ক্লারা ও প্রদোষ
ওরা যখন কলকাতা থেকে বেরোয়, তখন আকাশে ঘন মেঘ ছিল। ভোরবেলা থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছিল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কখনও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বাতাস বইছিল এলোমেলো। আগের সন্ধ্যায় টিভিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে কী একটা আসতে পারে বলা হয়েছিল, গুরুদাস বুঝতে পারেননি। ভোরে যখন গ্যারেজ থেকে প্রদোষ গাড়ি বের করছিল, লাল টুকটুকে নতুন ফিয়াট মোটরগাড়ি, গুরুদাস বারান্দা থেকে বলেন, নর্থে জল জমতে পারে রাস্তায়। প্রদোষ কিছু বলল না দেখে ফের বলেন, বিটি রোডে পৌঁছুলে অবশ্যি অসুবিধে হবে না। পুত্রের মেমবউ ক্লারা, ক্লারা গ্যালার রায়, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে অল্পস্বল্প লাগেজ গাড়ির ব্যাকসিটে বোঝাই করে। ক্লারার পরনে লালপেড়ে গরদের শাড়ি। সিঁথিতে বাড়াবাড়ি করা সিঁদুর। শ্বশুর-শাশুড়ির পায়ে গলবস্ত্রে প্রণাম করে এসে গাড়িতে ঢোকে। প্রদোষের গায়ে ফিকে লাল গেঞ্জি, পরনে জিনস, পায়ে বিদেশি কাউবয় জুতো। ক্লারা আস্তে প্রদোষকে বলে প্রণাম করে এলে না? প্রদোষ একবার ঘুরে শুধু বউয়ের দিকে তাকায়, মাছের চোখে। ক্লারা। একটু হাসে। গাড়ি রাস্তায় পৌঁছুলে প্রদোষ বলে, সিগারেট। ক্লারা হাসিখুশি মুখে বলে, তুমি কি ভাবছ আমি সত্যিই সিগারেট ছাড়ি নি? তুমি এমন কথা কেন ভাবছ? প্রদোষ বলে, তুমি একটা–সে থামলে ক্লারা আহ্লাদী হয়ে বলে, বলো, বলো আমি একটা–প্রদোষ বলে না। মিটিমিটি হেসে নিজেই সিগারেট ধরায়। ক্লারা বৃষ্টির ছাঁট সত্ত্বেও জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয় এবং নাকে আঁচল চাপা। দেওয়ার ভঙ্গি করে।
এভাবেই গাড়িটা, টুকটুকে লাল রঙের ফিয়াট মোটর গাড়িটা পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার গতিতে কলকাতা পেরিয়ে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে পৌঁছুলে মেঘ ফুটে সূর্যের ছটা বেরিয়ে এল। রাস্তায় খানাখন্দ, পিচ উঠে ছত্রভঙ্গ স্টোনচিপস, মাঝে মাঝে বাম্প। তাই গাড়িটা সমান গতিতে ছুটতে পারছিল না। কৃষ্ণনগর পৌঁছুতে ঘণ্টা চারেক, তারপর রাস্তাটা মোটামুটি ভালই, যদিও ট্রাক, বাস, টেম্পো যথেষ্ট। দুজায়গায় যুবকরা গাড়ি আটকে পুজোর চাঁদা নিল– ক্লারা অকৃপণ এবং প্রদোষ ক্রুদ্ধ, একটা নদীর ব্রিজ পেরুনোর সময় বলল, দিস ইজ ইন্ডিয়া। ক্লারা বলল, আমার ভাল লাগছে। ওগুলো নিশ্চয় ধানক্ষেত?
প্রদোষ বলল, ধানক্ষেত না পাটক্ষেত আমি জানি না। ক্লারা বলল, একটু থামো। ওই লোকটাকে লোকটার পাশ দিয়ে গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেলে ক্লারা বলল, তুমি একটা প্রদোষ হাসতে লাগল।
আকাশ আবার ঘন মেঘে ঢেকে গেল। কিন্তু শরৎকালের মেঘের স্বাভাবিক গর্জন শোনা যাচ্ছিল না। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল না। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে গাড়িটা বহরমপুর পৌঁছুল কাটায় কাটায় একটায়। ক্লারা বলল, আমি ক্ষুধার্ত। প্রদোষ বলল, চলো, গঙ্গার ব্রিজে গিয়ে খাব। ক্লারা বলল, আঃ! আমি মাছ-ভাত খাব। দিদি বলছিল বহরমপুর হোটেলে মাছ-ভাত পাওয়া যায়। গাড়িটা তখন চলন্ত। প্রদোষ বলল, মৃণালদি একটা-1 ব্রিজটা উঁচু, অত্যন্ত উঁচু। মাঝামাঝি গিয়ে গাড়ি থামাল প্রদোষ। ঘুরে হাত বাড়িয়ে কলো কিটব্যাগটা আনল। ক্লারা নদী দেখছিল। বলল, অবিকল মিসিসিপির মতো। প্রদোষ বলল, মোটেও না। লঞ্চ, স্টিমার, মোটরবোট দেখতে পাচ্ছ কি? ক্লারা বলল, তুমি মিসিসিপির খুব ভেতরটা দেখেছ কি? নিশ্চয় দেখনি! প্রদোষ লাঞ্চ-প্যাকেট বের করতে করতে বলল, ভেতরে মানে? ক্লারা যা বোঝাতে চাইছিল, পারল না। শুধু বলল, এদিকে পাহাড় দেখছি না। ভেবেছিলাম পাহাড় থাকবে। প্রদোষ বলল, কাম বেবি! ক্লারা চটে গিয়ে বলল, তুমি অমন করে কথা বলবে না। প্রদোষ খাচ্ছিল। সেদ্ধ ডিম, সেদ্ধ আলু, মৃণালিনীর হ্যামবার্গার তৈরির চেষ্টা, মাছভাজাও ছিল। খান আষ্টেক ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ, দুটো মাংসের চপ প্রকাণ্ড, পেঁয়াজকুচি ও টমাটোসস, নুন-গোলমরিচ গুঁড়োর প্যাকেট। ক্লারা নাকের ডগা কুঁচকে বলল, দিদিকে কিছু বোঝানো যায় না। প্রদোষ বলল, মাছ তো আছে। খাও। অগত্যা ক্লারা একটা মাছভাজা আলতোভাবে চিবুতে থাকল। নিচে নদীর দিকে দৃষ্টি। তার মিসিসিপি নদীর কথা মনে পড়ছিল। এখন বৃষ্টিটা বন্ধ। মেঘ ভেঙে খানিকটা রোদ গড়িয়ে আসছিল। গাড়ি থেকে নেমে ক্লারা ভাল করে নদীটা দেখতে গেল। বুকসমান উঁচু রেলিঙে ভর করে ঝুঁকে রইল। কিন্তু রোদটা ঢেকে আবার বৃষ্টি এল ঝিরঝিরিয়ে। প্রদোষ ডাকল, ক্লারা! ক্লারা ভিজছে টের পেয়ে গরদের শাড়ি ভাল করে লেপটে জড়িয়ে হাসতে হাসতে গাড়িতে ফিরল। প্রদোষ ঘড়ি দেখে কিটব্যাগ থেকে বিদেশি বিয়ারক্যান বের করছিল। ক্লারা আগেই জানিয়ে দিল, সে শুধু বিশুদ্ধ জল খাবে। প্রদোষ হাসতে হাসতে বলল, তুমি একটা–
একটা রেললাইন পেরিয়ে যাওয়ার পর দুধারে বিশাল মাঠ, জল থইথই অবস্থা, ধানগাছের ডগাটুকু শুধু জেগে আছে। এই রাস্তাটা হাইওয়ে নয়। ঘুরে ঘুরে চলেছে কালো পিচের রাস্তা। মাঝে মাঝে কংক্রিট। কংক্রিটের ফাটলে জল। কোথাও গর্ত আর স্টোনচিপস্। তারপর জনহীন গ্রাম, অথবা রাস্তার ধারে টালি বা তেরপলের ঘরে জড়োসড়ো কিছু লোক, যাদের কয়েকবার চা খাওয়া হয়ে গেছে। দুধারে ক্রমাগত ন্যাড়া উঁচু-উঁচু সব গাছ। ক্লারা জিগ্যেস করেছিল, গাছগুলো এমন হল কেন? প্রদোষ বলেছিল, দেখতে পাচ্ছ না? ডাল কেটে নিয়েছে। ক্লারা বলেছিল, কেন? প্রদোষ বলেছিল, বুঝতে পারছি না। ক্লারা বলেছিল, তুমি ভুল পথে যাচ্ছ না তো? প্রদোষ বলেছিল, চেনা পথ। মামার বাড়ি এপথে অসংখ্যবার গেছি। চলো, তোমাকে দেখাচ্ছি, একবার মামার অ্যামবাসাডার কোথায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। তখন দুপুর রাত্রি। পাশে একটা গাছ থাকায় গাড়িটা আটকে যায়। আসলে তখন রাস্তাটা নতুন। চাকা স্লিপ করেছিল। কারণ প্রচণ্ড বৃষ্টি–না, এমন নয়। রেইনিং ক্যাটস্ অ্যান্ড ডগস্, ইউ নো! ক্লারা হাসছিল। কেন হাসছিল প্রদোষ জানে না। : মামার অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা দেখাতে ভুলে গেল প্রদোষ। এবার অসমতল মাঠ। চড়াই ও উৎরাই। একটা বাঁকের পর রাস্তা ধীরে নেমেছে। দু-ধারে ধানক্ষেত উপচে জল রাস্তা ছুঁতে চেষ্টা করছে। নিচুতে সমতল কিছুদূর একধারের জল অন্যধারের ধানক্ষেতে গিয়ে পড়ছে। গাড়িটা পাতলা জলের স্রোত পেরুচ্ছিল সাবধানে। প্রদোষের মুখ একটু গম্ভীর। ক্লারার মুখে হাসি ঘন হয়ে লেগে আছে। খোঁপা থেকে আঁচল বার বার সরে যাচ্ছিল। মৃণালিনী খোঁপাটা যত্ন করে বেঁধে দিয়েছিল। জল পেরিয়ে যেতে হঠাৎ জোরালো ঝাঁকুনি খেল গাড়িটা। খোঁপাটা কীভাবে খসে গেল। ক্লারা গোছানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।
রাস্তা আবার উৎরাইয়ে উঠতে লাগল। বৃষ্টিটা কমেছে। কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা। গতি বাড়িয়ে আবার একটা বাঁক, বাঁকের মুখে বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, হাসপাতাল, কিছু দোকানপাট, রাস্তার ওপর ভিড়। প্রদোষ তেতো মুখে বলল, আবার চাঁদা! ক্লারা পার্স খুলতে তৈরি হল। ভিড়টা একটা ট্রাকের সঙ্গে কথা বলছিল। ট্রাকটা চলে গেল। প্রদোষের গাড়ি এসে পৌঁছুলে ভিড়টা সামনে দাঁড়াল। প্রদোষ বলল, কী? চাঁদা চাই? ভিড়ের মুখপাত্র সে-কথায় কান না করে বলল, যাবেন না স্যার! তাদের কেউ কেউ গরদের শাড়ি পরা মেমসায়েবটিকে লক্ষ্য করছিল। তারা তত অবাক হয়েছে, মনে হচ্ছিল না। প্রদোষ বলল, কী ব্যাপার? মুখপাত্র বলল, তিলেডাঙ্গা ব্যারেজ থেকে জল ছেড়েছে। প্রদোষ বলল, তাতে কী হয়েছে? এক যুবক খ্যাখ্যা করে হেসে বলল, ছেড়ে দাও নিবারণদা! গিয়ে দেখুন– ফিরে আসতে হবে। যুবকটি ক্লারাকে কেমন চোখে দেখছিল। তাই প্রদোষ, রাগী ও গোঁয়ার প্রদোষকুমার রায়, যাকে ভুল করে ক্লারা প্রথম প্রথম প্রদেশ বলে ডাকত, বলল, সরুন। মুখপাত্র বলল, যাবেন কোথায় স্যার? প্রদোষ বলল, বাদলপুর। মোহিনীমোহন ত্রিবেদী আমার মামা। মুখপাত্র করজোড়ে বলল, নমস্কার স্যার! এম এল এ মশাইকে বলবেন, আমার নাম পাঁচুগোপাল মুখার্জি। তবে আমার মতে, রিস্ক আছে। মৌরীর ওপারে হোল এরিয়া ফ্লাডেড। মৌরী ব্রিজে উঠে যদি তেমন দেখেন, ফিরে আসবেন। আমার বাড়ি, ওই যে দেখছেন, ওই যে–
লাল টুকটুকে ফিয়াট গর্জে উঠে বেরিয়ে গেল। সেই কেমন-চোখ-করে ক্লারাকে-দেখা যুবকটি সম্ভবত শালা মেমওলা বলে গাল দিল। ক্লারা হাসতে হাসতে বলল, প্রদোষ, অ্যাডভেঞ্চার বাংলায় কী? প্রদোষ কিছু বলল না। ক্লারা। বলল, খুব ভাল লাগছে। লোকগুলি খুব ভাল। ওরা আমাদের সাহায্য করতে চাইল। প্রদোষ, তুমি ওদের কথা শুনলে না, সেটাও ভাল লাগছে। বলো না, অ্যাডভেঞ্চারের বাংলা কী।
প্রদোষকে ভালবেসে এবং ভারতকে ভালবেসে ক্লারা গ্যান্সলার এক বছর ধরে বাংলা শিখেছিল। ভালবাসা থেকে একটা ভাষা শেখা, তারপর বউ হওয়া মোট তিনটে বছর লেগে গেছে। ক্লারা বিড়বিড় করে মুখস্থ করছিল, পাঁচুগোপাল মুখার্জি…পাঁচুগোপাল মুখার্জি..পাঁচুগোপাল মুখার্জি।
পাঁচ কিলোমিটার পরে মৌরী নদীর ব্রিজ। ব্রিজের উঁচু অংশে গাড়ি থামাল প্রদোষ। ক্লারা বেরুল। বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা। প্রদোষ বেরিয়ে চোখে বাইনোকুলার রেখে দেখতে দেখতে বলল, রাস্তায় জল। কিন্তু ট্রাকটা তো যাচ্ছে। কী করব? তার প্রশ্নে ঈষৎ কাতরতা ছিল। ক্লারা বাইনোকুলারটা ওর হাত থেকে নিয়ে এক মিনিট দেখার পর বলল, ট্রাকটা চলে গেল। চলো, আমরা যাই। প্রদোষের ঠোঁট ফাঁক হল, কিছু বলার ইচ্ছা। কিন্তু সেই মুহূর্তে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ দিয়ে এক ঝলক হলুদ আলো, তারপর ব্রিজের ডাইনে কাস্তে হাতে একটা প্রায় ন্যাংটা লোক। লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ক্লারা ব্যস্তভাবে হাত নেড়ে তাকে ডাকতে লাগল, আপনি আসুন! আপনি শুনুন! প্রদোষও গলা চড়িয়ে লোকটাকে ডাকল, এই যে ভাই! শোনো, শোনো! লোকটা আসলে ভয় পায়নি। অবাক হয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল কী প্রশ্ন তাকে করা হবে। তাই সে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলতে লাগল, তিলেপাড়া। বেরেজের জল ছেড়েছে। নাবালের গাঁগেরাম ভেসে গেছে। ওই যে বাঁধ। দেখছেন, দেখে এলাম এক্ষুনি, বাঁধে ফাটল ধরেছে। আর দেরি করবেন না। যাবেন তো চলে যান। যান, যান! সে কাস্তে নাড়া দিতে দিতে কথা বলছিল। মেমসায়েব দেখছিল। গরদের শাড়ি পরা মেমসায়েব সে এই প্রথম দেখল। প্রদোষ বুঝতে পারছিল, লোকটি– এই প্রিমিটিভ, প্রায়-ন্যাংটা, যদিও অবাক, তাদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। সে গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিল এবং রেগে গিয়ে দেখল, ক্লারার হাতে ক্যামেরা এবং ক্লারা লোকটির ছবি তুলল। লোকটি হলুদ দাঁত বের করেছিল। ক্লারা গড়িতে ফিরে হাসিখুশি মুখে বলল, লোকটা ভাল। গাড়ি চলতে থাকার সময় সে লোকটার উদ্দেশে হাত নাড়ল। লোকটা সভ্যতা বোঝে। সে তার কাস্তেটা নাড়তে থাকল। ব্রিজের পর ঢালুতে নামতে নামতে ক্লারা জানালা দিয়ে মুখ বের করে মুখটা ঘুরিয়ে সামনে হাত নাড়ছিল। জলের প্রথম স্পর্শে ফিয়াট মৃদুগতি হল। কিংক্রিটস্ল্যাবে চাকা মাঝে মাঝে স্লিপ। করছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রদোষ বলল, জল বাড়ছে। ডাইনে জড়াজড়ি করে থাকা ঝোপজঙ্গল, বাঁদিকে ডুবুডুবু ধানক্ষেত। ক্লারা ঝুঁকে জল দেখছিল। বলল, স্রোত আছে। প্রদোষ ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। কারণ জলটা ক্রমশ বাড়ছে এবং স্রোতটা জোরালো হচ্ছে। গাড়িটা অদ্ভুত গোঁ গোঁ শব্দ করছে। একখানে থেমে গেল। প্রদোষ বলল, ইমপসিল। ব্যাক করতে হবে। ক্লারা বলল, সে কী! প্রদোষ ব্যাকগিয়ার টানল। গাড়িটা পিছু হাটছিল। হটতে হটতে গোঁ গোঁ করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল। প্রদোষ ঠাণ্ডা মাথায় বলল, কারবুরেটারে জল ঢুকেছে।
সে নেমেই হাঁটু জল। সামনে এগিয়ে ঢাকনা তুলে ইঞ্জিনের ভেতর মাথা ঝুলিয়ে দিল। ক্লারা বলল, আমি দেখছি। ক্লারা জলে শাড়ি ভিজিয়ে ইঞ্জিনের কাছে এল। দেখেই বলল, নিরুপায়। প্রদোষ, আমরা এক কাজ করতে পারি। প্রদোষ শুধু ঠাণ্ডা মাথায় বলল, কী? ক্লারা বলল, ঠেলে ব্রিজে নিয়ে যাওয়া কষ্ট নয়, পরিশ্রম হবে। দু-জনে ঠেলতে লাগল, সামনে থেকে। প্রদোষের একহাতে স্টিয়ারিং। কিন্তু জলটা পেছনেও বেড়েছে। বাড়ছে। স্রোত জোরালো হচ্ছে। হাঁটু ছাড়িয়ে জল উঠলে প্রদোষ গলার ভেতর বলল, ইমপসিবল! ক্লারা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল। হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ওটা কী? প্রদোষ চমকে উঠেছিল। বলল, কী? ক্লারা আঙুল তুলে রাস্তার ঝোপজঙ্গলের দিকটা দেখাল। প্রদোষ বলল, এ মাউন্ড! ক্লারা বলল, গাড়িটা থাক। চলো, আমরা ওখানে যাই। তুমি বলছিলে পাহাড় নেই। ওই তো পাহাড়। প্রদোষ করুণ হাসল। আহা, পাহাড় নয়, ওটা একটা মাউন্ড ঢিবি। ক্লারা ব্যস্তভাবে বলল, দেরি কোরো না। জিনিসগুলি তুমি নাও, আমি নিই। চলো, আমরা ওখানে যাই। জল খুব বাড়ছে। এই দেখ জল কোথায় উঠেছে। তার মুখে হাসি। সে গাড়ির দরজা খুললে জল ঢুকে গেল। তার কিটব্যাগ আর মালপোয়ার হাঁড়িটা সে নিল। ক্যামেরা আর তার ব্যাগটা জলের ভেতর খুঁজে পেল না। প্রদোষ হতবাক দাঁড়িয়ে। ক্লারার তাড়ায় সে তার ব্রিফকেসটা তুলে নিল। যখন দু-জনে জলের ভেতর অনেকটা এগিয়ে গেছে, প্রদোষের মনে পড়ল বিয়ারক্যান ভর্তি প্যাকেটটার কথা। বলল, যাক গে! ক্লারার শাড়িটা অসুবিধায় ফেলেছে। জল এদিকে এক কোমর। জঙ্গলে ঢাকা ঢিবিটার কাছে পৌঁছুতে জল বুক ছুঁল। কিন্তু ক্লারা হাসছিল। সামনে পায়ে-চলা, হলুদ, ন্যাড়া একটা পলি রাস্তা উঠে গেছে। দু ধারে শ্লেটপাথরের স্ল্যাব পড়ে আছে। বোঝা গেল, এগুলো একদা সিঁড়ির ধাপ ছিল। খানিকটা উঠে প্রদোষ বসে পড়ল। ক্লারা তাড়া দিল, ওঠ! কিন্তু সেও পা বাড়াল। ঘুরে দেড়শো মিটার দূরে খোলামেলা এবং জলেঢাকা রাস্তায় গাড়িটা, লাল টুকটুকে ফিয়াট গাড়িটা দেখতে লাগল। গাড়িটা ভাসছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। প্রদোষ চুপ। ক্লারা আবার তাকে তাড়া দিল। কারণ বৃষ্টি এসে গেল আবার। প্রদোষকে উঠতে হল। উঠে দাঁড়িয়ে সে আস্তে বলল, শিট! ক্লারা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি একটা–
গাড়িটা, লাল টুকটুকে মোটর গাড়িটা দুলছে। বাঁদিকে সামান্য দূরে শাদা ব্রিজটার দিকে চাকা। ঝর ঝর, প্রপাতের মতো গর্জন। গর্জন হঠাৎ থেমে জলের শব্দ। উঁচু হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পালে পালে ঢেউ আসছে। গাড়িটা দুলতে দুলতে একপাশে কাত হতে হতে ভেসে যেতে থাকল। অতল ধানক্ষেতের ভেতর একটা নিচু গাছের গুঁড়িতে একটুখানি আটকে থাকার পর গাড়িটা, লাল টুকটুকে মটর গাড়িটা ছিটকে বেরিয়ে গেল। ভাসতে ভাসতে, ওল্টটাতে ওল্টটাতে, এক সময়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ক্লারা বলল, আমি দুঃখিত। প্রদোষ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে বলবে ভাবছিল, তোমারই জন্য গাড়িটা গেল। তুমি ভারতের গ্রামের পুজো দেখতে জেদ ধরেছিলে, আমি না। ঢিবিটা উঁচু। প্রদোষ ক্লান্ত। ক্লারা চমৎকার উঠছে। দু ধারে ভাঙাচোরা পাথরের স্ল্যাব। একটা ধ্বংসাবশেষ। গাছপালা ঝোপঝাড় ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমেছে। সামনে ভাঙা নিচু পাথরের দেয়াল, মধ্যিখানে খালি পায়ে-চলা রাস্তা। ক্লারাকে ভেজা শাড়ি জড়ানো কিম্ভুত প্রাণী দেখাচ্ছিল। ক্লারা খুব মজা পাওয়ার মতো করে বলছিল, খুব ভাল। খুব ভাল। তখন প্রদোষ বলল, তুমি একটা
.
ডাঃ ব্ৰজহরি কুণ্ডু
ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু, কাদরা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনপ্রিয় নতুন ডাক্তার, বাহান্ন-চুয়ান্ন বছর বয়স, অনিবার্যভাবে মাথায় টাক, বেঁটে, নাদুসনুদুস, সারাক্ষণ খুশি খুশি ভাব, মুখে ও হাতে বরাভয়, বৃষ্টিবাদলা অগ্রাহ্য করে বর্ষাতি ও টুপি পরে সাইকেল চেপে জিতপুরের কালোবরণ মণ্ডলমশাইকে দেখতে গিয়েছিলেন। দূরত্ব তিন কিলোমিটার, তেমন কিছুই না। তাছাড়া তিনি কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। আইন মেনে চলেন। ঘোর নীতিবাগীশ। রোগীদের হিতোপদেশ দিয়ে থাকেন, অর্থাৎ ওষুধ-পথ্যের সঙ্গে চারিত্রিক ও আচরণীয় সব কিছু। তার নিজস্ব একটি জীবনদর্শন আছে। মুমূর্ষ মণ্ডলমশাইকে তিনি বলছিলেন, প্রতিটি মানুষ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝলেন মণ্ডলমশাই, শুধু সেই জায়গাটুকু যদি সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে পারে, তাহলেই সারা পৃথিবীটা সুন্দর হয়। ব্যসযোগ্য হয়। অবশ্য এই বাক্যটি ব্ৰজহরি কোন বইয়ে পড়ে নোটবইয়ে টুকে রেখেছিলেন। মৃতপ্রায় মণ্ডলমশাই বলেছিলেন, খালি মাথাটা কেমন করছে- এই মাথাটা!
মণ্ডলমশাইয়ের বড়ছেলে বারীন্দ্র প্রাইমারি স্কুল-শিক্ষক। সদর দরজার কাছে ব্ৰজহরির হাতে দশ টাকার নোট গুঁজে দিলে ব্রজহরি খুব চটে গেলেও হাসলেন। তুমি তো জানো বারীন্দ্র, সরকারি রেটের বাইরে আমি এক পয়সা নিইনে। তুমি আমাকে চারটে টাকা দাও।
বারীন্দ্র জিভ কেটে বললেন, ও কী কথা ডাক্তারবাবু! এই দুর্যোগে বেরিয়েছেন, আমাদের সৌভাগ্য।
ব্ৰজহরি কিছুতেই নেবেন না। সাইকেলটি মণ্ডলমশাইদের বাড়ির মাহিন্দার কাঁধে বয়ে আনছিল। গ্রামের পথে প্রচুর জলকাদা। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বারীন্দ্র ছাতা মাথায় ডাক্তারবাবুর পেটমোটা ব্যাগটা বয়ে আনছিলেন। পিচ রাস্তার মোড়ে পৌঁছে বললেন, খুব দুঃখ পাব, ডাক্তারবাবু!
ব্ৰজহরি পিচে গামবুট ঠুকে নোটটা নিলেন এবং পকেট থেকে তিনটে দু টাকার নোট বের করে মাহিন্দার কানাইকে দিতে গেলেন। কানাই সাইকেল নামিয়েছে সবে, জোরে চেঁচিয়ে উঠল, না, না! ঠিক এই সময় বৃষ্টি ও বাতাসের ভেতর দিয়ে মণ্ডলমশাইদের বাড়ির দিক থেকে কান্নার কোলাহল ভেসে এল। বারীন্দ্র ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, ওই যাঃ! বলেই প্যাঁচপেচে কাদায় দৌড়তে শুরু করলেন।
কানাই টাকাগুলো কোমরের কাপড়ের ভাঁজে চালান করে দিয়ে ফিক করে হাসল।
ব্ৰজহরি ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছ কেন হে তুমি? মানুষের মৃত্যু হলে হাসতে নেই। যাও, গিয়ে দেখ।
কানাই গম্ভীর মুখে বলল, সে-আপনি কী জানবেন জাক্তারবাবু? ওই যে কাঁদছে শুনছেন, আমি গাঁ জুড়ে হাসি শুনছি। শালা মোড়লমশাই গাঁসুদ্ধ জ্বালিয়ে শেষ করেছে। আমাকেও!
ব্ৰজহরির সাইকেল চাপাটা দেখার মতো। হ্যান্ডেল ধরে কিছুদূর দৌড়ে যান, তরপর প্যাডেলে একটা পা রাখেন, আরও কিছুটা ওই অবস্থায় দৌড়ান, তারপর সিটে চেপে বসেন। কানাই একটা মানুষের মৃত্যুতে হেসেছে, তাকেই ছ-টাকা, বখশিস বলা চলে না, সাইকেল বওয়ার মজুরি বাবদ দিয়েছেন, এটা তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তদুপরি ওই কুৎসিত গাল। মনে হল, ওকে দুটো টাকা দেওয়া উচিত ছিল।
রাস্তাটা ততবেশি চওড়া না। একটা ট্রাক আসছিল সামনে থেকে। প্রচণ্ড গতিশীল খালি ট্রাক। ট্রাকের পেছনে তেরপল মুড়ি দেওয়া লোক উঁকি দিচ্ছিল। কংক্রিট স্ল্যাব থেকে সাইকেল নামাতে হল। লোকগুলো চেঁচিয়ে তাকে কিছু বলে গেল। বুঝতে পারলেন না। ট্রাকটা চলে গেলে স্ল্যাবের উঁচু কিনারা দিয়ে সাইকেলের চাকা ওঠানো গেল না। বাঁকের মুখে বাঁশবনের কাছে স্ল্যাবের সঙ্গে সমতল হয়েছে কিনারা, সেখানে আবার রাস্তা ফিরে পেলেন। বৃষ্টিটা বাড়ল। জোরে বাঁক ঘুরে যেতেই দেখলেন রাস্তার ওপর দিয়ে হাল্কা জলের স্রোত। আন্দাজ হাত দশেক গিয়ে বুঝলেন জল গভীরতর হচ্ছে। তখন সাইকেল থেকে নামলেন। আশা ছিল, কিছুদূর এভাবে যেতে পারলে মৌরী নদীর ব্রিজের চড়াই অংশটাতে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু জল কোমর অব্দি এবং প্রচণ্ড টান। ব্ৰজহরি সাইকেল কাঁধে তুলে ধরলেন। বুঝলেন, তিনি বিপন্ন। জল সাইকেলটা ঠেলে দিচ্ছে তাঁর ওপর, সেই প্রবল চাপে তিনি ডাইনে সরে যাচ্ছেন ক্রমাগত। তখন সাইকেলটা মাথার ওপর ওঠানোর জন্য তুলতেই ব্যাকসিটে ডাক্তারি ব্যাগটা চোখে পড়ল। ডাক্তার নিজের ডাক্তারি ব্যাগের কথা ভুলে যাবেন? ব্ৰজহরি সাইকেল ও ডাক্তারি ব্যাগের মধ্যে ডাক্তারি ব্যাগটাই বেছে নিলেন। সাইকেলটা ছেড়ে দিলে সেটা ওল্টটাতে ওল্টটাতে ভাসতে ভাসতে নিখোঁজ হয়ে গেল। ধূসর বৃষ্টিরেখার ভেতর কিছু স্পষ্ট নয়, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাঁদিকে এখানেই তো–ওই তো!
ব্ৰজহরি ডাক্তার ব্যাগটা মাথায় রেখে বর্ষাতিসুদ্ধ নিজের বেঁটে মোটাসোটা শরীরকে বয়ে নিয়ে জঙ্গলে ঢিবিটার দিকে পা বাড়ালেন, পা মানে গামবুট। প্রথমে ব্যাগটা ডাঙায় এগিয়ে দিলেন। তারপর আঁকুপাকু করে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে তুললেন। মসৃণ একটুকরো শ্লেটপাথরের স্ল্যাবে বসে একটু হাসলেন ব্ৰজহরি কুণ্ডু। কেন হাসলেন, তিনি নিজেই জানেন না।…
.
পুঁতি ও চাক্কু
বীরহাটার মোড়ে এলাকার নামী লোক হাজি বদরুদ্দিনকে পৌঁছে দিয়ে সাইকেল-রিকশোর সিট থেকে এক লাফে নেমে চাক্কু বলেছিল, আর দুটো টাকা বখশিস লাগবে হাজিসায়েব!
হাজি বদরুদ্দিন চাক্কুকে ভাল জানেন। দরকার হলে চাক্কু চাক্কুর মতোই তাঁর পেটে ঢুকে যাবে। টিপটিপে বৃষ্টির ভেতর ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে লম্বা-চওড়া, ঢিলে আজানুলম্বিত সবুজ পাঞ্জাবি, চেককাটা লুঙ্গি ও সাদা সচ্ছিদ্র আঁটোসাটো টুপি পরা ধর্মভীরু লোকটি ব্যাপক নির্জনতা লক্ষ্য করার পর একটি পাঁচ টাকা ও একটি দুটাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। শহরে মামলা ছিল আজ। ব্যাংক থেকে কিছু টাকাও তুলেছেন। দেওয়ানি মামলার শুনানির যা রীতি, গোরে ঢোকার পরও রায় দেওয়া হবে কি-না অনিশ্চিত। তেতো হয়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শোনেন, বাস বন্ধ। রেডিওতে খবর হয়েছে তিলেঝাড়া ও মশালজোড় ব্যারেজে জল ছেড়েছে। এই সময় চাক্কুকে দেখে দোনামনা করে শিরীষতলায় এগিয়ে যান বদরুদ্দিন। চাক্কু সিগারেট টানছিল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়, তবে ভাড়া লাগবে পাঁচ টাকা।
চাক্কুর এটা উপরিলাভ। সে আজ বৃষ্টিবাদলা হোক, পৃথিবী জলতল হোক, সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক, বীরহাটার এদিকে আসতই। কিন্তু সে যে আসতই, সেটা বলেনি হাজিসায়েবকে। পাঁচ মাইল রাস্তায় দু জায়গায় একটু জল ছিল। হাল্কা জলের স্রোত এধারের ধানক্ষেত থেকে ওধারের ধানক্ষেতে, তারপরের বার এধারের পাটক্ষেত থেকে ওধারের পাটক্ষেতে। চাক্কু একটু রোগা চেহারার জোয়ান হলেও গায়ে ও পায়ে প্রচণ্ড জোর।
মোড়ে হাজিসায়েবকে নামিয়ে চাক্কু নির্বিকার মুখে নোট দুটো নিয়ে নীল ফরেন ফুলপ্যান্টের পকেটে চালান করে দিয়েছিল। সে যখন প্রকৃত রিকশোচালক, তখন সে ডোরাকাটা আন্ডারওয়্যার হাফপ্যান্ট হিসেবে পরে। গায়ে নীলচে সুতীর কলারওয়ালা ছেঁড়া গেঞ্জি চাপায়। রোদের দিন হলে একটা টুপিও। স্যান্ডেল জোড়া আটকানো থাকে হ্যাঁন্ডেলের সামনে। কিন্তু আজ তার অন্য বেশ। ফুলপ্যান্টটা হাঁটু অব্দি গুটোতে হয়েছিল, তাহলেও তার গায়ে প্যারাশুট কাপড়ের চকরাবকরা ফুলহাতা জ্যাকেট। মাথায় ক্রিকেট দর্শকদের ব্যবহৃত টুপি। সামনে বাতাস ও বৃষ্টির ছাঁটে তাকে দস্তুরমতো লড়াই করে এগোতে হয়েছে। তাই বীরহাটার মোড়ে অশথতলায় দাঁড়িয়ে কাদা রাস্তায় হাজি বদরুদ্দিনকে প্রায় পালিয়ে যাওয়ার মতো হাঁটতে দেখে তার পস্তানি হয়েছিল, অনায়াসে দু টাকার বদলে পাঁচটা টাকা দাবি করতে পারত।
আরও এক মাইল কষ্ট করে এগিয়ে সে রিকশো থামায়। রিকশোটা রাস্তার কিনারায় নিয়ে যায়, দুটো চাকায় চেন আটকে তালা ঝোলায়। তারপর সিটের তলা থেকে ব্যাগটা বের করে। বাঁদিকের ধানক্ষেত ও পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে আল রাস্তায় কোনাকুনি হেঁটে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে মৌরীনদীর ধারে বাঁধে পৌঁছে যায়। জল বাঁধের কিনারা ছুঁয়েছে দেখে সে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তাছাড়া ওপারটা যদূর চোখ যায় সমুদ্র।
কিছুদূর চলার পর বাঁধের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ঝুপসি বটতলায় অবিশ্বাস্যভাবে চাক্কু দেখতে পায় পুঁতিকে। পুঁতি গুঁড়ির খোকলে সেঁটে দাঁড়িয়ে ছিল। তার শাড়ি ভিজে গেলেও তাকে চকচকে দেখাচ্ছিল। খোঁপা এবং টিপে তাকে নববধূ দেখে চাক্কু দাঁত বের করেছিল। পুঁতি বলেছিল, যাও। তোমার সঙ্গে আর কথাই বলব না।
চাক্কু ঘড়ি দেখে বলেছিল, একটুও বেটাইম হয়নি। সওয়া তিনটে বাজছে। আমার আসার কথা চারটেতে।
পুঁতি দু হাতে ওর ঘড়িপরা আঁকড়ে ঘড়িটা দেখে বলেছিল, আমার কি ঘড়ি আছে? মনিন্দের (মজুমদার) মশাইকে জিগ্যেস করলাম, কটা বাজে মশাই? বললে, টাইম জেনে কী করবি? খাবি, না মুখ ধুবি? পুঁতি খিলখিল করে হাসতে লাগল। শেষে তাড়া দিয়েছিল, চলো, চলো! এতক্ষণ মাসি পাড়া মাথায় করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কই, ওঠ! কী?
চাক্কুর একটু অন্য ইচ্ছে ছিল। জনহীন বটতলা, এক ঝলক রোদ্দুর হঠাৎ ফুটে মিলিয়ে গেল, বৃষ্টিটা থেমেছে, নিচে ভরা নদীর কলকল শব্দ, চকচকে পুঁতি স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন নয়। সে পুঁতিকে টানলে পুঁতি টের পেয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বলল, হুঁ, গাছে না উঠতে এক কাদি।
চাক্কু শ্বাসের সঙ্গে হাসল। তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে খুঁজে সিঁদুরের মোড়ক বের করে বলল, এস। পরিয়ে দিই। সাক্ষী বটগাছ।
ঠিক এই সময় তাদের খুব কাছে বাঁধের ওপর দিয়ে নদী উপচে এল। সামনে ফাটল। পুঁতি ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, না, না। এখানে নয়। বাঁধের গতিক দেখতে পাচ্ছ না? শিগগির চলো এখান থেকে।
চাক্কু গলার ভেতর বলল, চলো!
ওরা বাঁধ ধরে কিছুটা হেঁটেছে, পেছনে প্রচণ্ড শব্দে ধস ছাড়ল। প্রপাতের মতো জল পড়তে থাকল নিচু মাঠটাতে। পুঁতি ও চাক্কু হন্তদন্ত হাঁটতে থাকল। ডানদিকের মাঠটা দেখতে দেখতে জলময়। বৃষ্টি আবার এল ঝিরঝিরিয়ে। হিজল-জাম-জারুলের ঠাস বুনোট বাঁধের গায়ে কিছুদূর। তারপর আবার খোলামেলা। একটু দূরে উত্তর-পূর্ব কোণে মৌরীনদীর সাদা ব্রিজ দেখা যাচ্ছিল। পুঁতি দম আটকানো গলায় বলল, বিরিজে চলো বিরিজে!
কিন্তু ব্রিজের দিকে যেতেই সামনে আবার হুড়মুড় করে ধস, আবার জলপ্রপাত। চাক্কু পুঁতির হাত ধরে টেনে বাঁদিকের পাটক্ষেতে নেমে গেল। পাটক্ষেতের ভেতর পোকামাকড়, বনচড়ুইয়ের একটা ঝক, তেঁড়া সাপ, দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে হাঁটু জল, কোমরজল, তারপর পাটক্ষেতের শেষে বুক জল। যত এগোতে থাকে, তত জল বাড়ে। বৃষ্টিতে সব ধূসর। জলের প্রচণ্ড টান। দুটিতে দুটি ব্যাগ এক হাতে মাথার ওপর তুলে সাবধানে পা বাড়ায়। তারপর পুঁতি চেঁচিয়ে ওঠে, দরগা! দরগা! চাক্কু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। তারা স্রোতের চাপে যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেটা একটা উঁচু বিশাল ঢিবি–ঘন জঙ্গলে ঢাকা। খোঁড়া পিরের দরগা।
প্রথমে ওঠে চাক্কু একটা ঝোপ আঁকড়ে। তারপর হাত বাড়িয়ে তার। প্রেমিকাকে টেনে তোলে। বড়-ছোট, উঁচু-নিচু লাইম কংক্রিটের চাঙড় ছড়ানো ঢালু পিঠে। গাছগুলো না থাকলে কবে নিচে গড়িয়ে পড়ে যেত। একটা চাঙড়ে বসে চাক্কু একটু হাসে। বলে, রিকশোটা–
পুঁতি বলে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কই, সিগারেট থাকলে দাও, টানি।
চাক্কু বলে, পকেটের প্যাকেটটা ভিজে গেছে। টাকাগুলোও। দেখছ? বলে সে ব্যাগে হাত ভরে। থামো, আরেক প্যাকেট আছে। কিন্তু আগুন? দেশলাই কাঠিটার অবস্থা দেখ।
পুঁতি বলে, চলো! দরবেশবাবার কাছে যাই। আগুন পাব।
চাক্কু ওঠে। করুণ দাঁত বের করে বলে, শালা কানা নাকি হাত গুনতে জানে। দুটো টাকা নেবে তো নেবে, জিগ্যেস করব আমার রিকশোটা আছে না, ভেসে গেল।
পুঁতি জিভ কেটেছিল। পা বাড়িয়ে বলে, ওই যে গাল দিলে বাবাকে– দেখবে তাও জানতে পেরেছে।
চাক্কু একুট ভড়কে গেল। সে সহজে ভড়কায় না। কিন্তু এখন দুঃসময়।
.
বিপ্লবী নেতা ঘনশ্যাম রুদ্র
সত্তরের দশকে বিপ্লবী কৃষক পার্টির স্থানীয় নেতা ঘনশ্যাম রুদ্রের দশবছর জেল হয়েছিল। বেরিয়ে আসতে আশির দশক। কিছুদিন চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু চুপচাপ থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। সবসময় গোয়েন্দা পুলিশের গতিবিধি, স্থানীয় নৈরাজ্য ও বদমাইসি, খবরের কাগজের বিবিধ উত্তেজক খবর এবং তার আদর্শবাদ অথবা স্বভাব, এইসব মিলে তাঁকে অস্থির করে ফেললে তিনি তাঁর মহকুমা শহরের পৈতৃক বাড়ি থেকে গা ঢাকা দেন। গ্রামে-গ্রামে গড়েতোলা পার্টি ইউনিটগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে এবং পার্টিকমরেডদের জঙ্গি যুবকরা কেউ জোতদারদের ভাড়াটে গুণ্ডা, কেউ খুনে ডাকাত বা ছিনতাইবাজ হয়ে গেছে জেনে খুব দমে যান। কিন্তু তিনি সহজে কিছু ছেড়ে দেবার পাত্র নন। কয়েক মাসের স্টোয় পূর্ব-পরিচয়ের খেই ধরে কয়েকটি গ্রামে এবার শুধু ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুরদের ইউনিট গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এলাকায় শিক্ষিতের হার নগণ্য এবং দারিদ্র্যও ভীষণ। কিন্তু জোতদার ও প্রান্তিক চাষীরা আগের তুলনায় সংঘবদ্ধ। ফলে তাকে বার দুই খুন করার চেষ্টা হয়। তারপর পুলিশ পেছনে লাগে। আজ দুপুরে ক্ষেতমজুর নাকু শেখের বাড়িতে সবে খেতে বসেছেন, পুলিশ ঢোকার খবর হয়। খাওয়া ফেলে ঘনশ্যাম রুদ্রকে গা ঢাকা দিতে হয়। নাকু তাকে পাটক্ষেতের ভেতর পৌঁছে দিয়ে চলে যায়।
ঘনশ্যাম রুদ্র রোগা গড়নের মানুষ। বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর প্রায়। তামাটে। রঙ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। লম্বা খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, বড়বড় কান, চোখদুটি সুন্দর। তিনি চিরকুমার। তাঁর পরনে, খেতে বসার সময় ফিকে নীল লুঙ্গি ও গেঞ্জি ছিল। ব্যাগে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি। পাটক্ষেতের পর ডাইনে ঘুরে মৌরীনদীর বাঁধে উঠবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু পুলিশের কথা ভেবে সোজা নাকবরাবর ধানক্ষেতের আলে হাঁটতে হাঁটতে সামনে দেখলেন অগাধ জল। মরিয়া হয়ে জলে নেমে বুঝলেন ভুল হয়েছে। জলে স্রোতের টান। কিন্তু ঘনশ্যাম রুদ্র সহজে দমে যান না। জল যত বাড়ে, তত রেগে যান। পা বাড়িয়ে অভিজ্ঞ ঘনশ্যাম আল খুঁজে এগোতে থাকেন। কখনও পা হড়কে ক্ষেতের গভীরে পড়ে যান, আবার ওঠেন আলের ওপর। এভাবে চলতে চলতে বৃষ্টি, বৃষ্টির পর পায়ের স্যান্ডেল জলের তলায় ফেলে আসা, তারপর হাতের ব্যাগ উঁচু করে কোমর জল ভাঙতে ভাঙতে সাঁতার জল এবং ঘনশ্যাম চিতসাঁতার দিতে থাকেন, ব্যাগটি উঁচুতে। একসময় হঠাৎ তাঁর মনে হয়, বিপ্লবের আগে কিছু গঠনমূলক কাজকর্মের জন্য অপেক্ষা করা দরকার, যে-কাজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থেই করবে। একহাতে প্রকৃতি, অন্য হাতে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়াই করা পণ্ডশ্রম। বাঁধটা মজবুত হলে জোতদারদের লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু বিপ্লবীদের যাতায়াত ও লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শক্ত মাটিও পাওয়া যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের ওপর চটে গেলেন ঘনশ্যাম। পা নামিয়ে মাটি খুঁজলেন পেলেন না। ভয় হোল, কতক্ষণ এভাবে ভেসে থাকবেন এবং একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়বেনই, তখন তাঁকে খুব আদিম ধরনের মৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। তারপরই জলের ভেতর কী একটা শক্ত জিনিসের জোর ধাক্কা খেয়ে ঘুরে ভেসে ডুবে যাচ্ছে এবং আবার ভেসে উঠছে এমন দুটো, তিনটে বা পুরো চারটে টায়ার, মোটর গাড়িরই টায়ার দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গলেন। একটা ভেসে যাওয়া উল্টেটা মোটরগাড়ি থেকে মরিয়া হয়ে তফাতে সরে গেলেন ঘনশ্যাম রুদ্র। এইসময় বৃষ্টিটা থেমে গেছে। আরও অবিশ্বাস্যভাবে মেঘের ফাঁকে রোদ্দুর কিন্তু আবার রোদ্দুর মুছে জমাট মেঘ, তারপর ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টি–ধূসরকার ভেতর কালো টানা, লম্বাটে একটা দেয়ালের মতো জিনিস। ঘনশ্যামকে স্রোত সেদিকে টেনে নিয়ে গেল। তারপর মাটি পেলেন। দেখলেন এটা একটা বাঁশবন। কোমর জলে বাঁশঝাড়ের ভেতর যখন হাঁটছেন, তখন মনে পড়ল, পিচের রাস্তা আছে ওধারে।
কঞ্চি ও কাঁটাঝোপে তাঁর লুঙ্গি ও নিম্নাঙ্গ ক্রমাগত ছড়ে যাচ্ছিল। জ্বালা করছিল। বাঁশবন পেরিয়ে গিয়ে পিচের রাস্তার বদলে জলের রাস্তা দেখে একটু ভড়কে গিয়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু স্রোতটা পিচরাস্তার মহকুমা শহরের দিকেই বয়ে চলেছে। ঘনশ্যাম রুদ্র পুলিশ, বিপ্লব, এসব জরুরি ব্যাপার ছেড়ে হিসেব করছিলেন, ছমাইল দূরত্ব স্রোতে যদি ভেসেও চলেন, ঘণ্টা দেড়-দুই লাগবে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তি, জলে ও স্রোতে ধাক্কা এবং আজগুবি ওল্টটানো গুবরেপোকার মতো একটা মটরগাড়ির উপদ্রব, কোমরে ব্যথা, পা-অব্দি কাটাখোঁচে ছড়ে যাওয়া, তার চেয়ে বড় কথা অসহায় অবস্থায় প্রকৃতির হাতে একজন বিপ্লবীর অপমৃত্যু হবে– রাগী সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ডাইনেবাঁয়ে তাকাতে গিয়ে একটু তফাতে জঙ্গলে ঢিবিটা চোখে পড়ামাত্র ঘনশ্যাম হুড়মুড় করে জল ভেঙে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে জয়ী হলেন।
উঁচুতে উঠে যাওয়া ঢিবির মাটিতে ধেবড়ে বসে ব্যাগটা মাথায় রেখে শুয়ে পড়তে চাইলেন ঘনশ্যাম রুদ্র। মাথার দিকে টেরচা হয়ে আটকে আছে। একটা লম্বাটে শ্লেটপাথর। কীসব আঁকিবুকি খোদাই করা আছে। এই ঢিবিটা বাইরে থেকে দেখা ঘনশ্যামের। শুনেছেন এটা পিরের দরগা। যাই হোক, আপাতত একটা আশ্রয়। পাথরটাতে ব্যাগ রেখে হাঁটু ভাজ করে আধশোয়া হলেন ঘনশ্যাম। দেখলেন, লুঙ্গি কয়েক জায়গায় ফদা-ফাই, কিছু ক্ষতচিহ্ন ধুয়ে গেলেও আবার রক্ত জমছে, তবে আগে শুকনো জামাকাপড় পরে নেওয়ার দরকার ছিল।
ইচ্ছে করছে না। মাথার ওপর ঝাকড়া একটা গাছ, বড়-বড় পাতা। বৃষ্টি আটকালেও পাতা থেকে মোটা ফোঁটা পড়ছে। কিন্তু শরীর ঘনশ্যামকে নড়তে দিচ্ছে না। চোখ বুজে আধশোয়া অবস্থায় রয়ে গেলেন। তাঁকে যথাযথ মড়া দেখাচ্ছিল, ক্ষতবিক্ষত এবং ডাঙায় আটকে পড়া মড়া।
.
বাউল হরিপদ
গত শ্রাবণে ঝুলন পূর্ণিমার রাতে মহকুমা শহরের রাজবাড়িতে রাসের মেলায় হরিপদ বাউল তার কষ্টার্জিত তৃতীয় সাধনসঙ্গিনী হরিমতাঁকে হারিয়ে ফেলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেটা একটা গান, এবং বাউলরা যা কিছু করে, গানেই করে :
ভবের হাটে একলা হেঁটে চলো রে মোনকানা…
বাউলদের গান এরকমই সাদাসিধে, লাইনবাঁধা, যেটুকু বাঁকা সেটুকুর মানে গুরু ছাড়া কেউ জানে না বলে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। একতারা হাতে হরিপদ আশ্বিন অব্দি এই গানটা প্রচুর বদলেছে। কাল কাঁদরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার। ব্ৰজহরি কুণ্ডুকে গানটা শোনাতে শোনাতে সে হেসে অস্থির। ব্ৰজহরি সব কিছুতে সিরিয়াস। হাসির কারণ জানতে চাননি। হরিপদ এমন মাতিয়ে দিয়েছিল যে রোগীরা একবাক্যে স্বীকার করেছিল, সংসারে অর্থাৎ ভবসংসারে একলা হাঁটাই ভাল। রাতে হরিপদ ডাক্তারবাবুর বাসায় থেকে যায়। ব্ৰজহরি নিরামিশাষী। কাজেই হরিপদর খুব খাওয়া হয়েছিল। সকালে সে চা-বিস্কুট খেতে মাধুকরীতে বেরিয়ে যায়। পাকা রাস্তার কাছাকাছি গ্রামগুলোর চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোত এখনও বাউলগানের আদর আছে। আদড়-কুসুমখালিতে এক সদ্-গেরস্থ তাকে কুমড়োর ঘাট আর খেসারির ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ায়। তারপর হরিপদ মৌরীনদীর ধারে বাঁধ দিয়ে পিড়িং পিড়িং করে একতারা বাজাতে বাজাতে গাইতে গাইতে আসছিল। সকাল থেকে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, দুপুরে থেমে-থেমে, কখনও ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি। ব্রিজের দিকে আসতে আসতে বাধা পেল। বাঁধ ভেঙে নদী মাঠ ভাসিয়েছে। জয়গুরু বলে হরিপদ পিছিয়ে এল। অনেকটা পিছিয়ে বাঁদিকে তাকিয়ে ভাবছে কী করবে, খোঁড়া পিরের দরগাটা চোখে পড়ল। সে গেরুয়া বেনিয়ান ও গেরুয়া লুঙ্গি খুলে ঝোলায় পুরে মালকোচা মেরে গামছা পরে জলে নামল। একহাতে একতারা অন্য হাতে ঝোলা। একবুক জল ভেঙ্গে হরিপদ জয়গুরু বলে ঢিবিতে পৌঁছুল।
এদিকটায় ঝোপজঙ্গল খুব ঘন। গুঁড়ি মেরে উঠতে উঠতে সে চাপা স্বরে কথাবার্তা শুনতে পেল। তখন সে গামছা নিংড়ে উলঙ্গ শরীর মুছে তারপর ঝোলার ভেতর থেকে শুকনো লুঙ্গি ও বেনিয়ান বের করল। আবার সে পরিপূর্ণ বাউল। একতারা পিড়িং পিড়িং করতে করতে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল।
.
বংকুবিহারী দারোগা
কাঁদরা থানার বড়বাবু বংকুবিহারী ধাড়ার হাতে গোপন তথ্য ছিল, দাগী ডাকাত ইসমাইল নতুন ঘাঁটি করেছে কালীতলায়। এমন অখাদ্য গ্রাম, না যাবে জিপ না সাইকেলও। তার ওপর বৃষ্টি, জলকাদা। এলাকায় হাঙ্গামা চুরিডাকাতি লেগেই আছে। শেষ রাত্রে হানা দিতে হলে সন্ধ্যার পর বেরুতে হয়। তখন ভাগে পেলেন মাত্র দুজন সেপাই।
ইসমাইলের মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে পাঁচহাজার টাকা। এটা এ বাজারে কিছুই না। কিন্তু বিবিধ উন্নতির ইশারা আছে। বংকুবিহারী ঝুঁকি নিয়েছিলেন। প্রাণের ঝুঁকিও বলা চলে। ইসমাইল ডাকু এ পর্যন্ত তিনজন সেপাই এবং দুজন অফিসার কোতল করেছে।
কেদার চৌকিদার মৌরী নদীর এপারে তালভোঙা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তালডোঙায় চারটে লোক, ডুবুডুবু অবস্থা, আর কেদারের মতে, নদীর ভাবগতিক ভাল না, তবু এ একটা লড়াই। ইয়াসিন মোল্লার বাড়ির ভেতরে চুপিচুপি মুর্গির মাংস আর মোটা চালের ভাত খাওয়া হল। মোল্লার ঘরে তক্তাপোষে মশারি খাঁটিয়ে শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল দারোগাবাবুর। সেপাই দুজন মেঝেয়, অবশ্য তারাও মশারি পেল। ভীষণ মশার উপদ্রব। শুধু বেচারা কেদার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঢুলতে ঢুলতে মশার কামড় খেয়ে ঢোল। শেষ রাতে মোল্লা জাগিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
তখন কালীতলায় বানের জল ঢুকছে। সারা গ্রামে চাঁচামেচি, নদীর বাঁধের দিকে জল ভেঙে মানুষজন এগিয়ে যাচ্ছে। তালডোঙায় কাচ্চাবাচ্চা, স্ত্রীলোক, ক্রন্দন, সে এক বীভৎস ঘটনা। কেদারের তালডোঙাটি নদীর ধারে বাঁধা ছিল। পাওয়া গেল না, ইসমাইল ডাকু দূরের কথা! মোল্লা আশ্বাস দিলেন, শিগগির তালডোঙা যোগড় করে ফেলবেন। সেই তালডোঙাটি আসতে ভোর হয়ে গেল। তখন আর কেদারের পাত্তা নেই। সে তার সংসার বাঁচাতে গেছে।
হতাশ, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ বংকুবিহারী সেপাই দুজনকে বললেন, তোমরা পরের বার যাবে। আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক। মোল্লা সেপাই দুজনকে পরামর্শ দিলেন, বেগতিক দেখলে তারা যেন ঘরের চালে চড়ে বসে। মোল্লাই এখন কাণ্ডারী। তার ভিটেটি উঁচু মাটিতে। কিন্তু ভোরের আলোয় জলের হালচাল দেখে তার ভাল ঠেকছিল না। তালডোঙাটি কোনোক্রমে মৌরীনদী পার করে অন্যপারের বাঁধে পৌঁছে দিলেন দারোগাবাবুকে। তারপর যে চলে গেলেন সেপাইদের আনতে, তো গেলেনই। তখন বাঁধে ভিড়। কাচ্চাবাচ্চা, স্ত্রীলোক, ছাগল, হাঁস-মুরগি গেরস্থালির সরঞ্জাম, প্রচণ্ড ক্রন্দন। তার ওপর থেমে-থেমে বৃষ্টি। বংকুবিহারী বেলা নটা অব্দি অপেক্ষা করে বাঁধের দুদিকে তাকিয়ে ঠিক করতে পারছিলেন না কোনদিকে যাবেন। কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছিল না। যাকেই জিগ্যেস করেন, সেই প্রলাপ বকতে থাকে। অগত্যা বাঁধ বরাবর পূর্বে হাঁটতে থাকলেন। এপারের বাঁধটা অক্ষত আছে। তারপর তাঁর ব্রিজ এবং পাকা রাস্তাটির কথা স্মরণ হল। তখন বুঝলেন, ঠিক রাস্তায় চলেছেন। মাইলখানেক চলার পর ডাইনে একটা ছোট্ট গ্রাম পেলেন। গ্রামটি উঁচু ভিটের ওপর অবস্থিত। কিন্তু কোনো লোকজন দেখতে পেলেন না। একটি স্ত্রীলোক বাঁধে গাইগরু বাঁধতে এসেছিল। কেন কে জানে, তাঁকে দেখে ঘোমটা টেনে পাথরের মূর্তি হয়ে রইল। সামনে কোথাও বাঁধ ভেঙেছে কি না জানার ইচ্ছা ছিল বংকুবিহারীর। রাগ করে বংকুবিহারী পা বাড়ালেন। নদী এঁকেবেঁকে চলেছে। বাঁধটা কখনও কাছে, কখনও দূরে সরে গেছে, ব্রিজটি দেখা যাচ্ছে না, ভিজে জবুথবু বংকুবিহারী পরের গ্রামটিতে পৌঁছে ডাইনে একটা ঘরের বারান্দা দেখা মাত্র গুলি খাওয়া বাঘ অথবা শেয়ালের মতো কুঁজো হয়ে ছুটে গেলেন। বারান্দায় কয়েকজন লোক বসেছিল উদ্বিগ্ন মুখে। তারা ভড়কে গেল। তারপর শশব্যস্তে সেলাম দিতে থাকল।
দারোগাবাবু এই গ্রামেরই মোড়ল মশায়ের বাড়ি শেষ পর্যন্ত অতিথি হন। তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। খিদে ও ঘুম। ফলে এই গ্রামে তিনি দুপুর অব্দি থেকে যান। আর এই গ্রামেই অন্য প্রান্তে বিপ্লবী ঘনশ্যাম রুদ্র ক্ষেতমজুর। সমিতির বৈঠক করছিলেন। গ্রামের চৌকিদার পাটক্ষেত থেকে ফিরে ঘুমন্ত বংকুবিহারীর জন্য অপেক্ষা করে। ঘুম ভাঙলে খবরটি দেয়। তার আগে অবশ্য দেরিতে পাওয়া খবরের ধাক্কায় ঘনশ্যাম রুদ্র মুখের আহার ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এই গ্রামের চৌকিদারই বংকুবিহারীকে সামনের দিকে বাঁধ ভাঙার খবরটিও দেয় এবং কোনাকুনি আলপথে দ্রুত যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সে কিছুদূর ধানক্ষেত, পাটক্ষেত ও জঙ্গলের ভেতর দারোগাবাবুকে এগিয়ে দিয়েও আসে। বংকুবিহারী তারপর জলের সামনে পৌঁছান। আর পিছিয়ে যাওয়ার মানে ফের একটা পরাজয়। বংকুবিহারী রিভলবারটি, বেল্টট, বুলেট কেস আকাশে তুলে হাঁটুজল, কোমরজল, বুকজল ভাঙতে ভাঙতে খোঁড়াপিরের ঢিবিটি চোখে পড়ায় সেদিকে সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে যান। তিনিও কিছুক্ষণ নেতিয়ে একটুকরো লাইমকংক্রিটে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকেন। চাকরি, জীবন, সবকিছুর প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ।
.
এক বারবধূ
মহকুমা শহরের বাগানপাড়া গলির বারবধূ শাওনি খোঁড়াপিরের দরগায় সিন্নি। মেনেছিল মাসখানেক আগে। সিন্নির উদ্দেশ্য মাসির মৃত্যু। সে শুনেছিল খোঁড়া। পির জাগ্রত আত্মা। পাঁচটা খুদে মাটির ঘোড়া, মাটির সরায় খই ও বাতাসা, একখানা নতুন গামছা যত্নে পড়ের ব্যাগে ভরে সে চুপি-চুপি বেরিয়ে বাসে চেপেছিল। কাদরা পেরিয়ে রাস্তায় জল। বাস দাঁড়িয়ে গেল। যাত্রীরা বুঝিয়ে সুঝিয়েও ড্রাইভারকে রাজি করাতে পারল না। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। আর মাইল তিনেক গেলে দরগা। শাওনি জল ভেঙে এগোতে থাকল। যাত্রীরা তখন তুমুল হল্লা করছে। কিছুদূর চলার পর জল বাড়ছিল। স্রোতে টলতে টলতে বারবধু শাওনি একবার পিছু ফিরে দেখল, তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, বাসটা জলে ডুবতে ডুবতে পিছু হটছে। সে মুচকি হাসল। আবার হাঁটতে থাকল জলের ভেতর। খোঁড়া পিরের দরগায় পৌঁছুতে তার ঘণ্টা দুই মতো লাগল। হাতে ঘড়ি না থাকলেও সে ঘণ্টা মাপতে পারে। সে যখন ঢিবির মাটিতে হাত রাখল, তখন এত ক্লান্ত যে ওঠার জন্য পা তুলতে পারছে না। সে সাবধানে ব্যাগটা একটা ঝোপের গোড়ায় হাত বাড়িয়ে আটকে রেখে শরীরটা টেনে তুলতে থাকল। সে পিরবাবাকে ডাকছিল বিড়বিড় করে। তারপর সে বুঝল, কেউ তাকে টেনে তুলে নিল। সে চোখ বুজে ফেলেছিল, নির্জীব। তারপর যে তার হাত ধরে টেনে তুলেছিল, সে মৃদুস্বরে বলল, তুমি কি একটু কষ্ট করে উঠতে পারবে? তখন চোখ খুলেই বারবধূটি চমকে উঠল। স্বপ্ন, না সত্যি সত্যি? একটা ধপধপে শাদা দাড়িওয়ালা মুখ, লম্বাচওড়া এক মানুষ– পিরবাবাই কি? সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে একটানে উঠে বসে ধনুকের মতো বেঁকে পায়ে মাথা কুটতে গেল। গিয়ে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। পায়ে কালো অদ্ভুত গড়নের জুতো। এক শাদা দাড়িওয়ালা সায়েব গায়ে রেনকোট, মাথায় টুপি। বারবধূ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সায়েব লোকটি ফের বাংলায় বলল, এখানে ভিজো না। আমার সঙ্গে এস। ওখানে ঘর আছে। কী? উঠতে কষ্ট হচ্ছে? ধরতে হবে? শাওনি ধরা গলায় বলল, না। আমি যেতে পারব।
.
এবং একটি কুকুর
সাহেবলোকটি স্বনামখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ছোট ও বড় ধ্বংসপ, ঝোপঝাড় ও ভাঙা দেউড়ির আড়ালে টলতে টলতে বারবধূটি অদৃশ্য হলে তিনি ডাইনে ঘুরলেন। ওদিকটা ঢালু এবং ঝুরিওয়ালা একটি বটগাছ আছে। সেখানে জার্মান মেয়েটি ক্লারা গ্ল্যান্সলারকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। চোখে চোখ পড়লে ক্লারা ডাকল, কর্নেল! কর্নেল তার কাছে গেলেন। ক্লারার পরনে সিল্কের শাড়ি। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। খালি পা। ওর কপালটা বড় বেমানান। বাংলার গ্রামে এদেরই উঁচকপালি মেয়ে বলা হয়। ক্লারা হাসছিল। বলল, স্থানটি মূলত একটি সমাধিক্ষেত্র। এই দেখুন একটি সমাধি। কোনো ক্রস দেখছি না। অতএব স্থানটি মূলত মোজলেম সমাধিক্ষেত্র।
তুমি ঠিকই বলেছ। কর্নেল বললেন। তবে কষ্টকর সমাধিক্ষেত্রের বদলে কবরখানা বলতে পরো ডার্লিং!
ক্লারা নড়ে উঠল।..হ্যাঁ, হ্যাঁকবরখানা। তারপর নীল চোখে রহস্যের ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, আশাকরি এটা চুণ্ডু খানের কবর নয়। আপনি অ্যারাবিক পার্সিয়ান জানেন কি! ওই দেখুন, স্মৃতিফলকে কীসব লেখা আছে।
কর্নেল ঝুরির আড়ালে গিয়ে বললেন, তুনি দরবেশসায়েবের গল্পটা বিশ্বাস করো কি?
করি। ক্লারা বলল। ভারতের সবকিছুই বিশ্বাসযোগ্য।
তোমাকে বলেছি ডার্লিং, একটার পর একটা করে তোমার বিশ্বাস ভেঙে যাবে, তখন তুমি কষ্ট পাবে। কর্নেল বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে চুরুট ধরিয়ে নিলেন। ধোঁয়ার মধ্যে ফের বললেন, সত্যে পৌঁছুতে হলে অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হয়।
ক্লারা একটু ক্ষুব্ধ হল। বলল, আপনি প্রদোষের প্রতিধ্বনি করছেন। আমার ননদিনীর নাম মৃণালিনী। তাকে আমি দিদি বলি। সে বলল, তাদের মামার বাড়িতে পূজার প্রতিমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। আমি দিদিকে বিশ্বাস করি। সুতরাং তার কথায় বিশ্বাস করি।
কর্নেল হঠাৎ তাকে একটানে সরিয়ে আনলেন। ক্লারা হকচকিয়ে উঠেছিল। কর্নেল বললেন, কিন্তু সাপকে বিশ্বাস করতে নেই। সাপটি বিষাক্ত। ওই দেখ।
ক্লারা এবার সাপটিকে দেখতে পেল। সাপটি ক্লারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার একহাত তফাত দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল ইটের চাঙড় তুলতে গেলে ক্লারা তাকে বাধা দিল। সাপটি সম্ভবত মাটিতে স্পন্দনের প্রবলতা টের পেয়ে একটা স্কুপের ভেতর লুকিয়ে পড়ল। কর্নেল বললেন, আমাদের খুব সাবধানে চলাফেরা করা উচিত, ডার্লিং! চুণ্ডু খানের আত্মার চেয়ে সাপ। বিপজ্জনক। এস, আমরা দরবেশসায়েবের ডেরায় ফিরে যাই।
ক্লারা মুগ্ধদৃষ্টে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে বলল, যত দেখছি, অবাক হচ্ছি। ঠিক এমন কোনো স্থানেই আমি আসতে চেয়েছিলাম। খুব ভেতরে, অনেক অনেক ভেতরে। যেখানে ভারতের আত্মা আছে।
বৃষ্টিটা হঠাৎ থেমে গেল। ক্লারা কর্নেলকে অনুসরণ করছিল। উঁচু সব গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির আটকেপড়া ফোঁটাগুলি অনর্গল ঝরছিল। ভিজে যাচ্ছিল ক্লারা। দরবেশের ডেরায় পৌঁছুতে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে স্তূপ ও জঙ্গলের দরুন। টিবির সমতল অংশটা কর্নেলের মাপে আন্দাজ দশ একর। পশ্চিম ঘুরে ফাঁকায় পৌঁছে রোদ্দুর দেখা গেল। ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজে। কর্নেল ঝুঁকে একটা লম্বাটে পাথরের স্ল্যাব তুলে নিয়ে বললেন, দেখছ? আশ্চর্য ব্যাপার!
ক্লারা বলল, কী, কী?
পাথরটার একপিঠে দেবীমূর্তি, অন্যপিঠে অ্যারাবিক বা পার্সিয়ান কিছু লেখা আছে।
ডাক্তারবাবু বলছিলেন এটা হিন্দুরাজার প্রাসাদ ও মন্দির ছিল। মোজলেমরা তা অধিকার করে।
পাথরটা রেখে কর্নেল চাপা হেসে উঠলেন। আরও আশ্চর্য ব্যাপার তোমাকে দেখানো যায় ডার্লিং, যদি তুমি অশালীন মনে না করো। তোমার ক্যাথলিক, এবং ইওরোপীয় সংস্কারের কথা ভেবেই বলছি।
ক্লারা শক্ত মুখে বলল, আমি ভারতীয় এবং হিন্দু।
ভাল কথা। তাহলে ওই দেখ।
পশ্চিমের খোলামেলা ঢালু ঘাসজমিটায় দাঁড়িয়ে বংকুবিহারী ভিজে খাকি শার্ট-প্যান্ট খুলে ঝোপে শুকোতে দিচ্ছেন। পরনে শুধু গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার। জুতোজোড়া একটা লাইমকংক্রিটে রেখে পাশে বসলেন। মোজা খুললেন। শুকোতে দিলেন। রিভলবার ও বুলেটকেসসহ চওড়া বেল্টট কোলে রাখলেন। গোঁফ পাকাতে শুরু করলেন।
ক্লারা চাপা হেসে বলল, ভারতে সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনরক্ষকরা।
কর্নেলও একটু হাসলেন। তোমাকে পাসপোর্ট-ভিসা চাইছিলেন। তুমি দেখালেই পারতে!
কেন দেখাব? প্রদোষ ভারতীয় নাগরিক। আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু তুমি তো আমাকে বলেছ তোমার পাসপোর্ট-ভিসা আছে। তাছাড়া এবিষয়ে আইনটি জটিল।
ক্লারা আরও আস্তে বলল, দেখতাম শেষ পর্যন্ত। কিন্তু প্রদোষ যখন বলল, সে স্থানীয় আইনসভার সদস্যের আত্মীয়, তখন পুলিশ অফিসার লোকটি চুপ করে গেল।
ক্লারা, আরও একটু আশ্চর্য!
কই, কই! আমি দেখতে চাই। সে কর্নেলের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল।
একটা কুকুর। কর্নেল আঙুল তুলে দেখালেন।
কুকুরটা সাঁতার কেটে এসে দু ঠ্যাং বাড়িয়ে দিল। তারপর কয়েকবার চেষ্টার পর ডাঙায় উঠল। গা ঝাড়া দিল বারবার। তারপর সামনে তাকিয়ে বংকুবিহারীকে দেখেই মুখ তুলে ঘেউজাতীয় শব্দ করল। বংকুবিহারী আন্যমনস্ক ছিলেন নিশ্চয়। উঠে তাড়া করার ভঙ্গি করলেন। তখন কুকুরটা লেজ গুটিয়ে স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
ক্লারা বলল, আমার ভয় করছিল, যদি পুলিশ অফিসার গুলি করেন হতভাগ্য কুকুরকে!
কুকুরটি ঘোরাপথে ঘুরে কর্নেল ও ক্লারার খুব কাছে এসে পড়ল। তারপর সম্ভবত ক্লারাকে দেখে, তার পায়ে বৈদেশিক ঘ্রাণ থাকা সম্ভব, ঘেউ ঘেউ করতে থাকল। ভঙ্গিটি মারমুখী। ক্লারা হাসতে হাসতে আদুরে গলায় বলল, অমন করে না! প্রিয় কুকুর, তুমি কি ভাবছ আমি তোমার শত্রু? আমি তোমার বন্ধু।
বংকুবিহারী ঘুরে দেখছিলেন। গর্জন করে বললেন, কর্নেল! বজ্জাতটাকে তাড়িয়ে দিতে পারছেন না? নাকি আমি যাব?
কর্নেল হাত তুলে বললেন, না না। আমি দেখছি। আপনি ইউনিফর্ম শুকিয়ে নিন। রোদ্দুরটা এখনও কিছুক্ষণ থাকবে মনে হচ্ছে।
কর্নেল এগিয়ে গেলেন কুকুরটার দিকে। কুকুরটা পিছু হটতে থাকল। তারপর তার চাচামেচি থেমে গেল। সে লেজ নাড়তে নাড়তে আরও পিছু হটতে হটতে দরগা-সংলগ্ন জরাজীর্ণ ঘরদুটোর কাছে গিয়ে জোরে গা-ঝাড়া দিয়ে ভেঙেপড়া আরেকটা ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে পড়ল।…
.
অন্ধ দরবেশের আস্তানা
ডিবির ঠিক মাঝখানে বর্গাকৃতি খোলামেলা একটা প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণে একটা উঁচু বিলি কবর। কবরটি কালো পাথরের, কিন্তু সেটি বিরাট, অন্তত চার ফুট উঁচু ইটের চতুষ্কোণ স্তম্ভের মাথায় রয়েছে। স্তম্ভের ফাটলে-ফাটলে প্রচুর উদ্ভিদ, প্রচণ্ড সবুজ ও প্রাণবন্ত। কবরের ধারে চারদিকেই অসংখ্য ক্ষুদে মাটির ঘোড়া, বিমূর্ত–দিশি ভাস্কর্য সেগুলি। এটিই খোঁড়া পিরের দরগা। নিচেও কয়েকটি লাইমর্কংক্রিটের কবর আছে। সেগুলি দরগার সেবায়েত খাদিমদের। একসময় প্রাঙ্গর্ণের চারদিকেই একতলা ইটের ঘর ছিল। মুসাফিরখানা বলা হত। দূর দূরান্তের ভক্তদের রাত্রিবাসের জন্য ঘরগুলি কোনো মুসলিম শাসক তৈরি করেছেন। পশ্চিমের দুটি ঘর এখনও অক্ষত। কারণ মেরামত করা হয় প্রতি বছর। সেই ঘরের একটিতে থাকেন বর্তমান খাদিম, কালো আলখেল্লা, লুঙ্গি ও পাগড়িপরা প্রকাণ্ড চেহারার লোক, চোখে কালো চশমাপরা, তাঁকে স্থানীয় লোকেরা বলে কানা দরবেশ। তিনি নাকি কথা বলেন না মাঝে মাঝে, সেটা তার মৌনব্রত! জীর্ণ একটি গালিচায় বারান্দায় বসে আছেন, হাতে ফুট তিনেক লম্বা, চ্যাপ্টা ও ভারি চিমটে। চিমটেটি লোহার। গোড়ার দিকটায় পেতলের অনেকগুলি আংটা। বুকে চিমটেটি ঠুকছেন এবং ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। একটু-একটু দুলছেন সারাক্ষণ। গলায় কয়েকটা লাল-নীল-সবুজ পাথরের মালা। মাজে মাঝে তিনি হাঁক ছাড়ছেন, চুল্ল! চুল্লুর সাড়া না পেয়ে বলছেন, বেতমিজটা আবার পালিয়েছে। বাবারা, মায়েরা! আপনারা আমার মেহমান। কিন্তু চুল্লু না এলে আপনাদের কিছু খাওয়াতে পারব না।
কেউ খাওয়ার কথা বলেননি অবশ্য। ক্লারা ও প্রদোষ, না ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডু, না ঘনশ্যাম রুদ্র, না পুঁতি ও চাক্কু, না দারোগা বংকুবিহারী, না হরিপদ বাউল। প্রথমে কিছুক্ষণ সবাই অন্ধ দরবেশের সামনে ও পাশে চুপচাপ বসে তত্ত্ব কথা শুনেছে। তারপর কেউ-না-কেউ বৃষ্টির মধ্যে বা বৃষ্টি থামার সময় ঢিবির চারিদিক ঘুরে জলের অবস্থা দেখে এসেছে। জল ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিটি মুখ নিষ্প্রাণ, ক্লারা বাদে। প্রদোষ বিরক্ত ও ক্ষুদ্ধ। সে ক্লারাকে বোঝাতে পারেনি তারা বিপন্ন এবং প্রকৃতির করতলগত।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার মহকুমা শহর নবাবগঞ্জে তার সামরিক জীবনের বন্ধু। ক্যাপ্টেন সদাশিব চৌধুরীর বাড়ি এসেছিলেন। আসার পথে এই ঢিবিটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ক্যাপটেন চৌধুরীর কাছে ঢিবিটির কথা প্রসঙ্গক্রমে তোলায় তিনি বলেন, আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে দফতরে বহুবার চিঠি লিখেছি, খুঁড়ে দেখুন আপনারা। এই মাউন্ডটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। গত বছর দুজন ভদ্রলোক এসে দেখেও যান। তারপর কী হয়েছে জানি না। তবে ওখানে একজন পিরের দরগা আছে শুনেছি। একজন অন্ধ দরবেশ থাকেন শুনেছি। তাঁর নাকি বুজরুকি ক্ষমতা আছে। ইচ্ছে করলে দেখে আসতেও পারেন। তবে আমার সময় হবে না, দুঃখিত। দেখতেই তো পাচ্ছেন, কী অবস্থা চলেছে!
ক্যাপ্টেন চৌধুরী আর্মিতে সার্জেন ছিলেন। এখন বিনাপয়সায় রোগী দেখেন এবং প্রি হেলথকেয়ার ইউনিট গড়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা সাহায্য করে তাকে।
কর্নেল খোঁড়া পিরের দরগায় পৌঁছন সকাল দশটায়। তখন বৃষ্টি ছিল, দুপাশের মাঠে ধানক্ষেতের ডগা দেখা যাচ্ছিল, তবে পিচরাস্তায় জল ওঠেনি, বাস চলছিল। পিচরাস্তা থেকে বিশ গজ দূরে ঘনজঙ্গলে ঢাকা ঢিবিটিতে উঠে ধ্বংসাবশেষ দেখে কর্নেল একটি প্রাচীনতা অনুভব করেন। তারপর বিধ্বস্ত, পাথরের ফটক পেরিয়ে অন্ধ দরবেশের কাছে যান। দরবেশের মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, তবু বয়স অনুমান করা কঠিন। অন্ধদের স্মরণশক্তি স্বভাবত তীক্ষ্ণ। দরবেশ বলে ওঠেন, বাবা, আপনি যেই হোক, শিগগির চলে যান! বান আসছে। চারদিক ডুবে যাবে।
কর্নেল অবাক হয়ে বলেন, কীভাবে বুঝলেন বান আসছে!
চুল্লু বলে গেল।
কে সে?
আছে একজন। আপনি শিগগির চলে যান।
কর্নেল দরবেশের সামনে একটা পাঁচ টাকার নোট রেখে বলেন, সেলামি নিন দরবেশসায়েব!
কত দিচ্ছেন? দরবেশ হাত বাড়িয়ে ঠিকই টাকা তুলে নিয়ে বলেন, পাঁচ টাকা!
কিছু কথা আছে, দরবেশসায়েব!
শিগগির বলুন। বান আসছে। চুল্লুও আবার এসে পড়বে। বিপদ হবে আপনার।
চুল্ল কে?
দরগার দক্ষিণে তার কবর আছে।
বুঝলাম। কে ছিলেন তিনি– মানে যখন বেঁচে ছিলেন?
এই জায়গার মালিক। নাম ছিল শাহ্ ফরিদ। লোকে বলত চুল্লু খান। সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা।
আপনি এখানে কতদিন আছেন?
তা একশো সত্তয়া-শো বছর হয়ে গেল প্রায়।
আপনার বয়স কত?
বলব না। আপনি চলে যান। বান আসছে। দেরি করলে আর যেতে পারবেন না।
কর্নেল এবার একটি দশ টাকার নোট দরবেশের সামনে রেখে বলেন, সেলামি, দরবেশসায়েব! আমি একটা দিন আপনার কাছে কাটাতে চাই। ধর্মকথা শুনতে চাই।
দরবেশ নোটটি তুলে নিয়ে বলেন, আরও দশ দিতে হবে।
নিন।
দরবেশ মোট পঁচিশ টাকা পেয়ে আলখেল্লার ভেতর চালান করে বলেন, আপনার নিবাস?
কলকাতা।
নাম?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
দরবেশ হাসলেন। সঙ্গে খাবার-দাবার আছে, নাকি আমার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবেন? শুধু খিচুড়ি খেতে হবে। খাবেন?
চুল্লু খানকে বললে বেঁধে দেয় না?
তা দেয় মাঝে মাঝে। তবে ও বড় বেতামিজ। দরবেশ উঠে দাঁড়ান। আপনি এই সতরঞ্জি বিছিয়ে বসুন। বলে তাক থেকে সঠিকভাবে হাত বাড়িয়ে একটা বিবর্ণ ছেঁড়া সতরঞ্জি টানেন। ধপাস করে ফেলে দেন কর্নেলের সামনে। তারপর বলেন, চা খাবেন? চা চিনি দুধ সব মজুত আছে। বাথান আছে নদীর ওদিকে। আধসের করে দুধ দিয়ে যায় গয়লারা। পিরবাবার মানত চিরকাল।
চিরকাল শব্দটা জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করে অন্ধ দরবেশ তালা খুলে ঘরে ঢোকেন। ঘরের ভেতর কোনো জানালা নেই। অন্ধকার ছমছম করছিল। দরবেশ বেরিয়ে আসেন একটি কেরোসিন কুকার নিয়ে। বারান্দার তাকে কেটলি ছিল। একটা বাঁশের চুপড়িতে মাটির ভাঁড় ছিল অজস্র। বারান্দার কোনায় গর্তের ভেতর বসানো ছিল একটা মাটির জালা। তাতে জল ছিল। কর্নেল প্রশ্ন করে জেনে নেন, যারা মানত দিতে আসে, তারা একঘড়া করে জল আনে। এই জালায় ঢেলে দেয়। এটা একটা নিয়ম। এতে বেশি পুণ্য হয় মানুতে ভক্তদের।
চা, চিনি, চাল-ডাল-আনাজপাতি-তেলমসলা সবই ভক্তদের দান। একজন অন্ধ লোক এভাবে বেঁচে আছেন এবং তাঁর শরীরটিও নধর, কর্নেল খুব অবাক হয়ে যান। অন্ধ দরবেশ চমৎকার চা করতে পারেন। চা খেতে খেতে মারফতি তত্ত্বকথা এবং মাঝে মাঝে চুল্লুর প্রেতাত্মার দুষ্টুমির বিবরণ শুনতে শুনতে কর্নেল একসময় বলেন, আমি দেখে আসি বান এল নাকি। আপনি এবার খিচুড়ি রান্না করুন! বারোটা বাজে প্রায়।
কর্নেল ঢিবির চারদিকে সত্যি বানের জল দেখে একটু অস্বস্তি অনুভব করেন। কিন্তু আর কিছু করার নেই। জায়গাটা তার ভাল লেগেছে। এই ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ, জঙ্গল, অন্ধ দরবেশ, চুল্লুর প্রেতাত্মা প্রভৃতির সঙ্গে চারদিক থেকে জলের উপচে-ওঠা তার জীবনে আরও একটি রোমাঞ্চকর সংযোজন ঘটাবে। ফিরে গিয়ে দেখেছিলেন খিচুড়ি তৈরি এবং দরবেশ তার প্রতীক্ষা করছেন। বলেছিলেন, একদণ্ড দেরি করলে চুল্লু এসে খেয়ে নিত। আসুন, বসে পড়ুন।…