সোরাবিয়ার শয়তানি ফন্দি এড়িয়ে আনার সঙ্গে কয়েক মুহূর্তের আলাপে সান মার্কস-এর মিনারের নীচে গোপন সাক্ষাতের যে ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন, তা ব্যর্থ হওয়ায় একান্ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হওয়া সানসেদোর পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু আনার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কারণ তিনি যা ভেবেছিলেন তা ভুল। নিজের আগ্রহেই কথা দিয়েও আনা কেন যে তা রাখতে পারেনি, তা কল্পনা করাও সানসেদোর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আনার জীবনে সেদিন যা ঘটেছে তা তারও কল্পনাতীত।
সেভিল শহরের রাস্তায় সে এক অদ্ভুত আজগুবি জানোয়ার দেখে শঙ্কাবিহ্বল হয়েছে, তারপর সেইদিন সন্ধ্যাতেই তার নিজের আবাস থেকে বার হবার পথে যা দেখেছে তা অবিশ্বাস্য ভৌতিক কিছু ছাড়া প্রথমে ভাবতে পারেনি।
তার তিয়ো সানসেদোর সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই আনা তখন গ্রামাঞ্চলের চাষি মেয়ের পোশাকে সেজে সান মার্কস মিনার-এর দিকে রওনা হয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা যেতে না-যেতেই তাকে সবিস্ময়ে কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হয়েছে।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস অর্থাৎ তার স্বামী সোরাবিয়াই সেই পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছে।
কিন্তু তার সঙ্গে ও কে আসছে বেশ একটু উত্তেজিতভাবে আলাপ করতে করতে?
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন গাঢ় হতে শুরু করেছে। আনা রাস্তার ধারের একটি বাড়ির তোরণের নীচে লুকিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিল। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মত্ত সোরাবিয়া ও তার সঙ্গী তাকে লক্ষ করেনি, কিন্তু সেই বিলীয়মান আলোতে স্বামীকে যেমন তার সঙ্গীটিকেও তেমনই আনা নির্ভুলভাবেই চিনেছে।
চেহারাটা চিনতে ভুল হয়নি বলেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করা আনার পক্ষে শক্ত হয়েছে। অবিশ্বাস্য অলৌকিক কিছু বলে মনে হয়েছে ব্যাপারটা।
অবিশ্বাস্য অলৌকিক মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। জীবনে যাকে দেখতে পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, স্পেনের মাটিতে পা দেওয়া মানে স্বেচ্ছায় আত্মঘাত জেনেও সে শুধু সেভিল শহরের রাস্তাতেই নয়, তার স্বামী সোরাবিয়ারই সঙ্গী হয়ে তাদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ ব্যাপার সত্যই আনার সব কল্পনার বাইরে।
সান মার্কস মিনার-এ যাওয়া আনার আর হয়নি। স্বামী আর তার সঙ্গী কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর সে অন্ধকারে একটু দূর থেকে তাদের অনুসরণ করেছে।
সোরাবিয়া তার সঙ্গীকে নিয়ে বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢোকবার পর আনা বিমূঢ় স্তম্ভিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিষাণমেয়ের ছদ্মবেশে তখনই বাড়িতে ঢোকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অস্থির উদ্বেগ নিয়ে বাড়ির বাইরে অন্ধকার রাস্তাতেই তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অপেক্ষা করতে তার ক্লান্তি নেই। সোরাবিয়ার সঙ্গে যে বাড়ির ভেতর গেছে, তার জন্যে এমন অনেক দীর্ঘ রাত সে অপেক্ষা করতে প্রস্তুত।
স্বামীর সঙ্গে কেন যে সে তাদের বাড়িতে গেছে আনা তা অনুমান করতে গিয়ে কূল পায়নি। কিন্তু যে কারণেই গিয়ে থাক, বার হয়ে সে তো আসবেই। ইস্টারের সময় দক্ষিণ স্পেনের সেভিল শহরে শীতের দাপট আর নেই বললেই হয়। প্রচণ্ড তুষারঝড়ের রাত হলেও কিন্তু আনা অকাতরে যতক্ষণ প্রয়োজন, অপেক্ষা করতে দ্বিধা করত না। যার চেয়ে কাম্য তার কিছু নেই সেই আশাতীত সুযোগই আনা আজ পেয়েছে। যখনই বার হয়ে আসুক, আনার কাছে আজ ধরা না দিয়ে তার উপায় নেই।
খুব বেশিক্ষণ আনাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। তাদের বাড়ির ভেতর থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেছে। কয়েক মুহূর্ত বাদে ঘোড়সওয়ারই বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়।
কিন্তু এ-সওয়ার তো আমার স্বামী সোরাবিয়া!
সঙ্গীকে ভেতরে রেখে একলাই সে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে এসেছে কেন? সোরাবিয়ার ঘোড়ার খুরের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাবার পর আনা একমুহূর্তও আর অপেক্ষা করেনি। পরনে তার চাষি মেয়ের পোশাক। বাড়ির চাকর-দাসীদের লুকিয়ে এ-পোশাকে সে বাইরে এসেছিল। এখন কিন্তু তাদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা গ্রাহ্য না করে অস্থির উত্তেজনায় আনা বাড়ির ভেতর ছুটে গেছে।
চাকর-দাসী কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। কিন্তু যাকে সে খুঁজছে, সে-ই বা কোথায়? সোরাবিয়ার সঙ্গে এসে সে কি এই বাড়ির মধ্যে হাওয়াতেই মিলিয়ে গেল?
সত্যিই আনা কি তা হলে অশরীরী ছায়ামূর্তিই দেখেছে?
অস্থির ব্যাকুল উত্তেজনায় আনা চিৎকার করে ডাকে, দাস!
কোথাও কোনও সাড়া মেলে না।
মেক্সিকো থেকে এসপানিয়ায় ফেরার জাহাজে সম্ভ্রান্ত কাবালিয়েরো হিসেবে যাঁকে একদিন দেখা গিয়েছিল আর তারপর ভাগ্যচক্রে স্বেচ্ছায় পিজারোর বন্ধু মোরালেস-এর কাছে আবার ক্রীতদাস হয়ে কিছুকাল কাটিয়ে যিনি আশ্চর্যভাবে নতুন মহাদেশের পানামা থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, আনার ব্যাকুল সন্ধানের পাত্র যে সেই ঘনরাম দাস, তা বোধহয় আনার আকুলকণ্ঠে তাঁর নাম শোনবার আগেই বোঝা গেছে।
ঘনরাম দাসই যে অজানা নতুন দেশ থেকে সঙ্গে আনা গ্লামাগুলির একটিকে ছেড়ে দিয়ে সেভিল-এর নাগরিকদের পিজারোর বন্দিত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছেন তা-ও বোধহয় অনেকের পক্ষেই অনুমান করা কঠিন হয়নি!
নতুন মহাদেশ থেকে আদিবাসীদের একজন হয়ে পিজারোর জাহাজে ঘনরামের এসপানিয়ায় এসে নামা রহস্যময় নিশ্চয়ই, কিন্তু সোরাবিয়ার কাছে নিজে থেকে আত্মপ্রকাশ করে তারই বাড়িতে আসা কম বিস্ময়কর নয়।
ঘনরাম সত্যিই তা-ই করেছিলেন। করেছিলেন পিজারোকে সুদখোর মহাজন এনসিসো-র আক্রোশ থেকে বাঁচাবার আর কোনও উপায় না দেখে।
শহরের রাস্তায় অদ্ভুত আজগুবি প্রাণী হিসেবে গ্লামাটিকে ছেড়ে দেওয়ার কৌশল তাঁর আশাতীতভাবে সফলই হয়েছিল। পথের নানা জটলায় পিজারোর বন্দিত্বের সংবাদ জানিয়ে জনতাকে উত্তেজিত করে তোেলবার ফন্দিও তাঁর ব্যর্থ হয়নি। ইস্টারের উৎসবমত্ত সেভিল শহরের প্রায় অর্ধেক নাগরিকই বন্দরের চারিপাশে গিয়ে জড়ো হয়েছে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। জনতার মধ্যে মিশে থেকে, ঘনরাম কিছুক্ষণ বাদেই বুঝেছেন যে, তাদের উচ্ছাস আস্ফালন সবই বৃথা। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের যুগ শেষ হয়ে গেলেও জনগণের অধিকার স্বীকৃত হতে তখনও অনেক দেরি। ওপরের মহলের ভাগ্যবানরা জনসাধারণ বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে অচেতন। তাদের বিক্ষোভ অভিযোগের কোনও তোয়াক্কাই কেউ করে না। সেভিল-এর বন্দরের জনতার কণ্ঠ সম্রাট পঞ্চম চার্লস দূরে থাক, তাঁর পরিষদের কারও কান পর্যন্তও গিয়ে পৌঁছোবে না। তা পৌঁছে দেবার জন্যে এমন কাউকে দরকার রাজসভা যার কাছে অগম্য নয়।
এমন মানুষ কে আছে সেভিল-এ?
ঘনরাম জনতার সঙ্গে মিশে সন্ধান নিয়েছেন! সন্ধান যা পেয়েছেন তাতে হতাশই হতে হয়েছে।
রাজসভায় পর্যন্ত খাতির আছে এমন মানুষ সেভিল-এ থাকবে না কেন? সেভিল তো আজেবাজে শহর নয়। কিন্তু পিজারোর মতো মানুষের জন্যে নড়ে বসতে তাদের দায় পড়েছে। হাজার হলেও ব্যালির এনসিসোর মতো মহাজন তাদেরই জাত-ভাই। দুটো আজগুবি জানোয়ার এনেছে বলে কোথাকার কোন হাঘরে বাউণ্ডুলের জন্যে সেই জাতভাইকে চটাতে সেভিল-এর বনেদি বড় ঘরোয়ানার কেউ রাজি নয়।
ব্যাচিলর এনসিসোর ইয়ার-দোস্ত কি জাত-ভাই নয় এমন হোমরা-চোমরা কি আর কেউ নেই তা হলে সেভিল-এ?
আছে। ওই তো মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসই আছেন। দু-চারজন ভিড়ের ভেতর থেকে দেখিয়েও দিয়েছে—দরবারে ওঁর নাকি দারুণ খাতির। কোথায় কী ছিলেন কেউ জানে না। একধাপে একেবারে মার্কুইস হয়ে গেছেন কি অমনি অমনি!
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস!
ঘনরাম ভিড়ের ভেতর দূর থেকে মার্কুইসকে ঘুরতে দেখেছেন। মার্কুইসকে আরও অনেকের মতোই পিজারো আর তার জাহাজের আজগুবি জানোয়ারের খবর কৌতূহলী করে বন্দরে টেনে এনেছে। সেভিল-এর খানদানিরা অবশ্য ব্যাচিলর এনসিসোর এ-ব্যাপারের সঙ্গে সংস্রবের কথা জানবার পর আজেবাজে। চাষাভুষো ইতরের ভিড়ে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করেননি। সেভিল-এর বাইরের মানুষ বলেই মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসকে তখনও বন্দরে ঘুরতে দেখা গেছে।
মার্কুইসকে দূর থেকে চিনিয়ে দেবার পর ঘনরাম প্রথমটা চমকে উঠেছেন সত্যিই। কিন্তু তারপর একটু কৌতুকের হাসিই ফুটে উঠেছে তাঁর মুখে।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর ঠিক এই সময়টিতে সেভিল শহরে উপস্থিত থাকা নিয়তির আর-এক কুটিল কৌতুক সন্দেহ নেই।
অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মার্কুইসকেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধরতে হবে। পিজারোর খবর সম্রাটের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে দেবার এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। তাঁকে দেখে চিনতে পারলেই মার্কুইস কী করতে চাইবে তা তিনি ভাল করেই জানেন। পলাতক ক্রীতদাস হিসেবে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার উৎসাহ ছাড়া মার্কুইস-এর মাথায় আর কোনও চিন্তাই তখন থাকবার কথা নয়।
তবু এ-ঝুকি তাঁকে নিতেই হবে। যেমন করে তোক তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, পিজারোর খবর ঠিকমতো সম্রাটের দরবারে পৌঁছে দিলে তার নিজের ভবিষ্যৎই আরও উজ্জ্বল হতে পারে। মার্কুইস-এর ওপরে আরও বড় খেতাব আছে। মার্কুইস হিসেবে সে যা পেয়েছে, তার চেয়ে বড় ইনাম। সোরাবিয়া নাম মুছে যে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস হতে পেরেছে সম্রাটকে বাধিত করে রাখার এ সুযোগ ছাড়া তার উচিত নয়।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসকে এসব কথা বুঝিয়ে বিশ্বাস করানো ঘনরাম যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলেন তা হয়নি! সোরাবিয়া নির্বোধ নয়, সম্রাটের দরবারে পিজারোর হয়ে ওকালতি করতে যাবার লাভ যে কী হতে পারে কথা পড়তে-পড়তেইসে বুঝেছে।
প্রথমে অবশ্য ঘনরামকে দেখে সোরাবিয়া ঠিক চিনতে পারেনি, কিংবা চিনলেও বিশ্বাস করা তার পক্ষেও শক্ত হয়েছে।
ঘনরাম নিজে থেকেই ভিড়ের ভেতর সোরাবিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মহামান্য মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস পুরোনো এক আলাপীকে চিনতে পারবেন কি?
সোরাবিয়া মুখ ফিরিয়ে বেশ খানিকক্ষণ একটু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকেছে। তার চোখের বিভ্রম ধীরে ধীরে বিস্ময় থেকে হিংস্র উল্লাসে পৌঁছেছে তারপর।
তুই! তুই এসেছিস এই সেভিল শহরে আমারই চোখের সামনে। পৈশাচিক আনন্দটা সোরাবিয়ার গলায় লুকোনো থাকেনি।
হ্যাঁ, আমি নিজে থেকেই তোমার কাছে এসেছি, সোরাবিয়া! শান্ত অনুত্তেজিত স্বরে বলেছেন ঘনরাম, আমি এখানে সম্পূর্ণভাবে তোমার হাতের মুঠোয়। আমায় যখন খুশি তুমি ধরিয়ে দিতে পারো ফেরারি গোলাম হিসেবে। কিন্তু তার আগে আমি যা বলতে এসেছি, ধৈর্য ধরে নিজের স্বার্থে তোমায় একটু শুনতে অনুরোধ করছি। শুনে মনে না ধরলে আমায় কয়েদ করবার পুরো এক্তিয়ার তোমার থাকবে।
দু-এক মুহূর্ত কী ভেবে নিয়ে সোরাবিয়া বলেছে, চলো। তোমার কথাই আগে শুনব, কিন্তু আমার নিজের বাসায় আমার একটি শর্তে।
তাতেই রাজি হয়ে ঘনরাম সোরাবিয়ার সঙ্গে তার সেভিল-এর আবাসে গেছেন।