অগস্ত্য বলেন, সত্য কহিলেন ব্যাস।
আমি যাহা জানি শুন কহি সে আভাষ।।
পূর্ব্বে এককালে যজ্ঞ করেন শমন।
অহিংসাতে কোন প্রাণী না হয় মরণ।।
মনুষ্যে পূরিল ক্ষিতি, দেবে ভয় হৈল।
সবে আসি ব্রহ্মারে সকলি নিবেদিল।।
শুনি ব্রক্ষা চলিলেন সহ দেবগণ।
নৈমিষ-কাননে যজ্ঞ করেন শমন।।
ব্রহ্মারে দেখিয়া যম উঠি সম্ভাষেন।
কি কর্ম্ম করহ বলি ধাতা জিজ্ঞাসেন।।
সৃষ্টির উপরে আছে তব অধিকার।
পাপপূন্য বুঝি দণ্ড দিবা সবাকার।।
তাহা ছাড়ি তুমি আসি যজ্ঞে দিলা মন।
মম বাক্য লঙ্ঘিতেছ, ইহা বা কেমন।।
শুনিয়া কহেন যম করি যোড়পাণি।
মম শক্তি এ কর্ম্ম নহিল পদ্মযোনি।।
সব দেবগণ মধ্যে আমি হৈনু চোর।
ত্রিভুবন উপরে বিষয় দিলা মোর।।
ত্রৈলোক্যের রাজা হৈয়া দেব পুরন্দর।
তিনি যজ্ঞ করিতে পায়েন অবসর।।
কুবের বরুণ যজ্ঞ ইচ্ছা কৈলে করে।
মুহূর্ত্তেক অবকাশ নাহিক আমারে।।
না পারিনু এ কর্ম্ম করিতে দেবরাজ।
অন্য কোন জনেরে সমর্প এই কাজ।।
না পারিনু পাপ পুণ্য কর্ম্মের নির্ণয়।
কার কতকাল আয়ু, নির্ণয় না হয়।।
যমের বচনে সচিন্তিত প্রজাপতি।
দেহ হৈতে কৈল এক মূর্ত্তির উৎপত্তি।।
লেখনী দক্ষিণ করে, তালপত্র বামে।
জাতিতে কায়স্থ হৈল চিত্রগুপ্ত নামে।।
যমেরে বলেন, তুমি রাখ সাথে এরে।
যখন যা জিজ্ঞাসিবা, কহিবে তোমারে।।
যাহার যে কর্ম্ম তুমি জানিতে পারিবা।
ব্যাধিরূপ হৈয়া সবে বিনাশ করিবা।।
আপনার কর্ম্মভোগ ভুঞ্জিবে সংসার।
তথাপিহ তোমার উপরে অধিকার।।
ব্রহ্মার বচনে যম প্রবোধ পাইয়া।
সঞ্জীবনী পুরী যান যজ্ঞ সমাপিয়া।।
যমে প্রবোধিয়া সবে যথাস্থানে চলে।
যাইতে কনক-পদ্ম দেখে গঙ্গাজলে।।
সহস্র সহস্র পুষ্প ভাসি যায় স্রোতে।
দেখিয়া বিস্ময় হৈল সবাকার চিতে।।
অম্লান কনকপুষ্প গন্ধে মন মোহে।
তদন্ত জানিতে ইন্দ্র ধর্ম্মরাজে কহে।।
ইন্দ্রের আজ্ঞায় ধর্ম্ম গেল শীঘ্রগতি।
বহুক্ষণ নাহি দেখি চিন্তে সুরপতি।।
তাহার পশ্চাতে পাঠাইল দুইজন।
চলি গেল শীঘ্রগতি অশ্বিনী-নন্দন।।
হইল অনেকক্ষণ নাহি বাহুড়িল।
ইন্দ্র সুরপতি তথা আপনি চলিল।।
তদন্ত জানিতে তবে গেল সুরপতি।
হিমালয়ে গঙ্গাকূলে কান্দিছে যুবতী।।
কনক-কমল তবে গেল সুরপতি।
হিমালয়ে গঙ্গাকূলে কান্দিছে যুবতী।।
কনক কমল হয়, তার অশ্রুজলে।
খরস্রোতে ভাসি যায় মন্দাকিনী-জলে।।
কন্যারে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল দেবরাজ।
কে তুমি, কি হেতু কান্দ, কহ নিজ কাজ।।
নয়ন কুরঙ্গ বিম্ব জিনিয়া অধর।
কমল-সম তব অঙ্গ যে মনোহর।।
মুখ হব নিন্দে ইন্দু, মধ্য মৃগনাথ।
চারু ভুরু যুগ্ম ঊরু নিন্দে হস্তিহাত।।
কি কারণে আপনি কান্দহ একাকিনী।
আমারে বরহ যদি আছ বিরহিণী।।
কন্যা বলে, আমি হই দক্ষের নন্দিনী।
ছাড়িয়া সংসার-সুখ জন্ম-তপস্বিনী।।
মোরে হেন কহিতে তোমারে না যুয়ায়।
পাপ-চক্ষে চাহিলে অনেক কষ্ট পায়।।
এই মতে আমারে কহিল চারিজন।
তা সবার কষ্ট যত না যায় কথন।।
ইন্দ্র বলে, কহ তাঁরা আছয়ে কোথায়।
কন্যা বলে, যদি ইচ্ছা আইস তথায়।।
কন্যার সহিত গেল দেব পুরন্দর।
পর্ব্বত-উপরে দেখে পুরুষ সুন্দর।।
কেতকী বলিল, দেব আমি তপস্বিনী।
এ পুরুষ আমারে বলে উপহাস-বাণী।।
শিব বলিলেন, মূঢ় না দেখ নয়নে।
প্রতিফল ইহার পাইবা মম স্থানে।।
এই গিরিবর তুমি তোল পুরন্দর।
হরের আজ্ঞায় ইন্দ্র তোলে গিরিবর।।
পর্ব্বতের গহ্বরে হরের কারাগার।
চরণে নিগড় বন্দী আছয়ে সবার।।
ধর্ম্ম বায়ু অশ্বিনীদ্বয় আছে চারিজন।
দেখিয়া হইল ভীত সহস্র-লোচন।।
করযোড়ে বিস্তর করিল স্তব হরে।
তুষ্ট হইয়া সদানন্দ বলেন তাঁহারে।।
লক্ষ্মী-অংশ কেতকী আজ্ন্ম তপাচারী।
তার অপরাধ আমি ক্ষমিতে না পারি।।
তব স্তব-বাক্যে মোর হইল সন্তোষ।
তোমা হেতু ক্ষমিলাম এ চারির দোষ।।
বিষ্ণুর সদনে লৈয়া যাব তোমা সব।
তাঁর আজ্ঞামত কর্ম্ম করিবা বাসব।।
এত বলি সবে লৈয়া যান ত্রিলোচন।
শ্বেতদ্বীপে যথায় আছেন নারায়ণ।।
কহিলেন সকল কেতকী-বিবরণ।
শুনি করিলেন আজ্ঞা শ্রীমধুসূদন।।
ইন্দ্রত্ব পাইয়ে তোর নাহি খণ্ডে লোভ।
মর্ত্ত্যে জন্ম লইয়া ভুঞ্জিতে আছে ক্ষোভ।।
কর্ম্মফল অবশ্য ভুঞ্জয়ে যাহা করি।
হইবে তোমার ভার্য্যা কেতকী সুন্দরী।।
পঞ্চজন জন্ম সবে লভ নরযোনি।
কেতকী হইবে তোমা পঞ্চের ভামিনী।।
তোমা সবা প্রীতিহেতু আমিই জন্মিব।
দ্বাপরে ক্ষত্রিয়-দর্প নিঃশেষ করিব।।
এত বলি দুই কেশ দিলেন কেশব।
মহেশ সহিত তবে চলিলা বাসব।।
কেশবের কেশ লৈয়া আসিলা মহেশ।
শুক্ল কৃষ্ণ দুই হৈলা রাম হৃষীকেশ।।
শুনহ দ্রুপদ এই পূর্ব্বের কাহিনী।
সেই দেবী কেতকী হইলা যাজ্ঞসেনী।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে সাধুজন।।