১০৯তম অধ্যায়
ধর্ম্মপথে প্রতিষ্ঠা সত্য-মিথ্যার প্রশস্ততা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মনুষ্য ধর্ম্মপথে অবস্থান করিতে বাসনা করিলে কিরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে? সত্য ও মিথ্যা সমুদয় জগৎ সমাবৃত করিয়া রহিয়াছে; ধর্ম্মার্থী ব্যক্তির ঐ উভয়ের মধ্যে কি আশ্রয় করা উচিত? সত্য কি? মিথ্যা কি? সনাতন ধর্ম্ম কাহাকে কহে এবং কোন্ সময়ে সত্য আর কোন্ সময়েই বা মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিতে হয়, তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! সত্যবাক্য-প্রয়োগ সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সত্যের তুল্য উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। এক্ষণে আমি সমুদয় লোকের দুর্জ্ঞেয় বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যে স্থানে সত্য মিথ্যারূপে ও মিথ্যা সত্যরূপে পরিণত হয়, সেই স্থানে সত্য কথা না কহিয়া মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য। যিনি এইরূপে সত্য মিথ্যা বিচারে সমর্থ হয়েন, তিনিই জনসমাজে ধাৰ্মিক বলিয়া পরগণিত হইয়া থাকেন। অসচ্চরিত্র হিংস্রস্বভাব ব্যক্তিও অন্ধনাসা বলাক ব্যাধের [হিংস্রস্বভাব ব্যাঘ্রাদি পশু রাত্রিকালে অন্ধ; তাহারা ঘ্রাণচক্ষু নাসিকাদ্বারা ঘ্রাণ লইয়া দেখার কাৰ্য্য করে। সেই ব্যাঘ্রাদি পদনাশক ব্যাধেরও পুণ্য অর্জ্জন হওয়ায় স্বর্গলাভ হয়।] ন্যায় স্বর্গলাভ করিয়া থাকে। মূঢ়, ব্যক্তি ধৰ্ম্মকাম হইয়াও ধার্ম্মিক হইতে পারে না, কিন্তু গঙ্গাতীরস্থ উলূক ধৰ্ম্মকাম না হইয়াও অসংখ্য সৰ্পনাশনিবন্ধন, বিপুল পুণ্যলাভ করিয়াছিল। যথার্থ ধৰ্ম্ম স্থির করা অতি দুঃসাধ্য। প্রাণীগণের অভ্যুদয়, ক্লেশনিবারণ ও পরিত্রাণের নিমিত্তই ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে; অতএব যাহাদ্বারা প্রজাগণ অভ্যুদয়শালী, ক্লেশবিহীন ও পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয়, তাহাই যথার্থ ধৰ্ম্ম।
“কেহ কেহ শ্রুতিনিৰ্দিষ্ট কার্য্যমাত্রকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন এবং কেহ কেহ তাহা স্বীকার করেন না। যাঁহারা শ্রুতিনিৰ্দিষ্ট সমুদয় কাৰ্য্যকে ধৰ্ম্ম বলিয়া স্বীকার না করেন, আমরা তাঁহাদিগের নিন্দা করি না; কারণ, শ্রুতিনিৰ্দিষ্ট সমুদয় কাৰ্য্যই কখনও ধৰ্ম্মরূপে পরিণত হইতে পারে না। দস্যুগণ পরধন অপহরণ করিবার মানসে তাহার অনুসন্ধান জিজ্ঞাসা করিলে তাহাদিগের নিকট তাহা প্রকাশ না করাই প্রধান ধর্ম্ম। ঐরূপ স্থলে যদি মৌনাবলম্বন করিলে পরধনরক্ষা হয়, তবে তাহাই করিবে। আর যদি মৌনাবলম্বন করিলে দস্যুগণ সন্দেহ করে, তবে মিথ্যা কথা কহিবে; তাহাতে কিছুমাত্র পাপ জন্মিবার সম্ভাবনা নাই। অধিক কি, ঐরূপ স্থলে শপথপূৰ্ব্বক মিথ্যাবাক্যপ্রয়োগ করাও দোষাবহ নহে। সঙ্গতি থাকিলেও তস্করদিগকে ধনদান করা কর্ত্তব্য নহে। ঐ পাপাত্মাদিগকে দান করিলে দাতাকে নিশ্চয় বিপদে নিপতিত হইতে হয়। উত্তমর্ণ [মহাজন—যিনি সুদে টাকা ধার দেন] যদি ধনদানে অসমর্থ অধমর্ণকে [খাতককে] শারীরিক পরিশ্রমদ্বারা ঋণ হইতে মুক্ত করিবার বাসনা করিয়া ধর্ম্মাধিকরণে, সাক্ষীদিগকে আহ্বানপূর্ব্বক সত্যকথা কহিতে অনুরোধ করেন, তাহা হইলে সাক্ষিগণের সত্যবাক্যপ্রয়োগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য; ঐরূপ স্থলে মিথ্যাকথা কহিলে মিথ্যাবাদী হইতে হয়, কিন্তু বিবাহ ও প্রাণসংশয়কালে মিথ্যাবাক্যপ্রয়োগ করা দোষাবহ হয় না। অন্যের অর্থের রক্ষা, ধর্ম্মবৃদ্ধি ও সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত মিথ্যাবাক্যপ্রয়োগ করা অকৰ্ত্তব্য নহে।
“অঙ্গীকার করিলে তাহা প্রতিপালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য; যে ব্যক্তি ধর্ম্মানুগত নিয়মের বিপরীতাচরণ করে, তাহাকে বিধানানুসারে রাজদণ্ডদ্বারা দণ্ডিত করা উচিত। শঠ ব্যক্তিরা স্বধৰ্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া আসুরধৰ্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবনধারণ করিয়া থাকে; অতএব যে-কোন উপায়দ্বারা হউক না কেন, উহাদের দণ্ডবিধান অবশ্য কর্ত্তব্য। ঐ পাপাত্মারা ধনকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া গণনা করে। উহারা প্রেততুল্য, অপাংক্তেয় [শুদ্ধস্বভাব ব্যক্তির সহিত এক পংক্তিতে বসিয়া আহার করার অযোগ্য], যাগযজ্ঞশূন্য, তপঃপরাঙ্মুখ এবং দেবতা ও মনুষ্যের প্রতিকুলাচারী; অতএব উহাদিগের সহিত কিছুমাত্র সংস্রব রাখা উচিত নহে। উহারা ধননাশ হইলে প্রাণ [তাহার শোকে প্রাণ] পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া থাকে। উহাদিগকে প্রযত্নসহকারে ধৰ্ম্মোপদেশ প্রদান করা কর্ত্তব্য। উহাদিগের মধ্যে কাহারই ধৰ্ম্মজ্ঞান নাই। উহাদিগকে বিনাশ করিলে জীবহত্যা জনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না। কারণ, উহারা স্ব স্ব ধর্ম্মপ্রভাবেই নিহত হইয়া থাকে, সুতরাং তাহাদিগকে যে বধ করে, তাহার প্রাণীবধজনিত পাপ জন্মিবার সম্ভাবনা কি? যাহা হউক, উহাদিগকে বিনাশ করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হওয়া অকৰ্ত্তব্য নহে। শঠ ব্যক্তিরা কাক ও গৃধ্রের তুল্য; উহারা দেহত্যাগের পর কাকাদি যোনি প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যে যেরূপ ব্যবহার করিবে, তাহার সহিত সেইরূপ ব্যবহার করাই কৰ্ত্তব্য। যে ব্যক্তি মায়াবী, তাহার সহিত শঠতাচরণ এবং যে ব্যক্তি সাধু, তাহার সহিত সরল ব্যবহার করাই যুক্তিসিদ্ধ।”