ধর্ম্ম কহে, অতঃপর কহ মহাঋষি।
কি কার্য্য সাধেন হরি মরধামে আসি।।
পরিণয় হয় কিবা নয় কহ মুনি।
কেবা হয় রামপত্নী কহ মোরে শুনি।।
মুনি কন, মিথিলার জনক রাজর্ষি।
বহুদিন লাঙ্গলেতে যজ্ঞভূমি চষি।।
তথায় জন্মিল লক্ষ্মী অযোনিসম্ভবা।
পাইল লাঙ্গলমুখে পরম দুর্ল্লভা।।
জন্ম অনুরূপ নাম রাখিলেন সীতা।
কন্যার পালনে রাণী পরম সুস্থিতা।।
এ দিকে কারণ জানি যাবতীয় দেবে।
সঙ্গোপনে শিবধনু রাখিলেন সবে।।
জনকেরে কহিলেন সুরগণ ডাকি।
লক্ষ্মীর সমান এই তোমার জানকী।।
দুর্জ্জয় হরের ধনু ভাঙ্গে যেই জন।
তাহারে জানকী দিবে, কর এই পণ।।
সেইরূপ রাজঋষি প্রতিজ্ঞা করিল।
পত্র দিয়া পৃথিবীর নৃপতি আনিল।।
ধনুক দেখিয়া সবে ডরে পলাইল।
দুই চারি পরাভবে কেহ না আসিল।।
যেরূপে বিবাহ করিলেন রঘুবীর।
শুনহ পূর্ব্বের কথা, রাজা যুধিষ্ঠির।।
রাবণের অনুচর রাক্ষস রাক্ষসী।
যজ্ঞ আরম্ভিলে মুনি নষ্ট করে আসি।।
যজ্ঞ রক্ষা কারণে বিচার করি মনে।
বিশ্বামিত্র মুনি গেল দশরথ স্থানে।।
মুনি দেখি পূজে রাজা আনন্দিত মন।
জিজ্ঞাসিল এখানে কি হেতু আগমন।।
মুনি বলে, যজ্ঞ নষ্ট করে নিশাচরে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে দেহ যজ্ঞ রাখিবারে।।
শুনি রাজা বিচারিল পাছে দেয় শাপ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ গেলে হইবে সন্তাপ।।
দুই মতে বিপরীত বুঝিয়া রাজন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে করিলেন সমর্পণ।।
দোঁহে সঙ্গে করি মুনি যান হরষেতে।
হেনকালে তাড়কা সহিত দেখা পথে।।
যেমন উদয় ঘোর কাদম্বিনী-মাল।
গলে মুণ্ডমালা পরিধান বাঘছাল।।
দেখিয়া রাক্ষসী মূর্ত্তি ভীত মহাঋষি।
নির্ভয় করিয়া রাম মারেন রাক্ষসী।।
তবে দোঁহে লয়ে গেল যজ্ঞের সদন।
শ্রীরামের বলিলেন সব বিবরণ।।
শুন রাম, সদা নাহি রহে হেথা দুষ্ট।
আরম্ভ করিলে যজ্ঞ, আসি করে নষ্ট।।
যজ্ঞধূম নিরখিলে করে রক্তবৃষ্টি।
কোথায় থাকয়ে, কার নাহি চলে দৃষ্টি।।
শ্রীরাম কহেন, সবে হইয়া নির্ভয়।
যজ্ঞ কর, আসুক ঐ বক্ষ দুরাশয়।।
কেবল তোমার মাত্র চরণ প্রসাদে।
কোন ছার রাক্ষসেরে নাশিব অবাধে।।
এতেক শুনিয়া মুনিগণ মহাসুখে।
আরম্ভ করিল যজ্ঞ মনের কৌতুকে।।
হেনকালে নভোমার্গে হেরি ধূমচয়।
আইল মারীচ দুষ্ট জানিয়া সময়।।
মেঘেতে আচ্ছাদিল রাক্ষসের মায়া।
যজ্ঞভূমি আচ্ছাদিল রাক্ষসের ছায়া।।
দেখিয়া সকল মুনি শ্রীরামেরে কয়।
ঐ দেখ আইল রাম রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
মহাধানুকী শ্রীরাম দেখিয়া নয়নে।
যুড়েন ঐষিক বাণ ধনুকের গুণে।।
মহাশব্দ করি বাণ অগ্নি হেন জ্বলে।
গর্জ্জিয়া উঠিল বাণ গগন-মণ্ডলে।।
পলাইল নিশাচর মনে পেয়ে শঙ্কা।
লুকাইয়া রহে ত্রাসে প্রবেশিয়া লঙ্কা।।
নিরাপদে যজ্ঞ করে যত মুনিগণে।
আশীর্ব্বাদ করে বহু শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।
যজ্ঞ শেষে বিশ্বামিত্র আনন্দিত মন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে নিয়া করিল গমন।।
রামেরে কহিল পথে ধনুকের কথা।
শুনিয়া বলেন রাম, চল যাই তথা।।
হেনমতে সঙ্গে করি দুই সহোদরে।
উত্তরিল মহামুনি মিথিলা নগরে।।
দেখিয়া রামের রূপ চিন্তা করে মনে।।
বিচার করিয়া দেবী মানিল বিস্ময়।
কুলিশ সমান এই ধনুক দুর্জ্জয়।।
মধুর কোমল মূর্ত্তি শ্রীরঘুনন্দন।
হায় বিধি কৈল পিতা নিদারুণ পণ।।
অন্য অন্য পরস্পরে কথোপকথন।
হরিষ বিষাদে এইমত সর্ব্বজন।।
বিশ্বামিত্র মুখে রাম হয়ে অবগত।
ভাঙ্গিবারে শরাসন হলেন উদ্যত।।
দৃঢ় করি কাঁকালি বান্ধিয়া বস্ত্র সারি।
ধনুক তুলেন রাম বামহাতে ধরি।।
হেনকালে যোড়করে ঠাকুর লক্ষ্মণ।
সমাদরে বলিলেন যত দেবগণ।।
বাসুকিরে বলিলেন, ক্ষণ হও স্থির।
যাবৎ ধনুকে গুণ দেন রঘুবীর।।
শুনহ সকল নাগ অষ্ট কুলাচলে।
সাবধানে ধর ধরা যেন নাহি টলে।।
লক্ষ্মণ কহিল রামে করি যোড় হাত।
শীঘ্রগতি শরাসন ভাঙ্গ রঘুনাথ।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরে করিয়া প্রণাম।
দেবগণে করিলেন বন্দনা শ্রীরাম।।
মুনিগণে প্রণমিয়া দেব হৃষীকেশে।
নোয়াইয়া ধনুর্গুণ দেন অনায়াসে।।
যখন ধনুকে হাঁটু দিল রঘুমণি।
থর থর তখনি যে কাঁপিল মেদিনী।।
মুনি ঋষি সিদ্ধগণ ভাবিতে লাগিল।
মনুষ্য নহেন রাম, তখনি জানিল।।
পুনর্ব্বার পঙ্কারিয়া দিতে মাত্র টান।
মাঝখানে ভাঙ্গি ধনু হৈল দুই খান।।
শত বজ্রাঘাত জিনি মহাশব্দ হৈল।
আছুক অন্যের কাজ, বাসুকি টলিল।।
সেই শব্দ শুনি তবে লঙ্কার রাজন।
বলিল আমারে এই করিবে নিধন।।
এই মতে শরাসন ভাঙ্গে রঘুবীর।
মিথিলা নগর হৈল আনন্দ মন্দির।।
যুধিষ্ঠির বলে, মুনি এ বড় বিস্ময়।
পূর্ণ অবতার বিষ্ণু রাম মহাশয়।।
আপনারে প্রণমিল কিসের কারণ।
কৃপা করি কর মুনি সন্দেহ ভঞ্জন।।
মুনি বলে, শুন যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
সত্যযুগে হৈল এই অপূর্ব্ব কাহিনী।।
হিরণ্যকশিপু দৈত্য বধে নারায়ণ।
বিরাট নৃসিংহ মূর্ত্তি হলেন যখন।।
তাঁহার চীৎকার শব্দ শুনিয়া নির্ঘাত।
গর্ভিণী ব্রাহ্মণীর হইল গর্ভপাত।।
শাপ দিল সে ব্রাহ্মণী পেয়ে দুঃখভার।
যেই জন করিলেক এত অহঙ্কার।।
আপনা না জানিবে সে অন্য অবতারে।
বল বুদ্ধি পাসরিবে এই অহঙ্কার।।
ব্রাহ্মণীর অভিশাপ বৃথা নহে কভু।
ব্রহ্ম-পদাঘাত বুকে ধরিলেন প্রভু।।
বিস্মৃত হলেন আপনারে সে কারণ।
ব্রহ্মার বিধানে পূর্ব্বে রাবণ নিধন।।
সে কারণে হন প্রভু মনুষ্য-শরীর।
পূর্ব্ব বৃত্তান্ত এই, কহিনু যুধিষ্ঠির।।
দুর্জ্জয় ধনুক যদি ভাঙ্গিলেন রাম।
জনক রাজার হৈল পূর্ণ মনস্কাম।।
সীতা-সম্প্রদান হেতু বিচারিল মনে।
শুনিয়া কহেন রাম জনকের স্থানে।।
অযোধ্যা নগরে দূত পাঠাও রাজন।
পিতাকে জানাও আগে আমার মনন।।
সহিত আসিবে আর ভাই দুই জন।
বিবাহ করিব তবে এই নিরূপণ।।
জনক পাঠান তবে শীঘ্র দূতগণে।
কহিল সকল কথা নৃপতির স্থানে।।
শুনিয়া হলেন রাজা আনন্দে পূরিত।
দুই পুত্র সহ রাজা আইল ত্বরিত।।
মহাকোলাহল শব্দ চতুরঙ্গ দলে।
বেষ্টিত হইয়া রাজা মহা কুতূহলে।।
মিথিলা নগরে আসিলেন দশরথ।
জনক আইল আগুসরি কত পথ।।
সমাদরে অভ্যর্থনা করে বহু মান।
শুভক্ষণে রামে সীতা কৈল সম্প্রদান।।
সীতানুজা কন্যা ছিল পরমা রূপসী।
লক্ষ্মণে প্রদান কৈলে সুখে রাজঋষি।।
জনকের সহোদর কুশধ্বজ নাম।
দুই কন্যা ছিল তাঁর রূপে অনুপাম।।
ভরত শত্রুঘ্ন দোঁহে করাইল বিভা।
বৈকুন্ঠ জিনিয়া হৈল মিথিলার শোভা।।
চতুর্দ্দিকে মুনিগণ করে বেদধ্বনি।
আনন্দে পূরিল দশরথ নৃপমণি।।
দুই ভ্রাতা কৈল তবে চারি কন্যা দান।
কৌতুকে যৌতুক দিল নাহি পরিমাণ।।
দশরথ নৃপতিরে পূজিল বিশেষে।
আনন্দ বিধানে রাজা যান নিজ দেশে।।
মুনিগণে প্রণমিল ক্রমে সর্ব্ব জন।
আশীর্ব্বাদ করি সবে করিল গমন।।
শীঘ্রগতি যায় রাজা উঠি নিজ রথে।
হেনকালে ভৃগুরাম আগুলিল পথে।।
দুর্জ্জয় শরীর তার দেখে লাগে ভয়।
গভীর গর্জ্জনে ক্রোধে রঘুবীরে কয়।।
দুগ্ধপোষ্য শিশু তুমি রণে কর আশা।
মম নাম ধর তুমি এতেক ভরসা।।
ক্ষত্রকুলান্তক আমি জানে সর্ব্ব জনে।
সেই কথা পরীক্ষা করিব বিদ্যমানে।।
তোরে না করিলে বধ লুপ্ত হয় নাম।
পৃথিবীর মধ্যে যেন থাকে এক রাম।।
হরের ধনুক ভাঙ্গি হৈলি বলবান।
জীর্ণধনু ভাঙ্গিয়াছ, কি তার বাখান।।
দশরথ নৃপবর পেয়ে বড় ভয়।
করযোড়ে কৈল স্তুতি, অনেক বিনয়।।
না জানিয়া কৈল কর্ম্ম হইয়া অজ্ঞান।
সেবক বলিয়া মোরে দেহ পুত্রদান।।
পিতৃ-দুঃখ দেখি তবে রাম মহাশয়।
হাসিয়া কহেন, পিতা না করিহ ভয়।।
ডাকিয়া কহেন রাম তবে ভৃগুরামে।
কি হেতু তোমার দুঃখ হৈল মম নামে।।
যাত বিপ্র ত্যজ আজি, পূর্ব্ব অহঙ্কার।
অবধ্য ব্রাহ্মণ বলি পাইলে নিস্তার।।
নহে এত অপমান সহে কার প্রাণে।
দহিবারে পারি ক্ষিতি আমি এক বাণে।।
যখন ক্ষত্রিয় সহ তোমার সংগ্রাম।
সেইকালে মহীতলে নাহি ছিল রাম।।
কহিলে, শিবের ধনু ছিল পুরাতন।
দেখিব তোমার ধনু, দেহ ত কেমন।।
এত শুনি ভৃগুরাম ধনু লয়ে হাতে।
ক্রোধভরে বাড়াইয়া দেন রঘুবীরে।।
তবে রাম গুণ দিয়া যুড়ি দিব্য শর।
হাসিয়া কহেন, শুন ওহে দ্বিজবর।।
অবধ্য ব্রাহ্মণ তুমি, ব্যর্থ নহে বাণ।
শীঘ্র কহ, তোমার রোধিব কোন্ স্থান।।
হতবুদ্ধি হয়ে তবে কহিল ভার্গব।
না জানিয়া করি দোষ, ক্ষমা কর সব।।
স্বর্গ অভিলাষ নাই তব দরশনে।
স্বর্গপথ রুদ্ধ করি রাখ এই বাণে।।
তবে রাম স্বর্গপথ বাণে কৈল রোধ।
দেখিয়া সকলে করে চমৎকার বোধ।।
বিনয় করিয়া ভৃগুরাম গেল বনে।
দশরথ রাজা গেল আপন ভবনে।।
বিবাহ করিয়া যান চারি সহোদর।
আনন্দ মন্দির হৈল অযোধ্যা নগর।।
শাস্ত্রপাঠ নিমিত্ত ভরত মহাশয়।
শত্রুঘ্ন সহিত গেল মাতামহালয়।।