১০. অজানার উজানে
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আবার আমরা নিচে নামতে লাগলাম। এবার পথ সাপের মতো একেবেঁকে এগিয়ে গেছে। পায়ের তলায় কুলকুল শব্দ করে বয়ে চলেছে জলের স্রোত।
হঠাৎ সামনে পড়লো প্রকাণ্ড বড়ো একটা গহ্বর। যেন পাতালের অন্ধকারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। গহ্বরের মধ্য দিয়ে রাস্তা একরকম সোজা নিচে নেমে গেছে দেখে কাকামণি আনলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
হান্স্ দড়ি বের করে আমাদের কোমরে বাংলো, যাতে কেউ যদি পড়েও যায়, তবে অন্য দুজনের সাহায্যে আত্মরক্ষা করতে পারবে। উনিশে জুলাই থেকে সাতাশে জুলাই পর্যন্ত একটানা নিচে চললাম আমরা। কিন্তু সেই প্রকাণ্ড গহ্বরের যেন আর শেষ নেই; অতল, নিতল যেন সে।
কাকামণি বললেন, এখন আমরা কোথায় আছি জানিস? অতলান্তিক মহাসাগরের নিচে।
অবাক হয়ে বললাম, কী বলছে কাকামণি? এখন আমাদের মাথার উপরে প্রখর ভয়ঙ্কর অতলান্তিক? অসম্ভব।
কে বললে অসম্ভব? সত্যিই আমরা এখন অতলান্তিকের নিচে। অবশ্য এতো নিচে, যে আমাদের কাছে এখন সবই সমান।
উনত্রিশে জুলাই সন্ধের সময় আমরা একটা বিশাল গুহার মধ্যে প্রবেশ করলাম। সেখানেই সে-রাতটা কাটানো গেলো। পরদিন ভোরে আবার যাত্রার প্রস্তুতি চললো। গ্রানাইট পাথরের মেঝের উপর দিয়ে তখনো সেই জলস্রোত বয়ে চলেছে।
কাকামণি হিশেব করতে করতে বললেন : আজ পর্যন্ত আমরা মোটে একশো পঞ্চান্ন মাইল পথ চলেছি। মাথার উপরে এখন অতলান্তিক গর্জাচ্ছে। হয়তো এখন সমুদ্রের উপরে চলছে ঝড়, ঝঙ্কা বজ্রপাত–উন্মাদ হয়ে নাচছে ঢেউ–হয়তো কোনো জাহাজ ড়ুবতে ড়ুবতে চলেছে–হয়তো–
কাকামণির হয়তো আর ফুরোবে না দেখে বাধা দিয়ে শুধোলাম, আচ্ছা কাকামণি, সবশুদ্ধ আমরা কতো নিচে এখন?
হিশেব করে কাকামণি বললেন, আটচল্লিশ মাইল। এতে নিচে নেমেছি, অথচ দ্যাখ, কোনো রকম কষ্ট হচ্ছে না আমাদের, শুধু কানের মধ্যে সামান্য যা। তাও ক্রমশ সহ্য হয়ে যাবে।
ক্রমশই আমরা নিচে নেমে চলেছি। পথ কোথাও ঢালু, কোথাও একেবারে সোজা নেমে গেছে পাতালের দিকে অন্য পৃথিবীর সন্ধানে। একত্রিশে জুলাই অবধি ক্রমাগত নেমেই চললাম, কিন্তু পথের আর শেষ নেই যেন। শুধু অজ্ঞাত পথে এগিয়ে চলা।
এ কদিন আমাদের কোনো বিপদ ঘটেনি। শুধু সাতই আগস্ট আমি ভয়ানক এক বিপদে পড়লাম। আমি চলছিলাম সকলের আগে। পিছনে কাকামণি আর হানস। কাকামণির হাতে একটা আলো, আমার হাতেও একটা। পথের দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি, হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি, আমি একলা। কাকামণি আর হাসকে চারপাশে কত খুঁজলাম, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া গেল না। অগত্যা যে-পথ ধরে এসেছিলাম সে-পথে ফিরে চললাম। অনেকক্ষণ ঘুরেও কাকামণি বা হাসের সাক্ষাৎ পেলাম না। ওদের সাক্ষাৎ না পাওয়ার মানে সহজেই বুঝতে পারলাম। ভয়ে ছমছম করে উঠলো শরীর। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর সম্বিত ফিরতেই খুব জোরে চেঁচিয়ে কাকামণিকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু কর্কশ প্রতিধ্বনির অট্টহাসি ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলাম না।
এই পাতালে তো একটিই পথ-তবে আমি পথ হারালাম কী করে? হঠাৎ মনে পড়লো সেই জলধারার কথা। সেই জলরেখা ধরে হাঁটলেই তো আবার সেই গুহার কাছে পৌঁছনো যাবে।
হেঁট হয়ে জলে হাত-মুখ ধুতে যাচ্ছি, তখনই সমস্ত আশাভরসার শোচনীয় বিনাশ ঘটলো। কী সাংঘাতিক! পথের উপর জলের চিহ্নমাত্র নেই-শুকনো গ্রানাইট পাথর শুকনো পাত বের করে আমাকে যেন ব্যঙ্গ করতে লাগলো।
মাথায় যেন সারা পৃথিবী ভেঙে পড়লো। ভাববার শক্তি পর্যন্ত রইলো না। একেই হয়তো পুথি-পত্রে জীবন্ত সমাধি বলে! রহীন নীরবতা যেন শব্দহীন অট্টহাসিতে আমাকে টিটকিরি করতে লাগলো! ঝিমঝিম করতে লাগলো সমস্ত চৈতন্য।
কখন যে অন্যমনস্কভাবে চলতে-চলতে ভুল পথে এসে পড়েছি, তা বুঝতেও পারিনি। এখন কী করে কাকামণির সন্ধান পাওয়া যায়? তবে কি পাতালের এই অন্ধকার পথে জীবন্ত সমাধি হবে আমার মনে পড়লো পৃথিবীর আলো হাওয়ার কথা, শ্যামল স্নিগ্ধতার কথা, গ্রোবেনের কথা। বেদনায় গলার কাছটা টন-টন করে উঠলো।
সমস্ত ব্যাপারটাকে তলিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। আমার সঙ্গে দিন-তিনেক কাটানোর উপযোগী খাবার আছে, আর আছে এক বোতল জল। সেই ভরসায় ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠলাম-যদি আবার জলস্রোতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়–অন্ততপক্ষে যদি কোনো রকমে স্নেফেলের উপরেও উঠতে পারি।
আধ ঘণ্টা ধরে এগিয়ে চললাম। পথের চেহারা, দেয়ালের রঙ, পার্থরের কুচি দেখে পথ চেনবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। তবু দ্রুতপায়েই এগোলাম। চলা-চলতে হঠাৎ এক জায়গায় কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগলো, হাত বাড়িয়ে দেখতে পেলাম আমার সামনে নিরেট পাথরের দেয়াল। বোধহয় আমাকে এই অবস্থাতে ব্যঙ্গ করার অঙ্কই তার সৃষ্টি!
সর্বনাশ! এগোবা কী করে তবে? এবার আর কোনো আশা নেই, ভরসা নেই, শুধু অসহায়ভাবে মৃত্যুর প্রতীক্ষ্ণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। দুঃসহ নিরাশায় পাগলের মতো মেঝেয় মুখ ঘষতে লাগলাম। চেঁচিয়ে শেষবারের মতো কাকামণিকে ডাকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না।
এদিকে আস্তে-আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগলো আলো। আর সামান্য কিছুক্ষণ তার আয়ু। শূন্য চোখে ক্রমক্ষীয়মান আলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম, আলো ক্রমেই নিভে আসছে। চারপাশে কারা যেন ছায়ার মতো নাচছে। অন্ধকারের চাপ ঘন হচ্ছে ক্রমশ। যেন পিষে মারবে আমাকে। তারপর এক সময়ে দপ করে নিভে গেলো। এবার অন্ধকার।
অন্ধকার, অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। চারদিকে গভীর, সুতীক্ষ্ণ, অন্তহীন অন্ধকার–সে অন্ধকার যেন স্পর্শ করা যায়, জড়ানো যায় হাতে। ভয়ে শিরশির করে উঠলে গা। মরি যদি, আলোয় মরি যেন। আলো, আলো, একটু আলো–
তারপর আমার জ্ঞান হারিয়ে গেলো।
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম, সঠিক বলতে পারি না। জ্ঞান ফিরতেই উঠে দাঁড়ালাম-তারপর পাগলের মতো সেই অন্ধকারেই ছুটতে লাগলাম। কতোবার আছাড় খেয়ে পড়লাম, কতবার যে মাথা ঠুকে গেলো দেয়ালে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। রক্তে ভরে গেলো চোখ-মুখ। তবু ছুটতে লাগলাম উন্মাদের মতো। তারপর হঠাৎ সজোরে দেয়ালে মাথা ঠুকে গেলো। আবার আমার জ্ঞান হারিয়ে গেলো।
জ্ঞান ফিরতেই শুনতে পেলাম, দূরে-বহুদূরে, বজ্রগর্জনের মতো একটা শব্দ। কিসের শব্দ বুঝতে পারলাম না। উৎকর্ণ হয়ে সেই শব্দ শুনবার চেষ্টা করলাম। মিনিট-কয়েক পরে সেই আশ্চর্য শব্দ থেমে গেলো। বুঝতে পারলাম, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, তাই ঐ শব্দের সৃষ্টি হয়েছিলো আমার মগজের স্নায়ু উপশিরায়।
না ঐ তো আবার আবারো শব্দ শোনা যাচ্ছে। এবারে অন্যরকম শব্দ। কারা যেন কথা বলছে। কারা? কারা কথা বলছে দেয়ালের ওপাশে? মরিয়া হয়ে প্রাণপণ শক্তিতে চেঁচিয়ে উঠলাম : বাঁচাও, বাঁচাও।
প্রথমটা কোনো উত্তর পেলাম না। অনেকক্ষণ পরে আবার যেন কাদের কথা কানে ভেসে এলো। তার পরমুহূর্তেই একটা ভীষণ শব্দে চারদিক ছেয়ে গেলো। যতোবারই কথা শুনছি, তার পরক্ষণেই বজ্রের মতো শব্দ উঠছে আমার চারপাশে।
কে যেন আমার নাম ধরে ডাকলো, অ্যাকজেল! অ্যাকজেল।
এবারে বুঝতে পারলাম। তারের মধ্য দিয়ে যেমন করে বিদ্যুতের প্রবাহ বয়, তেমনই এই দেয়ালের ভিতর দিয়ে শব্দ আসছে। আমার কথা ওদের শোনাতে হলে এই দেয়ালে মুখ লাগিয়ে বলতে হবে। দেয়ালে মুখ রেখে ডাকলাম, কাকামণি।
উৎকর্ণ হয়ে রইলাম উত্তরের জন্য। এক-এক পলক যেন এক-একটি যুগ। অবশেষে আমার কানে এলো কাকামণির গলা : আকজেল, এ কি তোর গলার শব্দ? তুই এখন কোথায়?
হ্যাঁ কাকামণি, আমি অ্যাকজেল। পথ হারিয়ে ফেলেছি। আলোটাও নিভে গেছে।
সেই জলের রেখাটাই বা কী হলো?
জলস্রোতটাও হারিয়ে ফেলেছি।
হুঁ। কাকামণির কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। যাক, কোনো ভয় নেই। গ্যালারির রাস্তা ধরে তোকে কতো খুঁজেছি, তোর নাম ধরে কতো ডেকেছি, বন্দুকের শব্দ পর্যন্ত করেছি।-অ্যাকজেল, আরেকটু সাহস করে থাক। পরস্পরের গলা শোনা যাচ্ছে, অথচ কেউ কারো কাছে যেতে পারছি নে; কী করা যায়, ভেবে নি,–একটু অপেক্ষা করে থাক।
কাকামণি, আমাদের মধ্যে দূরত্ব কততটা বলতে পারো?
তোর কাছে ফসফরাস-দেয়া নোমিটারটা আছে তো? কাকামণি বললেন; এক কাজ কর। তুই বড়ি ধরে আমার নাম উচ্চারণ কর, আমিও খড়ি ধরে শুনছি, তারপর খেয়াল রাখ ঠিক কতো সময়ে আমার কথা শুনতে পাস। হ্যাঁ এবার ডাকতে পারিস।
আমি দেয়ালে মুখ রেখে কাকামণিকে ডাকলাম। একটু পরেই শুনতে পেলাম আমার নাম।
কাকাশি শুধোলেন, কতো সময় লাগলো?
চল্লিশ সেকেণ্ড।
তাহলে শব্দ আসতে ঠিক বিশ সেকেণ্ড লেগেছে। বললেন কাকামণি। শব্দ সেকেণ্ডে এগারোশো বিশ ফুট চলে। তার মানে, বিশ সেকেণ্ডে বাইশ হাজার চারশো ফুট। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে ব্যবধান হলো প্রায় শোয়া চার মাইল।
অবাক হয়ে বললাম, শোয়া চার মাইল।
হ্যাঁ। তুই এক কাজ কর। নিচের দিকে নেমে আয়, তাহলে শিগগিরই দেখতে পাবি আমাদের। তাড়াতাড়ি কর।
সঙ্গে-সঙ্গে রওনা হয়ে পড়লাম। পা চলতে চাইছিলো না, শ্রান্তিতে নুয়ে পড়তে চাইছিলো শরীর, তবু সেই ঢালু পথ ধরে এগিয়ে চললাম। পথ এমনভাবে গড়ানো যে কোনো-কোনো জায়গায় আমাকে হাঁটতে হলো না-কে যেন আমাকে ঠেলে নামতে লাগলো। মনে হলো যেন একটা কুয়োর মধ্যে দিয়ে নামছি। গতি ক্রমশ তীব্র হতে লাগলো। চেষ্টা করেও তাকে একটু ধীর করতে পারলাম না। তারপর অনেক নিচে একটা পাথরের উপর আছাড় খেয়ে পড়লাম। চোখের সামনে নেমে এলো একঝাক ঘন অন্ধকার, তারপরে কী হলো, তা আমার মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম একটা কম্বলের উপরে শুয়ে আছি-কাকামণি আমার উপরে ঝুকে পড়ে হাতের নাড়ি দেখছেন। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে শিশুর মত উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন উনি। ক্ষীণভাবে হাসবার চেষ্টা করে শুধোলাম, আমরা এখন কোথায় আছি?
এখন আর একটাও কথা না, কথা কাল হবে। এখন ঘুমো।
সত্যি বলতে কি, আমি তখন ভীষণ দুর্বল। তাই পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজোলাম দ্বিরুক্তি না-করে।
ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙল। চারদিক খচ্ছ আলোয় উল। দূরে, অনেক দূরে, কিসের যেন শব্দ হচ্ছিল–ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট, মৃদু অথচ উদাত্ত সেই শব্দ যেন দূরে বেলাভূমির উপরে সমুদ্রতরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে। প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। স্বপ্ন, না সত্যি?–
না, স্বপ্ন তো নয়—স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি তরঙ্গের শষ। তবে কি—
কাকামণি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস এখন?
ভালো। কিন্তু ও কীসের শব্দ? আর এতো উজ্জ্বল আলোই বা কিসের?
আস্তে-আস্তে সব বুঝতে পারবি, শুধু আজকের দিনটা ধৈর্য ধরে থাক। এখন খোলা হাওয়া লাগলে তোর অসুখ করতে পারে।
চমকে উঠলাম। খোলা হাওয়া? কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। হাওয়া এখন প্রবল, এমন অবস্থায় তোর চলাফেরা করা ঠিক হবে না। আজকের দিনটা জিরিয়ে নে। নইলে কাল সমুদ্রযাত্রায় আবার তোর অসুখ করবে।
আমি আরো হতভম্ব হয়ে পড়লাম। সম্বিত ফিরতেই উঠে দাঁড়ালাম। গায়ে রাগ্টা জড়িয়ে এগোলাম কাকামণির সঙ্গে।
অল্পক্ষণ পরেই চোখ-ধাঁধাঁনো দিগন্ত-বিসারী উজ্জ্বল আলো পিছলে পড়লো আমার উপরে। সহ্য হলো না সেই আলো, অনভ্যস্ত চোখ সহজেই বুজে এলো। একটু পরে চোখ খুলে যা দেখলাম তাতে বিস্ময়ে অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠতে হলো, সমুদ্র।
হ্যাঁ, সমুদ্র। বললেন কাকামণি! এই সমুদ্রের নাম আমার নামেই দিয়েছি, লিডেনব্রক সাগর।
নীলাঞ্জিত সমুদ্রের ঢেউ উচ্ছ্বসিত হয়ে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমির সোনালি বালিতে, আর সেই সোনালি বালিতে চিকচিক করছে ঢেউ-এর রুপোলি ফেনী। দেখতে একেবারে সমুদ্রের মতো। কিন্তু এ অন্য পৃথিবীর সমুদ্র, পাতালের। তাই যেন একটু নিষ্প্রাণ। চারদিকে যে উজ্জ্বল আলো, তা সূর্যালোক বা চন্দ্রালোক কিছুই নয়, অরোরা বোরিয়ালিসের মতো এও এক ধরনের বৈদ্যুতিক আলো।
নিঃসীম শূন্যে তখন অসম্ভব মেঘ করেছে। যে-কোনো মুহূর্তে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে পারে। বিস্ফারিত চোখে এই অলৌকিক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। মনে হলো পৃথিবী ছেড়ে যেন অন্য কোনো গ্রহে এসে পড়েছি। পাথরের অন্ধকার গহ্বরে সাতচল্লিশ দিন কাটানোর পর এমন উন্মুক্ত বাতাস আর নীলাঞ্জিত সমুদ্র আমাকে আশ্বাস দিলো, শক্তি দিলো, স্বাস্থ্য দিলো।
উপকূল ধরে হাঁটতে লাগলাম কাকামণির সঙ্গে। উপকূল অসম্ভব আঁকাবাকা। শুধু পাথর, আর পাথর। কোনোখানে-বা পাহাড়ের ফাটলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্নাধারা, কোথাও বা উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে উঠছে গরম তাপ।
একটু দূরে গভীর জঙ্গল দেখা গেলো। সেই জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই কেমন যেন শীত করতে লাগলো, পায়ের তলার মাটি ভিজে। আধ ঘণ্টা পর সেই জঙ্গল পেরিয়ে আবার সমুদ্র-কূলে এসে পৌঁছলাম। সামনে দেখতে পেলাম আর-একটি জঙ্গল। এই জঙ্গলের গাছপালা খুব বড়ো-বড়ো, প্রত্যেকটি একশো থেকে দেড়শো ফুট উঁচু। মাটিতে নানা জন্তুর শ্বেতবর্ণ কঙ্কাল। অনেকক্ষণ পর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম। কাকামণি আমাকে তাঁবুর দিকে নিয়ে চললেন। এইটুকু হাঁটতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই তাঁবুতে পৌঁছেই শুয়ে পড়লাম আমি।
পরদিন সকালবেলায় ঠিক করলাম, অনেক দিন স্নান করিনি, আজ এমন সুন্দর সমুদ্রে স্নান করতেই হবে। স্ফটিক-স্বচ্ছ উজ্জল জলে স্নান করে উঠবার পর সারা শরীরে স্বাস্থ্যের আবির্ভাব অনুভব করলাম। খিদেও লাগলো বেশ। তাড়াতাড়ি আহার সেরে নিলাম।
অল্পক্ষণ পরে কাকামণি জানালেন, এবারে সমুদ্রে জোয়ার আসবে।
পাতালের সমুদ্রেও জোয়ার-ভাটা হয়? আশ্চর্য!
আশ্চর্য কিছুই না, স্বাভাবিক। পৃথিবীর সব কিছুই তো অভিকর্ষের অধীন।
আচ্ছা কাকামণি, এখন আমরা কোন্ জায়গায় আছি?
আইসল্যাণ্ড থেকে প্রায় সাড়ে চারশো মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। আর পৃথিবীর উপর থেকে কতোটা নিচে নেমেছি জানিস? প্রায় একশো দশ মাইল। এখন আমাদের মাথার উপরে হয় স্কটল্যাণ্ড, নয়তো ইংল্যাণ্ড।-হ্যাঁ, এবারে এই সমুদ্র পেরোবার ব্যবস্থা করতে হবে।
সমুদ্র পার হবে? অবাক হলাম আমি। কী করে? জাহাজ কই?
জাহাজ বা নৌকা করে পেরোবার কথা তো বলিনি। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে ভেলা বানিয়ে নেবো।
আবার এখন গাছ কাটতে হবে?
কাটা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। চল, দেখে আসবি।
কাকামণির সঙ্গে মাইলখানেক দূরে গিয়ে দেখি, হান্স্ কাঠের টুকরো ও গুঁড়ি দিয়ে বেশ মজবুত করে একটা ভেলা তৈরি করছে।
পরদিন সন্ধের সময় ভেলা তৈরি হলো। লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় পাঁচ। তিনজনে ঠেলে ভেলাটিকে জলে নামালাম। জলের উপর বেশ সুন্দর দেখালো আমাদের জল-পোতকে। তখন অন্ধকার গাঢ় হয়েছে বলে ভেলাটিকে দড়ি দিয়ে একটা পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো। কাল ভোরে এই ভেলায় চড়েই আমরা পাড়ি দেবো অথই সমুদ্রে।