১০৯তম অধ্যায়
ঘটোৎকচ-অলম্বুষ যুদ্ধ
হে মহারাজ! এইরূপে অলক্ষুষ ভীমের নিকট হইতে পলায়ন পূর্ব্বক সংগ্রাম স্থলে অশঙ্কিত চিত্তে বিচরণ করিতে লাগিল। তখন হিড়িম্বা নন্দন ঘটোৎকচ মহাবেগে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে নিশিত শরে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিল। অলম্বুষও কোপাবিষ্ট হইয়া ঘটোৎকচকে তাড়িত করিতে লাগিল । এইরূপে সেই রাক্ষস দ্বয় পরস্পর মিলিত হইয়া বিবিধ মায়া ধারণ পূর্ব্বক সুরেন্দ্র ও শম্বরের ন্যায় ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিল। পূর্ব্বকালে রাম ও রাবণের যেরূপ ভীষণ সংগ্রাম হইয়াছিল, এক্ষণে সেই ভীষণ রাক্ষসদ্বয়ের তদ্রূপ তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। মহাবীর ঘটোৎকচ বিংশতি নারাচাস্ত্রে অলম্বুষের বক্ষস্থল বিদ্ধ করিয়া সিংহের ন্যায় মুহুর্মুহুঃ গভীর নিনাদ করিতে লাগিল। অলম্বুষও যুদ্ধদুৰ্ম্মদ হিড়িম্বানন্দনকে পুনঃ পুনঃ বাণ বিদ্ধ করিয়া বীরনাদে গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। সেই মায়া যুদ্ধবিশারদ মহাবল পরাক্রান্ত নিশাচরদ্বয় রোষিত হইয়া শত শত মায়া বিস্তার পূর্ব্বক পরস্পরকে মোহিত করিয়া মায়া যুদ্ধ আরম্ভ করিল। ঘটোৎকচ যে যে মায়া প্রকাশ করিল, অলম্বুষের মায়া প্রভাবে তৎসমুদায় তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হইয়া গেল। তখন ভীমসেন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ মায়া যুদ্ধ কুশল অলম্বুষের প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া রথারোহণ পূর্ব্বক চতুর্দ্দিক হইতে তাহার সম্মুখে আগমন করিলেন এবং অসংখ্য রথ দ্বারা তাহাকে অবরোধ করিয়া তাহার উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। নিশাচর বীরগণের শরাহত হইয়া উল্কাহত মাতঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল এবং অচিরাৎ অস্ত্র মায়া প্রভাবে বিপক্ষ নিক্ষিপ্ত অস্ত্র সকল নিবারণ করিয়া দগ্ধ বন হইতে নির্গত দন্তীর ন্যায় চতুর্দ্দিকস্থ রথসমূহের মধ্য হইতে বিনির্গত হইল এবং দেবরাজের অশনি সদৃশ শব্দায়মান ভীষণ শরাসন বিস্ফারণ করত ভীমসেনকে পঞ্চবিংশতি, যুধিষ্ঠিরকে তিন, সহদেবকে সাত, নকুলকে ত্ৰিসপ্ততি, প্রত্যেক দ্রৌপদেয়কে পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া ঘোরতর গভীর সিংহনাদ করিতে লাগিল। তখন ভীমসেন নয়, সহদেব পাঁচ, যুধিষ্ঠির শত, নকুল চতুঃষষ্টি ও দ্রৌপদেয়েরা প্রত্যেকে তিন তিন বাণে অলম্বুষকে বিদ্ধ করিলেন। বলবান ঘটোৎকচও ঐ সময় তাহাকে প্রথমত পঞ্চাশত শরে আহত করিয়া পুনরায় সপ্ততি শরে নিপীড়িত করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিল। মহাবীর হিড়িম্বা তনয়ের ভীষণ নাদে গিরি, কানন ও জলাশয়াদি সম্বলিত সমুদায় বসুন্ধরা এককালে কম্পিত হইল।
ঘটোৎকচ কর্ত্তৃক অলম্বুষ বধ
হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অলম্বুষ রথিগণের শরনিকরে সমাহত হইয়া তাঁহাদের সকলকে পাঁচ পাঁচ শরে বিদ্ধ করিলেন। তখন ঘটোৎকচ কোপাবিষ্ট হইয়া পুনৰ্ব্বার অলম্বুষকে সাত বাণে বিদ্ধ করিলেন। অলম্বুষও শরাৰ্দিত হইয়া হিড়িম্বা তনয়ের প্রতি সুবর্ণপুঙ্খ শিলাশিত সায়কসমূহ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। যেমন রোষাবিষ্ট মহাবল পন্নগসমূহ পর্ব্বত শৃঙ্গে প্রবেশ করে, সেইরূপ নতপর্ব্ব শরসমূহ ঘটোৎকচের কলেবরে প্রবিষ্ট হইল। তখন ঘটোৎকচ সমবেত পাণ্ডবগণ চতুর্দ্দিক হইতে অলম্বুষের উপর নিশিত, শরজাল নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। অলম্বুষ জয়শীল পাণ্ডবগণের বাণে বিদ্ধ হইয়া মনুষ্যের ন্যায় হীনবীৰ্য্য ও কর্ত্তব্যাবধারণে অক্ষম হইল। সমর নিপুণ মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন পুত্র ঘটোৎকচ অলম্বুষকে তদবস্থ দেখিয়া তাহার বিনাশ বাসনায় স্বীয় রথ হইতে তাহার ভিন্নাঞ্জনরাশিসন্নিভ দগ্ধ গিরিশৃঙ্গ সদৃশ রথে গমন করিল এবং গরুড় যেমন সর্পকে উত্তোলন করে, তদ্রূপ অলম্বুষকে রথ হইতে উত্তোলন পূর্ব্বক ভূতলে বারংবার নিক্ষেপ করিয়া প্রস্তর বিক্ষিপ্ত পূর্ণ কুম্ভের ন্যায় তাঁহাকে চূর্ণ করিয়া ফেলিল। সেনাগণ তাঁহার এই অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিয়া অতিশয় শঙ্কিত হইল। এইরূপে অতি ভীষণ রাক্ষস অলম্বুষ ঘটোৎকচের প্রহারে বিস্ফুটিতাঙ্গ ও চূর্ণিতাস্থি হইয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তখন পাণ্ডবগণ সেই নিশাচরের বিনাশ দর্শনে পুলকিত হইয়া পতাকা বিধুনন ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। কুরুপক্ষীয় সেনা ও বীরগণ ভীমরূপ মহাবল অলম্বুষকে বিশীর্ণ পর্ব্বতের ন্যায় সমরাঙ্গনে নিপতিত দেখিয়া ক্ষুব্ধ চিত্তে হাহাকার করিতে আরম্ভ করিলেন। সংগ্রাম দর্শনার্থ সমাগত ব্যক্তিরা কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া সেই সমরাঙ্গনে নিপতিত রাক্ষসকে যদৃচ্ছাক্রমে ভূতলে পতিত মঙ্গল গ্রহের ন্যায় অবলোকন করিতে লাগিলেন।
হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ঘটোৎকচ অমিতপরাক্রম অলম্বুষকে পক্ক অলম্বুষ ফলের ন্যায় ভূতলে নিপাতিত করিয়া আহ্লাদিত চিত্তে বলনিপাতন বাসবের ন্যায় ঘোরতর নিনাদ করিতে আরম্ভ করিল। তাহার পিতা ও পিতৃব্যের বন্ধুবান্ধবগণ সমভিব্যাহারে তাঁহাকে সেই দুষ্কর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে দেখিয়া বারংবার প্রশংসা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবসৈন্য মধ্যে শঙ্খনাদ ও নানাবিধ বাণ নিস্বন আরম্ভ হইল। কৌরবগণ সেই শব্দ শ্রবণ করিয়া ভীষণ নিনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে উভয় পক্ষের ভীষণ শব্দে ত্রিভুবন প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।”