১০৬তম অধ্যায়
কালকবৃক্ষীয়ের উপায়ান্তর উপদেশ—জনকবৃত্তান্ত
“ক্ষেমদর্শী কহিলেন, “ব্ৰহ্মণু! আমি প্রভূততর [অত্যধিক] ধনলাভ করিবার নিমিত্ত কাপট্য [কপটতা], দাম্ভিকতা বা অধর্ম্মাচরণ করিতে বাসনা করি না। আমি পূৰ্বেই আপনাকে কহিয়াছি যে, যাহাতে কেহ আমাকে পাপাত্মা বলিয়া শঙ্কা না করে এবং যাহাতে সমস্ত হিতকাৰ্য্য সুসিদ্ধ হয়, আপনি এরূপ উপদেশ প্রদান করুন। ইহলোকে অনৃশংসধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া অবস্থান করাই আমার উদ্দেশ্য; সুতরাং আমি কদাপি উক্তরূপ পাপজনক কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে পারিব না। আর আপনারও আমাকে এরূপ উপদেশ দেওয়া উপযুক্ত নহে।
“তখন মহর্ষি কহিলেন, রাজন্! তুমি স্বভাবতঃ অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন ও অশেষ গুণে ভূষিত। অতএব তুমি আপনার স্বভাবের অনুরূপ কথাই কহিয়াছ। এক্ষণে আমি যত্নপূৰ্ব্বক তোমার সহিত জনকের শাশ্বত সন্ধিসংস্থাপন করিয়া দিব। তুমি রাজ্য হইতে নিরাকৃত ও এরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াও অনৃশংসবৃত্তিদ্বারা জীবনধারণ করিতে বাসনা করিতেছ; অতএব কোন্ মহীপতি তোমার ন্যায় সৎকুলোদ্ভব শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন প্রজারঞ্জক মহাত্মাকে লাভ করিয়া অমাত্যপদে অভিষিক্ত না করিবেন? আজ আমি সত্য প্রতিজ্ঞ বিদেহাধিপতিকে আমার ভবনে আনয়নপূর্ব্বক তোমার সহিত সন্ধিস্থাপন করিতে অনুরোধ করিব। তিনি আমার বাক্যে কখনই অনাস্থা করিবেন না।
“অনুর মহর্ষি কালকবৃক্ষীয় বিদেহাধিপতিকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “রাজন! এই ক্ষেমদর্শী রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। আমি ইহার সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত আছি। ইনি শরৎকালীন শশধরের ন্যায় বিশুদ্ধ। আমি বিশেষ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি, ইহার কিছুমাত্র দোষ নাই। অতএব তুমি আমার ন্যায় ইঁহার প্রতি বিশ্বাস করিয়া ইঁহার সহিত সন্ধিস্থাপন কর। রাজা অমাত্য ভিন্ন তিনদিনও রাজ্যশাসন করিতে সমর্থ হয়েন না। অমাত্যের আবার অসাধারণ শৌর্য্য ও ধীশক্তি থাকা আবশ্যক। অতএব তুমি ইঁহাকে অমাত্যপদে নিযুক্ত করিয়া ইঁহার শৌর্য্য ও বুদ্ধিমত্তাপ্রভাবে উভয় লোকে মঙ্গল লাভ কর। উপযুক্ত অমাত্যের সাহায্যের ন্যায় ধৰ্ম্মাত্মা ব্যক্তিদিগের সদগতিলাভের উৎকৃষ্ট উপায় আর কিছুই নাই। এই মহাত্মা রাজতনয় সজ্জনোচিত পদবী অবলম্বন করিয়াছেন, অতএব ইহাকে সংগ্রহ করিয়া উপযুক্ত সম্মান করিলে তোমার সমুদয় শত্ৰুই বশীভূত হইবে। আর দেখ, যদি ইনি তোমাকে জয় করিবার বাসনায় কুলাচরিত ক্ষত্রিয়জনোচিত যুদ্ধধর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়েন, তাহা হইলে তোমাকেও জয়াভিলাষে উহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। অতএব আমার বাক্যানুসারে যুদ্ধ করিয়া সন্ধিস্থাপনপূর্ব্বক ইঁহাকে বশীভূত কর। এক্ষণে অনুচিত কাম লোভ ও বিদ্রোহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মপরায়ণ হওয়াই তোমার আবশ্যক। জয় ও পরাজয়ের কিছুই স্থির নাই। অনেকে শত্রুকে পরাজয় করিতে গিয়া স্বয়ং তাহার নিকটই পরাজিত হয়। অতএব দণ্ড অপেক্ষা ভোজনাদি-দানদ্বারা শত্রুকে বশীভূত করা উচিত। যিনি শত্রুর সর্ব্বনাশ করিতে উদ্যত হয়েন, তাঁহার আপনার সর্ব্বনাশের বিলক্ষণ সম্ভাবনা।
“মহর্ষি কালকবৃক্ষীয় এই কথা কহিলে জনকরাজ তাঁহাকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আপনি আমাদিগের হিতকামনায় যাহা কহিলেন, ইহা আমাদিগের উভয়েরই পরম হিতকর; অতএব আমি অবিচারিতচিত্তে [বিনা বিচারে–নিঃসন্দিগ্ধ হৃদয়ে] অচিরে উহা সম্পাদন করিব।
“মিথিলাধিপতি মহর্ষিকে এই কথা বলিয়া কোশলরাজকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি ধৰ্ম্ম ও নীতি অনুসারে সমস্ত পরাজয় করিয়াছি, তুমিও আমার নিকট পরাস্ত হইয়াছ; কিন্তু আমি জয় করিয়াছি বলিয়া তোমাকে অবজ্ঞা করি না। প্রত্যুত, তোমার বুদ্ধি ও পৌরুষের সবিশেষ প্রশংসা করি। অতএব তুমি যথাবিধি সম্মানিত হইয়া আমার ভবনে গমনপূৰ্ব্বক অবস্থান কর।’
“অনন্তর বিদেহাধিপতি জনক ও কোশলরাজ ক্ষেমদর্শী উভয়ে সেই মহর্ষিকে পূজা করিয়া বিদেহনগরে যাত্রা করিলেন। জনকরাজ কোশলরাজকে আপনার গৃহে আনয়নপূৰ্ব্বক পাদ্য, অর্ঘ্য ও মধুপর্কদ্বারা পূজা করিয়া তাঁহাকে স্বীয় কন্যা ও বিবিধ ধনরত্ন সম্প্রদান করিলেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! সন্ধিই নরপতিগণের প্রধান ধৰ্ম্ম। জয় ও পরাজয়ের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই।”