১০০তম অধ্যায়
লোকরক্ষার্থ দধীচি ঋষির আত্মত্যাগ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তম! মহর্ষি অগস্ত্য যে-সকল কর্ম্ম করিয়াছিলেন, পুনরায় তাহা বিস্তাররূপে শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।”
লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! অমিততেজাঃ অগস্ত্যের প্রভাববিষয়িণী অলৌকিকী কথা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। সত্যযুগে কালকেয়নামে কতকগুলি যুদ্ধদুৰ্ম্মদ দানব বৃত্ৰাসুরকে অধিপতি করিয়া বিবিধ আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক মহেন্দ্র প্রভৃতি সুরগণকে চতুর্দ্দিক হইতে আক্রমণ করিয়াছিল। অমরগণ তখন বৃত্ৰাসুরবধে উৎসুক হইয়া পুরন্দরকে পুরঃসর করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ব্ৰহ্মার আরাধনা করিলেন। অনন্তর ভগবান কমলাসন দেবগণকে কহিলেন, “হে দেবগণ! আমি তোমাদিগের অভিলষিত কাৰ্য্য অবগত হইয়াছি, এক্ষণে যে উপায়ে বৃত্ৰাসুরকে বধ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা কহিতেছি। দধীচ বলিয়া বিখ্যাত এক উদারাধী মহর্ষি আছেন, তোমরা সকলে একত্র হইয়া তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক বর প্রার্থনা করিবে; সেই ধর্ম্মাত্মা যখন প্রীতিপ্ৰফুল্লচিত্তে বর প্রদান করিতে উদ্যত হইবেন, তখন তোমরা তাঁহাকে কহিবে, “আপনি ত্ৰৈলোক্যের হিতের নিমিত্ত স্বীয় অস্থিসকল প্ৰদান করুন।” অনন্তর তিনি স্বীয় শরীর পরিত্যাগ করিয়া অস্থি প্রদান করবেন; তদ্দ্বারা ষড়স্র [ছয়টি কোণযুক্ত] ভীমনিম্বন সুদৃঢ় বজ্র বিনির্ম্মিত হইলে পুরন্দর সেই বজ্রে বৃত্ৰাসুরকে বধ করিবেন। আমি যাহা কহিলাম, তোমরা অনতিবিলম্বে সেইরূপ অনুষ্ঠান কর।’
“অনন্তর দেবগণ পিতামহের অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক সরস্বতী নদীর পরপারে দধীচ-মুনির আশ্রমে উপনীত হইলেন। নানাবিধ তরুরাজি ও লতাবিতানে যাহার সুষমা সম্পাদন করিতেছে, যাহাতে সামগানসদৃশ ষট্পদসমূহের সঙ্গীতধ্বনি জীবঞ্জীবক ও পুংস্কোকিলকুলের কলরবসহকারে উত্থিত হইতেছে, যাহাতে মহিষ, বরাহ, সূমর [মুগ] ও চমরীগণ শার্দূল-ভয় পরিত্যাগ করিয়া ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে, যাহাতে মদস্রাবী কারিগণ সরোবরে অবগাহনপূর্ব্বক করেণুকার [হস্তিনী] সহিত ক্রীড়া করিতেছে, যাহাতে গুহাকন্দরশায়ী সিংহ, ব্যাঘ্র ও অন্যান্য বনচরগণ ঘনঘটার ন্যায় ঘোরতর গর্জ্জন করিতেছে, দেবগণ সেই স্বৰ্গসদৃশ শোভমান আশ্রমে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, প্রভাকরপ্রভ দধীচ-ঋষি পিতামহের ন্যায় দীপ্যমানকলেবরে বিরাজ করিতেছেন। অনন্তর সুরগণ তাঁহার চরণগ্রহণপূর্ব্বক অভিবাদন করিয়া ব্রহ্মনির্দ্দিষ্ট বর প্রার্থনা করিলেন।
দধীচি-মুনি অমরগণের প্রার্থনা শ্রবণপূর্ব্বক সাতিশয় আনন্দিত হইয়া কহিলেন, “হে দেবগণ! আমি প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়াও আপনাদিগের উপকার করিব; কোনক্রমেই অভিলষিত বরপ্রদানে পরাঙ্মুখ হইব না।” হিতৈষী মহর্ষি এই কথা কহিয়া সহসা প্ৰাণ পরিত্যাগ করিলে সুরগণ তাঁহার অস্থিসকল গ্রহণ করিয়া জয়লাভের নিমিত্ত হৃষ্টচিত্তে বিশ্বকর্ম্মার সমীপে আগমনপূর্ব্বক আপনাদিগের প্রয়োজন কহিলেন। বিশ্বকর্ম্মা তাহা শ্রবণমাত্র অতিমাত্র হৃষ্টচিত্তে প্ৰযত্নসহকারে দধীচ-মুনির অস্থিদ্বারা অতিশয় উগ্রকান্তি ভীষণ বজ্র নির্ম্মাণ করিয়া পুরন্দরকে কহিলেন, “হে দেবরাজ ইন্দ্ৰ! এই বজ্র দ্বারা ভীষণ সুরারিগণকে নিধন করিয়া স্বগণ-সমভিব্যাহারে সমুদয় স্বৰ্গরাজ্য নির্ব্বিবাদে শাসন করুন।” বিশ্বকর্ম্মার বাক্যাবসান হইলে পুরন্দর আনন্দিত হইয়া বজ্রাগ্ৰহণ করিলেন।”