিল শুয়োরের বাচ্চা আফতাব দারোগা!’
শান্তভাষী ভদ্র সজ্জন প্রেমিকের কণ্ঠ থেকে এহেন বুলি শুনেও কারও মনে হল না যে এই বাক্যটি এখন অশ্লীল। কারণ, কী যেন ছিল সেই সান্ধ্য পরিবেশ ও আবহাওয়ায়, সুপ্রচুর শান্তি এবং তদগত ভাবসমূহ। বস্তুত স্থানটি বহুজনলাঞ্ছিত কোনো শহর নয়; বিশাল আকাশ এবং ব্যাপক মাটিতে প্রকৃতির স্বাধীনতা অব্যাহত ছিল। প্রকৃতি সেখানে মনুষ্যহৃদয় ও মস্তিষ্ককে দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। আর গঙ্গা নামে ঐতিহাসিক শুধু নয়, পৌরাণিক প্রবাহিনী তার খুব কাছেই রয়েছে। সকল প্রকার পাপ ও অশ্লীলতা তার জলে খুবই সহজে ব্রহ্মত্বে উত্তীর্ণ হয়।
সহকারী স্টেশনমাস্টারের ঘৃণা এবং অশ্লীল বাক্যটিও তাই খুব স্বাভাবিক শোনাল। এবং তান্ত্রিক সাধু মুগ্ধচোখে ঘোড়াটা দেখতে দেখতে বলে ওঠে, ‘চালসেপড়া চোখ আমার রেতের বেলা মায়ের কিপায় জ্বলে—ফুলকি বেরোয় রিং রিং! তো আহা! দেখ, দেখ সবাই—যেন বোররাখ! (সুন্দরী নারীর মুখমণ্ডলবিশিষ্ট পক্ষীরাজ অশ্ব—যা হজরত মোহাম্মদকে স্বর্গে ঈশ্বরের কাছে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল) হ্যাঁ, তাই লাগে। যেন, অবিকল রূপসী স্ত্রীলোকের মুখখানি দেখতে পাই। যেন…’
স্বর্ণ প্রশান্তি ভেঙে হাসে হঠাৎ।…’ফেট! ঘোড়াটা মদ্দা।’
‘কে মদ্দা, কে মাগি!’ সাধুর ধ্যান ভাঙে না। …’আহা হা! দেখ গো, দেখ।’
‘তুমি দেখ!’ বলে স্বর্ণ পা বাড়ায়।
সুধাময় বলে, ‘একটা দড়িদড়া হলে ভালো হত। নিয়ে যাবেন কীভাবে?’
‘আসুন তো।’
ইয়াকুব অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। দাওয়ায় চটের ওপর হেরুর ছেলে লন্ঠন দেখে যথারীতি হাত পা দোলাতে ব্যস্ত হয়েছে ততক্ষণে। এইসব ফেলে রেখে ওরা দুজনে এগিয়ে যায়।
সুধাময়ের মনে হয়, অনর্থক একটা অলৌকিক ব্যাপারের মধ্যে তারা যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে, এবং এর শেষ রক্ষা কতদূর হবে জানা নেই।
অথচ স্বর্ণ সুষমছন্দে পোড়ো ঘাসের জমির ওপর হেঁটে ঘোড়াটার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। ঘোড়াটা, আশ্চর্য, একটুও নড়ে না। স্বর্ণ তার পিঠে হাত রাখে। গলা জড়িয়ে ধরে। ঘোড়াটা তবু স্থির। স্বর্ণ বলে, ‘মাস্টারবাবু একটা ছিপটি হলে ভালো হত। দেখুন না, ওই ঝোপ থেকে একটা ডাল ভাঙতে পারেন নাকি।’
সুধাময় বিরক্তভাবে ঝোপ খোঁজে। একটু দূরে নিশিন্দাঝোপে অনেক চেষ্টা করে একটা ডাল ভাঙে সে। স্বর্ণ সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘মাস্টারবাবু, আমি কিন্তু চাপব।’
‘চাপবেন? কোথায়?’ সুধাময় হাঁ হাঁ করে ওঠে।
‘আপনার পিঠে নয় স্যার, এই শ্রীমানের।’
‘আর আমি?’
‘সেপাই সেজে সঙ্গে আসুন।’
সুধাময়ের হাসি পায়।…’কিন্তু ব্যাটা নির্ঘাৎ আপনাকে ফেলে দেবে।’
‘তখন আপনার পিঠে চাপব।’…স্বর্ণ খিলখিল করে হাসে।…’কেন? পারবেন না?’
সুধাময় মনে মনে বলে, ‘সে আমার প্রচণ্ড সুসময়।’ প্রকাশ্যে বলে, ‘আমি সব পারি।’
স্বর্ণ অভ্যস্তভঙ্গিতে চৈতকের পিঠে চেপে বসলেও সে নড়ে না। স্বর্ণ মৃদু ছিপটি সঞ্চালন করে গ্রাম্য স্ত্রীলোকসুলভ ঢঙে বলে, ‘আ মর! ভিরমি পেলি নাকি? হেট, হেট!’
সুধাময় বিস্ফারিত চোখে দেখে, ঘোড়াটা ধীর ছন্দে হাঁটতে লাগল। আশ্চর্য, আশ্চর্য এবং আশ্চর্য! ম্রিয়মাণ জ্যোৎস্নায় এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে তার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। কচি গমের খেত ভেঙে ঘোড়া যত হাঁটে, তার মন লোভে চঞ্চল হয়। এবং দৌড়ে কাছে গিয়ে বলে ওঠে, ‘এই! আমাকেও একবার চাপতে দেবেন কিন্তু।’
‘ঘোড়ায় চাপা অভ্যেস আছে তো?’
‘উঁহু।’
‘কোমর ব্যথা করবে। জিন ছাড়া তিষ্ঠোতেও পারবেন না।’
‘আপনি তো পারছেন!’
‘বারে! ছেলেবেলা থেকে চাপছি না?’
‘শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন যখন, তখনও কি চাপতেন! ওনাদের ঘোড়া ছিল বুঝি?’
‘যাঃ!’ বলে স্বর্ণ মৃদু ছিপটি হাঁকায়। ঘোড়া আরেকটু দ্রুতগামী হয়। এবং কাঁচা সড়কে গিয়ে ওঠে।
সুধাময় ক্লান্ত হয়ে ধুকুরধুকুর দৌড়য়। মাঝে মাঝে বলে, ‘আস্তে, আস্তে!’
তখন চাঁদ অনেকটা উঁচুতে চলে এসেছে। জ্যোৎস্না বেশ স্পষ্ট। বৃক্ষবিরল মাঠ একপাশে, অন্যপাশে ঐতিহাসিক টিলা। হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে স্বর্ণ সকৌতুকে বলে, ‘হ্যালো মাস্টারবাবু, কাম অন।’
সে ঘোড়া থেকে নামে। তার গলায় হাত রেখে নিজের পাছা ঝাড়ে একবার। তারপর বলে, ‘আসুন।’
সুধাময় হঠকারী আবেগে একলাফে ঘোড়ার পিঠে ওঠামাত্র ঘোড়াটা সামনের দু ঠ্যাং তুলে হ্রেষাধ্বনি করে এবং সুধাময় অমনি স্বর্ণের ওপর পড়ে যায়। পড়ার সময় সে স্বাভাবিকভাবে স্বর্ণকে ধরে ফেলেছিল। তার ফলে স্বর্ণসুদ্ধ জড়াজড়ি সে ধুলোয় আছাড় খায়।
ঠান্ডা ধুলোয় দুজনে ক’মুহূর্ত ঘন জড়াজড়ি থেকে ভেবেছিল, সব চেষ্টা এবার ব্যর্থ করে চৈতক ফের পালাবে। কিন্তু পুরুষ মানুষটির মধ্যে চকিতে সুপ্ত কামনা জেগে ওঠায় সে স্ত্রীলোকটিকে স্বাভাবিকভাবে নিষ্কৃতি দিতে চায় না এখন। আকুল দুইহাতে জড়িয়ে ধরে, পিঠের নিচে ঠান্ডা ধুলো নিয়ে, সে ভিখিরি চোখে তাকায় স্বর্ণর দিকে। স্বর্ণ হতচকিত ও বিভ্রান্ত ছিল এবং ঘোড়ার দিকে তার মন। সেই মুহূর্তে সহকারী স্টেশন মাস্টার তার গালে ঠোঁট ঘষে অস্ফুট স্বরে বলে, ‘স্বর্ণ, আমার সোনা।’
ভাঁড়ের মতন মুখভঙ্গি করে ঘোড়া মুখ ঘুরিয়ে এই দৃশ্য দেখল। সে হ্রেষায় একবার হাসলও। আর সেই মুহূর্তে দুঃখিতা স্বর্ণ বলে, ‘ছিঃ! একি মাস্টারবাবু!’
দুজনে একই সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সুধাময় নির্বাক। স্বর্ণ কাপড় ঝাড়ে শশব্যস্তে। সেও কিছু বলে না আর। তারপর ঘোড়ার কাছে যায়। তখন টিলার ওপর দৌড়ে আসার শব্দ শোনে ওরা।
আর কে! চরণ চৌকিদার। দাঁত ঝলকায় তার জ্যোৎস্নায়।…’পড়ে গেলেন নাকি?’
‘আর বোলো না হে!’ সুধাময় বলে। ‘ব্যাটা বড্ড পাঁজি। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল যদি—তো …আরে আরে!’
স্বর্ণ ঘোড়ার পিছে চেপে আচমকা পিছলে চলে গেল দূরের দিকে। কিছু ধুলো দৃশ্যমান হল জ্যোৎস্নায়। কিছু শব্দ শোনা যেতে থাকল খটখট খটাখট খটাখট…
স্তম্ভিত সুধাময়। এবং লজ্জিত, দুঃখিত। এবং অভিমানীও।
চরণ বলে, ‘ডাক্তোরবাবুর মেয়েটা ক্ষ্যাপা। এখন কী আর করবেন? চলে যান। বড়সায়েব খুঁজছেন আপনাকে। আমি বলেছি, ঘোড়া খুঁজতে গেছেন স্বন্নদির সঙ্গে। বলুন তো সঙ্গে যাই। যাব?’
সুধাময় অনুচ্চস্বরে বলে, ‘না। থাক।’
চরণ হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে গাঁয়ে ফিরে গেল। সুধাময় খুব আস্তে হাঁটে। একটা গভীর অনুশোচনা এবং দুঃখ তাকে দুপাশ থেকে চেপে ধরে। সে মনে মনে বলে, হা ঈশ্বর! আমি ভুলে যাই যে স্বর্ণ বিধবা। আমার মনেই থাকে না যে যা হয় না, হতে পারে না, কিংবা আদৌ হবে না—তার পিছনে ছোটাছুটি করা নিষ্ফল।
আর সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়াও পাপ মনে হওয়ায় সুধাময় ছটফট করে তার কোয়ার্টারে। তারপর চুপিচুপি বেরিয়ে আসে। চাঁদ তখন পশ্চিম দিগন্তে আঁরোয়া জঙ্গলের শীর্ষে চলেছে। স্টেশনে জর্জ লম্বা টেবিলে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ভোরের আগে আর গাড়ি নেই। সুধাময় লম্বা পা ফেলে লাইন ডিঙিয়ে হাঁটে।
স্বর্ণর জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দুরুদুরু বুকে, ভারী শরীরে ভাঙা গলায় সে ডাকে, ‘স্বর্ণ, স্বর্ণ, স্বর্ণ!’
স্বর্ণ ধুড়মুড় করে উঠে বলে, ‘কে, কে?’
‘আমি—আমি সুধাময়।’
‘কী?’
‘ক্ষমা চাইতে এসেছি।’
স্বর্ণ লন্ঠনের দম বাড়িয়ে দেয়। তারপর উঠে গিয়ে দরজা খোলে। বলে, ‘কী চাইতে এসেছেন?’
‘ক্ষমা।’
স্বর্ণ কেমন হাসে।… ‘ফেট! আমি ভাবলুম বুঝি…’
সদ্য ঘুমভাঙা ঢলঢল মুখ স্বর্ণর। সুধাময় ভাবে, ক্ষমা চাওয়াটা ঠিক হল না। সে ভিতরে ঢুকে বলে, ‘আপনার রাগ মানাতে এলুম।’
স্বর্ণ শান্তভাবে বলে, ‘আমি রাগিনি। খুব লজ্জা পেয়েছিলুম। আসুন, চা খাব।’