০৯. বাবা নিখোঁজ
মঙ্গলবার ভোরেই বাবা রওনা হলেন। গত কাল বন্দুক কিনেছেন। অনেক। দেখেশুনে ওয়েস্টলি রিচার্ড পছন্দ করেছেন। দাম পড়েছে বাইশ হাজার। লাইসেন্সও হয়ে গেছে। টিফিন ক্যারিয়ার বোঝাই করে জানু ফুপি খাবার দিয়েছেন। ফ্লাস্কে চা দিয়েছেন–জানি তো দাদা, বাড়িতে মার অত্যাচারে এক কাপের বেশি দুকাপ খেতে পাও না। মনে করে খেয়ো দাদা।
জানু ফুপিরও স্বভাব দিদার মতো। কথা একবার বলা শুরু করলে সহজে থামেন না।
তাড়াতাড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিলেন বাবা। রাস্তায় উঠে স্পীড বাড়ালেন। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। ফেরিগুলোও সময়মতো পেয়ে গেলেন। চট্টগ্রাম এসে যখন পৌঁছলেন ঘড়িতে তখন একটা বাজতে দশ মিনিট বাকি।
পাঁচলাইশে তালুকদারকে ঢাকার ইকবাল আহমেদের চিরকুটটা দিয়ে রামগড়ের রাস্তা ধরলেন। মাঝখানে শুধু দশ মিনিটের জন্য গাড়িটা থামিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলেন। সার্ভিসিং-এর পর গাড়িটা একেবারে নতুন হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম পর্যন্ত যে গতিতে বাবা গাড়ি চালিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম ছাড়ার পর সেটা অর্ধেকের নিচে নেমে গেলো। কারণ একটাই–বৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই এদিকের রাস্তাগুলো যাচ্ছেতাই হয়ে যায়। রামগড়ের পর তো একেবারে বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা! বৃষ্টির সঙ্গে মাঝে-মাঝে ঝড়ো বাতাস বইছিলো।
বাবা হিসেব করে দেখলেন, এভাবে গাড়ি চালালে রাত দশটার আগে কমলছড়ি পৌঁছতে পারবেন না। একবার ভাবলেন বৃষ্টি যদি না থামে রাতটা গোলাবাড়িতে হেডমাস্টারের বাসায় কাটিয়ে দেবেন। পরে মনে হলো বাড়ির সবাই ভাববে। বিশেষ করে দিদা তো কেঁদেকেটে সবার জান খারাপ করে দেবেন। না, রাত যত হোক কমলছড়ির আগে গাড়ি থামাবেন না।
সবকিছু যে প্ল্যানমতো হয় না বাবা সেটা টের পেলেন। সন্ধ্যে হতে তখনো অনেক দেরি, তবু তাঁকে গাড়ির হেডলাইট জ্বালাতে হয়েছিলো। এদিকটায় রাস্তার দুপাশে বন, দিনের আলোতেও ছায়া-ছায়া অন্ধকার ছড়িয়ে থাকে। খুব জরুরি দরকার না হলে একা কেউ চলাফেরা করে না। আকাশে মেঘ থাকলে তো কথাই নেই, রীতিমতো অন্ধকার। হেডলাইটের আলোতে বাবা সামনে দেখলেন, রাস্তার ওপর আড়াআড়িভাবে একটা গাছ। পড়ে আছে।
পথে কোথাও গাছ পড়ার মতো বাতাসের জোর তিনি দেখেন নি। হতে পারে এদিকে ঝড়ো বাতাসের দাপট বেশি ছিলো। কাছে গিয়ে গাড়িটা থামালেন। দেখলেন, গাছ না সরিয়ে যাবার কোনো পথ নেই। ভীষণ বিরক্ত হলেন। এমনিতেই এসব জায়গায় লোকজনের দেখা পাওয়া ভার, তার ওপর এই বৃষ্টি!
ইঞ্জিন বন্ধ করে নেমে দেখতে যাবেন আশেপাশে কোথাও কোনো বাড়িঘর আছে কি না, ঠিক তখনি দেখলেন দুপাশের জানালায় রেনকোটে মাথা আর মুখের অর্ধেক ঢাকা দুজন লোক। চাকমাদের মতো চেহারা। উঁচু করে ধরা স্টেনগানের নল চকচক
করছে। বাবার মেরুদণ্ড বেয়ে রক্তের স্রোত নেমে গেলো।
কোনো কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে আসুন। টেনে-টেনে বাংলায় হুকুম দিলো ওদের একজন। না, পেছনে তাকাবেন না। চুপচাপ নেমে আসুন।
বাবা কোনো কথা না বলে গাড়ি থেকে নামলেন। দেখলেন, অল্প দূরে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের হাতেও অস্ত্র।
আপনারা কি আমার গাড়ি হাইজ্যাক করতে চান? মনে-মনে ভয় পেলেও বাবার গলায় ভয়ের কোনো চিহ্ন ছিলো না।
গাড়ি নয়, আপনাকে চাই। আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন।
কোথায়?
আমাদের ঘাঁটিতে। ক্যাপ্টেন বিক্রম আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
আপনারা কি শান্তিবাহিনী?
হ্যাঁ, চলুন।
গাড়িতে আমার নতুন কেনা রাইফেলটা রয়েছে যে! পাইপ আর তামাক আছে।
পাইপ-তামাক নিতে পারেন। রাইফেল থাক। ওটা আমরা দেখবো। বলে স্টেনধারী তার সঙ্গীকে কি যেন বললো, বাবা কিছুই বুঝলেন না।
তিনি শুধু দেখলেন, কয়েকজন মিলে গাছটা টেনে নিয়ে গেলো জঙ্গলের ভেতরের দিকে। একজন গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গেলো।
বাবা বললেন, আমার গাড়ি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
স্টেনধারী নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, প্রাণে বেঁচে থাকলে গাড়ি বন্দুক সব ফেরত পাবেন। নাহলে ওটার কথা ভুলে যাওয়াই ভালো।
বৃষ্টিটা কমে এসেছে। বাবা বাড়ির কথা ভাবলেন। স্টেনধারী আবার কর্কশ গলায় বললো, চলুন, গায়ে হাত তুলতে আমাদের বাধ্য করবেন না।
বাবা ওদের সঙ্গে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বললেন, এটা কিন্তু ভীষণ অন্যায়। আপনাদের সম্পর্কে আমার ধারণা অন্য রকম ছিলো।
কথা যা বলার ক্যাপ্টেন বিক্রমকে বলবেন। অত্যন্ত কঠোর গলায় বললো স্টেনধারী।
লোকটার কথা বলার ধরন দেখে বাবার মনে হলো যে-কোনো সময় মানুষ খুন করতে পারে। আশেপাশে সাত-আটজনের কম হবে না। সবার চোখ বাবার ওপর।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দুঘণ্টা হেঁটে শান্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে এলেন বাবা। বেশ সুরক্ষিত ঘাঁটি। ঢোকার সময় অন্ধকারে কে যেন বললো, হল্ট। বাবার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন পাসওয়ার্ড বললো। ওদিক থেকে কি যেন বলা হলো। বাবাকে নিয়ে ওরা কাঁটাতারে ঘেরা একটা মাঠে ঢুকলো। মাঠের একপাশে কয়েকটা বেড়া আর ছনের ঘর, আরেক পাশে লম্বা একটা টিনের ঘর। গ্রামের স্কুলঘরের মতো মনে হচ্ছিলো ওটাকে। কয়েকটা ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছিলো। বাবাকে ওরা সেখানেই নিয়ে গেলো।
ক্যাপ্টেন বিক্রম যার নাম, বয়স খুব বেশি হলে তিরিশ হবে। পরনে খাকি শার্ট-প্যান্ট, টিপিক্যাল চাকমা চেহারা। স্টেনধারী দুজন বাবাকে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকে স্যালুট করলো। নিজেদের ভেতর কি যেন বললো ওরা। বাবা শুধু ইঞ্জিনিয়ার শব্দটা বুঝলেন। ইশারায় স্টেনধারীদের যেতে বললো ক্যাপ্টেন।
ওরা দুজন বেরিয়ে যাবার পর ক্যাপ্টেন পরিষ্কার বাংলায় বাবাকে বললো, বসুন।
বাবা ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন। হাতে বানানো একটা চুরুট ধরিয়ে ক্যাপ্টেন বললো, আপনি তো ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুল বাশার?
বাবা মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
কমলছড়িতে কেন এসেছেন?
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বাবা বললেন, আমি কি আপনাকে সেটা বলতে বাধ্য?
হ্যাঁ, কারণ এলাকাটা আমাদের। আমি জানি জায়গাটা বাংলাদেশের মাটিতে। সরকারের কাছ থেকে কমলছড়ির এক টুকরো খাস জমি আমি বারো বছর আগে লিজ নিয়েছি নিরানব্বই বছরের জন্য। বছর-বছর খাজনা দিচ্ছি। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিজের জমিতে বাড়ি করে থাকবো। এর জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে আমি প্রস্তুত নই।
কমলছড়িতে তিরিশ একর জমি আপনি লিজ নিয়েছেন, এটা আমরা জানি। আমাদের জানা দরকার অসময়ে চাকরি ছেড়ে কমলছড়ি এসে থাকার উদ্দেশ্য কী?
বাবা পাইপ ধরিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বললেন, যে সূত্রে আপনারা আমার অন্য সব পরিচয় পেয়েছেন, তাদের বলুন ঢাকায় আমার অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে।
কমলছড়িতে আপনার থাকা চলবে না। খুবই শান্ত শোনালো ক্যাপ্টেন বিক্রমের গলা।
আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন? বাবা রাগ চেপে রাখতে পারলেন না।
কথাটা যেভাবেই নেন, আমাদের ইচ্ছাটা আপনাকে জানিয়েছি।
আপনারাই তাহলে হুমকি দিয়ে কদিন আগে চিঠি পাঠিয়েছেন?
মানে! বিস্মিত হলো ক্যাপ্টেন।
সাত-আট দিন আগে আমি একটা চিঠি পেয়েছি। ওতে লেখা ছিলো আমাকে দশ দিনের মধ্যে কমলছড়ি ছাড়তে হবে। আমি নাকি গুপ্তচরগিরি করার জন্য এখানে এসেছি।
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ক্যাপ্টেন কি যেন ভাবলো। বললো, আপনার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির কোনো অভিযোগ আমাদের নেই। তবে গোলাবাড়ি বাজারে কয়েকজন দোকানদারকে আপনি আমাদের খাজনা দিতে বারণ করেছেন।
আমি কাউকে খাজনা দিতে বারণ করি নি। আমাকে ওরা জিজ্ঞেস করেছিলো আমি দেবো কিনা। বলেছি, আমি দেবো না।
ব্যাপারটা একই হলো। আপনি একজন প্রভাবশালী লোক। নতুন জিওসি জেনারেল মঞ্জুর আপনার পরিচিত। আপনি খাজনা দিতে অস্বীকার করলে কেউ দেবে না।
কে কাকে খাজনা দেবে এটা সরকার দেখবে। আমি সরকারি লোক নই। কাউকে আমি বলতে পারি না অমুককে খাজনা দাও। তবে আমার সিদ্ধান্ত আমি নেবো। আমি যেটা অন্যায় মনে করি তার বিরোধিতা অবশ্যই করবো।
আপনি কি আমাদের দাবি সমর্থন করেন না?
আপনি রাজনৈতিক আলোচনায় যাচ্ছেন। আমি এভাবে আপনার সঙ্গে রাজনীতি আলোচনা করবো না।
এভাবে মানে? কীভাবে কথা বলতে চান আপনি?
আপনার লোকজন আমাকে জোর করে ধরে এনেছে। এ অবস্থায় আপনাদের কোনো উপকার করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।
কোন অবস্থায় আলোচনা করবেন?
আগে বলুন আমি আপনাদের বন্দি কি না।
হ্যাঁ, বন্দি।
এ ধরনের আলোচনা কেবল মুক্ত পরিবেশে, সমমর্যাদার ভিত্তিতে হতে পারে।
আই সী! স্বগতোক্তি করলো ক্যাপ্টেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো, আমি মেজর রিককে খবর পাঠাচ্ছি। তিনি এসে আপনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তত দিন। আপনি আমাদের বন্দি।
.
১০. ল্যানটানা ঝোপের পাশে কে?
রাত যত বাড়ছিলো টুটুলরা বাবার কথা ভেবে তত চিন্তিত হচ্ছিলো। দিদা যথারীতি তসবি গোনা আর মানত করা শুরু করে দিয়েছেন। বাবা আসবে বলে মিতুল-ঝুমাও জেগে ছিলো। রাত দশটার পর দিদা ওদের ধমক দিয়ে ঘুমোতে পাঠিয়েছেন।
মা বললেন, এমনও তো হতে পারে বৃষ্টির জন্যে আসতে পারে নি।
সেদিন সকাল থেকেই এদিকে বৃষ্টি হচ্ছিলো। দিদা ভেজা গলায় বললেন, বৌমা, হাবুর চিঠিটা আবার পড়ে শোনাও তো।
রোববার থেকে এ নিয়ে কম করে হলেও দশবার পড়া হয়েছে বাবার চিঠি, যেটা তিনি ট্রাক ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়েছিলেন। ড্রাইভাররা রোববার রাতে জিনিসপত্র, পৌঁছে একরাত টুটুলদের বাড়িতে থেকে খেয়ে পরদিন চলে গেছে।
মা তাকের ওপর থেকে চিঠিটা নামিয়ে গড়গড় করে পড়ে গেলেন–নীনা, আমার ফিরতে দুদিন দেরি হবে। বন্দুকের লাইসেন্সের জন্য থাকতে হচ্ছে। তোমার ফর্দমতো জিনিসপত্র সব পাঠালাম। ফর্দের বাইরে টুটুলের ছবি আর গাছগুলো যাচ্ছে। আলাদা একটা ট্রাঙ্কে জানু সবার জন্য ঈদের কাপড় পাঠাচ্ছে। সব কিছু ফর্দ মিলিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে বুঝে নিও। আমি মঙ্গলবার ভোরে রওনা দেবো। সন্ধের পরপরই কমলছড়ি এসে পৌঁছবো। সব খবর ভালো। আরো ভালো কিছু খবর আছে, মুখে বলবো। আসিফকে বলবে আমি না আসা পর্যন্ত কোথাও যেন না যায়। ওদের খবর বেশি ভালো নয়। মাকে বোলো, ওঁর বেয়ান ঢাকা নেই। জানুরা শীতের ছুটিতে সবাই । বেড়াতে আসবে। ইতি হাবিব।
দিদা চিন্তিত গলায় বললেন, সন্ধ্যের পরপরই আসবে লিখেছে। এখন কটা বাজে টুটুল?
এগারোটা।
বাইরে গিয়ে দেখ তো বৃষ্টিটা ধরলো কি না।
টুটুল বাইরে এসে দেখলো, তখনো ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। তবে মেঘ হালকা হয়ে এসেছে।
মা আবার বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না মা। বৃষ্টির জন্য হয় রওনা হতে পারেনি, নয় চিটাগাং থেকে গেছে। কাল সকালে টুটুল খাগড়াছড়ি গিয়ে জানুদের বাসায় ট্রাঙ্ককল করবে।
দিদা টুটুল আর আসিফকে বললেন, তোরা তাহলে ঘুমোত যা। ভোরে উঠিস। মা বললেন, আপনিও ঘুমোতে চলুন মা।
না বৌমা। শুকনো গলায় দিদা বললেন, আমি ক রাকাত নফল নামাজ পড়ে তারপর শোব। তোমরা যাও।
টুটুল আর আসিফ ঘরে গিয়ে বিছানায় শোবার পরও ঘুমোতে পারলো না। আসিফ ভাবছিলো ওর দলের কথা। বাবা না ফেরা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না। লিখেছেন খবর বেশি ভালো নয়। ঢাকাতেও তাহলে বিপর্যয় শুরু হয়েছে? ইকবাল ভাই যদি এখনো ধরা না পড়েন, তাহলে ব্যবস্থা একটা হবেই।
টুটুল ভাবছিলো বাবার কথা। মা যতই বলুন, বৃষ্টির জন্য বাবা কোথাও আটকা পড়েছেন, ওর মন বলছিলো বাবা কোনো বিপদে পড়েছেন। ওর মোল বছরের জীবনে বাবার এমন একটা ঘটনা মনে পড়লো না যা কিনা বাবা কথামতো করেন নি। ও ট্রানজিস্টারে খবর শুনেছে, বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম আর নোয়াখালীতে। হতে পারে পথে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছেন। সেই পথ যদি রামগড় আর খাগড়াছড়ির হয়, তাহলে অনেক রকমের বিপদ হতে পারে। বাবা যদি আসার জন্য তাড়াহুড়ো করেন গাড়ির চাকা স্লিপ করতে পারে। ব্রেক যদি ঠিকমতো কাজ না করে মরণ অনিবার্য। হঠাৎ বাবা নেই–একথাটা মনে হতেই টুটুল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আসিফ উঠে টুটুলের কাছে এসে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কাঁদছো কেন টুটুল? বাবার জন্য খারাপ লাগছে?
টুটুল কান্না থামিয়ে উঠে বসলো–তুমি ঘুমোও নি বড়দা?
আসিফ বললো, ঘুম আসছে না।
বারান্দায় গিয়ে বসবে?
চলো।
দুজন কোনো শব্দ না করে ওদের ঘরের পাশের বারান্দায় গিয়ে বসলো। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। ছেঁড়া-ঘেঁড়া মেঘের ফাঁকে এক টুকরো ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ লুকোচুরি খেলছে। আসিফ সিগারেট ধরালো। এ বাড়িতে টুটুল ছাড়া কারো সামনে ও সিগারেট ধরায় না। গত রোববার বিদ্যুৎ আসার সময় আসিফের জন্য চার প্যাকেট স্টার এনেছিলো।
টুটুল আস্তে-আস্তে বললো, আমার কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে, বাবা কোনো বিপদে পড়েছেন।
ঘাবড়িয়ে না টুটুল। তাকে আমি যতটুকু জেনেছি, কোনো বিপদেই তিনি দিশেহারা হবার মানুষ নন। তুমি ইমোশনাল হয়ো না। বাবা যদি কোনো বিপদে পড়েও থাকেন, আমাদের দুজনকে অন্তত মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
টুটুলের মনে হলো, আসিফ ঠিকই বলেছে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সবকিছু করতে হবে। বললো, আমরা এখন কী করবো?
সকালে প্রথম কাজ হবে জানু ফুপিকে ফোন করা। বাবা যদি ঢাকা ছেড়ে থাকেন তাহলে কালকের দিনটা আমাদের দেখতে হবে। বিদ্যুতের বাবাকে খবরটা জানাতে হবে। এই এলাকার সঙ্গে আমি পরিচিত নই। বিদ্যুতের সাহায্য প্রয়োজন হবে। থানায়ও ওঁরা খবর নিতে পারবেন।
টুটুল মাথা নাড়লো–বাবা থানা-পুলিশ পছন্দ করেন না।
পথে যদি কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয় –কথাটা বলতে গিয়ে আসিফের গলা সামান্য কেঁপে গেলো–থানা সবার আগে খবর জানবে।
টুটুল ভাবলো বিদ্যুতের বন্ধু ফণীর কথা। এ ব্যাপারে ও কি কিছু করতে পারে? বললো, তোমার কী মনে হয় বড়দা, যারা চিঠি দিয়েছে তারা বাবাকে কিডন্যাপ করেছে?
সাধারণ চোর-ডাকাতের এত সাহস হবে না। আমি তো বলেছি, ওই চিঠি শান্তিবাহিনীর নয়। কিডন্যাপ করলে শান্তিবাহিনী করতে পারে। কিন্তু কেন করবে?
শান্তিবাহিনী যদি কিছু করে থাকে, বিদ্যুত্রা খবর নিতে পারবে।
আসিফ কোনো কথা বললো না। টুটুলও বসে রইলো চুপচাপ। ভাঙা চাঁদের ম্লান আলোয় পাহাড় আর জঙ্গলগুলোকে ভীষণ রহস্যময় মনে হচ্ছিলো। অনেকক্ষণ পর আসিফ বললো, টুটুল, ঘুমোবে চলো। কাল অনেক ছুটোছুটি করতে হবে।
টুটুল কোনো কথা না বলে ঘুমোতে গেলো।
পরদিন সকালে টুটুল লক্ষ্য করলো, মা, দিদা দুজনের মুখই থমথম করছে। মিতুল-ঝুমার অতটা বোঝার বয়স হয় নি। বডিবির সঙ্গে মাঠে কুকুরের বাচ্চা দুটো নিয়ে খেলছে। ছেলেটার নাম রেখেছে ওরা মিকি আর মেয়েটার নাম নিকি।
টুটুলকে দেখেই দিদা জিজ্ঞেস করলেন, খাগড়াছড়ির বাস কখন যাবে? টুটুল বললো, বাস নয় দিদা, জীপ। রামগড় থেকে প্রথমটা নটা থেকে দশটার ভেতর আসবে।
তখন ঘড়িতে সাতটা বাজে। দিদা হতাশ হয়ে বললেন, এত দেরি!
আরো দেরি হতে পারে দিদা। আমি মিতুলের সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি।
সাইকেলে এত দূর যেতে পারবি?
পাঁচ-ছমাইল এমন কি দূর!
তাহলে বাছা তুই রওনা হয়ে যা।
মা বললেন, জানু যাই বলুক না কেন, তুই সোজা এখানে আসবি। অন্য কোথাও যাবি না।
ঠিক আছে মা। বলে সাইকেল নিয়ে ছুটলো টুটুল।
আসিফ দেখলো, দিদা প্রাণপণে কান্না চাপছেন। মা কাল দিদাকে বলেছিলেন, তিনি কাঁদলে ছেলেমেয়েদের মন ভেঙে যাবে।
ঘরে শুয়ে কিছুক্ষণ বই পড়ার চেষ্টা করলো আসিফ। পড়ায় মন বসলো না। উঠে মাকে বললো, এ জায়গাটা ভালো করে দেখা হয় নি মা। চারপাশটা একটু ঘুরে দেখি।
মা শুধু বললেন, আমাদের জমি ছেড়ে দূরে কোথাও যেও না।
আর কোনো কথা না বলে আসিফ বেরিয়ে পড়লো। প্রথমে বেড়াটা দেখলো ভালো করে। কাঠের ফ্রেমে কাঁটাতার পেঁচিয়ে কিছু দূর পরপর কংক্রিটের পিলার বসিয়ে বেশ শক্ত হয়েছে কাঠামোটা। সহজে কেউ ভাঙতে পারবে না। প্রায় তিন বিঘা জমি বেড়ার ভেতর। পুকুরটা বাইরে। পুকুরের সাইজ দুবিঘার ওপরে। ওটাকে ঘেরার মধ্যে আনতে গেলে প্রচুর খরচ পড়তো। কাঠের খুঁটি নগদ দামে কিনতে না হলেও কংক্রিটের পিলার আর কাঁটাতারের জন্য খরচ কম হয় নি। বাবা ঢাকা থেকে আরো কুড়ি বস্তা সিমেন্ট পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে দশ বস্তা বাথরুমের জন্য রেখে বাকি দশ বস্তা দিয়ে পরদিন ওরা কংক্রিটের পিলার ঢালাই করেছে। বাবার কাজ এগিয়ে রেখে তাঁকে খুশি করার ইচ্ছে হয়েছিলো টুটুলের।
ঘুরতে-ঘুরতে বেড়ার বাইরে এলো আসিফ। গোটা জমিকে ভাগ করে একদিকে লাগিয়েছেন সেগুন আর মেহগনির মতো দামি গাছ। একদিকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারকেল জাতীয় বেশ কিছু ফলের গাছ। দু বিঘা জুড়ে করেছেন সিডলেস লেবুর বাগান। এদিকে এর ফলন ভালো হয়। সীমানা বরাবর লাগিয়েছেন কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার গাছ। সব মিলিয়ে পুরো জমির অর্ধেকও পরিষ্কার করতে পারেন নি। উত্তর আর পুব দিকে উঁচু পাহাড় বলে জঙ্গল এখনো কাটা হয় নি। পশ্চিমের সীমানা বরাবর একটা ছোট্ট পাহাড়ী ঝরনা বয়ে গেছে। জোর বৃষ্টি হলে ঘোলা পানির ঢল নামে পাহাড় থেকে। ওটার পাশে বেশ কিছুটা জমিতে করমালি ধান চাষ করছে। ওরা সারা বছর খেয়েও কিছু বিক্রি করে। প্রথম বার টুটুলদের জন্য পাঠিয়েছিলো। বাবা বারণ করাতে পরে আর পাঠায় নি।
একসময় উত্তরের ছোট পাহাড়ের কাছে এলো আসিফ। বেশি খাড়া নয়, তবু সাবধানে পা ফেলে ওপরে উঠলো। দেখলো, বড় একটা সেগুন গাছের নিচে ছোট-ছোট ঝোঁপের ভেতর হলুদ, লাল বুনো ল্যানটানা ফুল ফুটে আছে। আজকাল ঢাকায় ওগুলো যত্ন করে সবাই বাগানে চালাচ্ছে।
হঠাৎ ল্যানটানা ঝোঁপের পাশে চোখ আটকে গেলো আসিফের। বেশ কয়েকটা সিগারেটের টুকরো দেখলো সেখানে। বৃষ্টির পানিতে কয়েকটা খুলে গেছে। কয়েকটা আস্তই আছে। তুলে দেখলো ইংরেজিতে চার্মিনার লেখা। ইণ্ডিয়ান সিগারেট এখানে কীভাবে এলো ভাবতে গিয়ে কপালে ভাঁজ পড়লো। সামনে তাকালো। তখনি সন্দেহটা জাগলো। ছবির মতো দেখা যাচ্ছে কাঠের বাড়িটা। অল্প দূরে পাথরের ঘর দুটো, তার পাশে বেড়ার ঘরটা–সবকিছু রোদে ঝলমল করছে। করমালি পুকুরের ধারে মাটি কোপাচ্ছে, করমালির বৌ পুকুরে হাঁড়ি-পাতিল ধুচ্ছে। করুই গাছের নিচে মিতুল আর ঝুমা বডিবির সঙ্গে নিকি-মিকিকে নিয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে। বনের ভেতর কয়েকটা শালিকের ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। দিদা একবার ঘর থেকে বেরিয়ে বোধহয় মিতুলকে ডাকলেন। মিতুল ছুটে গেলো দিদার কাছে। দিদা ওকে কি যেন দিলেন। ওটা নিয়ে মিতুল আবার বডিবির কাছে গেলো। কোনো শব্দ শুনতে পেলো না আসিফ। আগেকার দিনের বায়স্কোপের মতো মনে হলো।
কেউ নিশ্চয়ই এখান থেকে ওদের বাড়ির ওপর নজর রাখছে। ভাবলো আশেপাশে একটু ঘুরে দেখবে, ঠিক তখনি দেখলো হন্তদন্ত হয়ে সাইকেল চালিয়ে টুটুল আসছে। নম্বা লম্বা পা ফেলে আসিফও ছুটলো বাড়ির দিকে।
সাইকেল রেখে হাঁপাতে-হাঁপাতে টুটুল বললো, জানু ফুপি বলেছেন, বাবা গতকাল ভোরে রওনা হয়ে গেছেন।
তাহলে? দিদার গলা ভেঙে গেছে।
খাগড়াছড়িতে হেডমাস্টার কাকার সঙ্গে দেখা। স্কুলের কি কাজে গিয়েছিলেন। বাবার কথা শুনে আমাকে নিয়েই থানায় গেলেন। গতকাল কোনো অ্যাকসিডেন্টের খবর আসে নি। থানা থেকে রামগড়ও খবর নিয়েছে। কাকা ফেরার সময় আসবেন। বললেন, তিনি এসে যা করার করবেন।
মা টুটুলকে একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে দিলেন। ঘামে ভেজা জামা খুলে বারান্দায় বসেই শরবত খেলো টুটুল। মিতুল ওকে দেখে ছুটে এলো–বাবা আসবে না দাদা?
আসবে। টুটুলের গলায় যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস।
কখন আসবে?
কাজে গেছে। কাজ শেষ হলেই আসবে।
আসিফ বললো, মিতুল, নিকি-মিকিকে বল ছুঁড়ে দৌড়ানো প্র্যাকটিস করাও।
মিতুল চলে গেলো। দিদা কতক্ষণ বসে থেকে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকলেন। আসিফ চাপা গলায় বললো, টুটুল, চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
কি জিনিস?
সামনের পাহাড়ের ওপর। এখনি যাবে, না কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে?
বিশ্রামের কি আছে, চলো যাই।
টুটুলকে নিয়ে আসিফ ছোট পাহাড়টায় উঠে ল্যানটানা ঝোঁপের পাশে এনে সিগারেটের টুকরোগুলো দেখালো।
টুটুল উত্তেজিত গলায় বললো, সিগারেটের টুকরো এখানে কে ফেলেছে?
আসিফ বললো, আমার মনে হচ্ছে কেউ এখান থেকে আমাদের বাড়িটার ওপর নজর রেখেছিলো।
রেখেছিলো বলছো কেন?
কাল রাতের পর থেকে এদিকে বৃষ্টি হয় নি। এই সিগারেটগুলো বৃষ্টির আগে খেয়েছিলো কেউ।
বাবার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে এর কি কোনো সম্পর্ক আছে?
থাকতে পারে।
জায়গাটা একটু ঘুরে দেখলে হয় না বড়দা? আমরা যদি কোনো সূত্র পাই? উত্তেজনায় টুটুলের চোখ দুটো চকচক করছিলো।
ওরা দুজন পাহাড়টা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও আর কোনো সূত্র পেলো না। এ পাহাড় থেকে জঙ্গল শুরু হয়ে উত্তর দিকে আরো ঘন হয়ে গেছে। টুটুল আসিফকে দেখালো ওদের জমির সীমানা কদ্দূর। আসিফ বললো, এখান থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার কদ্দূর জানো টুটুল?
জানি। বিদ্যুৎ বলেছে মাইল বিশেক হবে। ওদের গোলাবাড়ি থেকে দশ-এগার মাইলের মতো। রামগড় হচ্ছে বর্ডার। কেন, বর্ডারের খোঁজ করছো কেন?
সিগারেটগুলো ইণ্ডিয়ান। এদিকে হাটে কি ইণ্ডিয়ান জিনিসপত্র পাওয়া যায়?
গোলাবাড়ি, খাগড়াছড়িতে দেখি নি। রামগড়ে পাওয়া যায় কি না জানি না।
আমার ধারণা যে লোক বাড়ির ওপর নজর রেখেছিলো সে নিয়মিত ইণ্ডিয়া যায়।
কি করে বুঝলে?
এখানকার বাজারে চার্মিনারের চেয়ে স্টার অনেক সস্তা পড়বে। চার্মিনার বিক্রি করে কেউ পোষাতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই মনে হচ্ছে ইণ্ডিয়ায় নিয়মিত যাতায়াত না থাকলে চার্মিনারের অভ্যাস সম্ভব নয়।
টুটুল ওর ঘড়ি দেখে বললো, বাড়ি চলো বড়দা, দিদা না হলে চেঁচামেচি শুরু করবেন।