সুজাতা ও বিনয় বসেছিল।
সামান্য ব্যবধান দুজনের মধ্যে। দুজনের মধ্যখানে মাত্র ছোট একটা বেতের টেবিল। টেবিলের ওপরে কাচের টিপটটার মধ্যে হয়ত খানিকটা ঠাণ্ড চায়ের তলানি ও ভিজে নিংড়ানো কতকগুলো চায়ের পাতা। গোটাতিনেক চায়ের তলানি সমেত চায়ের কাপ। সন্ট্যাণ্ডের ওপরে জ্বলছে ছোট টেবিলল্যাম্পটা।
রাগ করেছে সুজাতা। নিশ্চয়ই রাগ করেছে, যদিও সেই রাগের সঙ্গে মিশে আছে একটা উগ্র অভিমান। রাগ আর অভিমানের মেশামেশিতে মুখখানা একটু গভীরই মনে হচ্ছে সুজাতার। ঠোঁটের কোণে বিনয়ের বঙ্কিম একটা চাপা হাসির নিঃশব্দ প্রকাশ।
রাগ আর অভিমান যাই হোক, বিনয় জানে সুজাতা এখন চট্ করে উঠে যাবে না। মান ভাঙিয়ে কথা বলবার একটা অবকাশ দিচ্ছে সুজাতা বিনয়কে। সত্যিই তো, সুজাতা যে ওদের সঙ্গে বহরমপুর এসেছে সে তো ওরই সঙ্গ-আকর্ষণে। বিনয়ের সান্নিধ্যকে একটু ঘনিষ্ঠ, আরো একটু নিবিড় করে পেতেই। নয় কি! সেই বিনয়ই যদি তাকে অবহেলা জানায়, রাগ-অভিমান হয় বৈকি। না, সুজাতার দোষ নেই।
বিনয় এবারে আপন মনেই সুস্পষ্টভাবে হাসল, তবে নিঃশব্দেই।
তারপর শ্ৰীমতী কোকিললাঞ্ছিতা!
কিন্ত নতুন নামকরণেও সুজাতা ফিরে তাকায় না। যেমন নিঃশব্দে বসে ছিল বসে রইল।
শ্ৰীমতী কৃষ্ণা-শোন শ্ৰীমতী কালোজিরে, রাগ করে যদি কথাই না বলো তো আজ দুপুরে যা সব অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে কিছুই শোনা হবে না কিন্তু!
কে শুনতে চায়! গোড়া কেটে আগায় জল না ঢাললেও চলবে।
তা চলবে না বটে, তবে ঐ যে বললাম অত্যাশ্চর্য ঘটনা শোনা হবে না!
এবার ঘুরে মুখোমুখি বসল সুজাতা। বোঝা গেল মুখে না বললেও মনে মনে সুজাতা বিনয়ের কথা শোনার জন্য উদ্গ্ৰীব ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
কি, বলব না বলব না!
কে বারণ করেছে বলতে!
শুনব বলেও তো কেউ সাড়া দিচ্ছে না!
ভণিতা না করে বলে ফেললেই তো হয়। কালা তো নাই যে শুনতে পাব না।
তা নয় বটে, তবে কানের সঙ্গে মনের একটা যোগাযোগ আছে কিনা। কথাগুলো বলে একান্ত নিম্পূহভাবে বিনয় সিগারেট-কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করতে তৎপর হয়ে উঠে। বিনয় আবার হাসে।
এবারে সুজাতাই তাগাদা দেয়, কই বললে না কি বলবে বলছিলে!
বিনয় আর বিলম্ব না করে দ্বিপ্রহরের তার সমস্ত অভিযান-কাহিনী যতটা সম্ভব সুষ্ঠভাবে বর্ণনা করে যায়। কোন কিছুই বাদ দেয় না।
লোকটা কে বলে তোমার মনে হয়! সুজাতা প্রশ্ন করে।
সেই থেকে তো সেই শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত মুখখানার কথাই ভাবছি। কে হতে পারেন। তিনি! বুঝতে পারছি না এখনো।
বাবাকে বললে না তো কিছু? না, বলিনি। ব্যাপারটা আগে ভাল করে খোঁজ না নিয়ে জানাজানি বা হৈচৈ করতে চাই না।
তোমার কোন কিছু সন্দেহ হয় নাকি?
নিঃসন্দেহই বা একেবারে হতে পারছি কই।
আচ্ছা কোন পাগল-টাগল নয় তো?
পাগল-টাগল হতে বাধা তো নেই, তবে আমন জায়গায় ঐ সময় হঠাৎই বা কেন আমনধারা এক পাগলের আবির্ভাব হল! আর হলাই যদি, আমন করে হঠাৎ আমার সঙ্গে চোখাচৌখি হতেই শ্ৰীমান পাগল নিজেকে অপসৃত করলেন কেন ভীতচকিত ভাবে?
তাই তো! তা হলে?
দাঁড়াও, ব্যস্ত হলে চলবে না। এটা রত্নমঞ্জিল—নবাবী আমলের ব্যাপার সব!
তার মানে? তুমি কি বলতে চাও বিনয়?
বলতে তো অনেক কিছুই চাই, তবে বলতে পারছি কই! সবই যে কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! সন্দেহ ও মিস্ট্রি যে ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
তুমি কি তাহলে বলতে চাও বিনয়, এ-বাড়ির সঙ্গে ঐ লোকটার কোন যোগাযোগ আছে?
আছে কিনা সত্যি জানি না, তবে থাকলে আশ্চর্য হব না! গোড়া থেকে এ বাড়ির সমস্ত ব্যাপারগুলো একবার ভেবে দেখ তো কালিন্দী। সেই সুবর্ণকিঙ্কন, তোমাদের বাড়িতে চোরের উপযুপরি উপদ্রব। কঙ্কনের পূর্ব ইতিহাস। তারপর এ-বাড়ি কেনবার জন্য রানার আবির্ভাব ও এ-বাড়ি ক্রয়ের ব্যাপারে তার জেদ্দাজেদি। ওরই মধ্যে আর এক ক্রেতার আবির্ভাব। টাকার অঙ্কও বাড়ে। সবশেষ সেই উড়ো চিঠি। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোকে যদি একসূত্রে গাঁথি তবে কোথায় আমরা পৌঁছই ভাব তো একবার!
সত্যি, আজ কিন্তু সমস্ত ঘটনাগুলো খাপছাড়া যোগসূত্রহীন বলে সুজাতার মনে হয় না।
কিন্তু কি রহস্য থাকতে পারে। এ সব কিছুর মধ্যে? সুজাতা প্রশ্ন করল!
আমিও তো সেটাই ভাবছি। কালী। কিন্তু কিছুই এ পর্যন্ত ধরতে পারছি না। অথচ এবাড়ির ব্যাপারে ক্রমেই যেন বেশ একটা উত্তেজনা বোধ করছি। অবশ্য একটা ব্যাপারে। আমি স্থিরনিশ্চিত হয়েছি।–
কি?
রত্নমঞ্জিল বিক্রি করা হবে না-লক্ষ টাকার বিনিময়েও না। মেসোমশাইকে এই রত্নমঞ্জিল বিক্রি করতে কিছুতেই আমি দেব না। শেষের দিকে বিনয়ের কণ্ঠে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেন। সুজাতা বিনয়ের মুখের দিকে তাকাল। ল্যাম্পের আলোয় মুখখানা যেন কি এক চাপা উত্তেজনায়। থমথম করছে, চোখের তারা দুটোয় একটা স্থির প্রতিজ্ঞার দীপ্তি ঝক ঝক করছে যেন।
মুহুর্তের জন্য বোধ হয় বিনয় চুপ করেছিল, হঠাৎ কিসের একটা স্পষ্ট শব্দে চকিতে পিছন ফিরে অন্ধকার সিঁড়ির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কে-কে ওখানে?
সিঁড়ির মুখে স্তুপীকৃত অন্ধকারের মধ্যে একটা অস্পষ্ট ছায়া যেন নড়ে ওঠে।
বিনয় ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।-কে ওখানে? বলতে বলতে এগিযে যায় বিনয়। সুজাতাও উঠে দাঁড়ায় কৌতূহলে, উতেজনায়।
আজ্ঞে আমি মনোহর দাদাবাবু–দ্বিধাজড়িত স্বলিত কণ্ঠে অন্ধকার হতে জবাবটা এল।
কে, মনোহর! অন্ধকারে ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ?
আজ্ঞে–
এদিকে এস।
বিনয়ের ডাকে মনোহর পায়ে পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
কি করছিলে ওখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মনোহর? বিনয়ের মনের মধ্যে সন্দেহ থাকলেও কিন্তু কণ্ঠস্বরে সেটা প্রকাশ পায় না।
আজ্ঞে নীচে ছিলাম, যেন আপনারা ডাকছেন শুনে উপরে আসছিলাম–
কোনমতে ঢোক গিলে একটা জবাবদিহি দেবার চেষ্টা করে যেন মনোহর। বিনয়ের ওর কথাগুলো শুনে ও বলবার ভঙ্গি দেখে তাইই মনে হয়।
বিনয় মনোহরের কথা শুনতে শুনতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। কিন্তু মনোহরের মুখটা যেন পাথরে খোদাই করা। কোনরূপ বৈলক্ষণ্যই তাতে যেন নেই। বোকাবোকা নিরীহ সরলতা যেন সমস্ত মুখখানা বোপে রয়েছে। চোখের তারায়ও অনুৎসাহিত সরল দৃষ্টি।
কিন্তু আমরা তো কেউ তোমাকে ডাকিনি মনোহর!
আজ্ঞে আমার যেন মনে হল, উপরে থেকে আপনারা আমায় ডাকলেন
না ডাকিনি, তুমি নীচে যাও।
মনোহর আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে নিঃশব্দে নীচের সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হল।
ক্ৰমে মনোহরের পদশব্দ সিঁড়িতে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
নির্বক বিস্ময়ে সুজাতা এতক্ষণ সমস্ত ব্যাপারটা শুনছিল।
মনোহরের কৈফিয়ত শুনে সুজাতা স্পষ্টই বুঝেছিল মনোহর মিথ্যা বলছে, কারণ চারদিকে একটা স্তব্ধতা, তার মধ্যে তারা কেউ ডাকলে স্পষ্টই শোনা যেত। তাছাড়া উপরের ডাক নীচে পৌঁছনোর কথা নয়। তাই মনে হল তার, বিনয়ের কথার জবাবে সম্পূর্ণ সে মিথ্যা বানিয়ে একটা জবাব দিয়ে গেল। সুজাতা বললে দেখ আমার যেন মনে হচ্ছে, লোকটা আমাদের কথা শোনার জন্যই উপরে এসেছিল, ধরা পড়ে গিয়েছে।
বুঝতে পেরেছি বৈকি সেটা। বিনয় বলে।
বললে না কেন মুখের ওপরে লোকটাকে?
উঁহু। এতে করে একপক্ষে আমাদের ভালই হল। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল। নাgन्म? যদি সত্যিই লোকটার মধ্যে সন্দেহের কিছু থাকে, তাহলে প্রথমতঃ মিথ্যা দিয়ে লোকটা জানিয়ে দিয়ে গেল সে কি চরিত্রের লোক! দ্বিতীয়তঃ ওকে যে অবিশ্বাস করলাম। এটা ওকে না জানিয়ে বুঝিয়ে দিলাম। ওকে আমরা সন্দেহ করিনি? তাতে করে যদি সত্যিই লোকটার মনে কোন দুরভিসন্ধি থাকে তো নিঃসন্দেহে ও ওর পথে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু—
না, ভয় নেই সুজাতা, আমরা ওকে চিনলাম এবং ওর ওপরে নজরও রাখতে পারব এবার থেকে। যদি তেমন কিছু থাকে–
তাহলে এ ব্যাপারের পরেও ওকে এ বাড়িতে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে কি! বাবাকে—
উঁহু। চট্ করে ছাড়িয়ে কোন লাভ হবে তো নয়ই, বিবেচনার কাজও হবে না। আরো কিছুদিন ওর ওপরে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেখতে হবে সত্যিই ওর মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে কিনা। শুধু তাই নয়, বহুদিন ধরে এ-বাড়ির ‘কেয়ারটেকার’ হিসাবে এ ওখানে আছে, ওকে খুব বিবেচনার সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে হবে।
কিন্তু তোমার এ যুক্তি মানতে পারছি না বিনয়!
ব্যস্ত হয়ে না। এতদিনের একটা বিশ্বাসী লোককে হঠাৎ সন্দেহ করে তাকে অবিশ্বাস করাটাই বরং যুক্তির ব্যাপার হবে না। তোমার বাবাকেও এ সম্পর্কে কিছু বলে না আপাতত।
দেখ একটা কথা বলি, লোকটাকে আমার কেন যেন প্রথম থেকেই ভাল লাগেনি—
বিনয় হেসে সান্তুনা দেয়। ভয় নেই, আমি সতর্ক থাকব।
আহারাদির পর বিনয় নিজের নির্দিষ্ট ঘরে শয্যার ওপরে এসে যখন গা ঢেলে দিল, চিন্তার ঘূর্ণাবর্তটা মন থেকে সরে গেল না, অবিশ্রাম পাক খেয়ে খেয়ে ফিরতে লাগল চিন্তাটা।
অন্ধকার রাত্রি। চাঁদ উঠবে সেই রাতের শেষ প্রহরে। শিয়রের ধারে খোলা জানালাপথে এক টুকরো স্বপ্নের মতো রাতের কালো আকাশের একটা খণ্ডাংশ ও কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা চোখে পড়ে।
নীচের বাগানের অন্ধকারের স্রোত পার হয়ে একটানা একটা বিবির শব্দ কানে আসছে। নিযুতি রাতের একতারা যেন বেজেই চলেছে ঝি বির রবে।
মনোহরের ব্যবহারটা বিনয়কে কেবল বিস্মিত করেনি ভাবিতও করে তুলেছে। সুজাতার সন্দেহ মিথ্যা নয়, সত্যিই মনোহর সিঁড়ির মাথায় অন্ধকারেও আত্মগোপন করে ওদের কথাবার্তা শোনবারই চেষ্টা করকছিল।
কিন্তু কেন?
এ-বাড়িতে অনেকদিনের লোক ঐ মনোহর। পাকানো বাঁশের মত পেটানো মজবুত শরীর। শরীরের কোথাও এতটুকু খুঁত নেই নির্ভেজাল। বলতে গেলে বাড়ির মালিকের অনুপস্থিতিতে মনোহরই দীর্ঘদিন ধরে হয়ে ছিল এ-বাড়ির সর্বেসর্ব। বামদেব ক্কচিত কালেভদ্রে এখানে এলেও এ-বাড়ি সম্পর্কে এতকাল তার কোনই আগ্রহ ছিল না। পিতৃপুরুষের নবাবী আমলের পুরাতন এই ভাঙা বাড়িটার ওপরে তার কোনরূপ আকর্ষণই ছিল না। এবং এ-বাড়ি এইভাবেই হয়ত পড়ে থাকত, যদি আচমকা গুজরাটী ব্যবসাদার রানা এই বাড়ি কেনবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করত।
কিন্তু হঠাৎ রানাই বা এ-বাড়িটা কেনবার জন্য এত আগ্রাহন্বিত হয়ে উঠল। কেন?
খাগড়াই বাসনের ফ্যাক্টরি খুলবে স্রেফ একটা বাজে কথা। এ-বাড়ি কেনবার পিছনে আসল উদ্দেশ্য যে তার অন্য, সেটা বুঝতে বিনয়ের অন্তত কষ্ট হয়নি।
বাড়িটা সে কিনতে ইচ্ছুকই শুধু নয়, বিশেষভাবেই ইচ্ছুক। উদ্দেশ্যটাই বা কি?
বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে নিশ্চয়ই। নচেৎ বাড়ির মূল্য বাবদ এই ভাঙা সেকেলে একটা বাড়ির পিছনে নিছক খেয়ালের বশে আজকালকার দিনে কেউই অতগুলো টাকা ঢালতে এগিয়ে আসবে না। বিশেষ করে রানার মত একজন ঝানু ব্যবসাদার। যারা প্রতি টাকার পিছনে অঙ্ক কষে লাভটা বুঝে চলে এবং শুধু রানাই নয়, আরো একজন খরিদ্দার এগিয়ে এসেছে বাড়িটার জন্য।
এতএব এর পশ্চাতে একটা যে রহস্য আছে সেটা বঝুতে কষ্ট হয় না।
সেদিন রাত্রে কিরীটীর সঙ্গে কথা বলেও সেই রকমই মনে হয়েছে বিনয়ের।