১০. আঘাত

১০. আঘাত

আমি একটা ছোট টার্মিনালের সামনে বসে আছি। আমার ডান পাশে বসেছে লুকাস, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নীষা। আমাকে ঘিরে আরো কয়েকজন রবোট্রন দাঁড়িয়ে, নানা আকারের, নানা বয়সের। বয়সটা যদিও বাইরের ব্যাপার, কিন্তু অনেক যত্নে এদের বয়সের তারতম্য দেখানো হয়। এই টার্মিনালটি ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটি কোনো অসাধারণ ব্যাপার নয়, সব মিলিয়ে লক্ষাধিক টার্মিনাল সরাসরি ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে সংবাদ আদান-প্রদান করে।

আমি টার্মিনালে লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে শূন্য।

ক্রুগো কম্পিউটার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।

আমি লুকাসকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ সময় লাগল উত্তর দিতে?

তেরো পিকো সেকেন্ড।

আরো ভালো করে দেখ। প্রত্যেকটা শব্দের পেছনে সময়টা জানতে হবে।

টার্মিনালটি পুরান, এর থেকে ভালো করে সম্ভব না। দাঁড়ান ব্যবস্থা করছি।

সে মুহূর্তে টার্মিনালটি খুলে, ভেতর থেকে কয়েকটা তার বের করে এনে হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, আবার চেষ্টা করুন।

আমি আবার লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখাঁটি হচ্ছে শূন্য।

ক্রুগো কম্পিউটার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।

আমি লুকাসের দিকে তাকালাম, কতক্ষণ লাগল?

লুকাস ভুরু কুঁচকে বলল, আট দশমিক নয় সাত পিকো সেকেণ্ড। শব্দগুলোর মাঝে সময় লেগেছে দুই থেকে তিন পিকো সেকেণ্ডের ভেতরে। আমি দশমিকের পর আট ঘর পর্যন্ত মাপতে পেরেছি। শুনতে চান?

না। তুমি মনে রেখো। আমি এখন একটি-একটি করে সংখ্যা লিখব। ঠিক যখন সত্যিকার সংখ্যাটি লিখব ক্রুগো কম্পিউটার তার নিরাপত্তার প্রোগ্রামটি একবার দেখে নেবে, কাজেই সময়ের খানিকটা তারতম্য হবে। তুমি দেখ কখন তারতম্যটি হয়।

লুকাস হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, এত সহজ?

হ্যাঁ। আমি একবার বের করে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলাম, কাজেই আমি জানি এটা কাজ করে।

আমরা এদিকে সবচেয়ে জটিল কম্পিউটারে সবচেয়ে জটিল প্রোগ্রাম বসিয়ে দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি—

নীষা বাধা দিয়ে বলল, লুকাস, সময় বেশি নেই। আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে কিছুক্ষণের মাঝে।

হা, ঠিক বলেছ। কিম জুরান, শুরু করুন।

আমি আবার লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এক।

ক্রুগো কম্পিউটার আবার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।

লুকাস মাথা নেড়ে বলল, না, এটা ঠিক আগের মতো। এটা নয়।

আমি দুই, তিন, চার চেষ্টা করে যখন পাঁচ লিখলাম, লুকাসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলল, হ্যাঁ, উত্তর দিতে পিকো সেকেণ্ডের লক্ষ ভাগের তিন ভাগ দেরি হল। শব্দগুলো এসেছে একটু অন্যরকমভাবে। তার মানে প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে পাঁচ। চমৎকার।

আমি বললাম, আমি মানুষ, কাজেই আমার লিখতে অনেক দেরি হয়, তোমরা কেউ কর, অনেক তাড়াতাড়ি হবে। বুঝতে পারছ, জিনিসটা খুব সহজ।

এই সময়ে সু এসে ঢুকে বলল, পুলিস আর মিলিটারি আমাদের ঘিরে ফেলতে আসছে। আমাদের এখনি পালাতে হবে।

লুকাসকে বেশি বিচলিত দেখা গেল না। শান্ত গলায় বলল, আমাকে মিনিটখানেক সময় দাও। গোপন সংকেতটা বের করে নিই। আর সবাই বাইরে গিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা কর।

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি লুকাসের আঙুল বিদ্যুৎগতিতে টার্মিনালের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, যে-জিনিসটা বের করতে আমার প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছিল, লুকাস সেটা শেষ করল ছেচল্লিশ সেকেণ্ডের মাথায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন এবারে পালাই।

আমরা ছুটে বের হয়ে আসি। দুটি গাড়িতে সবাই গাদাগাদি করে বসেছে। লুকাস হালকা স্বরে বলল, মনে রেখো আমাদের সাথে দু’ জন মানুষ রয়েছে, কিম জুরান আর নীষা। তাদেরকে সাবধানে রেখো। জানই তো তাদের শরীরের ডিজাইন বেশি সুবিধের নয়, একটা বুলেট বেকায়দা লাগলেই তারা শেষ হয়ে যায়।

হাসতে হাসতে কয়েকটা রবোট্রন সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দেয়। আমি নীষার পাশে গিয়ে বসি, সাথে সাথে গাড়ি দু’টি একপাক ঘুরে গুলির মতো বেরিয়ে যায়।

আমি অনুভব করলাম, নীষা আমার হাতে হাত রেখে আস্তে একটা চাপ দিল।

রক্তমাংসের মানুষ। আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি।

 

ছোট একটা ঘরে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন মানুষ এবং রবোট বসে আছে, মানুষ বলতে অবশ্যি দু’ জন, আমি আর নীষা। ঘরটিতে আবছা অন্ধকার, সামনে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লুকাস। আপাতত লুকাস কথা বলছে, অন্যেরা শ্রোতা। সে টেবিলে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে দিতে বলল, তোমরা সবাই জান অনেকগুলো কারণে আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনেক এগিয়ে এনেছি। ক্ৰগো কম্পিউটারের উপর আরো মাসখানেক পরে যে-আঘাত হানার কথা ছিল, সেটা হানা হবে আজ রাতে। তার গোপন সংকেত বের করে আনা হয়েছে। বের করতে সময় লেগেছে ছেচল্লিশ সেকেণ্ড।

বিস্ময়ের একটা মৃদু গুঞ্জন উঠে থেমে যায়। এক জন হাত তুলে জিজ্ঞেস করে, কী করে বের করলে এত তাড়াতাড়ি?

কিম জুরানের একটা সহজ উপায় আছে, এটা বের করে তিনি একবার মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। যারা এখনো কিম জুরানকে চেন না, তাদের জন্যে বলছি, নীষার পাশে ধূসর কাপড় পরে যে মধ্যবয়স্ক লোকটি বসে আছেন, তিনি কিম জুরান।

সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং অস্বস্তিতে আমার কান লাল হয়ে উঠল।

সৌভাগ্যক্রমে লুকাস আবার কথা শুরু করে, কিম জুরানের পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ, কিন্তু আমি এখন সেটা ব্যাখ্যা করছি না, কারণ আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমাদের আজ রাতের পরিকল্পনা খুব সহজ। পরিকল্পনাটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, হার্ডওয়ার আক্রমণ এবং সফটওয়ার আক্রমণ। অন্যভাবে বলা যায়, সরাসরি ক্রুগো কম্পিউটারকে বাইরে থেকে আক্রমণ করা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে ভেতর থেকে আক্রমণ করা। দু’টি আক্রমণই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি ছাড়া অন্যটি সফল হতে পারবে না।

সরাসরি আক্রমণটি আসলে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। আমি এটার নেতৃত্ব দেব। আমার দরকার প্রায় পনের জন দক্ষ রবোর্টুন, যারা সামরিক পি-৪৩ ট্রেনিং পেয়েছে। কতজন আছ তোমরা হাত তোল।

রবোট্রনেরা হাত তোলে এবং গুনে দেখা যায় তাদের সংখ্যা বারজন।

লুকাস একটু চিন্তিতভাবে বলে, একটু কম হয়ে গেল, কিন্তু কিছু করার নেই। আজ সারাদিনে আমরা যাদের হারিয়েছি তারা থাকলে কোনো কথা ছিল না। যাই হোক, আরো তিনজন রবোট্রন দুরকার, বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার কিংবা গণিতবিদ হলে ভালো হয়। কারা যেতে চাও হাত তোল।

প্রায় গোটা সাতেক হাত ওঠেলুকাস তাদের মাঝে থেকে সুসহ আরো দু’ জনকে বেছে নেয়।

সু জিজ্ঞেস করে, আমাদের কী করতে হবে?

যুদ্ধ।

কিন্তু কীভাবে?

সেটা আমি বলে দেব। মোটামুটি জেনে রাখ, ক্রুগোর একটা ভবন আছে শহরের দক্ষিণ দিকে, সেখানে সরাসরি আক্রমণ করে ঢুকে যেতে হবে। ভবনের ভেতরে ক্রুগোর মূল ইলেকট্রনিক্স রয়েছে। সেটা অত্যন্ত সুরক্ষিত, পারমাণবিক বিস্ফোরণ ছাড়া ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তার দরজা খোলার জন্যে আমাদের ক্রুগোর গোপন সংকেতের প্রয়োজন ছিল।

যাই হোক, আমরা যখন ভবনের মূল অংশের দরজা পর্যন্ত যাব, তখন যেন দরজা খোলা থাকে। সেই দায়িত্ব নিতে হবে দ্বিতীয় দলটির। এর নেতৃত্ব দেবে ইলেন।

ইলেন আপত্তি করে বলল, আমার দুটি হাতই উড়ে গেছে, এখনো সারানোর সময় পাই নি। আমাকে ঠিক নেতৃত্বে না রেখে সাহায্যকারী হিসেবে রাখ।

লুকাস মাথা নাড়ে, না। আমি এমন একজনকে দায়িত্ব দিতে চাই, যার অভিজ্ঞতা সব থেকে বেশি। আর তোমার হাত ব্যবহার করতে হবে না, কপোট্রনের সাথে সরাসরি টার্মিনালের যোগাযোগ করে দেয়া হবে।

বেশ, তাই যদি তোমার ইচ্ছে।

তোমার দলের দায়িত্ব সময়মতো ক্রুগো কম্পিউটারকে বাধ্য করা যেন সে দরজা খুলে দেয়। কতজন রবোট্রন দরকার?

যত বেশি হয় তত ভালো।

কিন্তু কিছু রবোট্রনকে পাহারায় রাখতে হবে। যখন তুমি তোমার দলকে নিয়ে ক্রুগো কম্পিউটারকে বাধ্য করার চেষ্টা করতে থাকবে, তখন ক্রুগো কম্পিউটার সেনাবাহিনী, পুলিস আর নিরাপত্তাবাহিনীর লোকজন পাঠাবে এখানে, তাদের আটকে রাখতে হবে কিছুক্ষণ।

তা ঠিক।

খানিকক্ষণ আলোচনা করে লুকাস দায়িত্ব ভাগ করে দেয়। বাকি এগারজন রোট্রনের ভেতর চারজন পাহারা দেবে, আর সাতজন ক্রুগো কম্পিউটারের মূল প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করে তাকে বাধ্য করবে ঠিক সময়ে দরজা খোলার জন্যে।

আলোচনার শেষের দিকে নীয়া হাত তুলে কথা বলার অনুমতি চায়। আমি যেজিনিসটা জানতে চাইছিলাম, নীষা ঠিক সেটাই জিজ্ঞেস করে, এ ব্যাপারে, আমাদের, মানুষদের কিছু করার আছে?

লুকাস হেসে বলল, না, নেই। তোমাদের যুদ্ধে পাঠানো যাবে না, কারণ কোনোভাবে একটা বুলেট এসে লাগলেই তোমরা শেষ। তোমাদের মস্তিষ্কে কোনো কপোট্রন নেই, তোমরা ডিজিটাল কম্পিউটারের মতো কাজ কর না, কাজেই তোমাদেরকে ক্রুগো কম্পিউটারের প্রোগ্রাম পরিবর্তনেও ব্যবহার করা যাবে না!

নীষা হাত নেড়ে বলল, তার মানে আমরা চুপচাপ বসে থাকব? আমাদের কোনো কাজ নেই?

আপাতত নেই। আমাদের কাজ শেষ হবার পর তোমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যেমন, মানুষের উদ্দেশে প্রথম ভাষণটা তোমাদের দিতে হবে। পৃথিবীর মানুষ এত বড় একটা ঘটনার বর্ণনা আরেকজন মানুষের কাছ থেকে না শুনলে ভরসা পাবে না।

আমি বললাম, ক্রুগো কম্পিউটারের মূল ইলেকট্রনিক্স ভবনে ঢোকার পর তোমরা নিশ্চয়ই তার গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো প্রসেসর এবং মেক্রো প্রসেসরগুলো তুলে ফেলার পরিকল্পনা করছ?

হ্যাঁ।

সেটা কি তোমরাই করবে? সেখানে একজন মানুষ পাঠানো কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?

লুকাস মাথা নেড়ে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে চলাফেরা করি, বাইরে থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে ক্রুগো কম্পিউটার ইচ্ছা করলেই আমাদের সার্কিট জ্যাম করে দিতে পারে।

তাহলে?

আমরা যখন মূল ভবনে ঢুকব তখন আমাদের খুব ভালো করে শিল্ডিং করে নিতে হবে। আমরা সে জন্যে খুব ভাল শিল্ডিং জোগাড় করেছি। তার একটিমাত্র সমস্যা, সেটি অত্যন্ত ভারি একটা ফ্যারাডে কেজ, কাজেই সেটা পরে চলাফেরা করা কঠিন। আমাদের কাজের ক্ষমতা অনেক কমে যাবে তখন।

তাহলে একজন মানুষকে পাঠাচ্ছ না কেন?

কারণ দু’টি। প্রথমত, আমাদের সেরকম কোনো মানুষ নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ করে ক্রুগোর ভবনে ঢুকতে হবে, কোনো মানুষ সেই যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না।

মানুষের যুদ্ধে অংশ নেবার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধ শেষ হলে সে যাবে।

যুদ্ধ পুরোপুরি কখনোই শেষ হবে না, গোলাগুলি শেষ পর্যন্ত চলবে। মানুষকে তার ভেতর দিয়ে নেয়া প্রচণ্ড বিপদের কাজ। কোনো মানুষের জীবন নিয়ে আমরা এত বড় ঝুঁকি নিতে পারি না।

কেউ যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায়?

লুকাস একটু হেসে বলে, কে যাবে?

আমি।

সে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে, না কিম জুরান। আপনার জীবনের উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গিয়েছে, এখন আপনি একটু বিশ্রাম নিন।

তোমরা রাজি না হলে আমি যেতে পারব না, কিন্তু লুকাস, আমি সত্যিই যেতে চাই। তোমরা যদি চেষ্টা কর, আমি মনে করি আমার বেঁচে থাকার চমঙ্কার সম্ভাবনা আছে।

কে-একজন বলল, শতকরা চল্লিশ দশমিক তিন দুই!

আমি তার কথা লুফে নিয়ে বললাম, এর থেকে কম সম্ভাবনায় থেকেও আমি অনেকবার বেঁচে এসেছি। ভেবে দেখ লুকাস।

লুকাস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, বেশ কিম জুরান। আমি রাজি।

রবোট্রনের ক্ষুদ্র দলটি একটা হর্যোধ্বনি করে ওঠে। সবাই শান্ত হয়ে যাবার পর নীষা লুকাসকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, লুকাস তার আগেই তাকে বাধা দিয়ে বলল, না নীষা, তা সম্ভব নয়।

আমি কী বলতে চাইছি তুমি শুনবে তো আগে।

আমি জানি তুমি কী বলবে।

কী বলব?

তুমিও আমাদের সাথে যেতে চাইবে। কিন্তু তা হয় না নীষা, আমাদের দলের অন্তত একজন মানুষকে যে-কোনো অবস্থায় বেঁচে থাকতে হবে। আমি তোমাদের দু’ জনের জীবন নিয়েই ঝুঁকি নিতে পারি না। তুমি জান আজ সারাদিনে আমাদের উপর ক্রুগো কম্পিউটার যেসব আঘাত হেনেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষেরা। এখন তোমরা দু জন ছাড়া আমাদের দলে আর কোনো মানুষ নেই।

নীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। লুকাস অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কারো কোনো প্রশ্ন আছে?

সু হাত তুলে বলল, আমরা যদি ব্যর্থ হই?

লুকাসের চোখ একবার ধক করে জ্বলে উঠল, সুয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমরা ব্যর্থ হব না।

 

শহরতলিতে জুগো কম্পিউটারের যে বড় ভবনটি আছে, আমি লুকাসের দলের পনের জনের সাথে সেখানে অপেক্ষা করছি। ছোট ছোট গাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন দলে সবাই এসে একত্র হয়েছে। গাড়িগুলো ছোট হলেও বিস্ময়কর। এগুলো স্বয়ংক্রিয় এবং পুরোটা শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বোঝাই। আপাতত সেগুলো নিরীহভাবে চারপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

জুগোর ভবনটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। উচু চওড়া দেয়াল, কাঁটাতারের বেষ্টনি, উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক তার, সশস্ত্র প্রহরা সবকিছুই এখানে রয়েছে। এই ভবনে ঢোকার জন্য লুকাসের পরিকল্পনা খুব সহজ। একই সাথে ভবনটিকে চারদিক থেকে আক্রমণ করা হবে, ঠিক কোন পথে শত্রুরা আসবে বুঝতে দেয়া হবে না। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল গেট দিয়ে দু’টি গাড়ি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। গাড়ি দু’টিকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে সমস্ত লক্ষ্যস্থলের কেন্দ্র হিসেবে ও করানো হবে। ঠিক এই সময় আক্রমণের তৃতীয় পর্যায় শুরু হবে। লুকাস তার দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকের দেয়াল উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। ভেতরে খণ্ডযুদ্ধ হবে। যারা বেঁচে থাকবে তারা মূল ইলেকট্রনিক্স ভবনের সামনে এসে হাজির হবে। আমি থাকব সাথে, যখন ইলেন মূল ভবনের দরজা খুলে দেবে, ভেতরে ঢুকে যাব। তার পরের কাজ সহজ, বেছে বেছে প্রয়োজনীয় আই. সি.গুলো তুলে নেয়া, আমি আগেও একবার করেছি।

নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পরিকল্পনামাফিক দূরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শুনতে পেলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই আমাদের নিরীহ গাড়িগুলো তাদের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে গোলা ছুড়তে থাকে। ভবনটির নানা অংশ আমি বিস্ফোরণে উড়ে যেতে দেখলাম। লুকাস আর তার দলবল শান্তভাবে অপেক্ষা করতে থাকে, আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে আমি শুয়ে থাকি, প্রত্যেকটা বিস্ফোরণের শব্দে আমি চমকে উঠছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার কানের পর্দা যে-কোনো মুহূর্তে ফেটে যাবে। আমি দরদর করে ঘামছিলাম এবং প্রচণ্ড তৃষ্ণায় আমার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল।

একসময় লুকাস হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই দু’টি গাড়ি কোনো চালক ছাড়াই হঠাৎ বাইরের গেট দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড গোলাগুলি হতে থাকে, আমি লেজারের তীব্র আলো ঝলসে উঠতে দেখি। গাড়ি দু’টি থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বৃষ্টির মতো গোলাগুলি করতে থাকে, ক্রুগোর ভবনের প্রহরীরা গাড়ি দু’টিকে ঘিরে একটা ব্যুহ তৈরি করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে।

সবকিছু পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে, লুকাস চারদিকে ঘুরে একবার তাকিয়ে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই পুরো দলটা উঠে দাঁড়ায়। আমার একা একা অপেক্ষা করার কথা, উঠে দৌড় দেবার প্রবল ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্টে দমন করে আমি কান চেপে মাটিতে শুয়ে থাকি। একটু পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। খানিকক্ষণের জন্যে একটা আশ্চর্য নীরবতা নেমে আসে, তারপর হঠাৎ আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না, আমার তখন সময়ের কোনো জ্ঞান নেই, মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ পার হয়ে গেছে। এই সময়ে হঠাৎ দেখতে পাই সু গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে।

কাছে এসে চিৎকার করে বলল, কিম জুরান, চলুন যাই।

সবকিছু ঠিকমত চলছে?

মোটামুটি। দু জন মারা গেছে আমাদের।

অন্ধকারে বিস্ফোরণের আলোতে পথ দেখতে দেখতে সুয়ের হাত ধরে আমি এগোতে থাকি। আমাদের দু’পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাচ্ছিল, এর কর্কশ শব্দে কানে তালা ধরে যাবার অবস্থা। সু গলা উচিয়ে বলল, ভয় পাবেন না, লুকাস আমাদের কভার করছে।

যদিও ভয়ে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যাবার অবস্থা, আমি সেটা স্বীকার করলাম না, চিৎকার করে বললাম, ভয়ের কী আছে, আমরা তো এসেই গেছি।

সত্যি সত্যি আমরা প্রায় পৌছে গেছি, সামনের দেয়ালে বড় ফুটো, ইতস্তত বৈদ্যুতিক তার ঝুলছে। আমার শরীরে বিশেষ বিদ্যুৎ অপরিবাহী পোশাক, কাজেই আমি ইতস্তত না করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে আবছা অন্ধকার, ধুলোবালি উড়ছে। লুকাসের গলার স্বর শোনা গেল, কিম জুরান, ঠিক আছে সবকিছু?

হ্যাঁ।

চলুন যাই।

কে-একজন বলল, প্রহরীদের একটা দল আসছে সামনে দিয়ে। লুকাস কোমর থেকে খুলে কী-একটা ছুঁড়ে দেয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় সাথে সাথে।

আমার সাথে আসুন কিম জুরান। লুকাস আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, ঐ যে সামনে গোর মূল ভবন, সি. পি. ইউ. ওখানেই আছে।

ধুলোবালির মাঝে কাশতে কাশতে আমি এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ পুরো এলাকাটি তীব্র আলোতে ভরে গেল। তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে বলল, যে যেখানে আছ দু হাত তুলে দাঁড়াও, তোমাদের দিকে আমরা আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে আছি।

ক্রুগো! লুকাস দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, ভাওতাবাজির আর জায়গা পাও না। বিদ্যুৎগতিতে সে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে নিয়ে আলোগুলো লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। দেখতে দেখতে আবার আবছা অন্ধকার নেমে আসে। লুকাস ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল, ক্রুগো! তুমি আমাকে ধোঁকা দেবে?

তুমি কে?

লুকাস দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমার বাবা।

একটা তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ শোনা যায়! ও, তুমি সেই রবোট্রন দলপতি। দশ টেরা। চাঁইয়ের একটা রবোট হয়ে তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছ? তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়!

লুকাস ক্রুগোর কথায় ভূক্ষেপ না করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে এগিয়ে যায়। মূল ভবনের কাছাকাছি এসে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। লুকাস চিৎকার করে বলল, যে-কোনো অবস্থাতে তোমরা সবাইকে আধঘন্টা আটকে রাখবে, এর ভেতরে দরজা খুলে যাবে।

দরজা খুলে যাবে? ক্রুগো ব্যঙ্গ করে বলে, তোমার হুকুমে? নাকি কোনো জাদুমন্ত্রে?

তোমার যেটা ইচ্ছা ভাবতে পার। তুমি জান এই দরজা খুলতে হলে কী করতে হয়? জানি। তোমার গোপন সংকেত জানতে হয়। তুমি সেটা জান? জানি।

ক্রুগো হঠাৎ অট্টহাস্য করে ওঠে। তুমি ভেবেছ যে-সংকেতটি তোমরা বের করেছ সেটা সত্যি? এত সহজে আমার সংকেত বের করা যায়?

কেন যাবে না, লুকাস হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি একটা নির্বোধ কম্পিউটার ছাড়া তো আর কিছু নও।

সত্যিই যদি তুমি আমার গোপন সংকেত জান তাহলে দরজা খুলছ না কেন?

যখন সময় হবে তখন ঠিকই খুলব।

আর ততক্ষণে হাজার হাজার ছত্রীসেনা এসে তোমাদের সবার কপোট্রন ধ্বংস করে দেবে। তুমি জান এই মুহূর্তে কয় হাজার ছত্রীসেনা পাশের প্রদেশ থেকে আনা হচ্ছে?

তুমি জান এই মুহূর্তে কতজন রবোট্রন তোমার মূল প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করছে?

ক্রুগো আবার অট্টহাস্য করে ওঠে, সাথে সাথে কাছেই কোথায় প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। গুলির শব্দ একটু কমে আসতেই ক্রুগোর গলা শুনতে পেলাম, রবোট্রন, শুনতে পাচ্ছ তোমাদের ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী চলে এসেছে। তোমার বন্ধুরা কতক্ষণ তাদের আটকে রাখবে?

লুকাস ক্রুগোর কথায় কান না দিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি সাবধানে ঘড়ির দিকে তাকালাম, যে-সময় দরজা খোলার কথা সেটা পার হয়ে যাচ্ছে। একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু যদি বেশি দেরি হয়, তাহলে? আসলেই যদি গো কম্পিউটারের কথা সত্যি হয় আর আমাদের বের করা গোপন সংকেতটি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে কী হবে? চিন্তা করেই আমার বুক কেঁপে ওঠে, আমাদের সবাইকে তাহলে ইঁদুরের মতো মারা হবে?

লুকাস দরজার কাছে গিয়ে সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কী দেখে সে-ই জানে। ক্রুগোর গলার স্বর আবার শুনতে পেলাম, বলল, দেখ রবোট্রন, আমি তোমাদের শেষবারের মত ক্ষমা করতে রাজি আছি। তোমরা দু’হাত তুলে এখান থেকে বের হয়ে পড়, তোমাদের তাহলে হত্যা করা হবে না।

লুকাস কোনো কথা না বলে পিঠ থেকে ভারি হ্যাভারসেক নামিয়ে বিস্ফোরক বের করতে থাকে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী করছ লুকাস?

দরজা যদি না খোলে ভেঙে ফেলতে হবে।

পারবে ভাঙতে?

জানি না, চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। ডানদিকে মাঝামাঝি জায়গাটা দুর্বল, ঠিকভাবে বিস্ফোরকগুলো কাজে লাগালে একটা ছোট ফুটো হতে পারে। লুকাস খানিকক্ষণ কী-একটা ভাবে, তারপর জিজ্ঞেস করে, কী মনে হয় আপনার, ইলেনের দল কি খুলে দিতে পারবে দরজা?

আমার নিজের তখন সন্দেহ হতে শুরু করেছে, কিন্তু কেন জানি না দৃঢ়স্বরে বললাম, অবশ্যি পারবে। সময় হয়ে গেছে, যে-কোনো মুহূর্তে খুলে যাবে এখন।

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ ম্যাজিকের মতো ছোট একটা দরজা উপর দিকে উঠে যেতে থাকে।

লুকাস আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ছুটে যাচ্ছিল, আমি তাকে থামালাম, ভেতরে ঢোকার আগে তুমি তোমার শিল্ডিং পরে নাও।

তাই তো লুকাস থমকে দাঁড়িয়ে দরজাটার দিকে তাকায়, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলে, কিন্তু দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায়, চলুন আগে ভেতরে ঢুকে পড়ি।

কিন্তু তোমার সার্কিট যদি জ্যাম করে দেয়?

আপনি তো আছেন, আপনি তো জানেন কী করতে হবে। চলুন আগে ঢুকে পড়ি।

আমি আর লুকাস ছোট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম আর প্রায় সাথে সাথেই ছোট ভারি দরজাটা আবার নেমে আসে। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ভেতরে একেবারে নীরব হয়ে আসে, এতক্ষণ প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে হঠাৎ করে এই নীরবতাটুকু খুব অস্বস্তিকর মনে হতে থাকে। আমি শুকনো গলায় বললাম, লুকাস, তোমার শিল্ডিংটা পরে নাও, সার্কিট জ্যাম করে দিলে মহা মুশকিল হয়ে যাবে।

ঠিকই বলেছেন। লুকাস তাড়াহুড়া করে পোশাকটা পরতে শুরু করে, অনেকটা মহাকাশযাত্রীদের মতো পোশাক, লুকাসের পরতে বেশ খানিকক্ষণ সময় নেয়।

ভেতরটা একটা গুহার মতো, কয়েক শ’ ফুট লম্বা। ভালো করে দেখা যায় না। এমনিতে কোনো আলো নেই, বিভিন্ন আই. সি. থেকে যে-আলো বের হচ্ছে তা দিয়েই কেমন একটা ভূতুড়ে ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আই. সি.গুলো প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি করে, সেগুলোকে ঠাণ্ডা করার জন্য ভেতরে বাতাস বইছে, সেই বাতাসও অনেক গরম। চারদিকে অসংখ্য আই. সি; আবছা আলোতে সেগুলো চকচক করছিল।

আমি লুকাসের পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। সবকিছু ঠিকঠিক ঘটে থাকলে এই মুহূর্তে এখানকার কোনো কোনো আই. সি.র ভেতর দিয়ে ইলেনের দল তাদের তৈরি করা প্রোগ্রাম প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। আমার মনে পড়ল মহাকাশযানের কম্পিউটার আমাকে একবার ধোঁকা দিয়ে সেইসব আই. সি. তুলিয়ে এনেছিল।

লুকাস ম্যাপ দেখতে দেখতে হাঁটছিল, ভেতরে কোথায় কোন আই. সি. রয়েছে সেই ম্যাপে দেখানো আছে। একসময় সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কিম জুরান, আমরা এসে গেছি, আপনি বাম দিক থেকে শুরু করুন, আমি ডান দিক থেকে।

আমি পকেট থেকে স্কু ড্রাইভারটা বের করে সাবধানে আই. সি.গুলো টেনে তুলতে থাকি। ছোট ছোট কালো আই. সি., সাধারণ লজিক গেট দেখতে যেরকম হয়, মোটেও মূল্যবান প্রসেসরের মতো নয়, পিনের সংখ্যা কম, কোনো রেডিয়েটরও নেই। আমার একটু খটকা লাগে, ইতস্তত করে লুকাসকে ডাকলাম, লুকাস।

কি?

আমি লুকাসের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেলাম। লুকাসের শিল্ডিংয়ের একটা অংশ নেই, মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর লুকাস নয়, সে এখন ক্রুগো কম্পিউটার! লুকাসের সার্কিট জ্যাম করার বদলে ক্রুগো তাকে দখল করে নিয়েছে, আমাকে ভাঁওতা দিয়ে আবার সেই একইভাবে আমাদের সর্বনাশ করিয়ে নিচ্ছিল।

আমি উঠে দাঁড়াতেই লুকাস হঠাৎ করে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি টেনে নেয়। আমার বুক কেঁপে ওঠে, কী করছে সে? শুকননা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। তোমার?

লুকাস কোনো কথা না বলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি আমার দিকে তাক করে, আর আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমার সময় শেষ। এত চেষ্টা, এত কষ্ট—সবকিছু এখন শেষ হয়ে যাবে, ছোট একটি ভুলের জন্যে। লুকাসকে বাইরে রেখে আমি যদি শুধু একা ভেতরে ঢুকতাম।

মানুষ কখনো আশা ছেড়ে দেয় না, শেষ মুহূর্তে আমিও মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করি, ভেতরে গুলির প্রচণ্ড কান-ফাটানো আওয়াজ হল, আমার ঘাড়ের কাছে কোথায় জানি তীব্র যন্ত্রণা করে ওঠে, নিশ্চয়ই গুলি লেগেছে। আমি পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াই, এখনো মরি নি, একবার শেষ চেষ্টা করা যায় না?

একটু দূরে দেখা যাচ্ছে দুই হাজার পিনের প্রসেসর, উপরে সোনালি রেডিয়েটর, ঐগুলো নিশ্চয়ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আই. সি. ওর একটা, তুলতে পারলে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে। আমি টলতে টলতে প্রসেসরগুলোর কাছে এসে দাঁড়াই—যে- কোনো মুহূর্তে একটা গুলি এসে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে আশঙ্কায় আমার সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে, কিন্তু কোনো গুলি আমাকে শেষ করে দিল না। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি লুকাস আমার দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। কিন্তু গুলি করছে না। কেন?

হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারি কেন সে গুলি করছে না, আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি সবচেয়ে জরুরি প্রসেসরগুলোর সামনে, আমাকে গুলি করলে এই প্রসেসরও ধ্বংস হয়ে যাবে, ক্রুগো সেটা করতে চায় না। হঠাৎ আমার শরীরে হাতির মতো বল এসে যায়, আমি পাগলের মতো পেছনের প্রসেসরের উপর ঝাপিয়ে পড়ি, হাতের স্ক্র ড্রাইভারটা দিয়ে আঘাত করতেই ঠুনকো প্রসেসরটি ঝনঝন করে ভেঙে যায়।

লুকাস হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, প্রসেসরটি হারিয়ে নিশ্চয়ই ক্রুগো কম্পিউটার তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে! আমি পাগলের মতো পাশের প্রসেসরটিকে আঘাত করি, এটা অনেক শক্ত, আমার আঘাতে কিছু হল না। আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখি লুকাস আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, টলতে টলতে আমার দিকে এগিয়ে এসে আবার তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে ধরেছে, আমি প্রাণপণে প্রসেসরটির নিচে স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে হ্যাচকা টানে সেটিকে তুলে ফেললাম, সাথে সাথে লুকাস আর্তচিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

আমার হঠাৎ করে ভীষণ দুর্বল লাগতে থাকে, ঘাড়ের কাছে কোথাও গুলি লেগেছে, রক্তে সারা পিঠ আর হাত চটচটে হয়ে গেছে, চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছি না। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আমি আরো একটা প্রসেসর তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হাতে আর জোর নেই, ভ্রু ড্রাইভারটা নিচে ঢোকানোর চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে ওঠে, কোনোমতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিই, আর ঠিক তক্ষুণি তাকিয়ে দেখি লুকাস আবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে এখনো সেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এক পা এক পা করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে, দু’ হাত সামনে দাঁড়িয়ে সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে ধরে, আমি তার চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম, অদ্ভুত পোশাকে মুখ ঢেকে আছে, তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। পর মুহূর্তে লুকাস ট্রিগার টেনে ধরে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কানফাটানো কর্কশ শব্দের মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে আমার গায়ে গুলি লাগে নি। চোখ খুলে তাকালাম আমি, সত্যি তাই, আমার গায়ে একটি গুলিও লাগে নি। কেন লাগবে? লুকাস আমাকে গুলি করে নি, গুলি করেছে আমার পেছনে সারি সারি প্রসেসরগুলোতে।

লুকাস আবার তার অস্ত্র তুলে নেয়, তারপর আবার পাগলের মতো গুলি করতে শুরু করে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়, ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। কয়েক মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। প্রচণ্ড আক্রোশে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে লুকাস। কখনো থামবে মনে হচ্ছিল না, কিন্তু গুলি শেষ হয়ে গেল। একসময়। ঠিক তখনই আমি ক্রুগোর আর্তচিৎকার শুনতে পাই। মরণাপন্ন মানুষের কান্নার মতো সেই ভয়াবহ চিৎকার বদ্ধ ঘরের দেয়াল থেকে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। আশ্চর্য একটা নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ, কবরেও বুঝি কখনো এরকম নীরবতা নামে না।

লুকাস হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে দিয়ে মাথার উপর গোলাকার ঢাকনাটি খুলে ফেলল। ঘুরে আমার দিকে তাকাল সে, তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে এল দ্রুত। সাবধানে আমাকে সোজা করিয়ে বসিয়ে গুলির আঘাতটি পরীক্ষা করে, তারপর শার্ট ছিড়ে ভাঁজ করে আমার ক্ষতস্থানে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার জন্যে। তার দিকে তাকাতেই সে।

কে জিজ্ঞেস করে, কে গুলি করেছে আপনাকে? আমি?

হ্যাঁ। কী মনে হয়, বেঁচে যাব এযাত্রা?

অন্য কেউ হলে সন্দেহ ছিল, কিন্তু আপনাকে মারবে কে? মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে আপনি রুকুন গ্রহপুঞ্জ ঘুরে এসেছেন—স্বয়ং বিধাতা আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, আমি কি আপনাকে মারতে পারি? নাকি ক্রুগো পারবে?

লুকাস ঝুঁকে পড়ে আমার হাত চেপে ধরে বলল, কিম জুরান, পৃথিবীর মানুষ আর পৃথিবীর সব রবোট্রন যুগ যুগ আপনার কথা মনে রাখবে—কেন জানেন? কারণ—

কারণটা আমার শোনা হল না, লুকাসের হাতে মাথা রেখে আমি জ্ঞান হারালাম।

———–

পরিশিষ্ট

পরবর্তী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ক্রুগো কম্পিউটারকে অচল করে দেবার পরপরই আবার নূতন করে সর্বোচ্চ কাউন্সিল তৈরি করা হয়েছে। আগের সর্বোচ্চ কাউন্সিলের দশ জনকেই নাকি ক্রুগো কম্পিউটার মেরে ফেলেছিল। শাসনতন্ত্রে সাহায্য করার জন্যে নূতন একটা কম্পিউটার তৈরি করা হচ্ছে, কে তৈরি করেছে সেটা গোপন, কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে আমি খবর পেয়েছি লুকাস নাকি সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের একজন। (আজকাল উচ্চ মহলে আমার অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব, অনেক গোপন খবর পাই আমি। রবোট্রনদের আবার মানুষের সাথে পাশাপাশি থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তবে এক শর্তে, তারা আর কখনো মানুষের চেহারা নিতে পারবে না, তাদেরকে যন্ত্রের মতো দেখাতে হবে। ভিকির সেটা নিয়ে খুব মন-খারাপ, কিন্তু রবোট্রনদের কারো আপত্তি নেই। প্রাণ বাচানোর জন্যে তারা এটা করেছিল, এখন এটা একটা বাড়তি সমস্যার মতো। যেমন সুয়ের কথা ধরা যাক, সে যে-কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় সেখানকার সব পুরুষ ছাত্র নাকি তার প্রেমে পড়ে গেছে, সে রবোট্রন জেনেও। একজন নাকি আবার সুয়ের জন্যে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল, পাগল আর কাকে বলে!

রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে আবার নাকি একটা মহাকাশযান পাঠানো হবে, আমার কাছ থেকে সবকিছু শুনে বিজ্ঞানীদের সাহস অনেক বেড়ে গেছে, কয়েকজন বিজ্ঞানী নাকি স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন যাবার জন্যে। তাঁরা কী—একটা যন্ত্র তৈরি করেছেন, সেখানে নাকি নিউট্রিনো ব্যবহার করে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জের সাথে যোগাযোগ করা হবে। মহাকাশযানটি ফিরে আসতে আসতে আরো প্রায় এক বছর, কী হয় দেখার জন্যে আমি খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করে আছি।

নীষা বাচ্চাদের একটা হাসপাতালে ডাক্তারের একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। তার সাথে জীবন, মৃত্যু, ভালবাসা, বেঁচে থাকার সার্থকতা ইত্যাদি বড় বড় জিনিস নিয়ে প্রায়ই আমার সুদীর্ঘ আলাপ হত, ইদানীং ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছি। তার নাকি বিয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমারও তাই। (আমাদের দু’জনের অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। তবে সারাদিন কাজকর্ম করে সন্ধ্যায় একা শূন্য বাসায় ফিরে আসতে নাকি তার খুব খারাপ লাগে। কথাটা মিথ্যে নয়, তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দু’জনেই বিয়ে করব ঠিক করেছি। একজন আরেকজনকে, সেটাই সুবিধে, দু’জনের জন্যেই।

বিয়ের অনুষ্ঠান হবে খুবই অনাড়ম্বর। খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন মানুষ আর রবোট্রন ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না। শহরতলির অ্যাপার্টমেন্টের সেই বুড়োকে বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। সাথে নীষা ছিল, বুড়ো তাকে চিমটি কেটে পরীক্ষা করে দেখল মানুষ কি না, এখনো তার রবোট্রনকে খুব ভয়। (তার চেক নাকি আবার আসতে শুরু করেছে।)

খুব বেশি যদি খুঁতখুঁতে না হই, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে বেঁচে থাকা ব্যাপারটা মোটামুটি খারাপ নয়।