পরদিন বিকেলে টুপুর সবে স্কুল থেকে ফিরেছে, কুশল লাফাতে লাফাতে উপস্থিত। চকচকে চোখে বলল, এই জানি, মিতিনমাসির আন্দাজই ঠিক।
টুপুর ভারিক্কি মুখে বলল, মিতিনমাসি কখনওই ভুলভাল গেস করে না।
তাই তো দেখছি। লিয়াংরা সত্যিই কাল খবর পেয়ে গিয়েছে। পুলিশ কাল বিকেলেই লিয়াংয়ের বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে আঙ্কল ঝিয়েনের মৃত্যুটা অ্যাকসিডেন্ট নয়, হোমিসাইড।
লিয়াংরা তো আগেই সন্দেহ করেছিল। পুলিশ তো জাস্ট কনফার্ম করল।
তা ঠিক। তবে ওর বাবা নাকি একদম গুম হয়ে গিয়েছেন। কারও সঙ্গে কথাই বলছেন না।
ওরকম হয়। সন্দেহটা সত্যি বলে প্রমাণ হলে একটা বড় ধাক্কা তো লাগেই …লিয়াংকে আমাদের কালকের কথাগুলো বললি?
হুঁ।
শুনে কী রিঅ্যাকশান?
বোঝা গেল না। ওর মুখে তো সহজে এক্সপ্রেশন ফোটে না। তবে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। তোর কী মনে হয় রে? কাল অত ঘোরাঘুরি করে কোনও লাভ হল?
জ্ঞান বাড়ল। ডেটা জমল।
কাজের কাজ কিছু হল কী?
নিশ্চয়ই হয়েছে। মিতিনমাসি মিছিমিছি ছোটাছুটি করে না।
তার মানে কাল যাদের মিট করলাম, তারা যে-কেউ কালপ্রিট হতে পারে? কুশল নাক কুঁচকোল, অবশ্য একটা ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছিলাম, একজন প্রোফেসর রাত্তিরবেলা একদম বদলে যেত। তখন সে ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, সব কিছু করতে পারত। হয়তো ওই তিনজনের মধ্যে একজন ওরকম দুমুখো মানুষ!
হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তবে ওঁদের সঙ্গে বাতচিত করে একটা তো লাভ হয়েছে। ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা যে একটি মহামূল্যবান বস্তু সেটা তো জানা গেল। আর ওটা কেনার পরে মৃত্যু, মানে ওটা কেনার জন্যেই মৃত্যু। এবং ওটা খোওয়া যাওয়াও কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। মোটিভ ইজ ক্লিয়ার। এবার শুধু খেলিয়ে খেলিয়ে তোলার অপেক্ষা।
অত সোজা নয় রে টুপুর। এখনও মিতিনমাসিকে প্রচুর দৌড়োতে হবে। আঙ্কল ঝিয়েনের স্কুল আছে। তাঁর সহকর্মীদের কে কেমন আমরা জানি না…
কিন্তু তারা কি কেউ জিনিসটার দাম জানে? গুরুত্ব বোঝে?
অবনী উঁকি দিয়েছেন টুপুরের ঘরে। সদ্য কলেজ থেকে ফিরেছেন, এখনও পোশাক বদলাননি। দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, কী-ই, তোমাদের চাইনিজ-পাজল কদ্দূর? একটাও গিঁট খুলল?
কুশল বলল, না মেলোমশাই। সুতো টানাটানি চলছে।
এবং গিঁট আরও শক্ত হচ্ছে। তাই তো? অবনী ঢুকে পড়লেন ঘরে, আমি কিন্তু তোমাদের কেসে খানিকটা হেল্প করতে পারি।
কীভাবে?
তোমরা তো কাল জেনে এলে কিউরিও শপের মালিকের কোনও পূর্বপুরুষ নাকি এক চিনেম্যানের কাছ থেকে ওয়ালহ্যাঙ্গিং.. থুড়ি, ম্যাপটা পেয়েছিল। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি, লোকটা এই কথাটা অন্তত মিথ্যে বলেনি।
টুপুর বলল, কোন যুক্তিতে বলছ?
কারণ, বজবজের দিকটায় সত্যিই একসময় চাইনিজ কলোনি ছিল। প্রপার বজবজ নয়, তার কাছাকাছি। জায়গাটার নাম এখন অছিপুর। এই অছিপুর নামটা কীভাবে হয়েছিল জানিস? আজ থেকে প্রায় সওয়া দুশো বছর আগে আৎসু নামে এক ক্যান্টনি চিনা জাহাজভরতি চা নিয়ে বাণিজ্যে যাচ্ছিল। পথে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ সরতে-সরতে এসে পড়ল বজবজের গঙ্গায়। জাহাজ গিয়েছে ভেঙে, তাই আৎসুকে বজবজেই নামতে হল। এক্কেবারে অচেনা জায়গা, অজানা ভাষা… আস্সুর তো মাথা খারাপ হওয়ার দশা। তবে জায়গাটা ওর খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির গভর্নর জেনারেল। আৎসু তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে চা-টা খাওয়াল, নিজের অবস্থাটা বোঝাল। হেস্টিংস তো চা খেয়ে বেজায় খুশি। আৎসুকে একটা ঘোড়া দিয়ে বললেন, এক ঘণ্টায় যতটা জায়গা বেড় দিয়ে আসতে পারবে, সবটাই তোমার। ব্যস, জমিজমা পেয়ে আৎসু থেকেই গেল। বজবজের কাছে একটা চিনির কারখানা খুলেছিল আৎসু। চিনে তখন ঘোর দুঃসময়, দুর্ভিক্ষ, মড়ক, দাঙ্গা লেগেই আছে। আসু সুযোগ বুঝে চিন থেকে সস্তায় লেবার আনতে শুরু করল চিনির কলে। ওই চিনিকল ঘিরেই তৈরি হল আসুপুর। চিনা মহল্লা। সেই আৎসুপুরই মুখে মুখে অছিপুর।
কুশল বলল, কিন্তু ওদিকে কি এখন আর চিনা আছে? শুনি না তো?
যারা ছিল, তাদের বংশধররা সবাই এখন কলকাতায়। আস্সুর চিনিকলটা তো চলেনি। পাঁচ-ছবছরের মধ্যে আৎসুও মারা গেল, চিনিকলও ডকে উঠল। আর ওখানকার চিনারাও ধীর ধীরে সরে এসে ডেরা বাঁধল কলকাতায়। …মনে হয় ওই আৎসুর সময়েই, কিংবা তার দশ-বিশ বছর পরে, কিউরিও শপের মালিকের পূর্বপুরুষের কপালে জুটেছিল ওই ম্যাপখানা। কিউরিও শপের মালিক এত ইতিহাস জেনে, সেইমতো সাজিয়েগুছিয়ে মিথ্যে বলবে–অসম্ভব।
টুপুর বলল, আমারও ওর কথার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিই বলছে।
অবনী হেসে বললেন, আমার এই ইনফরমেশনটা তা হলে তোমার ডিটেকটিভ মাসিকে পাস করে দিও।
চিনাদের নিয়ে আরও খানিকক্ষণ আড্ডা চলল তিনজনের। লিয়াংয়ের আবির্ভাবের পর থেকে চিনাদের সম্পর্কে অসম্ভব আগ্ৰহ বেড়ে গিয়েছে অবনীর। এখন তিনি অবিরাম জ্ঞানভাণ্ডার বাড়িয়ে চলেছেন। বছরে চিনাদের কটা বড় উৎসব হয়, কোন উৎসবের পিছনে কী গল্প আছে, কোনটাকে চিনারা শুভ বলে মানে, কোনটা অশুভ – সব তিনি সংগ্রহ করে ফেলেছেন ইন্টারনেট থেকে। অবনীর দৌলতেই টুপুররা জানতে পারল, চিনারা বেগুনকে শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে করে।
কুশল বাড়ি গেল সাড়ে ছটা নাগাদ। টুপুর বসল অ্যালজেব্রা নিয়ে। সন্ধের দিকেই অঙ্কটা তার আসে ভাল, রাত বাড়লে উত্তর আর কিছুতেই মিলতে চায় না। পুরো একটা প্রশ্নমালা শেষ করে, খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে, সবে একটু টিভির সামনে বসেছে, হঠাৎই ফোনের ঝনাৎকার। সহেলি রিসিভার তুলেছিলেন, কানে চেপেই আঙুল নেড়ে ডাকলেন টুপুরকে, ধরো। তোমার চিনে বন্ধু।
টুপুর একটু অবাকই হল। তবে স্বরে ফুটতে দিল না বিস্ময়। স্বাভাবিকভাবেই বলল, হাই!
হাই! গুড ইভনিং। আমি কি তোমাকে ডিসটার্ব করলাম?
নট অ্যাট অল। কী বলছ বল?
আমার পাপা তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।
টুপুর চমকাল। কী বলবেন লিয়াংয়ের বাবা?
ওপারে লিয়াংয়ের বাবার গলা শোনা গেল। কেমন যেন মিয়োনো-মিয়োনো, হ্যালো, মাই চাইল্ড!
ইয়েস আঙ্কল।
লিয়াংয়ের মুখে শুনলাম তোমরা কাল সারাদিন অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছ। তোমার মাসি আমার ভাইয়ের মৃত্যুর তদন্ত করছেন। তাঁকে বোলো, এই হতভাগ্য মানুষটা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
কৃতজ্ঞতার কিছু নেই আঙ্কল। লিয়াং আমার বন্ধু। তার বাড়ির একটা বিপদে আমরা সবাই তার পাশে থাকব, এটাই তো স্বাভাবিক।
নো মাই চাইল্ড। এটা তোমার মাসির মহানুভবতা। তিনি এক পেশাদার গোয়েন্দা। তাঁর মূল্যবান সময় আমার ভাইয়ের জন্য তিনি খরচ করছেন। তাঁকে বোলো, তাঁর যথাযোগ্য পারিশ্রমিক আমি হয়তো দিতে পারব না, তবু কথা দিচ্ছি, আমার ভাইয়ের হত্যাকারীকে ধরে দিলে তিনি যে-অঙ্কই চাইবেন, আমি দেব।
ছি ছি, পারিশ্রমিকের কথা উঠছে কেন আঙ্কল? মাসি তো আমাদের ভালবেসে… লিয়াংয়ের কথা ভেবে..
ঠিক কথা। গাছ কখনও প্রতিদানের আশায় ফল দেয় না। কিন্তু মানুষের তো গাছের প্রতি কর্তব্য আছে। তুমি মাসিকে আমার মিনতিটা জানিও। তাঁকে আরও বোলো, ঝিয়েনের মৃত্যুতে আমার পাঁজরের একটা হাড় খসে গিয়েছে। অপরাধী ধরা না-পড়লে আমার যন্ত্রণা কমবে না।
অত্যন্ত শান্ত স্বরে কথাগুলো বলছেন লিয়াংয়ের বাবা। কিন্তু শুনতে শুনতে টুপুরের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ঢোক গিলে বলল, নিশ্চয়ই বলব, আঙ্কল।
আর একটা অনুরোধ। যে ম্যাপটার কথা তোমরা শুনেছ, সেটা কিন্তু চিনাদেরই সম্পত্তি। কোনও একজন বাঙালিকে আমাদেরই কেউ একসময় উপহার দিয়েছিলেন। ওটা আবার আমরা ফেরত পেলে বিশেষ খুশি হব। আমার ভাইয়ের আত্মাও শান্তি পাবে।
আমি বলব মাসিকে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
শুভরাত্রি। প্রার্থনা করি, শয়তান যেন তোমার ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না-পারে।
টুপুরও গুডনাইট বলতে যাচ্ছিল, দুম করে কাজের কথাটা মনে পড়ে গেল। কাজটা কুশলেরই করার কথা, তবে সে নিৰ্ঘাত ভুলে মেরে দিয়েছে।
ব্যস্তভাবে টুপুর বলে উঠল, এক সেকেন্ড, আঙ্কল, এক সেকেন্ড।
বলো, মাই চাইল্ড?
আমার মাসি একটা কথা জানতে চেয়েছিল।
কী?
আঙ্কল ঝিয়েনের মোবাইল নাম্বারটা কী ছিল?
নোট করে নাও। নাইন এইট থ্রি…
ফোন রেখে একটুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইল টুপুর। মিতিনমাসিকে কি এখনই জানাবে লিয়াংয়ের বাবার কথাগুলো? ইচ্ছে করছে না। হঠাৎই মনটা কেমন ভারী হয়ে গিয়েছে।
রাতে অবশ্য বেশ গাঢ় ঘুম হল টুপুরের। লিয়াংয়ের বাবার শুভকামনায় কী? অন্য দিন বেশ স্বপ্নটপ্ন দ্যাখে, আজ সেসবের বালাই নেই।
সকালে নিদ্ৰা ভঙ্গ হতে না হতেই নতুন চমক। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চাঞ্চল্যকর সংবাদ। অবনীই ডেকে তুলে দেখালেন টুপুরকে। চিনা ইতিহাসবিদ ঝাও ঝিয়েনের হত্যাকারী সন্দেহে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নামটা পড়ে টুপুর প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মন্টু। কিউরিও শপের মালিক স্বপন দত্তর সেই ছোকরা কর্মচারী!
.
১০.
টুপুর ভাবছিল মিতিনমাসিকে একটা ফোন করবে, তার আগেই দূরভাষে মিতিনমাসি স্বয়ং।
টেলিফোন কানে চেপে টুপুর হাউমাউ করে উঠল, আজকের কাগজটা দেখেছ?
মন্টুকে গ্রেপ্তার? হুঁ, চোখে পড়ল। মিতিনের কোনও ভাবান্তর নেই, আজ তোর কটা অবধি স্কুল রে?
আজ তো শনিবার। একটায় ছুটি। টুপুর ফের প্রসঙ্গে ফিরল, এটা কেমন হল, মিতিনমাসি? একটা নিরীহ ছেলেকে পুলিশ অকারণে হ্যারাস করবে? মালিকটাকে পাকড়াও করলেও না হয় কথা ছিল।
কিছুই অকারণে ঘটে না টুপুর। বাতাস ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না।
কিন্তু তোমার যুক্তি কী বলে? আঙ্কল ঝিয়েন যেদিন জিনিসটা কেনেন, মন্টু তো সেদিন কাজেই আসেনি।
তাতে কিসসু প্রমাণ হয় না। নিশ্চয়ই পুলিশ কিছু একটা ভেবে তুলে নিয়ে গিয়েছে। ..যাক গে, পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দে, আমরা আমাদের মতো এগোই। মিতিন আবার একটু থেমে থেকে বলল, কাজের কথা শোন। দিদিকে বলে দে, তুই আজ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিস না। আজ আর কাল আমার এখানে থাকবি, পরশু মেসো তোকে স্কুলে পৌঁছে দেবে। ছুটির পর স্কুলগেটে দাঁড়াস, আমি তোকে তুলে নেব।
কোথায় যাব গো আমরা?
মিস্টার ঝিয়েনের কর্মক্ষেত্রে। কুশল যদি আগ্রহী থাকে, তাকেও সঙ্গে নিতে পারিস।
ওদের সেন্ট পিটার্সে তো শনিবার হলিডে। কুশল মনে হয় বাড়িতেই থাকবে।
ওকেও তা হলে তোর স্কুলের সামনে চলে আসতে বল। কাঁটায় কাঁটায় একটায়।
ঠিক আছে। …ইস, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম। লিয়াংয়ের বাবা কাল রাতে ফোন করেছিলেন। উনি বলছিলেন..
পরে শুনব। তাড়া আছে। ছাড়ছি।
ফোন রেখে বোঁ করে একখানা পাক খেয়ে নিল টুপুর। কী মজা! আজ আর কাল, দুটো দিন, উত্তেজনার আগুনে বেশ সেঁকে নেওয়া যাবে নিজেকে! মিতিনমাসি নিশ্চয়ই কোনও পরিকল্পনা করছে.. টুপুরকে কি আর একটুও বলবে না?
সহেলি অবশ্য প্রস্তাবটা শুনে খুব প্রীত হলেন না। গজগজ করতে করতে গুছিয়ে দিলেন টুপুরের জামাকাপড়। কড়া গলায় বললেন, যাচ্ছ যাও। কিন্তু কোনও অজুহাতেই সোমবার স্কুল ড়ুব দেওয়া চলবে না।
স্কুলে গিয়েও টুপুরের মন উচাটন। কখন একটা বাজে!
মিতিন আজ এল ট্যাক্সিতে। কুশলও সময়মতে পৌঁছেছিল, টুপুর আর কুশলকে তুলে নিয়ে স্টার্ট দিল ট্যাক্সি। টেরিটিবাজারের দিকে চলেছে।
স্কুলের নাম নানকিং হাই স্কুল। দোতলা বাড়ি, খুব একটা প্রকাণ্ড নয়। চেহারাও বেশ মলিন। ভিতরে ঢুকে টুপুর তো রীতিমতো হতাশ। ছাত্রছাত্রী কোথায়? স্কুল প্রায় শুনশান, দুটো-চারটে চিনা কুচোকাঁচা দেখা যাচ্ছে শুধু। সবে তো দেড়টা, আজ আগে-আগে ছুটি হয়ে গিয়েছে নাকি?
প্রিন্সিপালের নেমপ্লেট লাগানো ঘরে এক চিনা বৃদ্ধা। পরনে গাউন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
দরজায় দাঁড়িয়ে মিতিন বলল, মে আই কাম ইন?
মহিলা চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন একবার। নরম গলায় বললেন, ইয়েস?
আমরা মিস্টার ঝিয়েনের মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে এসেছি, মিতিন টেবিলের সামনে গিয়ে নিজের কার্ড বাড়িয়ে দিল, বসতে পারি?
ও শিয়োর। টুপুরদেরও হাত তুলে ইশারা করলেন মহিলা, তোমরাও বোসো।
ইংরেজিতেই কথাবার্তা চলছে। মহিলা বিনীত ভঙ্গিতে নিজের নাম-পরিচয় জানালেন। তিনিই অধ্যক্ষা কিউ ইউয়ান। থাকেন স্কুলেরই দোতলায়। প্রায় বিয়াল্লিশ বছর ধরে এই স্কুলে রয়েছেন। অবসর নেওয়ার বয়স হওয়া সত্ত্বেও স্কুল কমিটি তাঁকে নাকি দায়িত্ব থেকে রেহাই দিচ্ছে না।
মূল প্রসঙ্গে যেতে মিতিন সময় নিল না বিশেষ। জিজ্ঞেস করল, মিস্টার ঝিয়েনের মৃত্যুটা যে অস্বাভাবিক, তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন? আপনার কি কখনও মনে হয়েছিল, মিস্টার ঝিয়েনের এরকম একটা বিপদ ঘটতে পারে?
মিসেস ইউয়ান জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, কখনও না। একদমই না। ঝিয়েনের কোনও শত্রু থাকতে পারে, আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
সহকর্মীদের সঙ্গে মিস্টার ঝিয়েনের সম্পর্ক কেমন ছিল?
সহকর্মী? মিসেস ইউয়ান ম্লান হাসলেন, তা হলে তো আমাদের স্কুলের অবস্থাটা আগে বলতে হয়। আমাদের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমতে কমতে এখন ছেচল্লিশে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা সাকুল্যে ছয়। আমাকে নিয়ে। মিসেস মিং, মিসেস ওয়া আর মিস লি। ঝিয়েন ছাড়া আর-একজনই শিক্ষক আছেন। মিস্টার ওয়াং। তা মিস্টার ওয়াংয়েরও অবসর গ্রহণের সময় হয়ে গিয়েছে। এঁদের কারও সঙ্গে ঝিয়েনের অসদ্ভাব ছিল বলে আমি শুনিনি।
মিস্টার ঝিয়েন কি সহকর্মীদের সঙ্গে খুব গল্পগুজব করতেন? মানে উনি তো গবেষণা করছিলেন… সেসব বিষয় নিয়ে…?
কথা সে সকলের সঙ্গেই বলত। তবে আমরা একটু দূরত্ব বজায় রাখতাম।
কেন?
তার কি এই স্কুলে পড়ানোর কথা? সে তো ছিল অনেক উঁচু স্তরের। এই বিদ্যালয় এখন নামেই হাই স্কুল, কিন্তু এখানে তো ক্লাস ফোরের বেশি পড়ানোই হয় না। একটু আধটু চিনা ভাষা শেখাই বাচ্চাদের, চিনের ইতিহাস-ভূগোল সম্পর্কে খানিকটা অবগত করি, আর অঙ্কের প্রাথমিক পাঠটাঠ দিই। এর জন্য কতটুকু বিদ্যে লাগে, বলো? তাই আমাদের কারওই তেমন প্রথাগত ডিগ্রি নেই। একমাত্র ঝিয়েনেরই ছিল সেটা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে একজন উজ্জ্বল ছাত্র। এম.এ পাশ। তবু সে এখানে পড়াত। এই স্কুলকে ভালবেসে। ইচ্ছে করলে সে যে-কোনও ভাল জায়গায় যেতে পারত, কিন্তু যায়নি। আমরা সবাই ঝিয়েনকে খুব সমীহ করতাম। আমাদের মতো স্বল্পশিক্ষিতদের সঙ্গে সে গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেই বা কেন, আর আমরা তা বুঝবই বা কী! তবে জানতাম, সে চিনাদের গৌরব বৃদ্ধির জন্য পড়াশোনা করছে।
তার মানে কোনও ওয়ালহ্যাঙ্গিং বা কোনও ম্যাপ কেনার ব্যাপারে তিনি আপনাদের কাউকে কিছু বলেননি?।
মারা যাওয়ার দিন সকালে আমাকে একবার বলেছিল কী একটা যেন কিনতে যাবে। ভীষণ খোশমেজাজে ছিল সেদিন। বেরনোর মুখে মুখে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিল, তখন মোবাইলে কার যেন একটা ফোন এল। তাঁর সঙ্গেও খুব হেসে হেসে কথা হল খানিক।
চিনা ভাষায়?
না। ইংরেজিতে। …তারপর তো হুড়মুড় করে বেরিয়েই গেল। মিসেস ইউয়ান চশমা খুলে চোখ মুছলেন, কে জানত ওটাই তার শেষ যাওয়া! ছেলেটা আমাকে জিয়ের মতো, মানে বড় দিদির মতো দেখত। আমার ছোট ভাই আর রইল না।
আর-একটা কথা। আপনি কি স্মরণ করতে পারেন, মোবাইলে উনি কী বলছিলেন?
মিসেস ইউয়ানের বলিরেখা এসে যাওয়া কপালে ভাঁজ বাড়ল।
দুচার সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, শুধু তো ঠিক আছে ঠিক আছে করছিল। একবার বোধহয় সাড়ে চারটে শব্দটা উচ্চারণ করল…
কোথাও যাওয়ার কথা, বা কারও সঙ্গে দেখা করার কথা বলছিলেন কী?
সেটা তো বলতে পারব না। মিসেস ইউয়ান বড়সড় একটা শ্বাস ফেললেন, এবার বোধহয় আমাদের স্কুলটা উঠেই যাবে। ঝিয়েনের নাম দেখে দু-চারজন অভিভাবক তা-ও ছেলেমেয়ে পাঠাত, আর তো সেই আকর্ষণটুকুও রইল না। …এমনিই তো কেউ আর চিনে ভাষায় পড়াশোনা করতে চায় না, সবাই ছুটছে ইংরেজি মাধ্যমের দিকে…. কেনই বা ছুটবে না? ইংরেজি না জানলে কি আর চাকরি পাবে? ..আমার নাতিকেই তো এই স্কুলে ভর্তি করতে পারলাম না। ছেলে, ছেলের বউ, দুজনেই এমন আপত্তি জুড়ল! …অথচ আমাদের ভাষার কত ঐশ্বর্য ছিল…
দুঃখী-দুঃখী মুখে একটানা বলে চলৈছেন মিসেস ইউয়ান। তাঁর মন খারাপটা টুপুরকেও ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সত্যি, ইংরেজি ছাড়া বাকি সব মাতৃভাষারই বুঝি একই হাল।
স্কুল ছুটির ঘণ্টা পড়ল। বাচ্চারা বেরোচ্ছে ক্লাসরুম থেকে। টুপুরদের নিয়ে স্কুলের স্টাফরুমে এলেন মিসেস ইউয়ান। শিক্ষকশিক্ষিকারা যাওয়ার তোড়জোড় করছিলেন, মিস্টার ঝিয়েনের সম্পর্কে মিতিন জানতে এসেছে শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন তাঁরা। প্রত্যেকেই হায়-হায় করছেন। এক মধ্যবয়সি শিক্ষিকা তো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আলাপচারিতা কাম জিজ্ঞাসাবাদ সেরে টুপুররা যখন বেরোল, সূর্য অনেকটাই পশ্চিমে হেলে গিয়েছে।
বাইরে এসে মিতিন বলল, চল, এবার একটু লিয়াংয়ের বাড়ি যাই। লিয়াংয়ের বাবা দুপুরে বাড়ি থাকেন বলছিলি না?
শুধু লিয়াংয়ের বাবা নন, লিয়াংয়ের মাও আজ আছেন বাড়িতে। শনিবার লিয়াংদের লন্ড্রি দুটোয় বন্ধ হয়, দুপুরবেলা লিয়াংয়ের মাকেও তাই বেরোতে হয়নি। মিতিনদের আগমনে ববকাট চুল, শক্ত-সমর্থ চেহারার চৈনিক মহিলাটি বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কীভাবে অভ্যর্থনা করবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না। ঝটিতি বরফশীতল লেমন স্কোয়াশ এসে গেল, সঙ্গে স্যান্ডউইচ, পেষ্ট্রি, কাস্টার্ড। মেইলি হাতে হাতে সাহায্য করছে মাকে। তার কাঁধ ছোঁয়া চুলে আজও সেই নীল উল। তার মায়ের চুলেও। ছোট-ছোট চুলে উলের টুকরোটা বারবার ক্লিপ করতে করতে লিয়াংয়ের মা কতবার যে জিজ্ঞেস করলেন টুপুরদের দুপুরের খাওয়া হয়েছে কিনা। খেলে এখনই তিনি বানিয়ে দিতে পারেন, সংকোচ করার কোনও প্রয়োজন নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি।
লিয়াংয়ের বাবা অবশ্য আজ খুবই ম্ৰিয়মাণ। কথাই বলছেন না বিশেষ। ভাইয়ের মৃত্যুতেই তিনি যথেষ্ট শোকাহত ছিলেন, খুন হওয়ার সংবাদে যেন একেবারেই বিপর্যস্ত। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বিমর্ষ গলায় মিতিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ঝিয়েনের স্কুলে গিয়ে কেনও লাভ হল ম্যাডাম?
মিতিন বলল, একটা দরকারি তথ্য পাওয়া গেল। সেদিন স্কুল থেকে বেরনোর মুখে-মুখে মিস্টার ঝিয়েনের মোবাইলে একটা কল এসেছিল। সম্ভবত কেউ একজন আপনার ভাইয়ের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল। বিকেল সাড়ে চারটেয়।
লিয়াংয়ের মা বিস্মিত স্বরে বললেন, কই, এ খবরটা তো আমাদের কেউ জানায়নি!
ফোনটা এসেছিল মিসেস ইউয়ানের সামনে। উনিও খুব আপসেট হয়ে পড়েছেন তো, তাই হয়তো কথাটা ঠিক মাথায় ছিল না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎই মনে পড়ে গেল।
উনি কি বলতে পারলেন কার ফোন ছিল?
না।
তা হলে তো আর জানা যাবে না। লিয়াংয়ের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মোবাইলটাই তো মিসিং।
তাতে কিছু যায় আসে না মিস্টার ঝাও। সেদিন আপনার ভাইয়ের মোবাইলে কোন-কোন নাম্বার থেকে কল এসেছিল আমি জেনে নেব। যে কোম্পানির কানেকশন, তাদের কাছে সবই রেকর্ডেড আছে।
ইজ ইট? তা হলে তো কালপ্রিট ধরাই পড়ে গেল।
অত সহজ নয় বোধ হয়। ফোন করে কেউ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেই কি প্রমাণ হয় দুজনের দেখা হয়েছিল? আর হলেও সেই যে খুনি, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
লিয়াংয়ের মা অস্ফুটে বললেন, ও। তা হলে এখন কী করবেন?
দেখি। ইনফরমেশনগুলো ভালভাবে যাচাই করি। আর-একবার স্বপন দত্তর কাছেও যেতে হবে। মিতিন একটা স্যান্ডউইচ তুলল। ছোট্ট কামড় দিয়ে বলল, এবার আপনাদের কি দু-চারটে প্রশ্ন করতে পারি? পার্সোনাল?
বলুন কী জানতে চান?
ওই ওয়ালহ্যাঙ্গিং… মানে ওই ম্যাপের কথাটা আপনারা ছাড়া আর কে কে জানতেন?
লিয়াংয়ের বাবা বললেন, ওটা যে অত মূল্যবান ম্যাপ, সেটা তো আমরাই জানতাম না। সুতরাং আমাদের মাধ্যমে কারও জানার প্রশ্নও আসে না।
তা ঠিক। মিতিন মাথা দোলাল, তবে মিস্টার ঝাও ঝিয়েন যদি আপনাদের কমিউনিটির কারও কাছে গল্পটল্প করে থাকেন..
অসম্ভব। সে আমাদেরই বলেনি, অন্য লোকদের বলতে যাবে কেন?
লিয়াংয়ের মা বললেন, তা ছাড়া আমাদের ঝিয়েন তো কারও সঙ্গে সেভাবে মিশতই না। আর এই ছাতাওয়ালা গলি থেকে বেশিরভাগ চিনাই তো চলে গেছে সেই ট্যাংরায়। এখন আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই প্রায় ওখানে। সামাজিক অনুষ্ঠানটনুষ্ঠান ছাড়া ঝিয়েনের সঙ্গে তাদের দেখাসাক্ষাৎই হত না।
অর্থাৎ আপনারা নিশ্চিত, ওই ম্যাপের লোভে আপনাদের সম্প্রদায়ের কারও পক্ষে ওই কাজ করা সম্ভব নয়?
দুশো ভাগ নিশ্চিত। ওই সব ম্যাপট্যাপ, ইতিহাস-টিতিহাস নিয়ে আমরা তো কেউ ভাবিই না। ঝিয়েন ছিল নেহাতই ব্যতিক্রম। এখানকার চিনারা, মানে আমরাতো ব্যস্ত থাকি কীভাবে দুবেলা রুটির জোগাড় করব, কী করে একটা চাকরি জোটাব, কিংবা ব্যবসা চালাব, এসব নিয়ে। ঝিয়েনকে তো তাই প্রায় আমাদের সমাজের বাইরের লোক বলে ধরে নেওয়া যায়।
মিতিন শরবত শেষ করে মুখ মুছল। হেসে বলল, ধন্যবাদ। আপনারা আমার কাজটাকে অনেক সহজ করে দিলেন। আশা করছি, শিগগিরই মিস্টার ঝাও ঝিয়েনের হত্যাকারীকে ধরে ফেলতে পারব।