১০১তম অধ্যায়
যুদ্ধক্ষেত্রে জয়দ্রথের দর্শনলাভ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় ভূপতিগণ বাসুদেব ও ধনঞ্জয়কে সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া প্রথমত ভয়ে পলায়নোম্মুখ হইলেন। পরিশেষে তাঁহারা সত্বসন্ধুক্ষিত হইয়া ক্রোধভরে স্থিরচিতে ধনঞ্জয়ের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। যাঁহারা ক্রোধোত্তেজিত হইয়া অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে গমন করিলেন, তাঁহারা সাগরে পতিত তরঙ্গিনীর ন্যায় আর প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। তদ্দর্শনে অনেক অসাধু ক্ষত্রিয় বেদ বিমুখ নাস্তিকের ন্যায় নরক গমনের ভয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক সমর পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলেন। তখন পুরুষ শ্রেষ্ঠ কেশব ও অর্জ্জুন দ্রোণের সেনাসমূহ বিদারণ ও রথিগণকে অতিক্ৰম পূর্ব্বক অস্ত্রজাল হইতে বিমুক্ত হইয়া রাহুবদন বিনিঃসৃত চন্দ্র সূৰ্য্যের ন্যায় মহাজাল বিমুক্ত, মকরমুখবিনির্গত মৎস্য দ্বয়ের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতে লাগিলেন এবং মকর যেমন সমুদ্র সংক্ষোভিত করে, সেইরূপ শস্ত্র দ্বারা কৌরব পক্ষীয় সেনাগণকে বিক্ষোভিত করিয়া ফেলিলেন।
হে মহারাজ! যখন মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব দ্রোণাচার্য্যের সৈন্য মধ্যে অবস্থান করিতেছিলেন, তৎকালে আপনার পুত্রগণ ও তৎপক্ষীয় যোদ্ধা সকল মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন কদাপি দ্রোণাচাৰ্য্য ও হার্দ্দিক্যের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবেন না; অতএব সিন্ধুরাজের আর কোন বিপদের আশঙ্কা নাই। জয়দ্রথের জীবিত রক্ষা বিষয়ে কৌরব পক্ষীয়গণের মনে এই বলবর্তী আশার সঞ্চার হইয়াছিল, কিন্তু কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন দ্রোণকে অতিক্রম করিয়া গমন করিলে তাঁহাদের সে আশা একেবারে উম্মলিত হইল। তাঁহারা প্রজ্বলিত পাবক তুল্য প্রতাপশালী মহাবীর কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে দ্রোণসৈন্য ও ভোজসৈন্য অতিক্ৰমণ করিতে দেখিয়া এককালে জয়দ্রথের আশা পরিত্যাগ করিলেন। তখন অরাতিকুল ভয়বর্দ্ধন, নির্ভীকচেতা কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় পরস্পর জয়দ্রথবধবিষয়িনী মন্ত্রণা করিয়া কহিলেন, “কৌরব পক্ষীয় ছয় জন মহারথী জয়দ্রথের চতুর্দ্দিকে অবস্থান পূর্ব্বক উহাকে রক্ষা করিতেছে; কিন্তু ঐ দুরাত্মা একবার আমাদের নয়ন গোচর হইলে কদাচ বিমুক্ত হইতে সমর্থ হইবে না। অধিক কি বলিব, যদি দেবগণের সহিত দেবরাজ স্বয়ং সমরে উহাকে রক্ষা করেন, তথাপি আজি উহার নিস্তার নাই।” হে মহারাজ! মহাবাহু কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন জয়দ্রথকে অন্বেষণ করিয়া পরস্পর এইরূপ কহিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সেই সকল কথা আপনার পুত্রগণের কর্ণ কুহরে প্রবিষ্ট হইল। ঐ সময় মহাবীর কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন মরুভূমি অতিক্ৰমণানন্তর বারি পানে পরিতৃপ্ত মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। বণিকেরা ব্যাঘ্র, সিংহ ও গজ সমাকীর্ণ ভূধর অতিক্রম করিয়া যেরূপ প্রফুল্ল হয়, জরা মৃত্যু বিহীন অরিনিসূদন মধুসূদন ও অর্জ্জুনকে সেইরূপ হৃষ্টচিত্ত বোধ হইতে লাগিল। আপনার পুত্রগণ তদ্দর্শনে চতুর্দ্দিকে চীৎকার করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন প্রজ্বলিত জ্বলন তুল্য, আশীবিষ সদৃশ দ্রোণ, হার্দ্দিক্য এবং অন্যান্য নরপতিগণের শরজাল হইতে বিমুক্ত হইয়া ইন্দ্র ও অগ্নির ন্যায়, দ্যুতিমান ভাস্করদ্বয়ের ন্যায় সমধিক শোভা ধারণ করিলেন! লোকে সমুদ্র হইতে উত্তীর্ণ হইলে যেরূপ হৃষ্ট হয়, উক্ত বীরদ্বয় অর্ণব সদৃশ দ্রোণ সৈন্য হইতে উত্তীর্ণ হইয়া সেই রূপ আহ্লাদিত হইলেন। তাঁহারা ভারদ্বাজের শাণিত শর প্রহারে রুধিরাক্ত
হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, পর্ব্বতদ্বয় মধ্যে কর্ণিকারপুষ্প প্রস্ফুটিত হইয়াছে। সেই মহাবীরদ্বয় শক্তিরূপ আশীবিষ, নারাচরূপ মকর ও ক্ষত্রিয় রূপ সলিলশালী দ্রোণরূপ হ্রদ এবং জ্যাঘোষরূপ অশনি নিস্বন, গদা ও খড়্গ রূপ বিদ্যুৎ সম্বলিত, দ্রোণাস্ত্র রূপ মেঘ হইতে বিমুক্ত হইয়া অন্ধকার বিনির্ম্মুক্ত চন্দ্র সূর্যের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তাঁহারা দ্রোণের অস্ত্রজাল হইতে বিমুক্ত হইলে সকলেরই বোধ হইতে লাগিল যেন, ঐ বীরদ্বয় বাহু দ্বারা বর্ষাকালীন সলিণ্রাশিসমন্বিতযাদোগণসমাকুল সমুদ্রগামী নদী সমুদায় হইতে সমুত্তীর্ণ হইলেন। হে মহারাজ! যেমন ব্যাঘ্ৰদ্বয় মৃগজিঘাংসায় দণ্ডায়মান থাকে, সেই রূপ সেই বীরদ্বয় সমীপস্থ জয় দ্রথের বিনাশেচ্ছায় তাঁহাকে অবলোকন করিয়া অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের মুখবর্ণ নিরীক্ষণ করিয়া কৌরব পক্ষীয় সমুদায় যোধগণ জয়দ্রথকে বিনষ্ট বলিয়া অবধারিত করিলেন।
তখন লোহিত লোচন কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় সিন্ধুরাজকে সন্দর্শন করিয়া হৃষ্টচিত্তে মুহুর্মুহু সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় অভীষু-হস্ত শৌরি ও ধনুষ্মান্ ধনঞ্জয় সূৰ্য্য ও পাবকের সমান প্রতাপশালী হইয়া উঠিলেন। হে মহারাজ! এই রূপে অরাতিনিসূদন মধুসূদন ও ধনঞ্জয় দ্রোণ সৈন্য হইতে মুক্ত হইয়া জয়দ্রথকে সমীপে অবলোকন করিয়া যার পর নাই আহ্লাদিত হইলেন এবং আমিষলোলুপ শ্যেন পক্ষির ন্যায় বিক্রম প্রকাশ পূর্ব্বক ক্রোধভরে সিন্ধুরাজের সমীপে গমন করিতে লাগিলেন। তখন দ্ৰোণ সম্নদ্ধ দুর্ভেদ্য কবচধারী অশ্ব সংস্কারবিৎ বিপুল পরাক্রম রাজা দুৰ্য্যোধন সেই বীরদ্বয়কে সিন্ধুরাজের অভিমুখে ধাবমান হইতে দেখিয়া তাঁহার রক্ষার্থ এক রথে কৃষ্ণ ও পার্থকে অতিক্রম পূর্ব্বক কৃষ্ণের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন কৌরব সৈন্য মধ্যে বিবিধ বাদিত্র বাদিত ও শঙ্খধ্বনির সহিত সিংহনাদ সমুত্থিত হইতে লাগিল। অনল তুল্য তেজস্বী যে যে বীরগণ সিন্ধুরাজের রক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহারা সকলে দুৰ্য্যোধনকে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের পুরোবর্তী দেখিয়া যার পর নাই আহ্লাদিত হইলেন। তখন মহাত্মা কেশব অনুচর পরিবৃত রাজা দুৰ্য্যোধনকে অতিক্ৰমণ করিতে দেখিয়া অর্জ্জুনকে তৎকালোচিত কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন।”