০৯.
সময় পরিভ্রমণের সমীকরণটি প্রফেসর রাইখ এক রাতে সমাধান করে ফেলেছিল কিন্তু সময় পরিভ্রমণ করার জন্যে টাইম ক্যাপসুলটি তৈরি করার বিষয়টি মোটেও এক রাতের ব্যাপার নয়। সত্যি কথা বলতে কি সেটি কীভাবে তৈরি হবে সে সম্পর্কে পৃথিবীর কারো কোনো ধারণা নেই। প্রফেসর রাইখ নিজের পরিবারকে ছেড়ে ক্যাটাগরি সি মানুষদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত না নিলে এটি একটি অসম্ভব প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়াত।
প্রায় প্রতিদিনই প্রফেসর রাইখ এখানকার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে বসে। প্রফেসর রাইখ ক্যাটাগরি এ মানুষ, যাদের বিরুদ্ধে এখানে সবাই সংগ্রাম করছে কাজেই প্রথম দিকে তাকে নিয়ে সবার ভেতরেই একধরনের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছিল। প্রথমবার বসার পরেই সেটি অনেকখানি কেটে গেল। একেবারে প্রথম দিন রিটিন সুপ্রিম কাউন্সিলের সবার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্লিওন জ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল, “প্রফেসর রাইখ, তোমাকে একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যে এখানে আনা হয়েছিল। কাজ শেষ হয়েছে এখন তুমি কেন ফিরে যাচ্ছ না?”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি বিজ্ঞানের মানুষ। বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ আমার ভালো লাগে–তোমাদের এখানে যে চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে তার তুলনা নেই।”
“শুধু তাই? তুমি ক্যাটাগরি এ মানুষ আমাদের পুরো প্রোগ্রামটুকু হচ্ছে তোমাদের বিরুদ্ধে। তোমাকে এখানে রাখা আমাদের জন্যে মোটেও নিরাপদ নয়।”
প্রফেসর রাইখ একটু রেগে উঠল, বলল, “তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করছ?”
একজন কমবয়সী তরুণ যে এখানে কাজ চালানোর মতো ইঞ্জিনিয়ারিং শিখেছে, মুখ শক্ত করে বলল, “একজন ক্যাটাগরি এ মানুষকে আমরা কখনো বিশ্বাস করি না।”
“আমাকে ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখো।”
“কেন?”
প্রফেসর রাইখ গলা উঁচু করে বলল, “তোমরা বলেছ এবং আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যে, মানুষের মাঝে এই বিভাজন কৃত্রিম। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তোমরা এবং আমরা একই মানুষ।”
কমবয়সী তরুণটি আরো বেশি গলা উঁচু করে বলল, “কিন্তু তারপরও তোমরা শত শত বৎসর থেকে আমাদের উপর অবিচার করে যাচ্ছ, অত্যাচার করে যাচ্ছ।”
প্রফেসর রাইখ তখন গলা নরম করে বলল, “আমি সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। আমি আমার ব্যক্তিগত অপরাধের গ্লানি কমাতে চাই–তাই আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে এখানে থাকতে চাই!”
কমবয়সী তরুণটি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্লিওন হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রফেসর রাইখের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রফেসর রাইখ, আমরা তোমাকে সাদরে আমাদের ক্যাটাগরি সি পরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। শুধুমাত্র আমরা আশা করব আমাদের নিরাপত্তার জন্যে তুমি আমাদের নিয়মকানুনগুলো মেনে চলবে।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো।”
“চমৎকার! আমরা তাহলে কাজের কথা শুরু করে দিই।” ক্লিওন সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সবাই জানো রিটিনকে পাঁচশ বছর অতীতে পাঠানোর জন্যে আমাদের একটা টাইম ক্যাপসুল বানাতে হবে। কীভাবে বানাব আমরা জানি না কিন্তু আমরা যে শেষ পর্যন্ত বানাতে পারব সেটা জানি। কারণ আমরা দেখেছি রিটিন অতীতে পৌঁছেছে।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকি না কেন? প্রকৃতির দায়িত্ব তাকে অতীতে পৌঁছে দেয়া!”
প্রফেসর রাইখ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। সেটা হবে ভয়ংকর বিপজ্জনক একটা কাজ। তোমরা যখন রিটিনকে কন্ট্রোল সেন্টারে পঠিয়েছিল সেটাও ছিল ভয়ংকর বিপজ্জনক একটা কাজ–তার শরীরে যদি একটা গুলি কোনোভাবে লেগে যেত তাহলে পুরো প্রকৃতি ওলটপালট হয়ে যেত–”
“মানে?”
“তোমাদেরকে আমি সবকিছু বোঝাতে পারব কি না জানি না। এটা বোঝার জন্যে আমাকে স্পেস টাইম ফেব্রিক স্ট্রেচিং মাল্টিডাইমেনশনাল সমীকরণ সমাধান করতে হয়েছে। তার সমাধানের একটা অংশ হচ্ছে একটা ঘটনা ঘটার প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা। প্রকৃতির নিজস্ব পরিকল্পনার সাথে যতটুকু সম্ভব মিল রেখে একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয় যেন প্রকৃতি সেটা করে নিতে পারে। প্রকৃতিকে সাহায্য করতে হয় যেন প্রকৃতি সেটা করতে পারে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে হয় না। সেটা হচ্ছে আত্মহত্যা। আমার সমীকরণে জিটা নটের মানটা দেখো, এটা কমপ্লেক্স, যার অর্থ–”
ক্লিওন হাত তুলে প্রফেসর রাইখকে থামাল, বলল, “আমাদের বেশির ভাগ তোমার জিটা নটের মানের মাথামুণ্ডু বুঝব না। সেটা থাকুক। আমরা যেভাবে বুঝি সেভাবে বলো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “ঠিক আছে। প্রথমে মূল পরিকল্পনায় আসা যাক। তোমাদের মূল উদ্দেশ্যটা তোমরা বলো। কিছু গোপন করবে না।”
ক্লিওন কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর বলল, “আমি নিজেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না একজন ক্যাটাগরি এ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ একজন বিজ্ঞানীর সামনে আমি আমাদের সবচাইতে গোপন পরিকল্পনাটা প্রকাশ করে দিচ্ছি।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি আর ক্যাটাগরি এ মানুষ নই। আমি শুধু মানুষ। তোমরাও আর ক্যাটাগরি সি মানুষ নও। তোমরাও শুধু মানুষ।”
“ঠিক আছে।” ক্লিওন বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অল্প কিছু ক্যাটাগরি এ মানুষের পক্ষে বিশালসংখ্যক ক্যাটাগরি সি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সেটি করা সম্ভব হয়েছে কারণ তারা আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকটা মানুষকে তার ট্র্যাকিওশান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই ট্র্যাকিওশান হচ্ছে আসলে এক ধরনের দাসত্ব। এটি দিয়ে তারা আলাদা আলাদাভাবে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
“আমরা ট্র্যাকিওশান ফেলেও দিতে পারি না। কারণ ট্র্যাকিওশান বের করে ফেলে দিলে হঠাৎ করে পুরো নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাই। তখন আমি আর মানুষ থাকি না, অস্তিত্ববিহীন একটি অশরীরী হয়ে যাই। কোথাও যেতে পারি না, কিছু খেতে পারি না, কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে চিকিৎসাটাও পাই না। তা ছাড়া ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেলা ভয়ংকর একটি অপরাধ। ট্রাকিওশান ছাড়া অবস্থায় কাউকে ধরা হলে তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন না করে সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মেডিকেল ভল্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের অনেক কর্মী এভাবে ধরা পড়ে জীবন হারিয়েছে।”
“তারপরেও প্রায় নিয়মিতভাবে ক্যাটাগরি সি মানুষ আমাদের দলে যোগ দিচ্ছে এবং তাদের ট্র্যাকিওশান ফেলে দিচ্ছে। আমাদের রিটিন সেরকম একজন মানুষ।”
“যাই হোক, আমরা পৃথিবীর মানুষকে সত্যটুকু জানাতে চাই। ক্যাটাগরি এ এবং ক্যাটাগরি সি বলে যে কিছু নেই সেটি সবার কাছে প্রকাশ করতে চাই। পৃথিবীর সকল ক্যাটাগরি সি মানুষকে মুক্ত করতে চাই। সেটি করা সম্ভব যদি যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষের সকল তথ্য রক্ষা করা হয় এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেটি ধ্বংস করতে পারি। সেটি যে ভবনে আছে সেটি কোথায় আমরা জানি। ভবনটি অসম্ভব সুরক্ষিত। বিশ্বাস করা হয় নিউক্লিয়ার কিংবা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও সেই ভবন ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এর কোনো দরজা নেই, এর ভেতরে কিছু মানুষ থাকে তারা কখনো বের হতে পারে না। সেই মানুষগুলোই যন্ত্রগুলো রক্ষা করে পৃথিবীর সকল মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।”
“আমরা যেহেতু কোনোভাবেই এই ভবনটির ভেতরে ঢুকে ভবনের ভেতরকার তথ্যগুলো ধ্বংস করে মানবসমাজকে উদ্ধার করতে পারব না তাই এখন আমাদের একটিমাত্র পথ খোলা আছে। সেটি হচ্ছে ভবনটি যখন তৈরি হয়নি তখন সেই ভবনটির ভূখণ্ডের নিচে রিটিনকে একটি টাইম ক্যাপসুলে ভরে রেখে আসা। ধরা যাক আজ থেকে পাঁচশত বছর আগে। তারপর কোনো এক সময় সেই ভূখণ্ডের উপরে নিয়ন্ত্রণ ভবন তৈরি হবে-যারা তৈরি করবে তারা জানবে না নিচে একটা টাইম ক্যাপসুলে একজন বসে আছে ভয়ংকর বিস্ফোরক নিয়ে। কোনো একটা নির্ধারিত সময়ে মাটি খুঁড়ে মেঝে ভেদ করে সে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে ঢুকবে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্যভান্ডার ধ্বংস করবে। আমরা মুক্ত হব।”
রিটিন হকচকিতের মতো ক্লিওনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তার মানে আমি এই মুহূর্তে একটি টাইম ক্যাপসুলে করে নিয়ন্ত্রণ ভবনের নিচে অপেক্ষা করছি–কিংবা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে উপরে উঠে ভবনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছি।” রিটিন নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল, “তাহলে এই আমিটি কে? কিংবা কোন আমিটি সত্যি?”
ক্লিওন মাথা চুলকাল, বলল, “আমি এটার উত্তর জানি না–”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি জানি। আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, যদি সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো অগ্রসর হয় তাহলে এই মুহূর্তে তোমার আরেকটি অবস্থা নিয়ন্ত্রণ ভবনের নিচে অপেক্ষা করছে। মনে রেখো প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্যে তোমাদের দুটি অবস্থান কোনোভাবেই একত্র হতে পারবে না। তোমাদের দুজনের জগৎ হতে হবে আলাদা। কাজেই আমরা যখন টাইম ক্যাপসুল বলি তখন আমরা কী বোঝাই জানো?”
কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“আমরা বোঝাই এমন একটি ক্যাপসুল যার ভেতর থেকে একটি অণু কিংবা পরমাণুও বের হতে পারবে না। কোনোভাবে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। একটা পরিপূর্ণ আবদ্ধ জগৎ যার সাথে এই পৃথিবীর কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। কাজেই রিটিনের একটি অবস্থা যদি আসলেই নিয়ন্ত্রণ ভবনের নিচে অপেক্ষা করছে তার ভেতরে আসলে কী আছে সেটি সম্পর্কে এই জগতের কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারবে না। অর্থাৎ রিটিন আসলে আছে কি নেই সেটা কেউ জানে না, প্রকৃতি এভাবে তার চরিত্র রক্ষা করে।”
কেউ একজন কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিন্তু রিটিন উঠে দাঁড়িয়ে অনেকটা আর্তনাদের মতো করে বলল, “প্রফেসর রাইখ, তুমি কী বলতে চাইছ? আরেকটা রিটিনকে পাঁচশ বছরের জন্যে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছে? পাঁচশ বছর? পাঁচশ–”
প্রফেসর রাইখ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।”
“কেন পাঁচশ বছর পুঁতে রাখতে হবে? সময় পরিভ্রমণ করে পাঁচশ বছর কেন তাড়াতাড়ি অতিক্রম করা যায় না।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “কে বলেছে যায় না। অবশ্যই অতিক্রম করা যায়, সেটা হচ্ছে স্পেস টাইম ফেব্রিক পারফোরেশনের সৌন্দর্য। তোমাকে যখন অতীতে পাঠানো হবে তুমি এভাবে যাবে, অনেকটা চোখের পলকে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“আমরা তোমাকে সময় পরিভ্রমণে পাঠাতে পারব, কারণ এখানে আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটা বিন্দুতে অচিন্তনীয় শক্তি জমা করে স্পেস টাইম ফেব্রিকে ফুটো করে তোমাকে অতীতে পাঠাব। কিন্তু তুমি যখন পাঁচশ বছর অতীতে যাবে তখন সেখানে তোমার কোনো প্রযুক্তি থাকবে না! তোমাকে ভবিষ্যতে পাঠাবে কে?”
“আমার টাইম ক্যাপসুলে সেই প্রযুক্তি দিয়ে দাও।”
প্রফেসর রাইখ এমনভাবে হাসল যেন রিটিন খুব হাস্যকর একটা কথা বলেছে। তার হাসিতে কেউ যোগ দিল না দেখে প্রফেসর রাইখ হাসি থামিয়ে বলল, “সেই প্রযুক্তি ছোট একটা ক্যাপসুলে ঢোকানো সম্ভব না। তার জন্যে বিশাল অতিকায় প্রায় আস্ত শহরের মতো বড় একটা ক্যাপসুল দরকার। তা ছাড়া—”
“তা ছাড়া কী?”
“তুমি যে পাঁচশ বছর টাইম ক্যাপসুলে মাটির নিচে থাকবে তুমি তো আর তখন জেগে থাকতে পারবে না। তোমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, তোমার দেহকে পুরোপুরি একটা জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলতে হবে। সেটা করার জন্যে তোমার শরীরের তাপমাত্রা চার ডিগ্রি কেলভিনে নামিয়ে আনতে হবে–মানুষের শরীরের মতো বড় একটা কিছুকে চার ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় নামিয়ে সেটাকে পাঁচশ বৎসর রেখে দিতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হবে সেই শক্তিটা তুমি কোথায় পাবে? সেটাও এখান থেকে ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে দিতে হবে। বুঝেছ?”
রিটিন অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। কিন্তু মনে হচ্ছে, না বুঝলেই বুঝি ভালো হতো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “এখনো শেষ হয়নি।”
রিটিন চিন্তিত মুখে বলল, “শেষ হয়নি?”
“না। তোমার পাঁচশত বছর পার হওয়ার পর তোমার জেগে উঠতে হবে। তারপর ক্যাপসুল থেকে বের হওয়ার পর মাটি খুঁড়ে উপরে উঠতে হবে।”
ক্লিওন বলল, “এই অংশটা মনে হয় বেশ সোজা হবে। আমরা রিটিনের হাতে একটা ছোট নিও মিসাইল দিয়ে দেব। সেটা দিয়ে ব্লাস্ট করে পুরো মাটি কংক্রিট নিয়ন্ত্রণ ভবনের বেস ফুটো করে ফেলতে পারবে! তখন সেই ফুটো দিয়ে একটা জেট ব্যবহার করে বের হতে পারবে। একবার বের হতে পারলে বাকি কাজ পানির মতো সোজা। বিস্ফোরকগুলো এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভেতরের সবকিছু তছনছ করে দেওয়া!”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খুব ছোট একটা ক্যাপসুলের ভেতর এইসব যন্ত্রপাতি অস্ত্র বিস্ফোরক বসানো! এটার নিয়ন্ত্রণটি অত্যন্ত যত্ন করে তৈরি করা।”
ক্লিওন বলল, “অন্যান্য সামাজিক ব্যাপারও আছে, পাঁচশ বছর আগের মানুষের ভাষা, রীতিনীতি শেখা। সেখানে তুমি যখন পৌঁছাবে কিছুতেই কাউকে জানানো যাবে না তুমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছ। সেই সময়ের মানুষ তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করবে আমরা জানি না!”
এখানে একজন বিজ্ঞান শিখছে সেরকম একজন মেয়ে একটুখানি হেসে বলল, “অতীত থেকে আমরা যে ছবিটা পেয়েছি সেখানে অবশ্যি দেখছি রিটিন মায়া মায়া চেহারার একটা মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। যার অর্থ সে নিশ্চয়ই অন্তত পক্ষে একজন মেয়েকে পাবে যে তাকে গ্রহণ করবে।”
রিটিন কিছু বলল না। কেউ জানে না দূর অতীতের একটি মেয়ে, যার সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি রিটিন তার জন্যে নিজের ভেতর একধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করেছে।
রিটিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ শুনল ক্লিওন বলছে, “আমরা এখন একটুখানি উত্তেজক পানীয় খেয়ে নিই। তারপর টাইম ক্যাপসুলের ডিজাইনের কাজ শুরু করি।”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “চমৎকার আইডিয়া।”
.
ছয়মাস টানা কাজ করে শেষ পর্যন্ত একটি টাইম ক্যাপসুল তৈরি হলো। ক্যাপসুলটি আসলে তিন মিটার ব্যাসের দুটি টাইটেনিয়াম সিলঝিনিয়ামের সঙ্কর ধাতুর অর্ধগোলক। অর্ধগোলাকের দুটি অংশ জুড়ে দেয়ার পর সেটি আক্ষরিক অর্থে একটি গোলক হয়ে যায়। ভেতরে একটি প্লাটিনামের সিলিন্ডার, যেখানে রিটিন শুয়ে থাকবে। তার শরীরের সাথে মিল রেখে সিলিন্ডারের কনট্র তৈরি করা হয়েছে। শরীরের নিচে একটা ফিউসান জেনারেটর যেটি পাঁচশত বৎসর তার শরীরকে চার ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় নামিয়ে শরীরটাকে জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলবে। তার বাম পাশে একটি নিও মিসাইল। অতীত থেকে ফিরে আসার পর সে এটি দিয়ে মাটির নিচ থেকে নিয়ন্ত্রণ ভবনের মেঝে পর্যন্ত ফুটো করে ফেলবে। ডান পাশে থাকবে কিছু বিস্ফোরক এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। গোলকের ফাঁকা জায়গাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ফটো ইলেকট্রনিক নিউট্রিনিয়াল সার্কিট। একবার ভেতরে ঢুকে গোলকটি বন্ধ করে দেয়ার পর রিটিন সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা হয়ে পড়বে।
এই টাইম ক্যাপসুল নিজে থেকে সময় পরিভ্রমণ করতে পারবে না। এটাকে স্পেস টাইম ফেব্রিকের একটা ছোট ফুটো দিয়ে ঠেলে দিতে হবে। সেই ফুটোটা করার জন্যে অচিন্তনীয় পরিমাণ শক্তি একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শক্তি যখন ক্রিটিক্যাল মানটুকু অতিক্রম করবে তখন টাইম ক্যাপসুলটির উপর থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। ক্যাপসুলটি সেই ফুটো দিয়ে সবার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এটি কোথায় গিয়ে বের হবে সেটি নিয়ে প্রফেসর রাইখের একটুখানি দুর্ভাবনা আছে তবে যেহেতু পাঁচশ বছর অতীতের একটা ছবি আছে, প্রফেসর রাইখ অনুমান করছে তবে হিসেব ঠিক আছে এবং রিটিন প্রায় পাঁচশত বৎসর আগেই পৌঁছাবে। সেখানে কোথায় কীভাবে হাজির হবে সেটি এখানে কেউ জানে না। জানার উপায়ও নেই। তবে ক্যাপসুলের ভেতর রিটিনের নিজেকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি এবং রসদ দেয়া হয়েছে। খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও রিটিন যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারে তাকে সেভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সবকিছু শেষ হলো। সুপার কন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে পুরো ক্যাপসুলটিকে লেভিটেড করে শূন্যে ঝোলানো হয়েছে। চারদিক থেকে দুশ ছাপ্পান্নটি গামা লেজার এক বিন্দুতে ফোকাস করে আছে। সেখানে ট্রিটিয়ামের একটা ক্ষুদ্র এম্পুল রয়েছে। গামা লেজার যখন এম্পুলটিকে উত্তপ্ত করবে তখন ফিউসান বিক্রিয়ায় যে শক্তি বের হবে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দিয়ে সেটাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখবে। সেই অচিন্তনীয় শক্তি স্পেস টাইমকে ফুটো করে ফেলবে।
সেই ফুটো দিয়ে অণু-পরমাণু ঢুকে যাবার সময় ঘর্ষণে আয়নিত হয়ে এক্সরে স্পেকট্রাম দিতে শুরু করবে। বোঝা যাবে স্পেস টাইমে ফুটো হয়েছে। টাইম ক্যাপসুলটিকে তখন ছেড়ে দেয়া হবে, খুবই সূক্ষ্মভাবে তার গতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে যেন সেটি একটা নির্দিষ্ট তৃরণে ফুটো দিয়ে ঢুকে যায়, কারণ সেটাই নির্ধারণ করবে টাইম ক্যাপসুলটি কতখানি অতীতে যাবে।
সবকিছু প্রস্তুত। এখন শুধু রিটিনের রওনা দেয়ার অপেক্ষা। সময় পরিভ্রমণের দিনক্ষণ ঠিক করে রাখা হয়েছে, শুধু সেটি রিটিনকে জানানো হয়নি। ঠিক রওনা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে জানানো হবে। রিটিন তাই অপেক্ষা করছে।
.
১০.
রিটিন ঘুম থেকে উঠে দেখল তার ঘরে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন টেকনিশিয়ান অপেক্ষা করছে। রিটিন বুঝতে পারল আজকে সেই দিন। তার বুকের ভেতর রক্ত ছলাত করে উঠল। এটুকুই–বাড়তি কোনো উত্তেজনা কিংবা আতঙ্ক কিছুই হলো না। সাদা পোশাক পরা মানুষগুলোর পিছু পিছু সে হেঁটে যেতে থাকে। তারা তাকে সময় পরিভ্রমণের জন্যে প্রস্তুত করিয়ে দেবে।
তাকে কিছু খেতে হলো, শরীরে কিছু ইনজেকশান দেয়া হলো, শরীরের ভেতর কিছু এঙ্গুল ঢোকানো হলো। শরীরের নানা জায়গায় মনিটর লাগানো হলো। বিশেষ একটা পোশাক পরতে হলো, সেই পোশাক পরিয়ে তাকে যখন করিডর ধরে টাইম ক্যাপসুলের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন রিটিন দেখল করিডরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ক্লিওন একটা সুন্দর পোশাক পরে আছে, সুপ্রিম কাউন্সিলের সব সদস্যই তাদের বুকে ব্যাজ লাগিয়ে এসেছে। সবাই রিটিনের সাথে হাত মিলাল, দুই-একটা ভদ্রতার কথা বলল। বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রিটিন তাদের সাথেও হাত মিলিয়ে ছোটখাটো ভদ্রতার কথা বলে এগিয়ে যায়। সবার শেষে প্রফেসর রাইখ দাঁড়িয়ে আছে, সে রিটিনের দুই কাঁধ ধরে ছোট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “মনে রেখো, পৌঁছেই তোমার বান্ধবীর সাথে ছবি তুলে আমাদের পাঠাবে!”
রিটিন বলল, “পাঠাব!”
টাইম ক্যাপসুলটি স্ট্যান্ডের উপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। রিটিনকে ঢুকিয়ে ঢাকনাটি ফেলে ক্যাপসুলটি বন্ধ করে দেবার পর সেটাকে সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে লেভিটেড করা হবে, সেটি তখন শূন্যে ঝুলে থাকবে।
সাদা কাপড় পরা টেকনিশিয়ানরা রিটিনকে টাইম ক্যাপসুলের ভেতর ঢুকিয়ে সিলিন্ডারের সাথে স্ট্যাপ দিয়ে আটকে দিতে থাকে। শরীরের মনিটরগুলো পরীক্ষা করে, যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করে।
তখন একজন একটা চেক লিস্ট ধরে রিটিনকে শেষ মুহূর্তের জন্যে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। বিদায় নেবার আগে টেকনিশিয়ানরা নিজেদের উত্তেজনা ঢেকে জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমার সময় পরিভ্রমণ শুভ হোক, রিটিন।”
রিটিনও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।
“তোমাকে অচেতন করা হবে না, তাই পরিভ্রমণ পুরোটাই তুমি অনুভব করবে। যদি দেখা যায়, তোমার কোনো এক ধরনের শারীরিক কষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র তখন তোমাকে অচেতন করে দেয়া হবে। বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
“তোমার নিরাপত্তার জন্যে একটা অ্যাটমিক ক্লাস্টার দেয়া হয়েছে। যদিও আমরা আশা করছি সেটা তোমাকে কখনো ব্যবহার করতে হবে না।”
“ঠিক আছে।”
“নিও মিসাইল আর বিস্ফোরকগুলো দেখে নিয়ো।”
“দেখে নেব।”
“তোমার দুই আঙুলে দুটো বিস্ফোরক আছে। মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“ঢাকনাটা ফেলে দেয়ার পর আমাদের সাথে তোমার আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না। তোমার অন বোর্ড প্রসেসর তোমার সব দয়িত্ব নেবে।”
“চমৎকার।”
“আমরা তাহলে যাই? কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।”
“যাও।”
টেকনিশিয়ানরা সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে ঢাকনাটা নামিয়ে দিতে থাকে। ধাতব একটা শব্দ করতে করতে ঢাকনাটা নেমে আসে। গোলকটাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে রিটিন পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা হয়ে গেল। এখন এই টাইম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে একটি অণু বা পরমাণুও বের হতে পারবে না।
রিটিন সিলিন্ডারের ভেতর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। সে খুব সূক্ষ্ম একটা কম্পন অনুভব করে, বাইরে কী হচ্ছে সে আর কোনো দিন জানতে পারবে না। যেকোনো মুহূর্তে সে সময় পরিভ্রমণের যাত্রা শুরু করবে, রিটিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। এর আগে কেউ কখনো স্পেস টাইম ফেব্রিক ভেদ করে যাত্রা করেনি, কেউ জানে না অভিজ্ঞতাটি কী রকম, রিটিন সেই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। মাথার ভেতর কিছু একটা দপদপ করছে, রিটিন জোর করে তার সমস্ত চিন্তা দূর করে মস্তিষ্কের ভেতরটুকু শূন্য করে ফেলার চেষ্টা করে।
.
বাইরে বড় একটা মনিটরের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল একটি গোলক শূন্যে ঝুলে আছে, দৃশ্যটি খানিকটা অস্বাভাবিক। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছে কখন একটি বিন্দুতে অচিন্তনীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করে স্পেস টাইমকে ফুটো করে ফেলা হবে।
কোনো একটা স্পিকার থেকে কাউন্ট ডাউনের শব্দ শোনা যেতে থাকে। কাঁপা গলায় কেউ একজন বলছে, “দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক শূন্য–”
সাথে সাথে দুশ ছাপ্পান্নটি গামা লেজার থেকে অদৃশ্য রশ্মি ট্রিটিয়ামের ছোট এম্পুলটিকে আঘাত করল। ফিউসানের প্রচণ্ড শক্তি ক্ষুদ্র একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়, তার তীব্র আলো ঝলসে উঠে মনিটরটিকে মুহূর্তের জন্যে বর্ণহীন করে দেয়। প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং সবগুলো বিপদসূচক অ্যালার্ম এক সাথে আর্তনাদ করে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত পর মনিটরটি আবার চালু হয়, তীব্র আলোতে চারদিক ধাধিয়ে গেছে, পরিষ্কার করে দেখা যায় না, আবছাভাবে দেখা গেল গোলকটি দুলতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে এক্সরে ডিটেক্টরগুলো একসাথে শব্দ করে ওঠে, প্রফেসর রাইখ উত্তেজিত গলায় বলল, “স্পেস টাইম ফেব্রিকে ফুটো হয়েছে! ফুটো হয়েছে!”
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, এখন গোলকটি নেমে আসবে তারপর সেই ফুটো দিয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, টাইম ক্যাপসুলের গোলকটি দুলতে শুরু করেছে, হঠাৎ সেটি মুক্ত হয়ে নিচে নামতে শুরু করে। একটা ফুটো দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার বদলে হঠাৎ করে সেটি কোথায় যেন আটকে গেল, দেখে মনে হতে থাকে অদৃশ্য একটা পর্দার মাঝে গোলকটি ঝুলে আছে। এটি নিচে নামতে পারছে না!
প্রফেসর রাইখ মুখ বিকৃত করে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ!”
ক্লিওন জানতে চাইল, “কী হয়েছে?”
“দেখছ না, স্পেস টাইম ফেব্রিকের ফুটোটা যথেষ্ট বড় না, এটা ঢুকতে পারছে না!”
“এখন কী হবে?”
কী হবে কেউ জানে না, সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে এবং তখন হঠাৎ মনে হলো নিচের অদৃশ্য পর্দাটা ছিঁড়ে গেল। সবাই সবিস্ময়ে দেখল গোলকটি নিচে নামতে নামতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাথে সাথে হঠাৎ করে সবকিছু নীরব হয়ে যায়। অ্যালার্মের আর্তনাদ, এক্সরে ডিটেক্টরের শব্দ, যন্ত্রপাতির গুঞ্জন সবকিছু থেমে যায়। এই নীরবতাটুকু কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। প্রফেসর রাইখ বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি বের করে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “পৃথিবীর ইতিহাসের জন্যে এটি একটি মাইলফলক! আমরা প্রথমবার একজন অভিযাত্রীকে সময় পরিভ্রমণে পাঠাতে পেরেছি।”
ঘরের সবাই তখন এক সাথে আনন্দোৎসবের মতো করে চিৎকার করে হাততালি দিতে শুরু করে।
ক্লিওন প্রফেসর রাইখের কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বলল, “আমি দুঃখিত প্রফেসর রাইখ, বিজ্ঞানের এত বড় একটা ঘটনার কথা পৃথিবীর কাউকে আমরা জানাতে পারছি না।”
ক্লিওনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটির মানুষটি নিচু গলায় বলল, “আমরা জানাতে না চাইলেও এটা জানাজানি হয়ে গেছে ক্লিওন।”
ক্লিওন চমকে উঠে বলল, “কী বললে?”
“আমার কাছে তথ্য এসেছে আমাদের এই গোপন আবাসস্থলের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। একটু আগে এখানে যে অচিন্তনীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল সেটা গোপন রাখা সম্ভব নয়।”
ক্লিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সারাটি জীবন সে গোপন একটি আস্তানা থেকে আরেকটি আস্তানায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে, তার কাছে এটি নতুন নয়। সে ক্লান্ত গলায় বলল, “সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলো।”
“তুমি?”
“আমি এখানেই থাকব।”
সিকিউরিটি অফিসার ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা দেবে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
ক্লিওন হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি জানি না কেন। হয়তো প্রফেসর রাইখের কথাই সত্যি। প্রকৃতি যেভাবে চায় তাকে সেভাবে সাহায্য করতে হয়। আমি প্রকৃতিকে সাহায্য করি।”
প্রফেসর রাইখ হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আমিও তাহলে প্রকৃতিকে সাহায্য করি। আমিও তোমার সাথে থাকি।”
ক্লিওন বলল, “চমৎকার। চলো তাহলে স্নায়ু শীতল করার চমৎকার এক বোতল পানীয় পাওয়া গেছে। সময় পরিভ্রমণের এই বিশাল সাফল্যটা আমরা সেই পানীয় খেয়ে উদযাপন করি!”
প্রফেসর রাইখ বলল, “চলো।”
দুজন শান্ত ভঙ্গিতে করিডর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। দুজনেই ক্লান্ত। খুবই ক্লান্ত।