১০৮তম অধ্যায়
সৌমদত্তি বধ-কৌরব পলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! যশস্বী সোমদত্তপুত্র ধনুর্দ্ধারী দ্রৌপদেয়দিগের প্রত্যেককে পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সাত সাত বাণে বিদ্ধ করিলেন। দ্রৌপদেয়গণ সৌমদত্তির শরে নিতান্ত নিপীড়িত ও বিচেতন প্রায় হইয়া সংগ্রামে ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন। অনন্তর নকুলপুত্র শতানীক নরর্ষভ সোমদত্তপুত্রকে দুই শরে বিদ্ধ করিয়া প্রসন্ন চিত্তে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন শতানীকের অপর ভ্রাতৃচতুষ্টয় অকুটিল তিন তিন বাণে সৌমদত্তিকে আহত করিলেন। মহাবীর সৌমদত্তিও তাঁহাদিগের পাঁচ জনের বক্ষস্থলে পাঁচ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। তখন সেই পাঁচ ভ্রাতা সৌমদত্তির বাণে পীড়িত হইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিকে অবস্থান পূর্ব্বক সায়ক বর্ষণ করিতে লাগিলেন। কোপপূর্ণ অর্জ্জুননন্দন চারিটি শাণিত শরে সোমদত্ত নন্দনের অশ্ব সমুদায় শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। ভীমসেনতনয় তাঁহার শরাসন ছেদন পূর্ব্বক তাঁহাকে নিশিত শরে আহত করিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠিরতনয় তাঁহার ধ্বজছেদন করিয়া ফেলিলেন, এবং নকুল পুত্র তাঁহার সারথিকে রথ হইতে নিপাতিত করিলেন। তখন সহদেবনন্দন সৌমদত্তিকে স্বীয় ভ্রাতৃগণের শরে বিমুখীকৃত অবগত হইয়া ক্ষুরপ্র অস্ত্রে তাঁহার শিরচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। বালসূৰ্য্যসদৃশ প্রভাসম্পন্ন সুবর্ণালঙ্কৃত সৌমদত্তির মস্তক ভূতলে পতিত হইয়া রণস্থল আলোকময় করিল। তখন আপনার সেনাগণ সোমদত্ত পুত্রের বিনাশ দর্শনে শঙ্কিত হইয়া নানা স্থানে পলায়ন করিতে লাগিল।
রাক্ষস অলম্বুষসহ ভীমের ভীষণ যুদ্ধ
হে মহারাজ! রাবণপুত্র ইন্দ্রজিত লক্ষণের সহিত যেরূপ যুদ্ধ করিয়াছিলেন; রাক্ষস অলম্বুষ ক্রুদ্ধ হইয়া মহাবল পরাক্ৰান্ত ভীমসেনের সহিত সেইরূপ ঘোর সংগ্রাম আরম্ভ করিল। ভীমসেনের সহিত রাক্ষসের ঘোর সংগ্রাম সন্দর্শন করিয়া সকলেই বিস্মিত ও আনন্দিত হইলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন হাস্য করিয়া নয়টি নিশিত শরে রোষপরবশ রাক্ষসেন্দ্র অলম্বুষকে বিদ্ধ করিলেন। ঋষ্যশৃঙ্গনন্দন অলম্বুষ বাণ বিদ্ধ হইয়া গভীর নিনাদ করিয়া ভীমসেনের ও তাঁহার অনুগামিগণের সম্মুখীন হইয়া প্রথমত তাঁহাকে নতপর্ব্ব পাঁচ শরে বিদ্ধ ও তাঁহার ত্রিংশৎ রথ বিনষ্ট করিল। পরে পুনরায় তাঁহার চতুঃশত রথ বিনাশ পূর্ব্বক তাঁহাকে তীক্ষ্ণ শরে বিদ্ধ করিতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন রাক্ষসের শরপ্রহারে ব্যথিত হৃদয় হইয়া রথোপরি মূর্চ্ছিত ও নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে সংজ্ঞা লাভ করিয়া ক্রোধকম্পিত কলেবরে ঘোর শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক তীক্ষ্ণ শরে অলম্বুষকে পীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। নীলকজ্জ্বলসদৃশ নিশাচর ভীমের বহু বাণে বিদ্ধ হইয়া সমরাঙ্গনে প্রফুল্ল কিংশুকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। হে মহারাজ! ঐ সময় অলম্বুষের ভ্রাতৃবধ বৃত্তান্ত স্মৃতি পথে সমুদিত হইল। তখন সে ঘোর রূপ ধারণ পূর্ব্বক ভীমসেনকে কহিল, ‘রে মূঢ়! আজি সংগ্রামে আমার পরাক্রম দেখ্! তুই পূর্ব্বে আমার ভ্রাতা মহাবীর বক রাক্ষসের প্রাণ সংহার করিয়া ভাগ্য ক্রমে পরিত্রাণ পাইয়াছিস্। আমি তথায় তৎকালে উপস্থিত থাকিলে অবশ্যই তোরে যমালয়ে প্রেরণ করিতাম।’ মহাবীর অলম্বুষ ভীমকে এই কথা বলিয়া মুহূর্ত্ত মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া অসংখ্য শরবর্ষণ পূর্ব্বক তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিল। ভীমসেন নিশাচরকে অদৃশ্য জানিয়া নতপর্ব্ব শরনিকরে আকাশ মণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। রাক্ষস ভীমবাণে বিদ্ধ হইয়া তৎক্ষণাৎ রথারোহণ পূর্ব্বক কখন ভূতলে ও কখন আকাশ মণ্ডলে গমন করিতে লাগিল এবং কখন সূক্ষ্ম, কখন বৃহৎ, ও কখন স্থূল আকার ধারণ পূর্ব্বক অলম্বুদের ন্যায় গর্জ্জন ও নানাবিধ বাক্য প্রয়োগ করিয়া আকাশ হইতে চতুর্দ্দিকে বিবিধ শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। রাক্ষস বিসৃষ্ট শক্তি, কুণপ, প্রাস, শূল, পট্টিশ, তোমর, শতঘ্নী, পরিঘ, ভিন্দিপাল, পরশু, শিলা, খড়্গ, গুড়, ঋষ্টি, বজ্র প্রভৃতি শস্ত্র সকল সংগ্রাম মধ্যে বারিধারার ন্যায় নিপতিত হইয়া পাণ্ডুনন্দনের অসংখ্য সৈন্য সংহার করিতে লাগিল। তখন অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও পদাতি বিনষ্ট হইয়া গেল। রথিগণ রথ হইতে পতিত হইতে লাগিলেন।
ভীমসমরে অলম্বুষ পরাজয়
হে মহারাজ! এই রূপে মহাবীর অলম্বুষ পাণ্ডব সৈন্যগণকে সংহার করিয়া সমরাঙ্গনে রাক্ষসগণ-সমাকুল শোণিত নদী প্রবাহিত করিল। রথসকল উহার আবৰ্ত্ত, হস্তিসকল গ্রাহ, ছত্ৰ সমুদয় হংস ও বাহু সকল পন্নগের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। চেদি, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ ঐ নদীর ভীষণ প্রবাহে ভাসিতে লাগিল। সেই ঘোররণে পাণ্ডবগণ রাক্ষসের নিঃশঙ্কচিতে পরিভ্রমণ ও অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিয়া অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। কৌরব সেনাগণের আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তাঁহারা লোমহর্ষণ তুমুল বাদিত্ৰ নিস্বন করিতে লাগিল। করতালি শব্দ ভুজঙ্গের যেমন অসহ্য হয়, কৌরবগণের বাদিত্ৰ নিস্বন ভীমসেনের তদ্রূপ অসহ্য হইল। তখন তিনি কোপে প্রজ্বলিত হইয়া রোষ কষায়িত লোচনে ত্বাষ্ট্র অস্ত্র শরাসনে সন্ধান করিলেন। ঐ সময় চতুর্দ্দিক হইতে সহস্র সহস্র শর প্রাদুর্ভূত হওয়াতে অসংখ্য কৌরবসৈন্য সমর পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। তখন সেই ভীমসেন প্রেরিত ত্বাষ্ট্র অস্ত্র সমরে নিশাচরের মহামায়া বিনষ্ট করিয়া তাঁহাকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিল। রাক্ষস শরাৰ্দিত হইয়া ভীমসেনকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক প্রাণ রক্ষাৰ্থ দ্রোণাচার্য্যের বাহিনীমুখে ধাবমান হইল।
হে মহারাজ! এইরূপে নিশাচর ভীম কর্ত্তৃক পরাজিত হইলে পাণ্ডবেরা আনন্দিত চিত্তে সিংহনাদ করিয়া দশ দিক পরিপূরিত করিলেন এবং প্রহ্লাদ পরাজিত হইলে দেবগণ ইন্দ্রকে যেরূপ প্রশংসা করিয়াছিলেন, সেইরূপ তাঁহারা ভীমসেনকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।”