আমবাগানের পশ্চিম দিকটায় বাঁশঝাড়ের পাশে নির্জন জায়গায় একটা শুকনো খাদের ধারে এসে দাঁড়াল শ্বেত। হাতে ভয়ংকর শূল। মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি।
তার পিছনে রতনবাবু। তাঁর মুখে হাসি নেই, ভয়ও নেই।
শ্বেত বলল, “রতনবাবু, অনেকদিন ধরেই আমি এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিলাম। রাজাসাহেবকে বশ করে একসময়ে তুমিই রাজ্যপাট চালাতে শুরু করেছিলে। রাজবাড়ির গুপ্তধন আবিষ্কার করে সেটা রাজাকে দিয়ে তুমি একটু সততার পরিচয় দিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু সেই গুপ্তধনের জন্যই রাজপরিবারে অশান্তি নেমে আসে। তোমার ষড়যন্ত্রেই গুপ্তধনের কথা ফাঁস হয়ে যায়। আর তার ফলেই রামদুলাল প্রায় নির্বংশ হয়ে যান। আজ তোমাকে বধ করে সেই ঘটনার শোধ নেব।”
রতনবাবু অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, “সব জানি হে শ্বেত। নির্লোভ, সদাচারী, সত্যনিষ্ঠ দেখে রামদুলাল আমাকে তাঁর কাছে রেখেছিল। কিন্তু তোমরা আমাকে সহ্য করতে পারতে না। আমি অনেক জোচ্চুরি, বাটপাড়ি ধরে ফেলতাম। তোমরা তক্কেতক্কে ছিলে আমাকে নিকেশ করার জন্য। রামদুলালের জন্য তখন পারোনি। স্বজন-বিদ্রোহে রামদুলালের পরিবার শেষ হয়ে যাওয়ায় আর আমি চলে আসায় তোমাদের সুযোগ হাতছাড়া হয়। আজ সুযোগ পেয়েছ। মারো আমি এই তৃপ্তি নিয়ে মরব যে, আমি আজও সত্যনিষ্ঠ, সত্যবাদী।”
খেতের চোখ অন্ধকারে একবার জ্বলে উঠল। গম্ভীর স্বরে সে বলল, “ইষ্টনাম স্মরণ করো রতনবাবু।”
“করছি। আমি সর্বদাই ইষ্টনাম স্মরণ করি।”
শ্বেত তার ভয়ংকর তীক্ষ্ণ শূল উদ্যত করল। রতনবাবু নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঠিক এই সময়ে একটা গুলতির গুডুল এসে টং করে শূলের গায়ে লাগল। আর একটা এসে লাগল খেতের কপালে।
“ও।” বলে বসে পড়ল শ্বেত। তারপর কপালটা চেপে ধরে বলে উঠল, “বিশ্বাসঘাতক।”
রতন বাঁড়ুজ্যে অবাক হয়ে দৃশ্যটা অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলেন।
বাঁশঝোঁপের অন্ধকার থেকে ছায়ামূর্তির মতো হাবুল বেরিয়ে এসে বলল, “দাদু, আমি হাবুল।”
রতন বিরক্ত স্বরে বললেন, “একাজ কেন করলে? আমাকে সত্যরক্ষা করতেই হবে।”
হাবুল দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কার কাছে সত্যরক্ষা দাদু? এ লোকগুলো যে ভীষণ পাজি। গন্ধর্ব মোটেই রামদুলালের নাতি নয়। আর তোমার কাছ থেকে হিরের আংটিও সে-ই চুরি করে নিয়ে যায়।”
“বলিস কী? কে বলল একথা?”
অন্ধকার কুঁড়ে আরও দুই মূর্তি এগিয়ে এল। একজনের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। অন্যজন তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে আনছে।
“গন্ধর্ব নিজেই স্বীকার করেছে বাবা।” রতনবাবু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতবাঁধা গন্ধর্বের মুখে বিরু টর্চের আলো ফেলল। মুখটা রক্তাক্ত, ঠোঁট কেটেছে, কপাল ঢিবি হয়ে আছে, গায়ে ধুলো ময়লা।
রতনবাবু বললেন, “ও রামদুলালের নাতি নয়?”
বিরু বলল, “না। ওর হাবভাব দেখে আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর ষষ্ঠীর কাছে শুনলাম ও নাকি চুরি হাতসাফাই আর ছিনতাইয়ের ওস্তাদ লোক। কালী-স্যাকরার দোকান দু’বার লুঠ করেছে। ষষ্ঠী আর টিকের কাছ থেকে টাকা ছিনতাই করেছে। তার ওপর শুনলাম, সে কুকুরটাকে বশ করতে পারে। তখনই মনে হল আপনার মতো সাবধানী লোকের ঘর থেকে আংটি চুরি করা তো যেমন-তেমন চোরের কাজ নয়, এরকম ধুরন্ধর লোকই তা পারে। তবু সন্দেহ দূর করার জন্য ষষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে আমি আমবাগানে লুকিয়ে ছিলাম। ষষ্ঠী যখন ফাঁস করে দিল যে কালী-স্যাকরার দোকান থেকে লুটকরা সোনা-দানা সব গন্ধর্বের কোমরে গেঁজের মধ্যে আছে তখনই লোহিতের সঙ্গে গন্ধর্বের বখরা নিয়ে লেগে গেল। বুঝতে পারলাম যে, এরা সাঁট করে এসেছে। গন্ধর্ব একটি পাকা চোর, শ্বেত আর লোহিত ওর স্যাঙাত।”
রতনবাবু খেতের দিকে তাকালেন। বিরুর টর্চের আলোয় শ্বেতের চোখ দুখানা আর একবার ঝলসে উঠল। সে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর দু পা এগিয়ে গিয়ে বিরাশি সিক্কার একটা চড় কষাল গন্ধর্বের গালে। বলল, “গাধা কোথাকার! কয়েক ঘণ্টা বাদে রাজার ধন হাতে পেতিস। তাও লোভ সামলাতে পারলি না। ধরা পড়ে গেলি?” ৭০
গন্ধর্ব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্বেত রতনবাবুর দিকে ফিরে বিষণ্ণ গলায় বলল, “আমাদের নিয়ে কী করবে রতনবাবু? পুলিশে দেবে? দাও। আমাদের ফন্দি যে খাটল না তা কপাল খারাপ বলেই। এই লোভী ছেলেটা আমারই ছেলে। সঙ্গদোষে খারাপ হয়ে গেছে। তাই ভেবেছিলাম, ওর একটা হিল্লে করে দিয়ে যাব।
তা আর হল না।”
রতনবাবু বললেন, “কিন্তু রামদুলাল আর তার আসল নাতি কোথায়?”
শ্বেত বিষণ্ণ গলায় বলল, “আজ আর বলতে বাধা নেই। রামদুলাল পালালেও বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারেনি। শত্রুপক্ষের গুপ্তঘাতকরা তাকে খুঁজে বের করে হাজারিবাগের জঙ্গলে মেরে ফেলে। নাতিরও একই দশা হয়েছিল। সে-খবর আমরা তোমাকে জানাইনি, তোমাকে নিষ্কণ্টক হতে দেব না বলেই। তবে এটা স্বীকার করছি রতনবাবু, তোমার বুকের পাটা আছে। তুমি সত্যবাদী, সৎ, প্রকৃত ব্রাহ্মণ। লোভের বশবর্তী হয়ে তোমার সর্বনাশ করতে আজ এসেছিলাম বটে, কিন্তু মনে-মনে তোমাকে বাহাদুর বলে মেনেছি। এখন পুলিশ ডাকো রতনবাবু।”
রতনবাবু একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “এর মধ্যে পুলিশকে ডাকার কোনও মানে হয় না। আজ রাত পোয়ালেই রামদুলালের শর্তের সময় পার হয়ে যাবে। তোমরাও আর আসবে না। আজ এই শেষ দিনটায় কোনও তিক্ততার স্বাদ রাখতে চাই না মুখে। তোমরা যাও। আমি তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। সভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।”
জালদড়ি দিয়ে বাঁধা লোহিতকে ঘটনাস্থলে টেনে আনছিল পাঁচু। মুখটা বিকৃত করে বলল, “কতাবাবুর কেবল ক্ষমা আর ক্ষমা। অন্তত পুকুরে দুটো চুবোন দিয়ে, মাথাটা কামিয়ে তবে না ছাড়া উচিত।”
রতনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না,যথেষ্ট হয়েছে। এবার ওদের যেতে দাও।”
.
ভোর হয়ে আসছে। আমবাগানের মধ্যে স্নিগ্ধ একটু আলো ফুটে উঠল।
বাঁধন খুলে দেওয়ার পর শ্বেত, লোহিত আর গন্ধর্ব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সামান্য মাথা নত করে অভিবাদন জানাল রতন বাঁড়ুজ্যেকে। তারপর ধীরে-ধীরে হেঁটে চলে গেল।
ভোরের আলোয় গন্ধর্বের সুন্দর মুখোনা আর একবার দেখল হাবুল। তার মনে হল, অত সুন্দর চেহারা যার সে কেন এরকম নষ্ট হয়ে যাবে? হাবুল তার কাকার দিকে ফিরে বলল, “তুমি গন্ধর্বদার সঙ্গে গায়ের জোরে পারলে কী করে? ওর তো গায়ে দারুণ জোর।”
বিরু মৃদু একটু হেসে বলল, “গন্ধর্ব লোভী। সে লড়ছিল লোভের তেষ্টা মেটাতে। আর আমি লড়েছি আমার বাবার প্রাণ বাঁচাতে। ও আমার সঙ্গে পারবে কেন? তা ছাড়া কোনও মানুষই অতিমানুষ নয়।”
.
আগে-আগে রতনবাবু, তাঁর পেছনে হাবুল আর বিরু, সবশেষে পাঁচু পেতলের বাক্সটা ঘাড়ে করে আর দলিল-দস্তাবেজের বাণ্ডিল বগলে নিয়ে ফিরতে লাগল। রতনবাবু হিরের আংটিটা হাবুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি আমার প্রাণরক্ষা করেছ। এটা আজ থেকে তোমার। বড় হয়ে পরো। এখন মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে দিও।”
একটু তফাতে থেকে ষষ্ঠী দৃশ্যটা দেখল। তার মনটা আজ খুশিতে ভরা। বিরুবাবু বলেছেন, পুরনো দরোয়ান দেশে যেতে চাইছে। তার জায়গায় ষষ্ঠীকে বহাল করা হবে।
ষষ্ঠী আমগাছতলায় মাটি খুঁড়ে লোটা দুটো বের করে আনল।
না, লোটা দুটো সে নেবে না। জীবনে এই প্রথম চুরির জিনিস ষষ্ঠী ফেরত দেবে। মনটা আজ বেশ ভালো লাগছে তো, তাই।