প্রধান প্রধান যোদ্ধৃপতি দিল থানা।
সকল লঙ্কায় হৈল শ্রীরামের সেনা।।
ভয়েতে রাবণ বন্ধ করিলেন দ্বার।
মন্ত্রী লয়ে পরামর্শ করে যুদ্ধ সার।।
সবান্ধবে সুসজ্জায় আসে দশানন।
দেখি চমকিত হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
জিজ্ঞাসেন বিভীষণে মানিয়া বিস্ময়।
একে একে বিভীষণ দিল পরিচয়।।
শ্রীরাম কহেন শুনি মিত্র বিভীষণে।
নাহিক বুদ্ধির লেশ অজ্ঞান রাবণে।।
শতেক ইন্দ্রের নাহি এত পরিচ্ছদ।
কি কারণে নষ্ট করে এতেক সম্পদ।।
এইমত চিত্তে রাম করেন বিচার।
হেথায় রাবণ আসি কৈল মহামার।।
সেনাপতি সেনাপতি হইল সংগ্রাম।
ইন্দ্রজিৎ লক্ষ্মণ, রাক্ষসপতি-রাম।।
রণেতে পণ্ডিত রাম যুদ্ধে পরিপাটী।
মাথার মুকুট দশ ফেলিলেন কাটি।।
লজ্জা পেয়ে পলাইল রাজা দশানন।
উভয় সৈন্যেতে আর নাহি দরশন।।
তবে রাম পাঠালেন বালির নন্দনে।
অনেক ভৎসিল গিয়া রাজা দশাননে।।
অঙ্গদের বাক্যে দশানন দুঃখমতি।
পাঠাইল বহু বহু শ্রেষ্ঠ সেনাপতি।।
মুনি বলে, সেই কথা কহিতে বিস্তর।
সংক্ষেপে কহিব শুন ধর্ম্ম নৃপবর।।
বজ্রদন্ত মহাবাহু মহাকায় আদি।
প্রহস্ত করিল যুদ্ধ, নাহিক অবধি।।
পড়িল রাক্ষস সেনা নাহি পরিমিত।
ক্রোধভরে আসে তবে বীর ইন্দ্রজিত।।
করিল রাক্ষসী মায়া বহু বহু রণে।
নাগপাশে বন্দী কৈল শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।
গরুড় স্মরিয়া রাম পবন আদেশে।
নাগপাশে মুক্ত হৈলা প্রকার বিশেষে।।
গর্জ্জিয়া বানরগণ করে সিংহনাদ।
শুনিয়া রাবণ রাজা গণিল প্রমাদ।।
বিস্ময় মানিয়া অতি চিন্তাকুল মনে।
মহাপাশ মহোদরে পাঠাইল রণে।।
আর চারি সেনাপতি রাবণ কুমার।
মহাক্রোধ আসি সবে করে মহামার।।
শিলা বৃক্ষ লয়ে যুদ্ধ করিল বানর।
অস্ত্রশস্ত্রে বিশারদ যত নিশাচর।।
উভয় সৈন্যেতে যুদ্ধ হৈল অপ্রমিত।
ছয় সেনাপতি মরে সৈন্যের সহিত।।
শুনিয়া রাবণ রাজা গণিল প্রমাদ।
পুণর্ববার আসে তবে বীর মেঘনাদ।।
অপূর্ব্ব রাক্ষসী মায়া ইন্দ্রজিৎ জানে।
দেখিতে না পায় কেহ থাকে কোন্ স্থানে।।
করিল সংগ্রাম ঘোর রাবণ সন্ততি।
চারি দ্বারে মারিল প্রধান সেনাপতি।।
থাকুক অন্যের কার্য্য শ্রীরাম লক্ষ্মণে।
জিনিয়া পরম সুখে কহিল রাবণে।।
কেবল জীবিত মাত্র ছিল তিন জন।
হনুমান, সুষেণ, রাক্ষস বিভীষণ।।
উপদেশ কহিলেন সুষেণ প্রধান।
গন্ধমাদন গিরি আনিল হনূমান।।
ঔষধি চিনিয়া দিল বানর সুষেণ।
আপনি বাটিয়া দিল রক্ষ বিভীষণ।।
যেই মাত্র পাইলেন ঔষধের ঘ্রাণ।
যত ছিল মৃত সৈন্য, সবে পায় প্রাণ।।
মৃত সৈন্য প্রাণ পায় হনূর প্রসাদে।
কাঁপিল রাবণ বানরের সিংহনাদে।।
তবে বহু যুদ্ধ করি মরে অকম্পন।
ভয় পেয়ে কুম্ভকর্ণে জাগায় রাবণ।।
নিদ্রা হতে উঠি যায় রাজ সম্ভাষণে।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল ভাই দুই জনে।।
বিভীষণে জিজ্ঞাসিল কহ সমাচার।
সত্তর যোজন উচ্চ শরীর কাহার।।
তবে বৃথা কি কারণে করিতেছ রণ।
রাক্ষসের মায়া কিছু না বুঝি কারণ।।
বিভীষণ বলে, ভয় ত্যজহ অন্তর।
কুম্ভকর্ণ নামে মোর্এক সহোদর।।
পূর্ব্বে ব্রহ্মা বর দিয়া কৈল নিরূপণ।
নিদ্রা ভাঙ্গি জাগাইলে অবশ্য মরণ।।
পাচঁ মাসে জাগাইল ভয় পেয়ে মনে।
সন্দেহ নাহিক আজি, মরিবেক রণে।।
এত যদি কহিলেন রক্ষ বিভীষণ।
তুষ্ট হয়ে রাম তারে দেন আলিঙ্গন।।
রাবণ কহিল কুম্ভকর্ণে সমাচার।
ক্রোধে মহাবীর আসি কৈল মহামার।।
গিলিল বানর একেবারে শতে শতে।
বাহির হইল কেহ নাক-কান-পথে।।
দেখিয়া বিকট মূর্ত্তি ধায় সৈন্যগণ।
অস্ত্র যুড়ি অগ্রে যান কমললোচন।।
রামে দেখি কম্ভকর্ণ ধায় গিলিবারে।
সত্বর মারেন রাম ব্রহ্ম-অস্ত্র তারে।।
সেই বাণে মরিল দুরন্ত নিশাচর।
পুষ্পবৃষ্টি করিলেন যতেক অমর।।
ভীত হইল রাবণ, সৈন্য নাহি আর।
কি প্রকারে এ বিপদে পাইবে নিস্তার।।
বানর পড়িয়া লঙ্কা কৈল ছারখার।
কাহারে পাঠাব যুদ্ধে, কে করিবে পার।।
ভাবিয়া পাঠায় শেষে মকরাক্ষ বীরে।
সে আমি অনেক যুদ্ধ করিল সমরে।।
বহু যুদ্ধ করি মৈল শ্রীরামের বাণে।
কুম্ভ ও নিকুন্ত পরে প্রবেশিল রণে।।
বল বুদ্ধি বিক্রমেতে বাপের সমান।
প্রাণপণে যুঝিল সুগ্রীব হনূপান।।
দুই ভাই পড়ে ক্রমে সহ সর্ব্বসেনা।
তবে ইন্দ্রজিৎ বীরে নাহি সম্ভাবনা।।
তবে ইন্দ্রজিতে আজ্ঞা দিল দশানন।
সসৈন্য মারহ তুমি শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
সংহতি লইয়া তবে সেনা অপ্রমিত।
যুদ্ধ হেতু অগ্রসর হয় ইন্দ্রজিত।।
ক্রোধে আসি মেঘনাধ করে বহু রণ।
তেমতি করিল যুদ্ধ ঠাকুর লক্ষ্মণ।।
সংহতি লইয়া তবে সেনা অপ্রমিত।
যুদ্ধ হেতু অগ্রসর হয় ইন্দ্রজিত।।
ক্রোধে আসি মেঘনাদ করে বহু রণ।
তেমতি করিল যুদ্ধ ঠাকুর লক্ষ্মণ।।
মায়ায় রাক্ষস যুদ্ধ করে বহুতর।
দেখাদেখি মহাযুদ্ধ হৈল পরস্পর।।
সহিতে নারিল যুদ্ধ রাবণ নন্দন।
ভঙ্গ দিয়া প্রবেশিল নিজ নিকেতন।।
প্রবেশ করিয়া সেই যজ্ঞ আরম্ভিল।
হেনকালে বিভীষণ লক্ষ্মণে কহিল।।
যজ্ঞ আরম্ভিল দেব রাবণ-কুমার।
যজ্ঞ সাঙ্গ হৈলে মৃত্যু নাহিক উহার।।
বিধিবাক্য আছে হেন, আমি জানি ভালে।
তবে সে মারিতে পার যজ্ঞ নষ্ট কৈলে।।
শুনিয়া হইল সবে হরষিত মন।
যজ্ঞ নষ্ট কৈল গিয়া পবন নন্দন।।
তবে ব্রহ্মা-অস্ত্রে তারে মারিল লক্ষ্মণ।
নিশ্চিন্তে হইল স্বর্গে সহস্র-লোচন।।
বার্ত্তা পেয়ে শোকাকুল রাক্ষসের পতি।
রাবণ আসিল রণে অতি ক্রোধমতি।।