ইন্দ্রপ্রেরিত ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে উপেক্ষা
“তখন ইন্দ্র কহিলেন, ‘হুতাশন! ব্রহ্মবল যে অতি উৎকৃষ্ট এবং ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম যে আর কেহই নাই, তাহা যথার্থ বটে; কিন্তু মরুরাজার পরাক্রম আমার কিছুতেই সহ্য হইতেছে না। অতএব আমি নিশ্চয়ই তাহাকে বজ্রপ্রহার করিব।’ সুররাজ পুরন্দর অনলকে এই কথা কহিয়া গন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘ধৃতরাষ্ট্র! তুমি শীঘ্র মরুত্তরাজার নিকট গমন করিয়া সংবর্ত্তের সমক্ষে তাহাকে বল যে, মহারাজ! তুমি অচিরাৎ বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ কর, নচেৎ দেবরাজ তোমাকে বজ্রপ্রহার করিবেন।’
“সুররাজ এইরূপ আদেশ করিলে গন্ধৰ্ব্বরাজ ধৃতরাষ্ট্র অচিরাৎ মরুত্তের নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘মহারাজ। আমার নাম ধৃতরাষ্ট্র; আমি গন্ধৰ্ব্বকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি। এক্ষণে লোকাধিপতি দেবরাজ ইন্দ্র যে নিমিত্ত আপনার নিকট আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। তিনি কহিয়াছেন, যদি আপনি বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ না করেন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই আপনার প্রতি বজ্রপ্রহার করিবেন।’
“তখন মরুত্ত কহিলেন, ‘গন্ধৰ্ব্বরাজ! মিত্রদ্রোহী যে ব্ৰহ্মহত্যাসদৃশ মহাপাপে লিপ্ত হইয়া থাকে এবং তাহার যে কোন কালে নিষ্কৃতিলাভ হয় না, ইহা কি তোমার, কি ইন্দ্রের, কি বসুগণের, কি অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের, কি মরুদগণের কাহারই অবিদিত নাই; অতএব আমি কখনই আমার পরমমিত্র সংবর্ত্তকে পরিত্যাগ করিয়া বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ করিতে পারিব না। সুরগুরু বৃহস্পতি বজ্রধর দেবরাজের পৌরোহিত্য করুন। মহাত্মা সংবর্ত্তই আমার যজ্ঞ সম্পাদন করিবেন। আমি কদাচ ইহার অন্যথা করিতে পারিব না।’
ইন্দ্রভীত মরুত্তের প্রতি সংবর্ত্তের অভয়বাণী
“ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “মহারাজ! ঐ দেখুন, ভগবান শতক্রতু আপনার প্রতি বর্জ্য পরিত্যাগ করিবেন বলিয়া আকাশপথে ভীষণ সিংহনাদ করিতেছেন; অতএব এই সময়ে স্বীয় হিতচিন্তা করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য।
“গন্ধৰ্ব্বরাজ ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিলে মহারাজ মরুত্ত আকাশে ইন্দ্রের ভীষণ গর্জ্জন শ্রবণ করিয়া উপানুষ্ঠাননিরত ধৰ্ম্মবিদগণের অগ্রগণ্য মহাত্মা সংবৰ্ত্তকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘ভগবন্! সুররাজ অধিক দূরে অবস্থান করিতেছেন বলিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতেছেন না। কিন্তু উনি বজ্রপ্রহার করিলে নিশ্চয়ই আমাকে কালকবলে নিপতিত হইতে হইবে; অতএব এক্ষণে আপনি আমাকে অভয় প্রদান ও আমার মঙ্গলবিধান করুন। ঐ দেখুন, দেবরাজ বজ্ৰধারণপূৰ্ব্বক দশদিক আলোকিত করিয়া আগমন করিতেছেন। উহার ভয়ঙ্কর নিনাদে সভাস্থ সমস্ত লোকই নিতান্ত ব্যাকুলিত হইয়াছে।’
‘সংবর্ত্ত কহিলেন, ‘মহারাজ! ইন্দ্র হইতে তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। আমি অবিলম্বে সংস্তম্ভিনী বিদ্যাপ্রভাবে উঁহার সমুদয় কাৰ্য্য স্তম্ভিত করিয়া তোমার ভয় নিবারণ করিব। আমি সমুদয় দেবতার অস্ত্র বিনষ্ট করিতে পারি। বজ্ৰ দিক্মুদয়ে নিক্ষিপ্ত, বায়ু প্রবাহিত, কাননে বারিধারা নিপতিত, সমুদ্র প্লাবিত ও আকাশপথে সৌদামিনী লক্ষিত হউক, তুমি কিছুতেই ভীত হইও না। হুতাশন তোমার মঙ্গলবিধান করুন বা না করুন এবং ইন্দ্র তোমার কামনা পূর্ণ করিতে বা বজ্রপ্রহার করিতে সমুদ্যত হউন, তাহার নিমিত্ত তোমার কিছুমাত্র চিন্তা নাই।’
“মরুত্ত কহিলেন, ‘ভগবন! বাসবের বায়ুঘোষ [বায়ুবেগ তুল্য শব্দ]সম্বলিত ভীষণ বজ্রনিস্বন শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ বারংবার ব্যথিত হইতেছে। আমি কোনরূপে স্বাস্থ্যলাভে সমর্থ হইতেছি না।’
“সংবৰ্ত্ত কহিলেন, ‘মহারাজ! ইন্দ্রের ভীষণ বজ্র হইতে তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। আমি বায়ুভূত হইয়া অবিলম্বে ঐ বজ্র সংহার করিতেছি। এক্ষণে তোমার আর কোন কাৰ্য্যসাধন করিব, তাহা প্রকাশ কর।’
ইন্দ্রের মরুত্ত যজ্ঞে আগমন—যজ্ঞভাগগ্রহণ
“মরুত্ত কহিলেন, ‘ভগবন্! এক্ষণে দেবরাজ ও অন্যান্য দেবগণ সহসা এই যজ্ঞভূমিতে সমুপস্থিত হইয়া নির্দ্দিষ্ট আসনসমুদয়ে উপবেশনপূৰ্ব্বক স্ব স্ব যজ্ঞভাগ গ্রহণ করুন।’
“মহারাজ মরুত্ত এই কথা কহিলে মহর্ষি সংবৰ্ত্ত মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক ইদ্রাদি দেবগণকে আহ্বান করিয়া মরুত্তকে কহিলেন, “মহারাজ! ঐ দেখ, দেবরাজ আমার মন্ত্রবলে হরিদশ্বযুক্ত [সবুজবৰ্ণ-অশ্বযুক্ত] রথে সমারূঢ় হইয়া দেবগণের সহিত এই যজ্ঞস্থলে আগমন করিতেছেন।’
“মহাত্মা সংবৰ্ত্ত এই কথা কহিবামাত্র দেবরাজ ইন্দ্র মরুক্তরাজার যজ্ঞীয় সোমরস পান করিতে অভিলাষী হইয়া অন্যান্য দেবগণের সহিত সেই যজ্ঞস্থলে সমুপস্থিত হইলেন। তখন মহারাজ মরুত্ত দেবগণপরিবেষ্টিত সুররাজকে সমাগত দেখিয়া পুরোহিতসমভিব্যাহারে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া যথোচিত সৎকার করিলেন। ঐ সময় মহাত্মা সংবর্ত্ত পুরন্দরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “দেবরাজ! আপনি ত’ সুখে আগমন করিয়াছেন? আপনার আগমনে এই যজ্ঞ সমধিক শোভাসম্পন্ন হইল, এক্ষণে আপনি এই সোমরস পান করুন।’
“অনন্তর মহারাজ মরুত্ত পুনৰ্ব্বার ইন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি প্রণিপাত করিতেছি, আপনি প্রশান্তভাবে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, আজ আপনার আগমনে আমার যজ্ঞ ও জীবন সফল হইল। এই দেখুন, বৃহস্পতির কনিষ্ঠ ভ্রাতা। ভগবান্ সংবৰ্ত্ত আমার যজ্ঞ সমাপন করিতেছেন।’
“ইন্দ্র কহিলেন, ‘মহারাজ! এই দীপ্ততেজা ভগবান্ সংবর্ত্তের মাহাত্ম্য আমার অবিদিত নাই। আজ আমি এই মহাত্মাকর্ত্তৃক সমাহূত হইয়া তোমার প্রতি কোপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রীতমনে এই যজ্ঞস্থানে সমাগত হইয়াছি।’
“সংবর্ত্ত কহিলেন, ‘দেবরাজ! যদি আমার প্রতি প্রীত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনি এই সমাজমধ্যে ভাগসমুদয় যথাযোগ্য কল্পনা ও এই যজ্ঞে কর্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য বিষয়ে উপদেশ প্রদান করুন।’
“মহাত্মা সংবৰ্ত্ত এই কথা কহিলে, দেবরাজ দেবগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘হে সুরগণ! তোমরা অবিলম্বে স্বর্গীয় সভার তুল্য অতিসমৃদ্ধ বিচিত্র সভা নির্ম্মাণ করিয়া উহার মধ্যে অসংখ্য স্তম্ভ এবং গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরাগণের নৃত্যগীতাদির স্থান প্রস্তুত কর। ঐ সভাতে গন্ধৰ্ব্বগণ গান ও অপ্সরাগণ নৃত্য করুক।’
“সুররাজ এইরূপ আজ্ঞা করিলে দেবগণ তৎক্ষণাৎ তাঁহার আজ্ঞানুরূপ কাৰ্য্য করিলেন। তখন দেবরাজ প্রীতমনে মরুত্তকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি, তোমার পিতৃলোক ও অন্যান্য দেবগণ আমরা সকলেই তোমার প্রতি প্রীত হইয়া যজ্ঞভাগ গ্রহণ করিতে সমুদ্যত হইয়াছি। অতএব এক্ষণে ব্রাহ্মণগণ অগ্নির প্রীতি নিমিত্ত লোহিত ছাগ, বিশ্বদেবগণের প্রীতির নিমিত্ত নানাবর্ণ ছাগ এবং অন্যান্য দেবগণের প্রীতির নিমিত্ত পবিত্র বৃষ ছেদন করুন।’
“দেবরাজ এই কথা কহিবামাত্র যজ্ঞের উৎসব পরিবর্দ্ধিত হইতে আবদ্ধ হইল, দেবগণ স্বয়ং অন্ন পরিবেশন করিতে লাগিলেন এবং দেবরাজ স্বয়ং সদস্যকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন।
বহনক্ষম বিপ্রগণের মরুদত্ত-স্বর্ণত্যাগ
“অনন্তর দ্বিতীয় পাবকের ন্যায় পরমতেজস্বী মহাত্মা সংবৰ্ত্ত দেবগণের নাম উল্লেখ করিয়া অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিতে লাগিলেন। তখন সর্ব্বাগ্রে দেবরাজ ও তৎপরে অন্যান্য দেবগণ সোমরস পান করিয়া প্রীতিলাভপূৰ্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। পরিশেষে মহারাজ মরুত্ত যজ্ঞভূমির নানা স্থানে রাশি রাশি সুবর্ণ সংস্থাপিত করিয়া ব্রাহ্মণগণকে দান করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণগণ সেই অপরিমিত সুবর্ণবহনে অসমর্থ হইয়া অগত্যা উহার অধিকাংশ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অল্পাংশমাত্র গ্রহণ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।
“এইরূপে মহারাজ মরুত্তের যজ্ঞক্রিয়া সুসম্পন্ন হইলে তিনি সেই স্থানে ব্রাহ্মণগণের পরিত্যক্ত সুবর্ণসমুদয় পাকার করিয়া গুরুর আজ্ঞানুসারে রাজধানীতে প্রত্যাগমনপূৰ্ব্বক সসাগরা পৃথিবী শাসন করিতে লাগিলেন।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! মরুত্ত এইরূপ গুণশালী ছিলেন। তাঁহার যজ্ঞে প্রভূত সুবর্ণ সঞ্চিত হইয়াছিল। এক্ষণে তুমি সেই সমুদয় সুবর্ণ আনয়ন করিয়া অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক দেবগণের তৃপ্তিসাধন কর।”
মহাত্মা বেদব্যাস এই বাক্য কহিলে ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁহার এই বাক্যশ্রবণে পরিতুষ্ট হইয়া যজ্ঞ করিবার মানসে অমাত্যদিগের সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন।