১০২তম অধ্যায়
বিজয়ী সেনার লক্ষণ–বিবিধ যুদ্ধনীতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কোন্ কোন্ লক্ষণ সৈন্যগণের জয়সূচনা করিয়া থাকে?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যে লক্ষণ দৃষ্ট হইলে সৈন্যগণের জয়প্রত্যাশা করা যায়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। দৈবপ্রতিকূলতাবশতঃ মানবগণ কালকবলে নিপতিত হইতে আরম্ভ করিলে বিদ্বান ব্যক্তিরা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ঐ বিষয় সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া প্রায়শ্চিত্ত ও জপ প্রভৃতি বিবিধ মঙ্গলকাৰ্য্যের অনুষ্ঠানদ্বারা সেই দৈবদুর্ঘটনার উপশম করিয়া থাকেন। যে সৈন্যের মধ্যে যোধগণ ও বাহনসকল হৃষ্টচিত্ত থাকে, সেই সৈন্যের নিঃসন্দেহ জয়লাভ হয়। সৈন্যগণের যাত্রাকালে বায়ু মন্দ মন্দ প্রবাহিত, ইন্দ্রধনু উদিত, মেঘ ও সূর্য্যরশ্মি প্রকাশিত এবং শৃগাল, কাক ও গৃধ্রগণ অনুকূল হইলে সিদ্ধিলাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা। ধূমশূন্য হুতাশনের রশ্মি ঊৰ্দ্ধগত ও শিখা দক্ষিণাবর্ত্ত, যজ্ঞের পবিত্র গন্ধ অনুভূত, শঙ্খ ও ভেরীসমুদয় গম্ভীরশব্দে নিনাদিত এবং যোধগণ প্রসন্নচিত্ত হইলে জয়লাভের আর কোন সংশয় থাকে না। মৃগগণ সৈন্যসমুদয়ের সমরযাত্রাকালে বামভাগ বা পশ্চাদ্ভাগে এবং তাহাদের অরাতিনিধনে প্রবৃত্ত হইবার সময় দক্ষিণভাগে অবস্থান করিলে শুভসূচক বলিয়া পরিগণিত হয়। উহারা সৈন্যগণের অগ্রসর হইলে কোনমতেই সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই। হংস, ক্রৌঞ্চ [বক], শতপত্র [ময়ূর] ও ভাস [কুক্কুট] প্রভৃতি বিহঙ্গমগণ মঙ্গলসূচক শব্দ করিলে এবং যোধগণ পুলকিতচিত্ত হইলে ভাবী জয়লাভ প্রতীয়মান হইয়া থাকে। যাহাদিগের সৈন্যগণ অস্ত্র, যন্ত্র, কবচ, ধ্বজ ও মুখবর্ণপ্রভাবে নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হয়, তাহারা নিশ্চয়ই শত্রুগণকে পরাজিত করিতে পারে। যাহাদিগের যোধগণ শুচি, শুশ্রূষাপরতন্ত্র, অনভিমানী ও পরস্পর সৌহার্দ্দ্যসম্পন্ন, তাহাদিগের জয়লাভে কিছুমাত্র সংশয় নাই। শব্দ, স্পর্শ ও গন্ধসকল সুখজনক এবং যোধগণ ধৈৰ্য্যশালী হইলে জয়লাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা। সমপ্রবেশোদ্যত ব্যক্তির বামপার্শ্বস্থ ও সমরপ্রবিষ্ট ব্যক্তির দক্ষিণপার্শ্বস্থ কাক অনুকূল হইয়া থাকে। কাক পশ্চাদ্গত হইলে শুভসূচক এবং সম্মুখস্থ হইলে অশুভজ্ঞাপক হয়।
“চতুরঙ্গিণী সেনা সংগ্রহ করিয়াও প্রথমে সান্ত্ববাদদ্বারা শত্রু সহিত সন্ধিস্থাপনের চেষ্টা করিবে। সন্ধিস্থাপনে কোনমতে কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারিলে যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য। সংগ্রাম করিয়া শত্রুকে পরাজয় করিলে সেই জয়লাভ জঘন্য বলিয়া পরিগণিত হয়। যুদ্ধে জয়লাভ হওয়া দৈবায়ত্ত। সৈন্যগণ সমর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলে, জলের বিষম বেগের ন্যায় ও ভীতচিত্তে পলায়মান মৃগযূথের ন্যায় উহাদিগকে নিবারণ করা নিতান্ত কঠিন হইয়া উঠে। সৈনিক পুরুষেরা পলায়নে প্রবৃত্ত হইয়াছে শ্রবণ করিলে তন্মধ্যস্থ যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ বীরগণও সমর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করেন। আবার পঞ্চাশজন মাত্র মহাবীর পরস্পর মিলিত, জীবিতনিরপেক্ষ ও যত্নবান হইয়া অসংখ্য অরাতিসৈন্য নিপীড়িত করিতে পারেন। অনেক স্থলে একত্র সমবেত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পাঁচ, ছয় বা সাতজন মাত্র সৎকুলোদ্ভব বীরপুরুষকে প্রভূত অরাতি পরাজয়পূৰ্ব্বক জয়লাভ করিতে দেখা গিয়াছে, অতএব রাজা অপরিমিত বলশালী হইলেও প্রথমে যুদ্ধযাত্রা করিবেন না। সাম, দান ও ভেদদ্বারা কাৰ্য্যসিদ্ধি না হইলেই যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য।
“অরাতিগণের রাজ্যমধ্যে যুদ্ধার্থে সৈন্যসমুদয় প্রেরণ করিলেই ভীরুগণ তাহাদিগকে বজ্রের ন্যায় জ্ঞান করিয়া ভীত হয়। আর যাহারা বিজয়বাসনায় সেই সৈন্যগণকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হয়, তাহাদিগেরও গাত্র হইতে অনবরত স্বেদধারা নির্গত হইতে থাকে। ঐ সময় বিপক্ষগণের সমুদয় রাজ্য ব্যথিত ও অস্ত্রপ্রতাপে বীরগণের মজ্জা অবসন্ন হইতে থাকে; অতএব রাজা শত্রুর প্রতি সান্ত্ববাদ প্রয়োগ ও তাহাকে ভয় প্রদর্শনার্থ তাহার রাজ্যে সৈন্য প্রেরণ করিবেন। ঐরূপ কৌশল করিলে অরাতির সহিত সন্ধি হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। অরাতির আত্মীয়ভেদ উৎপাদন করিবার নিমিত্ত চর প্রয়োগ ও তাহার শত্রুর সহিত সন্ধি স্থাপন করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। শত্রুর বিপক্ষগণের সহিত মিলিত ও তাহাকে নিপীড়িত করাই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেয়স্কর।
“ক্ষমাগুণ সাধুদিগকেই সতত আশ্রয় করিয়া থাকে। অসাধুদিগের নিকট উহা সর্ব্বদা অবস্থান করে না। এক্ষণে তোমার ক্ষমা ও অক্ষমার প্রয়োজন বিদিত হওয়া আবশ্যক। অরাতিবর্গকে পরাজিত করিয়া তাহাদের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করিলে রাজার যশোবৃদ্ধি হয়। ক্ষমাশীল ব্যক্তি অতিশয় অপরাধী হইলেও শত্রুগণ তাহাকে বিশ্বাস করিয়া থাকে। সম্বর কহিয়া গিয়াছেন, বক্র কাষ্ঠকে যেমন অগ্নির উত্তাপ প্রদান না করিয়া সরল করিলে উহা তৎক্ষণাৎ পূৰ্ব্বপ্রকৃতি প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ শত্রুকে নিপীড়ন না করিয়া ক্ষমা করিলে সে অচিরাৎ বৈরাচরণ করিতে আরম্ভ করে; অতএব শত্রুগণকে বিশেষরূপে নিপীড়িত করিয়া পরিশেষে তাহাদিগের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করা উচিত। সৎস্বভাব বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সম্বরাসুরের ঐ মতের প্রশংসা করেন না। শত্রুকে বিনাশ না করিয়া পুত্রের ন্যায় বশীভূত করাই নরপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা উগ্ৰস্বভাব হইলে প্রজাগণের দ্বেষভাজন ও মৃদুস্বভাব হইলে সকলের অবজ্ঞাস্পদ [অবজ্ঞার পাত্র] হইয়া থাকেন; অতএব ভূপতিকে মৃদুতা ও উগ্রতা উভয়ই অবলম্বন করিতে হইবে। লোককে প্রহার করিবার পূৰ্ব্বে ও প্রহার করিবার সময় তাহার প্রতি প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করা ও প্রহার করিয়া বিলাপ ও অনুতাপসহকারে তাহাকে কৃপা প্রদর্শন করা ভূপতির কর্ত্তব্য। রাজা সমরে অরাতিপক্ষীয় বীরগণকে নিপাতিত করিয়া হতাবশিষ্ট শত্রুগণকে নির্জ্জনে আহ্বানপূৰ্ব্বক কাতরস্বরে কহিবেন, ‘আহা! আমার সৈন্যগণ সংগ্রামে ঐ সকল ব্যক্তিকে বিনষ্ট করিয়া আমার নিতান্ত অপ্রিয়চরণ করিয়াছে। আমি আমার সৈন্যগণকে উহাদের প্রাণসংহার করিতে বারংবার নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহারা কোনক্রমেই আমার বাক্য রক্ষা করিল না। হায়! ঐ যে মহাবীর নিহত হইয়াছেন, উনি অদ্বিতীয় সমরবিশারদ। উনি কখন সমর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পলায়ন করেন নাই। উঁহার ন্যায় বীরপুরুষ অতি দুর্লভ। উঁহার নিধনে আমি নিতান্ত অপ্রীত হইয়াছি। ভূপতি এই প্রকারে শত্রুগণকে সান্ত্বনা করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত হত ব্যক্তিদিগের আত্মীয়ের ন্যায় বিলাপ ও পরিতাপ করিবেন। রাজা এইরূপে সকল অবস্থাতেই শান্তিগুণ অবলম্বন করিলে ভয়বিহীন এবং প্রজাগণের প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইতে পারেন। রাজা বিশ্বাসভাজন হইলে তাঁহার সমুদয় কামনা পূর্ণ হয়, সন্দেহ নাই। অতএব যে নরপতি সুস্থচিত্তে পৃথিবী ভোগ করিতে অভিলাষ করেন, তাঁহার মায়া পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সকল লোকের বিশ্বাসপাত্র হইতে চেষ্টা করা আবশ্যক।