১০৫তম অধ্যায়
কৌরব-পাণ্ডব সঙ্কুলযুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহাবীর ধনঞ্জয় সেই সমুদয় সুশর্ম্মার অনুচর ভূপতিগণকে নিশিতসায়কদ্বারা শমনসদনে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সুশর্ম্মা বাসুদেবকে সপ্ততি ও অর্জ্জুনকে নয়বাণে বিদ্ধ করিলেন। মহারথ অর্জ্জুন শরনিকরদ্বারা সুশর্ম্মার শরজাল নিবারণ করিয়া তাঁহার সহচর যোদ্ধৃগণকে যমালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। যোদ্ধৃগণ যুগান্তকালীন কৃতান্তসদৃশ প্রভাবশালী পার্থের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ভয়ব্যাকুলিতচিত্তে কেহ অশ্ব, কেহ রথ ও কেহ গজ পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। অনেকে রথ, অশ্ব ও গজসমুদয় লইয়া সত্বর প্রস্থান করিতে লাগিল। পদাতিগণ অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক সমরে নিরপেক্ষ হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইল।
“এইরূপে কৌরবসৈন্যগণ ত্ৰিগৰ্তরাজ সুশর্ম্মা ও অন্যান্য ভূপতিকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলে কুররাজ দুৰ্য্যোধন ত্রিগর্তের জীবনরক্ষার্থ মহারথ ভীষ্মকে অগ্রসর করিয়া অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। তৎকালে কেবল মহাবীর দুৰ্য্যোধনই ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে বহুবিধ শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক সমরাঙ্গনে অবস্থান করিতে লাগিলেন; আর সকলেই পলায়ন করিল। এদিকে পাণ্ডবগণও সর্বোদ্যোগসহকারে বর্ম্ম ও বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের প্রভাব অবগত ও শক্রগণের হাহাকারে উত্তেজিত হইয়া শান্তনুতনয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর ভীষ্ম সন্নতপর্ব্বশরনিকরদ্ধারা পাণ্ডবসৈন্যগণকে সমাচ্ছাদিত করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে মধ্যাহ্নসময়ে কৌরবগণ পাণ্ডবদিগের সহিত ঘোরতর সমর আরম্ভ করিলেন। মহাবীর সাত্যকি পাঁচবাণে কৃতবর্ম্মকে বিদ্ধ করিয়া সহস্ৰ-সহস্ৰ শরবর্ষণপূর্ব্বক সংগ্রামস্থলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহারাজ দ্রুপদ প্রথমতঃ দ্রোণকে বহুসংখ্যক সুশাণিতশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহাকে সপ্ততি ও তাঁহার সারথিকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর ভীমসেন মহারাজ বাঁহ্লীককে শরনিকরে বিদ্ধ করিয়া কাননস্থ শার্দুলের ন্যায় চীৎকার করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত অভিমন্যু চিত্রসেনের বহুসংখ্যক শরে বিদ্ধ হইয়া তাঁহার হৃদয়ে দৃঢ়রূপে তিনবাণ বিদ্ধ করিলেন। এই ধনুৰ্দ্ধরদ্বয় সংগ্রামে সমাগত হইয়া আকাশমণ্ডলস্থ বুধ ও শনৈশ্চরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অরতিনিপাতন অর্জ্জুনতনয় নয়বাণে চিত্ৰসেনের অশ্বচতুষ্টয় ও সারথিকে সংহার করিয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহারথ চিত্ৰসেন সেই অশ্ববিহীন রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সত্বর দুর্ম্মুখের রথে সমারূঢ় হইলেন। মহাবীর দ্রোণাচার্য্য সন্নতপর্ব্বশরনিকরে দ্রূপদের দেহ ভেদ করিয়া সত্বর তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। মহারাজ দ্রুপদ এইরূপে দ্রোণকর্ত্তৃক দৃঢ়তর নিপীড়িত হইয়া পূর্ব্ববৈর স্মরণপূর্ব্বক বায়ুবেগগামী অশ্বসমুদয় সঞ্চালনপূর্ব্বক সমরস্থল হইতে পলায়ন করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন সর্ব্বসৈন্যসমক্ষে মুহূৰ্তমধ্যে বাহ্লীকের অশ্বসমুদয় ও সারথিকে বিনষ্ট করিলে পুরুষোত্তম বাহ্লীক যৎপরোনাস্তি সম্ভ্রান্ত ও সংশয়াপন্ন হইয়া স্বীয় রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক সত্বর লক্ষ্মণের রথে সমারূঢ় হইলেন।
“এদিকে মহাবীর সাত্যকি কৃতবর্ম্মাকে সমরে নিরাকৃত করিয়া শরজালবর্ষণপূর্ব্বক ভীষ্মের সমীপে গমন করিলেন এবং তাঁহাকে নিশিত লোমসনাথ ষষ্টিশরে বিদ্ধ করিয়া শরাসন বিধূননপূর্ব্বক যেন নৃত্য করিতে করিতে রথোপস্থে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর শান্তনুতনয় সাত্যকির উপর সুবর্ণচিত্রিতা মহাবেগশালিনী নাগকন্যাসদৃশী মহাশক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাযশাঃ সাত্যকি এই মৃত্যুসদৃশ দুর্জ্জয় শক্তি অৰ্দ্ধপথে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তাহা তৎক্ষণাৎ মহাপ্রভাৎসম্পন্ন মহোল্কার ন্যায় ধরাতালে নিপতিত হইল। মহাবীর সাত্যকি ভীষ্মের শক্তিচ্ছেদন করিয়া কনকসমুজ্জ্বল স্বীয় শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক শান্তনুতনয়ের রথাভিমুখে নিক্ষেপ করিলেন। সাত্যকিনির্ম্মুক্ত মহাশক্তি কালরাত্রির ন্যায় মহাবেগে আগমন করিতেছে দেখিয়া, শান্তনুতনয় নিশিত ক্ষুরপ্রদ্বয় নিক্ষেপ করিয়া সেই ভীষণ শক্তিকে সহসা দুইখণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর শান্তনুতনয় এইরূপে সত্যকির শক্তি ছেদন করিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহার বক্ষঃস্থলে নয়বাণ নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহারথ পাণ্ডুতনয়গণ সাত্যকির পরিত্রাণ নিমিত্ত অসংখ্য রথ, নাগ ও অশ্ব লইয়া ভীষ্মকে পরিবেষ্টন করিলেন। পরে পরস্পর বিজয়াকাঙ্ক্ষী কৌরব ও পাণ্ডবগণের ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল।”