১০৮তম অধ্যায়
পিতামাতা প্রভৃতি গুরুজনসেবা-প্রশংসা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ধৰ্ম্মপথ অতি সুবিস্তীর্ণ ও বহুশাখাসঙ্কুল। অতএব এক্ষণে আপনার মতে কোন ধর্ম্মের অনুশীলন করা উচিত এবং কোন্ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে ইহলোক ও পরলোকে পরমধর্ম্মলাভ করিতে সমর্থ হওয়া যায়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমার মতে পিতা, মাতা ও অন্যান্য গুরুজনের সেবাই পরমধর্ম্ম। উহা অনুষ্ঠান করিলে মানবগণ দিব্যলোক ও মহীয়সী কীৰ্ত্তিলাভে সমর্থ হয়। তাঁহারা সুসেবিত হইয়া যাহা অনুজ্ঞা করিবেন, উহা ধৰ্ম্ম হউক বা অধৰ্ম্মই হউক, অবিচারিতচিত্তে অচিরাৎ সম্পাদন করা কর্ত্তব্য। তাঁহাদিগের অনভিমত কাৰ্য্য করা কদাপি বিধেয় নহে। তাঁহারা যাহা অনুমতি করেন, তাহাই শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম, সন্দেহ নাই। তাঁহারা তিন লোক[ভূ, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ], তিন আশ্রম [ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ], তিন বেদ [ঋক্, সাম ও যজুঃ] এবং তিন অগ্নি[গার্হপত্য, আহবনীয় ও দক্ষিণ]স্বরূপ। পিতা গার্হপত্য, মাতা দক্ষিণ ও অন্যান্য গুরুজন আহবনীয় অগ্নি বলিয়া পরিগণিত হয়েন। এই তিন অগ্নিই অতি প্রশস্ত; অপ্রমত্তচিত্তে তিনের উপাসনা করিলেই অনায়াসে ত্রিলোক জয় করিতে সমর্থ হইবে। পিতার সেবায় ইহলোক, মাতার সেবায় পরলোক এবং অন্যান্য গুরুজনের সেবায় ব্রহ্মালোক পরাজিত করা যায়। তুমি উত্তমরূপে উঁহাদিগের শুশ্রুষায় নিরত হইলে অনায়াসে ধর্ম্ম ও যশোলাভে সমর্থ হইবে। কদাচ উঁহাদিগকে অতিক্রম বা উঁহাদের দোষ কীৰ্ত্তন করিও না। প্রতিনিয়ত উঁহাদের পরিচর্য্যা করাই পরমধৰ্ম্ম এবং যশ, পুণ্য, কীৰ্ত্তি ও দুর্ল্লভ লোকসমুদয়লাভের প্রধান উপায়। যাঁহারা ঐ তিনের সমাদর করেন, তাঁহাদের সমুদয় লোক বশীভূত হয়; আর যাঁহারা উঁহাদিগের সমাদর না করেন, তাঁহাদিগের সমস্ত কার্য্যই বিফল হয় এবং তাঁহারা কি ইহলোক, কি পরলোক কোন স্থানেই শ্রেয়োলাভে সমর্থ হয়েন না। আমি তাঁহাদিগের নিমিত্ত যে যে কাৰ্য্য করিয়াছি, আমার সেই সেই কার্য্যানুষ্ঠানের শতগুণ সহস্রগুণ পুণ্যলাভ হইয়াছে এবং সেই পুণ্যবলেই আমি এক্ষণে ত্রিলোক প্রত্যক্ষ করিতেছি।
“দশ শ্ৰোত্ৰিয় [বেদজ্ঞ] অপেক্ষা এক আচার্য্য [বৈদিক দীক্ষাদাতা-বেদ-উপদেশক], দশ আচার্য্য অপেক্ষা এক উপাধ্যায় [অধ্যাপক], দশ উপাধ্যায় অপেক্ষা এক পিতা এবং দশ [পিতা অপেক্ষা মাতা দশগুণ অধিক গুরু] পিতা বা সমুদয় পৃথিবী অপেক্ষা এক মাতা গুরুতর বলিয়া গণনীয় হয়েন। মাতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গুরু আর কেহই নাই; কিন্তু আমার বোধ হয়, উপদেষ্টা গুরু পিতা ও মাতা অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। পিতামাতা যে দেহের সৃষ্টি করিয়া থাকেন, উহা অচিরস্থায়ী, কিন্তু আচার্য্য যাহা উপদেশ প্রদান করেন, তাহার কোনকালেই ধ্বংস নাই। পিতামাতা সহস্র অপকার করিলেও তাঁহাদিগকে বধ করা পুত্রের নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। অপরাধী পিতামাতার দণ্ডবিধান না করিলে পুত্রগণকে দূষিত হইতে হয় না; পিতামাতা ধর্ম্মদ্বেষী হইলেও তাঁহাদের প্রতিপালনে যত্ন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যিনি বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রানুযায়ী যথার্থ উপদেশ প্রদান করিয়া অকৃত্রিম অনুগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি পিতামাতাস্বরূপ। অতএব তাঁহার প্রতি বিদ্বেষশূন্য হইয়া তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। যাহারা উপাধ্যায়ের নিকট বিদ্যাভ্যাস করিয়া তাঁহার সমাদর ও কায়মনোবাক্যে তাঁহার হিতসাধন না করে, তাহাদিগের সেসমস্ত নষ্ট হইয়া যায় এবং তাহাদিগকে ভূণহত্যাপিতকে লিপ্ত হইতে হয় এবং এই ভূমণ্ডলে আর কাহাকেও তাহাদিগের অপেক্ষা পাপাত্মা বলিয়া গণনা করা যায় না। শিক্ষকগণ শিষ্যগণের প্রতি যেরূপ, স্নেহপ্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহাদিগেরও ধৰ্ম্মকামনায় যত্নপূৰ্ব্বক তাঁদের তদনুরূপ পূজা করা কর্ত্তব্য। পিতা প্রসন্ন হইলে প্রজাপতি, মাতা প্রসন্ন হইলে বসুমতী এবং উপাধ্যায় প্রীত হইলে ব্ৰহ্ম প্রীত হইয়া থাকেন। অতএব পিতা ও মাতা অপেক্ষা। উপাধ্যায়ই পূজ্যতম। শিক্ষকদিগের পূজা করিলে দেবতা, ঋষি ও পিতৃগণ যারপরনাই পরিতুষ্ট হয়েন। অতএব কোনরূপেই গুরুকে অবজ্ঞা করা কর্ত্তব্য নহে। শিক্ষাদাননিবন্ধন উপাধ্যায়গণ যাদৃশ পূজ্য, পিতামাতা তাদৃশ নহেন। উপাধ্যায়দিগের কাৰ্য্যে দোষারোপ করা কর্ত্তব্য নহে। তাঁহাদের সৎকার করিলে দেবতারা প্রসন্ন হয়েন। যাহারা শিক্ষক, পিতা ও মাতার অনিষ্টাচরণ বা অনিষ্টচিন্তা করে, যাহারা পিতামাতার যত্নে প্রতিপালিত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া তাঁহাদিগের ভরণপোষণে বিরত হয়, তাহাদিগকে ভূণহত্যাপিতকে লিপ্ত হইতে হয়; তাহাদিগের অপেক্ষা পাপাত্মা আর কেহই নাই। মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন, স্ত্রীঘাতক ও গুরুহত্যাকারী এই চারি ব্যক্তির নিষ্কৃতি কুত্রাপি শ্রবণগোচর হয় না। হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে ইহলোকে মানবগণের যাহা কৰ্তব্য, ধৰ্ম্মানুসারে সংক্ষেপে তাহার সারাংশ কীৰ্ত্তন করিলাম। ইহা অপেক্ষা শ্রেয়স্কর আর কিছুই নাই।”