১০৮তম অধ্যায়
ভগীরথের গঙ্গা-আরাধনা
লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! চক্রবর্ত্তী মহারথ ভগীরথ সমুদয় লোকের মন ও নয়নের আনন্দবৰ্দ্ধন ছিলেন। তিনি কিংবদন্তী দ্বারা শ্রবণ করিলেন যে, পূর্ব্বপিতামহগণ দারুণ কপিলকোপানলে দগ্ধ হইয়া স্বৰ্গে গমন করিতে সমর্থ হয়েন নাই। তখন তিনি যৎপরোনাস্তি দুঃখার্ত্ত হইয়া সচিবের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণপূর্ব্বক তপস্যাদ্বারা পাপ বিনাশ ও গঙ্গার আরাধনা করিবার নিমিত্ত হিমাচলে গমন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, শৈলরাজ হিমবান ধাতুরঞ্জিত বিবিধাকার বিচিত্ৰ শৃঙ্গে উপশোভিত হইয়া রহিয়াছে; জলধরপটল পবনবেগে সঞ্চালিত হইয়া উহার চতুর্দ্দিকে জলসেক করিতেছে। নদী, নিতম্ব ও নিকুঞ্জসকল সতত শোভাসম্পাদন করিতেছে; গুহাকন্দরে সিংহ ও ব্যাঘ্ৰসকল বিষন্ন হইয়া রহিয়াছে; চতুর্দ্দিকে হংস, দাত্যূহ, জলকুকুট, ময়ুর, সারস, জীবঞ্জীবক, কোকিল, চকোর ও খঞ্জন প্রভৃতি বিচিত্রাঙ্গ পক্ষিগণ সতত মধুরস্বরে কলরব করিতেছে; মধুকরেরা গুনগুন ধ্বনি করিতেছে; মনোরম জলাশয়-সমুদয়ে কমলসকল প্রফুল্ল হইয়া রহিয়াছে ও উপকূলে সারসকুল মধুরধ্বনি করিতেছে, শিলাতলে কিন্নর ও অন্সরাগণ নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে, চতুর্দ্দিকে দিগ্গজগণ ভীষণ বিষাণাগ্রা [দন্তের অগ্রভাগ] দ্বারা বৃক্ষসমূহ উন্মলন করিতেছে; বিদ্যাধরগণ সতত বিচরণ করিতেছে; নানাবিধ রত্নরাজি চারিদিকে বিরাজিত হইতেছে এবং তীব্রবিষ দীপ্তজিহ্ব ভয়ানক ভুজঙ্গসকল ইতস্তত পরিসর্পণ [ভ্ৰমণ] করিতেছে, উহার কোন স্থান বা কনকনিকরের ন্যায়, কোন স্থান বা রজতরাশির ন্যায়, কোন স্থান বা অঞ্জনপুঞ্জের ন্যায় শোভমান হইতেছে।
ভগীরথের গঙ্গাসাক্ষাৎকার
“মহারাজ ভগীরথ ঐ মহাশৈলে বাস করিয়া কেবল ফল-মূল ও জল ভক্ষণপূর্ব্বক দেবপরিমাণে সহস্ৰ বৎসর কঠোর তপস্যা করিলেন। দিব্য সহস্ৰ বৎসর অতীত হইলে মহানদী গঙ্গা স্বয়ং মূর্ত্তিমতী হইয়া ভগীরথের সম্মুখে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে মহারাজ! তুমি আমার নিকট কি প্রার্থনা কর বল, কি প্রদান করিতে হইবে?” রাজা ভগীরথ গঙ্গার বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, ‘হে বরদে! সগররাজের ষষ্টিসহস্ৰ সন্তান অশ্বান্বেষণে গমন করিয়া কপিলদেবের কোপানলে ভস্মীভূত হইয়াছেন। তাঁহারা আমার পূর্ব্বপিতামহ; তাঁহাদের অকালমৃত্যু হওয়াতে স্বৰ্গলাভ হয় নাই। যাবৎ তাহাদের সেই ভস্মীভূত কলেবর সকল আপনার সলিলে অভিষিক্ত না হইবে, তাবৎ তাহাদিগের সদগতিলাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। হে মহাভাগে! আমি সেই পূর্ব্বপিতামহ সগরসন্ততিগণের সদগতিলাভজন্য অবনীন্তলে আপনার আগমন প্রার্থনা করিতেছি।’
“সর্ব্বলোকনমস্কৃত গঙ্গা ভগীরথের বাক্য-শ্রবণে পরমপ্রীত হইয়া কহিলেন, “হে রাজন! আমি নিঃসন্দেহই তোমার বাসনা পূর্ণ করিব; কিন্তু আমি যৎকালে স্বৰ্গ হইতে মেদিনীমণ্ডলে নিপতিত হইব, তখন আমার বেগ নিতান্ত দুৰ্দ্ধাৰ্য্য হইয়া উঠিবে। এই ত্ৰিলোকমধ্যে দেবাদিদেব মহাদেব ব্যতীত এমন কোন ব্যক্তি নাই যে, আমার সেই বেগ ধারণ করে, অতএব তুমি তপস্যাদ্বারা সেই আদিদেব মহাদেবকে পরিতুষ্ট কর। তিনি পতন-সময়ে মস্তকদ্বারা আমার বেগ ধারণ করিয়া ত্বদীয় পিতৃগণের হিতার্থে অবশ্যই তোমার অভিলাষ পূর্ণ করিবেন।’ মহারাজ ভগীরথ
তপানুষ্ঠাদ্বারা কালক্রমে ভগবান ভবানীপতিকে পরিতুষ্ট করিয়া স্বীয় পিতৃলোকদিগের স্বৰ্গ-প্রাপ্তির নিমিত্ত গঙ্গাধারণরূপ বর প্রার্থনা করিলেন।”