১০৮তম অধ্যায়
ভীষ্মবর্ধার্থ মন্ত্রণা—যুধিষ্ঠিরবিষাদ
সঞ্জয় কহিলেন, “দিবাকর অস্তগত ও ঘোর সন্ধ্যা প্রাদুর্ভূত হইলে যুদ্ধ আর নয়নগোচর হইল না। সন্ধ্যাকাল সমুপস্থিত হইয়াছে, সেনাগণ ভীষ্মের হস্তে আহত হইয়া ভয়বিহ্বলতায় অস্ত্ৰ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছে, মহারথ ভীষ্ম রোষসহকারে তাহাদিগকে নিপীড়িত করিতেছেন এবং মহারথ সোমকগণ পরাজিত ও নিরুৎসাহ হইয়াছেন। অবলোকন করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির চিন্তাপূর্ব্বক অবহার করিতে অনুমতি করিলেন। অনন্তর তাঁহার ও আপনার সৈন্যগণের অবহার হইল। সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত মহারথীগণ সৈন্যগণের অবহার করিয়া সেনানিবেশে প্রবেশ করিলেন। ভীষ্মবাণপীড়িত পাণ্ডবগণ ভীষ্মের সমরকৃত্য চিন্তা করিয়া নিতান্ত আকুলিত হইতে লাগিলেন। ভীষ্মও পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকে পরাজিত করিয়া হৃষ্টচিত্তে কুরুগণের মধ্যে উপবেশন করিলেন। আপনার পুত্ৰগণ তাঁহার পূজা ও স্তব করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর সর্ব্বজীবসম্মোহিনী [নিদ্ৰাপ্রয়োগে মোহকারিণী] শর্ব্বরী সমুপস্থিত হইল। তখন পাণ্ডব, বৃষ্ণি ও সৃঞ্জয়গণ মন্ত্রণা করিতে বসিলেন, মন্ত্রণায় নিশ্চয়জ্ঞ মহাবলগণ সকলেই আপনি আপন মঙ্গলকর মন্ত্রণা আরম্ভ করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির বহুক্ষণ মন্ত্রণা করিয়া কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বাসুদেব! দেখ, উগ্রপরাক্রম মহাত্মা ভীষ্ম মাতঙ্গের নলবনদলনের ন্যায় আমার সৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত ও প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় সন্তাপিত করিতেছেন। আমাদিগের এমন সামর্থ্য নাই যে, তাঁহার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করি। তীক্ষ্নশস্ত্র প্রতাপবান ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হইলে মহানাগের ন্যায়, বিষপূর্ণ তক্ষকের ন্যায় ভয়ানক হইয়া উঠেন। যদি যমরাজ শরাসন ধারণপূর্ব্বক শরনিকর বর্ষণ করেন, যদি দেবরাজ বজ্রহস্তে, বরুণ পাশহস্তে বা ধনেশ্বর গদাহস্তে যুদ্ধে আগমন করেন, তাঁহাদিগকেও পরাজয় করিতে পারি; কিন্তু ভীষ্ম মহাযুদ্ধে ক্রুদ্ধ হইলে তাঁহাকে জয় করিতে সমর্থ হইব না; এক্ষণে আমি বুদ্ধির দুর্ব্বলতা নিবন্ধন ভীষ্মের যুদ্ধে শোকসাগরে নিমগ্ন হইলাম। ভীষ্ম প্রতিদিনই আমাদিগের সৈন্য নিহত করিতেছেন; অতএব যুদ্ধে আমার আর স্পৃহা নাই; অরণ্যে গমন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর। যেমন পতঙ্গগণ প্রজ্বলিত পাবকের প্রতি ধাবমান হইয়া একেবারে বিনষ্ট হয়, সেইরূপ পরাক্রম সত্ত্বেও আমি ভীষ্মের সহিত মিলিত হইয়া দিন দিন ক্ষীণ হইতেছি এবং শৌৰ্য্যশালী ভ্রাতৃগণও নিতান্ত শরপীড়িত হইতেছেন। সৌভ্রাত্ৰশালী ভ্রাতৃগণ আমার নিমিত্তই রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া অরণ্যে গমন করিয়াছিলেন। দ্রুপদনন্দিনী আমার নিমিত্তই পরিক্লেশিত হইয়াছেন। আজি জীবনকে সর্বোৎকৃষ্ট ও দুর্লভ বোধ হইতেছে; অতএব অদ্য জীবন থাকিতে থাকিতে উৎকৃষ্ট ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিব। আমি যদি তোমার ও ভ্রাতৃগণের অনুগ্রহের যোগ্য হই, তাহা হইলে স্বধর্ম্মের অবিরোধী হিতকর উপদেশ প্ৰদান কর।”
কৃষ্ণকর্ত্তৃক যুধিষ্ঠিরসান্ত্বনা
“বাসুদেব যুধিষ্ঠিরের করুণ-রসপূর্ণ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনাপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! আপনার ভ্রাতা বায়ু ও অগ্নিসম তেজস্বী দুৰ্জয় ভীমার্জ্জুন এবং ইন্দ্রসদৃশ পরাক্রান্ত নকুল-সহদেব থাকিতে বিষাদ করিবেন না। আমাকে আদেশ করুন, আমিও সেই সৌহার্দ্যনিবন্ধন ভীষ্মের সহিত যুদ্ধ করিব। আপনি নিয়োগ করিলে আমি মহাযুদ্ধে কি না করিতে সমর্থ হই? যদি অর্জ্জুনের যুদ্ধে ইচ্ছা না হয়, তবে আমিই ধাৰ্তরাষ্ট্রগণের সমক্ষে পুরুষবর ভীষ্মকে আহ্বান করিয়া সংহার করিব। যদি মনে করেন, ভষ্মি হত হইলেই জয়লাভ হইবে, তাহা হইলে আমি একরথে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের প্রাণনাশ করিব। আপনি এই যুদ্ধে মহেন্দ্রের বিক্রমতুল্য আমার বিক্রম অবলোকন করুন, আমি মহাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে রথ হইতে নিপাতিত করিব। আপনাদিগের শত্রুই আমার শত্ৰু, আপনাদিগের প্রয়োজনই আমার প্রয়োজন, আর আমার প্রয়োজনই আপনাদিগের প্রয়োজন, তাহাতে সন্দেহ নাই। আপনার ভ্রাতা ধনঞ্জয় আমার সখা, সম্বন্ধী ও শিষ্য। আমি তাঁহার নিমিত্ত নিজ মাংস কর্ত্তন করিয়া প্ৰদান করিব; ইনিও আমার নিমিত্ত প্ৰাণ দান করিবেন; এইরূপে আমরা পরস্পরকে উদ্ধার করিব প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। অতএব আপনি আমাকে যোদ্ধৃপদে নিযুক্ত করুন। পূর্ব্বে পার্থ উপপ্লব্যনগরে লোকসমক্ষে এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, আমি গাঙ্গেয়কে নিহত করিব, এক্ষণে সেই প্রতিজ্ঞা দূরে নিক্ষেপ করুন; আমিই পার্থের প্রতিজ্ঞানুযায়ী কাৰ্য্যসম্পন্ন করিব; অথবা এই ভার পার্থের পক্ষেই পৰ্য্যাপ্ত হইবে; অতএব ধনঞ্জয়ই পরপুরঞ্জয় ভীষ্মকে সংহার করিবেন; ইনি সমুদ্যত হইলে অশক্য [অসাধ্য] কাৰ্য্যও সম্পাদন করিতে পারেন। ভীষ্মের কথা দূরে থাকুক, দেবগণ, দৈত্য ও দানবদলের সহিত যুদ্ধে সমুদ্যত হইলে ইনি তাঁহাদিগকেও বিনষ্ট করিতে পারেন। মহাবীর ভীষ্ম ত’ বিপরীতমতি [বুদ্ধিভ্রংশ], সত্ত্বহীন ও অল্পচেতন হইয়া কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়াছেন।”
ভীষ্মবধোপায় পরিজ্ঞানার্থ তৎসমীপে গমন
“যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহাবাহো! তুমি যথার্থই কহিতেছ; কৌরবেরা সকলে একত্র হইয়াও তোমার বেগধারণে সমর্থ হয় না। তুমি যখন আমার পক্ষে অবস্থান করিতেছ, তখন প্রতিনিয়তই আমার সমুদয় অভিলাষ পরিপূর্ণ হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। তুমি রক্ষা করিলে মহারথ ভীষ্মের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্রপ্রভৃতি দেবগণকেও পরাজয় করিতে পারি। কিন্তু আত্মগৌরবের নিমিত্ত তোমাকে মিথ্যাবাদী করিতে আমার উৎসাহ হয় না; তুমি অযোধ্যমান [যুদ্ধে নির্লিপ্ত] থাকিয়াই ঐ রূপে সাহায্য কর। পিতামহ ভীষ্ম আমার পক্ষ হইয়া যুদ্ধ করিবেন না; দুৰ্য্যোধনের নিমিত্তই যুদ্ধ করিবেন; কিন্তু আমার হিতার্থ মন্ত্রণা প্ৰদান করিবেন প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। তিনিই আমাদিগকে রাজ্য ও মন্ত্রণা প্রদান করিবেন; অতএব চল, সকলে একত্র হইয়া তাঁহার বধের নিমিত্ত তাঁহারই নিকট গমন করিয়া মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করি, তিনি অবশ্যই সত্য ও হিতবাক্য কহিবেন, আমরা যুদ্ধকালে তাঁহার বাক্যানুসারেই কার্য্য করিব। সেই দৃঢ়ব্ৰত আমাদিগকে জয় ও মন্ত্রণা প্রদান করিবেন। ক্ষাত্র [ক্ষত্রিয়োচিত] জীবিকায় ধিক! আমরা বাল্যকালে পিতৃহীন হইয়া যাঁহার হস্তে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছি, এক্ষণে সেই পিতামহকে সংহার করিবার অভিলাষ করিতেছি!”
“বাসুদেব কহিলেন, “মহারাজ! আপনার বাক্য আমার মনোমত হইয়াছে; দেবব্রত কৃতী ভীষ্ম দৰ্শনমাত্র সকলকে দগ্ধ করিতে পারেন; অতএব তাঁহার বধোপায় জিজ্ঞাসা করিবার ত্ত তাঁহার নিকটই গমন করুন; বিশেষতঃ আপনি জিজ্ঞাসা করিলে তিনি হিতবাক্য কহিতে পারেন। এক্ষণে চলুন, শান্তনবের নিকট গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করি; তিনি আমাদিগকে যেরূপ মন্ত্রণা প্রদান করিবেন, আমরা অদনুসারে অরাতিগণের সহিত যুদ্ধ করিব।
“বাসুদেব ও পাণ্ডবগণ এইরূপ মন্ত্রণা করিয়া পিতামহের নিকট গমন করিলেন এবং অস্ত্র ও কবচ পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার গৃহে প্রবেশ ও পূজাসহকারে প্রণাম করিয়া শরণাপন্ন হইলেন। মহাবাহু ভীষ্ম তাঁহাদিগকে কহিলেন, “হে কেশব! ধনঞ্জয়! ধর্ম্মরাজ! ভীমসেন! নকুল! সহদেব! তোমাদের স্বাগত। তোমাদের প্রীতিবৰ্দ্ধানের জন্য কি কাৰ্য্য করিতে হইবে? যদি তাহা অত্যন্ত দুষ্কর হয়, তাহা হইলেও সর্ব্বপ্রযত্নে সম্পাদনা করিব।”
“কুরুপিতামহ ভীষ্ম প্রীতিসহকারে পুনঃ পুনঃ এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে দীনাত্মা রাজা যুধিষ্ঠির প্রণয়পূর্ব্বক কহিলেন, “পিতামহ! আমরা কি প্রকারে জয় বা রাজ্যলাভ করি এবং কি প্রকারেই বা প্ৰজাগণের রক্ষা হয়? অতএব আপনি আমাদিগকে আপনার বধোপায় বলুন। আমরা কোন প্রকারে আপনার সহিত সংগ্রাম করিতে সমর্থ নহি; সংগ্রামসময়ে আপনার বিন্দুমাত্র ছিদ্রও নয়নগোচর হয় না; আমরা যুদ্ধকালে দেখি, আপনি প্রতিনিয়ত মণ্ডলাকার শরাসন ধারণ করিয়া আছেন। আপনি কখন শর গ্রহণ করেন, কখন সন্ধান করেন, আর কখনই বা ধনু আকর্ষণ করেন, কিছুই দৃষ্ট হয় না। আপনি রথারূঢ় হইলে আপনাকে অপর সূৰ্য্য এবং রথ, অশ্ব, মনুষ্য ও হস্তিগণের সংহারকর্ত্তা বলিয়া বোধ হয়। কোন পুরুষ আপনাকে জয় করিতে সমর্থ হয়? আপনি শরজাল বর্ষণ করিয়া নিয়তই শক্ৰ বধ করিতেছেন; আমার বিপুলতর সৈন্য ক্ষীণ করিয়াছেন। অতএব যাহাতে আপনাকে জয় করিতে সমর্থ হই, যাহাতে আমার রাজ্যলাভ হয়, যাহাতে মদীয় সৈন্যগণ কল্যাণ লাভ করিতে পারে, তাহাই বলুন।”
“তখন ভীষ্ম কহিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! সত্য কহিতেছি, আমি জীবিত থাকিতে কোন প্রকারে তোমাদিগের জয়লাভ হইবে না; আমি পরাজিত হইলে পর তোমরা জয়লাভ করিবে। অতএব যদি জয়লাভের ইচ্ছা থাকে, আমি অনুমতি করিতেছি, পরমসুখে আমাকে প্রহার কর; তোমরা যে আমাকে বিদিত হইয়াছ, ইহাই সুকৃত বলিয়া বিবেচনা হইতেছে। আমি নিহত হইলে সকলেই নিহত হইবে; অতএব ইহাই কর।”
“যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পিতামহ। আপনি সমরে ক্রুদ্ধ হইলে, বোধ হয় যেন যমরাজ দণ্ডহস্তে আগমন করিয়াছেন; অতএব কি উপায়ে আপনাকে পরাজিত করিতে পারি, তাই বলুন। দেবরাজ, যমরাজ ও বরুণকেও পরাজয় করিতে পারা যায়, তথাপি আপনাকে পরাজয় করিতে পারি না, ইন্দ্ৰপ্ৰভৃতি দেবগণ এবং অসুরগণও আপনাকে জয় করিতে সমর্থ হয়েন না।”
ভীষ্মের স্বকীয় বধোপায় কথন
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহাবাহো! আমি কামুক ও অস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিলে ইন্দ্ৰপ্ৰভৃতি সুর ও অসুরগণ যে আমাকে পরাজয় করিতে অসমর্থ হয়েন, তাহা অযথার্থ নহে; আমি অস্ত্ৰ ত্যাগ করিলে তাহারা আমাকে বধ করিতে পারেন। হে যুধিষ্ঠির! যে ব্যক্তি শস্ত্ৰ, কবচ বা ধ্বজহীন, পতিত, পলায়মান, ভীত, স্ত্রীজাতি, স্ত্রীনামা, বিকলাঙ্গ, পিতার একমাত্র পুত্র, অপ্রশস্ত বা ‘আমি তোমার’ বলিয়া শরণাপন্ন হয়, তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে আমার অভিরুচি হয় না। আর পূর্ব্বে এরূপ সঙ্কল্পও করিয়াছিলাম যে, অমঙ্গল লক্ষণযুক্ত ধ্বজ অবলোকন করিলে কখনই যুদ্ধ করিব না। তোমার সৈন্যের মধ্যে শিখণ্ডীনামে যে মহারথ দ্রুপদতনয় আছেন, উনি যেরূপ স্ত্রীরূপ হইতে পুরুষবিগ্ৰহ পরিগ্রহ করিয়াছেন, তাহা তোমরা সকলেই অবগত আছ; বার্ম্মিতাঙ্গ ধনঞ্জয় তাঁহাকে অগ্ৰে করিয়া নিশিত বিশিখজালে আমাকে প্রহার করুন। শিখণ্ডী অমঙ্গলযুক্ত-ধ্বজ বিশেষতঃ স্ত্রীপূর্ব্ব, অতএব উহাকে শস্ত্রদ্বারা প্রহার করিতে ইচ্ছা করি না। ধনঞ্জয় এইরূপ অবসর প্রাপ্ত হইয়া শীঘ্র শরদ্বারা আমার সর্ব্বাঙ্গে আঘাত করুন। আমি সংগ্রামে সমুদ্যত হইলে মহাভাগ কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় ব্যতীত এই ভূমণ্ডলে কেহই আমাকে বধ করিতে পরিবে না; অতএব ধনঞ্জয় যত্নসহকারে শর-শরাসন ধারণপূর্ব্বক শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া আমাকে পাতিত করুন; তাহা হইলেই তোমার জয় হইবে সন্দেহ নাই। হে সুব্ৰত! আমি যেরূপ কহিলাম, তদনুসারে কাৰ্য্য করিয়া সংগ্রামে সমাগত সমস্ত ধার্ত্তরাষ্ট্রকে সংহার কর।”
ভীষ্মবধে অর্জ্জুনের অনভিপ্ৰায়
“কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণ এইরূপ উপায় অবগত হইয়া কুরুপিতামহ মহাত্মা ভীষ্মকে অভিবাদনপূর্ব্বক স্বশিবিরে আগমন করিলেন। কিন্তু ধনঞ্জয় প্ৰাণপরিত্যাগে সমুদ্যত পিতামহের বাক্যশ্রবণে দুঃখসন্তপ্ত ও লজ্জিত হইয়া কৃষ্ণকে কহিলেন, “মাধব! বাল্যকালে ক্রীড়া করিতে করিতে ধূলিধূসরিতকলেবরে যাঁহাকে ধূলিধূসরিত করিতাম, অঙ্কে আরোহণ করিয়া পিতা বলিয়া সম্বোধন করিলে যিনি কহিতেন, “আমি তোমার পিতা নহি, তোমার পিতার পিতা’, সেই বৃদ্ধ পিতামহের সহিত কি প্রকারে যুদ্ধ করিব, কি প্রকারেই বা তাঁহাকে বধ করিব! অতএব তিনি আমার সৈন্যগণকেই বধ করুন। আর আমার জয় কিংবা নিধনই হউক, মহাত্মা ভীষ্মের সহিত কদাচ যুদ্ধ করিব না; অথবা তুমি কিরূপ বিবেচনা কর?”
“বাসুদেব কহিলেন, “ধনঞ্জয়! তুমি ভীষ্মকে বধ করিব বলিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলে; ক্ষত্ৰিয় হইয়া এক্ষণে কিরূপে তাহার অন্যথা করিবে? অতএব এই যুদ্ধদুর্ম্মদ ক্ষত্রিয়কে রথ হইতে পতিত কর; ভীষ্মকে বধ না করিলে তোমার জয়লাভ হইবে না। দেবগণ পূর্ব্বে অবগত হইয়াছেন, ভীষ্ম মৃত্যুমুখে প্রবিষ্ট হইবেন। এক্ষণে তাঁহাই সফল হউক, তুমি তাহার অন্যথা করিও না। তোমা ভিন্ন আর কেহই তাঁহাকে সংহার করিতে সমর্থ হইবে না; অধিক কি, স্বয়ং বজ্রধরও ব্যাদিতবদন অন্তকসদৃশ দুর্দ্ধৰ্ষ ভীষ্মকে সংহার করিতে পরিবেন না, অতএব স্থির হইয়া ভীষ্মকে বধ কর। পূর্ব্বে মহাবুদ্ধি বৃহস্পতি দেবরাজকে কহিয়াছেন যে, হে দেবরাজ! জ্যেষ্ঠ, বৃদ্ধ অথবা গুণবান ব্যক্তি আততায়ী হইলে, তাহাকে সম্মুখীন দেখিবামাত্ৰ বধ করিবে। হে ধনঞ্জয়! ক্ষত্ৰিয়দিগের এই সনাতন ধর্ম্ম যে, অসূয়াশূন্য হইয়া যুদ্ধ করিবে, রক্ষা করিবে ও সকল বিষয় জানিতে অভিলাষ করিবে।”
“ধনঞ্জয় কহিলেন, “হে বাসুদেব! ভীষ্ম শিখণ্ডীকে অবলোকন করিলেই যুদ্ধে পরাত্মখ হইবেন; অতএব শিখণ্ডী ভীষ্মের মৃত্যু, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমরা তাঁহাকে অগ্ৰে করিয়া গাঙ্গেয়াকে নিপাতিত করিব, এই উপায়ই আমার মনোমত। আমি শরশরাসনদ্বারা অন্যান্য সকলকে নিবারণ করিব। আর শিখণ্ডী কেবল যোদ্ধৃপ্রধান ভীষ্মের সহিত যুদ্ধ করিবেন। আমি ভীষ্মের মুখে শুনিয়াছি, শিখণ্ডী অগ্ৰে কামিনী ছিলেন, পশ্চাৎ পুরুষ হইয়াছেন; এই নিমিত্ত পিতামহ তাহার সহিত সমর করিবেন না।” বাসুদেব ও পাণ্ডবগণ এইরূপ কৃতনিশ্চয় হইয়া হৃষ্টচিত্তে স্ব স্ব স্থানে উপস্থিত হইলেন।”