১০২তম অধ্যায়
বৃত্ৰবধে অসুরগণের ব্রাহ্মণহিংসা
লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! কালকেয়গণ সাগরমধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ত্ৰৈলোক্য-বিনাশে প্রবৃত্ত হইল। তাহারা জাতক্ৰোধ হইয়া যামিনীযোগে আশ্রম ও পুণ্যায়তনবাসী ঋষিগণকে ভক্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। সেই দুরাত্মা অসুরেরা এইরূপে বশিষ্ঠাশ্রমে প্রবেশ করিয়া একশত সপ্তনবতি বিপ্ৰ ও অন্যান্য তাপসীগণকে ভক্ষণ করিল ও অতিপবিত্র দ্বিজসেবিত চ্যবনাশ্রমে গমন করিয়া শতসংখ্যক ফলমূলাদি ঋষিকে কবলিত করিল। এইরূপ ভরদ্বাজের আশ্রমে প্রবেশ করিয়া কেবল বায়ুভুক ও জলাহারী বিংশতিসংখ্যক ব্ৰাহ্মণকে বিনাশ করিল। তাহারা রাত্ৰিতে এইরূপ দৌরাত্ম্য করিয়া দিবাভাগে সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিত। সমুদয় আশ্রম ভুজবীৰ্য্যশালী কালোপসৃষ্ট কালকেয়গণের উৎপাতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। ভূরি ভূরি ব্রাহ্মণগণ প্রাণ পরিত্যাগ করিলেন; কিন্তু কেহই তাহাদিগের অনুসন্ধান করিতে পারিলেন না।
“দুরাত্মা দানবদল তাপসাগণের প্রতি প্রতিদিন রজনীতে এইরূপ অন্যায়াচরণ করিতে আরম্ভ করিল। প্ৰভাতে কেবল নিয়মাহারকৃশ তাপসগণ গতজীবিত হইয়া ধরাতলে পতিত রহিয়াছেন, ইহাই দৃষ্ট হইত। তত্ৰত্য ভূমিখণ্ড মাংস, শোণিত, মজ্জা ও অন্তবিহীন, সুতরাং শঙ্খরাশিসদৃশ মৃতকলেবরে আকীর্ণ হইয়া রহিয়াছে, নয়নগোচর হইত। ভগ্ন কলস, সুব ও অগ্নিহোত্ৰসকল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকিত; বেদপাঠ ও বিষট্কার আর শ্রবণগোচর হইত না; যজ্ঞ উৎসব ও ক্রিয়াকলাপ একেবারে বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছিল। ফলতঃ সমুদয় জগৎ কালকেয়কুলের ভয়ে সম্যাকুল ও নিরুৎসাহ হইয়া উঠিল।
অসুরকর্ত্তৃক বিপ্ৰধ্বংস-সমুদ্রপলায়ন
“এইরূপে লোকসংখ্যার সংক্ষয় হইতে আরম্ভ হইলে অবশিষ্ট মানবগণ ভীত হইয়া আত্মরক্ষার নিমিত্ত দিগদিগন্তে পলায়ন করিতে লাগিল। কেহ বা পর্ব্বত-গুহায় প্রবেশ করিল; কেহ বা নির্ব্বারসমীপে লুক্কায়িত হইয়া প্রাণরক্ষা করিল; কেহ বা মৃত্যুভয়ে ভীত হইয়া প্ৰাণ পরিত্যাগ করিল। কোন কোন মহাধনুৰ্দ্ধর বীরপুরুষগণ হৃষ্টষ্টচিত্ত হইয়া যত্নাতিশয়সহকারে দানবগণের অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইল; কিন্তু দানবগণ সমুদ্রগর্ভে অবস্থিতি করাতে কেহই তাহাদিগের বৃত্তান্ত অবগত হইতে সমর্থ হইল না, বরং কালক্রমে ক্রমে ক্ৰমে শ্ৰান্ত হইয়া ক্ষয়প্রাপ্ত হইল।
“দানবগণের দৌরাত্ম্যে পৃথিবী নষ্টপ্রায় এবং যজ্ঞ, উৎসব ও ক্রিয়াকলাপ বিলুপ্ত হইলে ত্ৰিদশগণ দুস্তর দুঃখে নিপতিত ও নিতান্ত পীড়িত হইয়া উঠিলেন। অনন্তর মহেন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ মন্ত্রণা করিয়া বৈকুণ্ঠে গমনপূর্ব্বক ভগবান নারায়ণের শরণাপন্ন হইলেন এবং নমস্কারপূর্ব্বক স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন, “হে জগৎপ্ৰভো! তুমি আমাদের স্রষ্টা, কর্ত্তা ও সংহর্ত্তা; তুমি এই চরাচর বিশ্ব সৃষ্টি করিয়াছ। হে কমললোচন! পূর্ব্বে এই পৃথিবী বিনষ্ট হইয়াছিল, তুমি বরাহবিগ্ৰহ পরিগ্রহ করিয়া তাহার উদ্ধার করিয়াছ। তুমি নরসিংহ আকার স্বীকার করিয়া মহাবলপরাক্রান্ত আদিদৈত্য হিরণ্যকশিপুর প্রাণসংহার করিয়াছ। তুমি বামনরূপ অঙ্গীকার করিয়া সকলের অবধ্য বলিপ্ৰধান বলিকে ত্ৰৈলোক্যভ্রষ্ট করিয়াছ। তুমিই যজ্ঞের বিঘ্নস্বরূপ মহাসুর জম্ভাসুরকে বিনাশ করিয়াছ। হে মধুসূদন! তুমি এবম্প্রকার অসংখ্য ব্যাপার সম্পন্ন করিয়াছ; অতএব তুমিই ভয়বিহ্বল সুরগণের শরণস্থান। হে দেবদেবেশ! এক্ষণে তুমি সমুদয় লোক, দেবগণ ও দেবেন্দ্রকে এই মহাভয় হইতে পরিত্ৰাণ কর।’