১০৫তম অধ্যায়
উভয়পক্ষীয় বীরগণের ধ্বজচিহ্ন বর্ণন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাণ্ডবপক্ষীয় ও অস্মৎপক্ষীয় সেই বিবিধাকার অসামান্য শোভা সম্পন্ন ধ্বজ সমুদায়ের বিষয় কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহারথগণের রথস্থিত নানা প্রকার ধ্বজ সমূহের নাম ও আকার ও বর্ণ বর্ণন করিতেছি শ্রবণ করুন। সংগ্রামস্থলে মহারথদিগের রথোপরি সুবর্ণভরণভূষিত, সুবর্ণমাল্যমণ্ডিত, সুবর্ণময় বিবিধ প্রকার ধ্বজ-সমুদয় প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় ও অত্যুচ্চ সুমেরু-পর্ব্বতের কাঞ্চনশৃঙ্গের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। ঐ সমুদয় ধ্বজের উপরিস্থিত নানারাগ-রঞ্জিত, ইন্দ্রায়ুধ প্রতিম, বিচিত্র পতাকা সকল বায়ুবিকম্পিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, নর্ত্তকীরা রঙ্গমধ্যে নৃত্য করিতেছে।
গাণ্ডীবধন্বা ধনঞ্জয়ের ধ্বজস্থিত পতাকা সমলঙ্কৃত, সিংহ লাঙ্গলধারী, বিকটাস্য, ভীষণাকার কপিবর সংগ্রামস্থলে কৌরব পক্ষীয় সৈন্যগণের ত্ৰাসোৎপাদন করিতে লাগিল। মহাবীর অশ্বত্থামার শক্ৰধ্বজ সদৃশ, পবনকম্পিত, বালসূৰ্য্যপ্রতিম, অত্যুচ্ছ্রিত, কাঞ্চনময় ধ্বজাগ্রভাগ কৌরবগণের হর্ষ বর্দ্ধন করিল। মহাবীর কর্ণের মাল্য ও পতাকা যুক্ত সুবর্ণময় হস্তিকক্ষাধ্বজ বায়ুবিকম্পিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, উহা আকাশমার্গ ভেদ করিয়া নৃত্য করিতেছে। পাণ্ডবগণের আচাৰ্য্য তপঃসম্পন্ন গোতমতনয়ের রথে বৃষধ্বজ শোভা পাইতে লাগিল। ত্রিপুরবিজয়ী দেবাদিদেব মহাদেব বৃষদ্বারা যেরূপ শোভমান হন, গোতমপুত্র মহাত্মা কৃপাচার্য্য সেই রথস্থ বৃষভধ্বজ দ্বারা তদ্রূপ শোভা ধারণ করিলেন। সেইরূপ মহাত্মা বৃষসেনের ধ্বজে মণিরত্নাদি মণ্ডিত ময়ূর সেনাগ্রভাগ শোভিত করিয়া বিরাজিত হইতে লাগিল। ঐ ময়ূর হঠাৎ নেত্রপথে পতিত হইলে বোধ হয়, যেন উহা কিছু বলিতে বাসনা করিয়াছে। মহাত্মা বৃষসেন সেই ময়ুর দ্বারা সমরাঙ্গনে কার্ত্তিকেয়ের ন্যায় শোভমান হইলেন। মদ্ররাজ শল্যের ধ্বজাগ্রভাগে সর্ব্ববীজ প্রসবিনী শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবতার ন্যায় অগ্নিশিখাকার সুবর্ণময় লাঙ্গল শোভা পাইতে লাগিল। সিন্ধু রাজ জয়দ্রথের ধ্বজোপরি বালার্কসদৃশ হেমাভরণ ভূষিত বরাহ নয়নগোচর হইল। পূৰ্ব্বকালে দেবাসুর যুদ্ধ সময়ে সূৰ্য্য যেমন শোভমান হইয়াছিলেন, মহাবীর জয়দ্রথ সেই বরাহ দ্বারা সেইরূপ শোভা ধারণ করিলেন। যজ্ঞশীল ধীমান সৌমদত্তির কনকময় যূপধ্বজ মখশ্রেষ্ঠ রাজসূয় যজ্ঞের উচ্ছ্রিত যূপের ন্যায় বিরাজমান হইতে লাগিল। ঐরাবত যেমন দেবরাজের সৈন্যগণকে শোভিত করে, তদ্রূপ মহাবীর শলরাজের ধ্বজস্থিত বিচিত্র সুবর্ণময় ময়ূর সমুদায়ে পরিশোভিত মাতঙ্গধ্বজ আপনার সৈন্যগণের শোভা সম্পাদন করিল। আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন রথস্থ সুবর্ণ মণ্ডিত শব্দায়মান কিঙ্কিণী শত সমাযুক্ত মণিময় নাগধ্বজ দ্বারা অতীব শোভমান হইলেন। হে রাজন্! আপনার পক্ষীয় এই নয় মহাধ্বজ যুগান্তকালীন সূর্যের ন্যায় আপনার বাহিনী মণ্ডল প্রদীপ্ত করিল। তন্মধ্যে মহাবীর অর্জ্জুনের এক মাত্র বানরধ্বজ শোভা পাইতে লাগিল। হুতাশন দ্বারা হিমাচল যেরূপ দেদীপ্যমান হয়, মহাবীর ধনঞ্জয় ধ্বজস্থিত কপি দ্বারা তদ্রূপ প্রদীপ্ত হইলেন।
কৌরবাক্রমণে পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে কোলাহল
অনন্তর শত্রুতাপন মহারথগণ অর্জ্জুনকে পরাভব করিবার নিমিত্ত বিচিত্রাকার বৃহৎ শরাসন সমুদায় গ্রহণ করিতে লাগিলেন। তখন অদ্ভুতকৰ্ম্মা অর্জ্জুনও স্বীয় শত্রু বিনাশন গাণ্ডীব ধনু গ্রহণ পূর্ব্বক বাণবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার শর প্রভাবে, আপনার দুৰ্ম্মন্ত্রণা নিবন্ধন নানা দিগ্দেশ হইতে অভ্যাগত প্রভূত হস্তী, অশ্ব ও রথসম্পন্ন বহুতর নরপতিরা কালকবলে নিপতিত হইতে লাগিলেন। তখন দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি মহারথগণ ও মহাবীর অর্জ্জুন পরস্পরের প্রতি গর্জ্জন করত পরস্পরকে ভৎসনা করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারাজ! ঐ সময় কৃষ্ণসারথি মহাবীর ধনঞ্জয় সেই সকল মহারথিগণকে পরাজয় ও জয়দ্রথকে সংহার করিবার মানসে একাকী তাঁহাদের সহিত সংগ্রামে মিলিত হইয়া সর্ব্বাপেক্ষা শোভা পাইতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই বিস্ময়াপন্ন হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীব বিধুনন ও শরজাল বিস্তার করত কৌরব পক্ষীয় যোধগণকে অদৃশ্য করিলেন;
তাঁহারাও চতুর্দ্দিক হইতে শরবর্ষণ করিয়া শত্রুতাপন অর্জ্জুনকে অদৃশ্য করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে পাণ্ডুনন্দন অর্জ্জুন অরাতি শরনিকরে অদৃশ্য হইলে সৈন্য মধ্যে কোলাহল ধ্বনি সমুত্থিত হইল।”