দশরথ শুনি তবে রামের প্রস্থান।
হা রাম হা রাম বলি ত্যজিল পরাণ।।
পূর্ব্বেতে আছিল অন্ধ মুনির এ শাপ।
মরিবে পুত্রের শোকে পেয়ে মনস্তাপ।।
হেনমতে নৃপতির হইল মরণ।
অযোধ্যার ঘরে ঘরে উঠিল রোদন।।
বিচার করিল পাত্রমিত্রগণ যত।
দূত পাঠাইয়া দেশে আনিল ভরত।।
ভরত শুনিল আসি সব সমাচার।
জননীরে নিন্দা করি করে তিরস্কার।।
নৃপতির সৎকার কৈল সেইক্ষণে।
ভরতেরে বলে সবে বৈস সিংহাসনে।।
ভরত কহিল, সবে হৈলে জ্ঞানহত।
সে কারণে বলিতেছ অজ্ঞানের মত।।
পিতৃসত্য হেতু প্রভু চলিলেন বনে।
আমি রাজা হইয়া বসিব সিংহাসনে।।
এমত অনীতি কর্ম্ম করে কোন্ লোকে।
ঈশ্বর থাকিতে রাজ্য সম্ভবে সেবকে।।
বিশেষে মায়ের কর্ম্ম শুনিতে দুষ্কর।
চল সবে যাই শীঘ্র রামের গোচর।।
মাগিয়া মায়ের দোষ প্রভুর চরণে।
যত্নে ফিরাইব সবে কমললোচনে।।
যেমন করিয়া বেশ রাম যান বন।
তেমন বাকল পরি ভাই দুই জন।।
শিরে জটাভার ধরি তপস্বীর বেশ।
চিত্রকূট পর্ব্বতেতে পেলেন উদ্দেশ।।
অষ্টাঙ্গ লোটায়ে ক্ষিতি পড়িল চরণে।
করযোড়ে কহিলেন রাম বিদ্যমানে।।
আজন্ম আমার মন জানহ গোঁসাই।
তোমার চরণ বিনা অন্য গতি নাই।।
মোরে দেখি কর ক্ষমা, জননীর দোষ।
কৃপা করি কর দূর মনের আক্রোশ।।
চল প্রভু, নরপতি হবে সিংহাসনে।
শূন্য রাজ্য, বিলম্ব না সহে সে কারণে।।
তব বনযাত্রা বার্ত্তা শুনি লোকমুখে।
প্রাণ ত্যজিলেন পিতা সেই মনোদুঃখে।।
তবে রাম শুনিলেন সব সমাচার।
পিতৃশোকে কান্দিলেন পেয়ে শোকভার।।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দিলেন পেয়ে মহাতাপ।
সেইমতে সর্ব্বজন করিল সন্তাপ।।
ভরতের চরিত্রেতে তুষ্ট রঘুনাথ।
আলিঙ্গন করি অঙ্গে বুলালেন হাত।।
কি দোষ তোমার ভাই, কেন হেন কহ।
প্রাণের সমান তুমি কভু দোষী নহ।।
জননীর কিবা দোষ, দৈবের ঘটন।
দেশে গেলে পিতৃসত্য হইবে লঙ্ঘন।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ আমি নিবসিব বনে।
ততদিন রাজা হয়ে বৈস সিংহাসনে।।
ভরত কহিল, ইহা শোভা নাহি পায়।
কিমতে সিংহের ভার জম্বূকে কুলায়।।
তবে যদি সত্য প্রভু করিবে পালন।
চতুদ্দর্শ বর্ষ বাস কর তুমি বন।।
পাদুকা যুগল তব দেহ নরপতি।
নতুবা, রহিব আমি তোমার সংহতি।।
ভরতের ব্যবহারে কমললোচন।
তুষ্ট হয়ে পুনর্ব্বার দেন আলিঙ্গন।।
পাদুকা দিলেন রাম বুঝি মনোরথ।
মাথায় করিয়া সুখে চলিল ভরত।।
দেশে আসি পাদুকা রাখিয়া সিংহাসনে।
চতুর্দ্দিকে তাহা বেড়ি বসে সর্ব্বজনে।।
সাবধানে রাত্রি দিনে পালে রাজধর্ম্ম।
ইহা বিনা ভরতের নাহি অন্য কর্ম্ম।।
চিত্রকুট গিরিবরে শ্রীরাম লক্ষ্মণে।
পিতৃশ্রাদ্ধ করিলেন চতুর্দ্দশ দিনে।।
লক্ষ্মণ কহিল, প্রভু চল হেথা হৈতে।
পুনর্ব্বার ভরত আসিবে তোমা নিতে।।
এইমত বিচার কিরয়া তিন জনে।
কতক্ষণে যান অগস্ত্যের তপোবনে।।
কারণ জানিয়া মুনি পরম আদরে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে নিল আপনার ঘরে।।
দিনেক বিঞ্চয়া তথা মাগেন বিদায়।
জিজ্ঞাসিল, কহ মুনি বঞ্চিব কোথায়।।
জানিয়া ভবিষ্য কথা কহে তপোধন।
আশ্রম করহ সুখে পঞ্চবটী বন।।
শুনিয়া গেলেন রাম আনন্দিত মন।
সহিত জানকী আর অনুজ লক্ষ্মণ।।
মুহূর্ত্তেকে উপনীতপঞ্চবটী বনে।
আশ্রম করেন রাম যথাযথ স্থানে।।
রহিলেন বহুদিন পঞ্চবটী বনে।
একদিন শুন তথা দৈবের ঘটনে।।
সূর্পণখা নামে রাবণের সহোদরা।
স্বচ্ছন্দ গমনে ফিরে, অত্যন্ত মুখরা।।
চতুর্দ্দশ সহস্র সংহতি নিশাচর।
খর ও দূষণ সঙ্গে দুই সহোদর।।
দূর হৈতে দেখে দোঁহে দিব্য রূপধারী।
কামে হত চিত্তা হয়ে দুষ্ট নিশাচরী।।
সীতার সমান রূপ ধরিয়া রাক্ষসী।
বিনয়ে কহিল সেই রাম পাশে আসি।।
নিবেদন করি, আমি দেবের দুহিতা।
ভজিব তোমারে, আজ্ঞা করহ সর্ব্বথা।।
শ্রীরাম কহেন, তুমি ভজ অন্য জনে।
সঙ্গেতে আমার নারী, দেখ বিদ্যমানে।।
এত শুনি লক্ষ্মণেরে কহিল রাক্ষসী।
লক্ষ্মণ কহিল, আমি আজন্ম তপস্বী।।
তবে সূর্পণখা অতিশয় দুঃখমনে।
কার্য্য সিদ্ধি না হইল সীতার কারণে।।
ইহারে খাইলে দুঃখ খণ্ডিবে আমার।
এত বলি ধায় মুখ করিয়া বিস্তার।।
দেখিয়া লক্ষ্মণ ক্রোধে এড়িলেন বাণ।
দিব্য অস্ত্রে রাক্ষসীর কাটে নাক কাণ।।
কান্দিয়া রাক্ষসী খর দূষণেরে কয়।
দোঁহে আসি যুদ্ধ দিল ক্রোধে অতিশয়।।
দেখিয়া উঠেন রাম অতি ক্রোধমনে।
মুহূর্ত্তেকে সংহারিল নিশাচরগণে।।
তাহা দেখি সূর্পণখা নিশাচরগণে।
কান্দিয়া কহিল গিয়া রাবণের আগে।।
শুন ভাই বলি, দশরথের নন্দন।
ভার্য্যা সহ বনে আসে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
চতুর্দ্দশ সহস্র রাক্ষস মারে বানে।
নাক কাণ কাটে মোর অস্ত্র খরশানে।।
যতেক কামিনী আছে এই ত্রিজগতে।
সীতা সম রূপবতী না পাই দেখিতে।।
দেখিয়া আনন্দ বড় হৈল মোর মনে।
আনিতে করিনু ইচ্ছা তোমার কারণে।।
তাহাতে এ গতি মোর শুন মহাশয়।
বুঝিয়া করহ কার্য্য উচিত যে হয়।।
অনুক্ষণ রক্ষা করে দুই মহাবীর।
হরিয়া আনিতে সীতা মন কর স্থির।।
শুনিয়া রাবণ হৈল ক্রোধেতে অজ্ঞান।
বিশেষ দেখিয়া ভগিনীর অপমান।।
সীতার রূপের কথা ভেদিল অন্তরে।
কাছে ডাকি অবিলম্বে বল মারীচেরে।।
যাহ শীঘ্রগতি তুমি পঞ্চবটী বনে।
মায়া করি দূরে লহ শ্রীরায় লক্ষ্মণে।।
আপনি যাইব ধরি তপস্বীর বেশ।
সীতারে হরিব যেন না পায় উদ্দেশ।।
মারীচ কহিল, রাজা মোর শক্তি নয়।
আছে যে রামের বাণে ভাল পরিচয়।।
বালক কালের শিক্ষা আমি জানি ভালে।
মুনি-যজ্ঞ-নষ্ট হেতু গেলাম যে কালে।।
না দেখিয়া অস্ত্র রাম করিল সন্ধান।
প্রবেশিয়া লঙ্কাপুরী রক্ষা কৈনু প্রাণ।।
এখন যৌবন কালে ধরে মহাবল।
এ কর্ম্ম করিলে, তবে পাব ভাল ফল।।
ইহা শুনি দশানন ক্রোধচিত্ত হয়ে।
মারীচে কাটিতে যায় হাতে খড়গ লয়ে।।
ভয়েতে মারীচ বলে, যাব পঞ্চবটী।
তুমিই কাটহ, কিবা রাম ফেলে কাটি।।
অসহ্য তোমার বাক্য রাক্ষস দুর্জ্জন।
তুমি মার কিংবা রাম অবশ্য মরণ।।
এত বলি চলিল মারীচ নিশাচর।
রাবণ চলিল রথে হরিষ অন্তর।।
উত্তরিল মারীচ যথায় রঘুবর।
কাঞ্চনের মৃগ, অঙ্গ দেখিতে সুন্দর।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া সীতা হরিষ অন্তর।
আনিতে কহিল রামে যুড়ি দুই কর।।
সীতার রক্ষণে রাখি লক্ষ্মণ ঠাকুরে।
মায়ামৃগ খেদাড়িয়া রাম যান দূরে।।
কতক্ষণে শ্রীরাম মারেন দিব্য শর।
ভাই রে লক্ষ্মণ বলি পড়ে নিশাচর।।
ইহা শুনি বিস্ময় মানিয়া সীতা মনে।
শেষে পাঠাইয়া দিল তথায় লক্ষ্মণে।।