সিন্ধুতলের মৃগয়া
পর-পর সাতদিন ক্যাপ্টেন নেমোর কোনো পাত্তাই পাওয়া গেলো না। একবারও তার সঙ্গে দেখা হলো না আমাদের, কোনো কথা হলো না; একা-একা ঘুরে বেড়ালুম তাঁর গ্রন্থাগারে ও সংগ্রহশালায়; আর নটিলাস ছুটে চললো সেই সিন্ধুতলের চঞ্চল স্রোতের মধ্য দিয়ে তার নির্দিষ্ট পথ ধরে।
ক্যাপ্টেন নেমোর কোনো দেখা না-পেয়ে নেড আর কোনসাইল বেশ বিচলিত হয়ে পড়লো। তাহলে এই আশ্চর্য মানুষটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? না কি আমাদের সম্বন্ধে তার মত আর সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়েছে? আমার মনে হলো হঠাৎ আড়ালে চলে যাওয়াটাও বুঝি তার রহস্যময় স্বভাবের একটা বিশেষ দিক–নিজের চারপাশে কোনো দেওয়াল তুলে দিতেই তিনি বুঝি ভালোবাসেন। জানি না কেন এই মানুষটি আমার সমস্ত চেতনাকে যেন নাড়িয়ে দিয়েছেন।
হঠাৎ ষোলোই নভেম্বর আমার কামরায় টেবিলের উপর তার একটি চিরকুট পেলুম। অনেকটা আলেমান হরফের ধরনে লেখা চিঠিটা, গথিকভঙ্গির হস্তলিপি। চিরকুটে লেখা :
অধ্যাপক আরোনা সমীপেষু, নটিলাস জাহাজ।
ক্রেসপো অ্যাইল্যাণ্ডের জঙ্গলে আগামী কাল প্রাতঃকালে ক্যাপ্টেন নেমে শিকারে যাবেন বলে স্থির করেছেন। এই মৃগয়ায় তিনি অধ্যাপক আরোনা ও তাঁর সঙ্গীদের সাহচর্য পেলে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করবেন।
নেড আর কোনসাইল তো এই আমন্ত্রণ পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলো। অনেক দিন পরে পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া যাবে-এটা কি কম আনন্দের কথা!
কিন্তু তাদের এই আনন্দ পরের দিনই মিলিয়ে গেলো, যখন পরদিন সকালে ছোটোহাজরির সময় খাবার-টেবিলে ক্যাপ্টেন নেমোর সঙ্গে দেখা হলো তখন স্পষ্ট করে জানা গেলো, আমরা ক্রেসপো অ্যাইল্যাণ্ডে যাচ্ছি বটে, কিন্তু তা দ্বীপের উপরে নয়, নিচে জলের তলায়। সিন্ধুতলের সেই সুন্দর বনের অধীশ্বর ক্যাপ্টেন নেমো; সেখানেই আমরা বন্দুক নিয়ে পায়ে হেঁটে শিকারে বেরোবে।
জলের তলায়? পায়ে হেঁটে শিকার? বন্দুক নিয়ে? আমার বিস্ময় অস্ফুট কতগুলি কথায় মুখর হয়ে উঠলো।
প্রফেসর, আপনি ভাবছেন যে লোকটা বুঝি পাগল, তাই না? তা যদি ভেবে থাকেন তাহলে আপনি আমার সম্বন্ধে ভুল ভেবেছেন। আমার মতো আপনিও নিশ্চয়ই জানেন যে জলের তলাতেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে যদি সে নিজের সঙ্গে স্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ হাওয়া নিয়ে যেতে পারে। আমাদের সঙ্গে প্রচুর হাওয়া থাকবে সিলিণ্ডারের মধ্যে সংমিত বাতাস নিয়ে যাবে আমরা। রাসায়নিক প্রক্রিয় এই বাতাস তৈরি হবে, একটা বিশেষ ধরনের হুঁকনি দিয়ে হেঁকে এই ঘন বাতাসকেই হালকা করা হবে, এবং তাই আপনার নাকে পৌঁছোবে। মাথাটা ঢাকা থাকবে ড়ুবুরিদের মতো পিতলের বর্তুল শিরস্ত্রাণে। এই বন্দোবস্তে অন্তত ন-দশ ঘণ্টা বাতাস সরবরাহ করা যাবে।
কিন্তু জলের তলায় আপনি দেখতে পাবেন কী করে?
কেন? কোমরবন্ধে বৈদ্যুতিক মশাল বাঁধা থাকবে।
আর বন্দুক? জলের তলায় বন্দুক কাজে লাগবে কী করে?
প্রফেসর, এ সাধারণ বন্দুক নয়। সংমিত বাতাসের চাপে এর গুলি ছুটে চলে–গুলিগুলো সব বৈদ্যুতিক। শিকারের গায়ে লাগলেই বোমার মতো ফেটে যায়। একেকটা বন্দুকে এরকম দশটা করে গুলি থাকে।
ছোটোহজরি শেষ করে আমরা ড়ুবুরি-পোশাকের ঘরে গেলুম। ঘরটা ইঞ্জিন ঘরের পিছনে। সেখানে দেয়ালে গোটা বারো পোশাক বুলিছে। এই ড়ুবুরিপোশাকের পরিকল্পনা যিনি করেছেন, তাঁর সৃজনী-প্রতিভার তারিফ না-করে পারা যায় না। তামার পাতার উপর খুব পুরু রবারের প্রলেপ লাগানো এই পোশাকের আগাগোড়া কোথাও শেলাই নেই। পা দুটো ক্রমশ সরু হয়ে নেমে এসেছে শিশে-দিয়ে-ভারি-করা পুরু দুটো জুতোর মধ্যে; হাতে দস্তানাও ওইভাবেই পরতে হয়। ক্যাপ্টেন নেমোর অনুচরদের সাহায্যে কোনোরকমে এই মস্ত ভারি পোশাক পরা গেলো। তারপর পিতলের শিরস্ত্রাণ আঁটার পালা : পিতলের কলারের সঙ্গে স্কু দিয়ে ওই ভারি শিরস্ত্রাণ এটে দেয়া হলো। শিরস্ত্রাণের মধ্যে তিনটে পুরু কাচের জানলা রয়েছে, যাতে আশেপাশে বা সামনে তাকাতে কোনো অসুবিধে না-হয়। নিশেস নিতেও কোনোরকম কষ্ট হলো না। তারপরে আমরা এক অদ্ভুত ধরনের বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে জলের তলায় শিকারে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে নিলুম।
পোশাকটা এতই ভারি যে নড়াচড়ার কোনো ক্ষমতাই ছিলো না। আমাদের ওরা ঠেলেঠুলে পাশের ছোট্ট কোঠাটায় ঢুকিয়ে দিলে; ক্যাপ্টেন নেমোও আরেকজন ড়ুবুরি-পোশাক পরা অনুচর নিয়ে আমাদের সঙ্গে এলেন। তারপর ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে শোঁ-শোঁ করে একটা শব্দ উঠলো অন্ধকারে; অনুভব করলুম যে পায়ের তলা থেকে একটা ঠাণ্ডা স্রোত উপরে উঠে আসছে। বুঝতে পারলুম, ছোট্ট কোঠাটিতে জল ঢুকছে; দেখতে-দেখতে ঘরটা জলে ভরে গেলো। তারপরেই খুলে গেলো একটা ভারি ঢাকার মতো দরজা। উজ্জ্বল সবুজ আলো জ্বলে উঠলো পাশে। পরক্ষণেই ড়ুবো-জাহাজের ভিতর থেকে আমরা বেরিয়ে এসে সমুদ্রের তলায় এসে নামলুম।
ক্যাপ্টেন নেমোই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। মাঝখানে রইলুম আমি আর কোনসাইল-সকলের পিছনে রইলো ক্যাপ্টেন নেমোর সেই অনুচর। নীলচে আলোয় একশো ফুট পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। তারপরেই নীল কুয়াশায় সব ঢাকা পড়ে আছে। এত ভারি পোশাক পরে জলের নীচে হাঁটতে মোটেই অসুবিধে হচ্ছিলো না, বরং বেশ হালকা লাগছিলো আর কেমন যেন নতুন-এক মজার অনুভূতি হচ্ছিলো। বেলা তখন দশটা হবে। সূর্যের আলো জলের মধ্যে প্রতিসরিত হয়ে মসৃণ বালির উপর থেকে ঠিকরে পড়ছিলো। তারও কিছুক্ষণ পরে সূর্যকিরণ টেরচাভাবে জলের মধ্যে প্রবেশ করলো–আর তেলা কাচের মধ্য থেকে যেমন সাত রঙে ভেঙে আলো বিচ্ছুরিত হয় তেমনিভাবে বর্ণালির মতোই তা সাত রঙে ভেঙে গেলো। এর সেই সাত রঙের স্নিগ্ধ সুষমা সিন্ধুতলের এই আশ্চর্য জগতে যেন কোনো অপূর্ব স্বপ্নলোক সৃষ্টি করে গেলো। কত বিচিত্র উদ্ভিদ, গুল্ম, কঠিন আঁশে টাকা প্রাণী যেন বর্মাবৃত, আর কত অগুন্তি ধরনের মাছ যে চোখে পড়লো, তার কোন ইয়ত্তা নেই। সেই নীল আলো-অন্ধকারের মধ্যে, নটিলাসকে ধীরেধীরে অনেক পিছনে ফেলে আমরা স্বপ্নের মতো সুন্দর এক অস্পষ্ট দেশে অনেক বাঁও জলের তলায় এগিয়ে গেলুম, যেখানে শ্যাওলা-শামুক-হাড়ের পাকে পাকে আশ্চর্য ও ঐশ্বর্যময় সিন্ধু-রূপান্তরে কালক্রমে সমস্ত কিছুই বদলে যায়।
বেলা একটা নাগাদ ক্রেসপো অ্যাইল্যাণ্ডের জঙ্গলে প্রবেশ করা গেলো। সিন্ধুতলের সেই আশ্চর্য অরণ্যের মধ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে। মন্ত গাছপালার মতো বিরাট-বিরাট উদ্ভিদ সোজা উঠে গেছে উপরে; ঘোটৰাটো গুল্ম থেকে শুরু করে গাছের ডাল-পালারও এই ঊর্ধ্বমুখ বৃদ্ধি সত্যি লক্ষ্য করার মতত। ডাঙার উপরে জঙ্গলে যেমন কত জানা-অজানা ফুল পাপড়ি ছড়িয়ে দেয় তেমনি ফুটে উঠছে সামুদ্রিক উদ্ভিদ সী-অ্যানিমোন পাপড়ির মতো ছড়িয়েপড়া ডালপালায় যেমন গুঞ্জন করে খেলা করে পাখিরা, তেমনি সেখানে খেলা করছে নানা রঙের চঞ্চল মাছেরা। ক্যাপ্টেন নেমোর নির্দেশে বিশ্রাম করার জন্য। সেখানেই আমরা বসে পড়লুম। কখন যে ক্লান্তির মধ্যে তন্দ্রা নেমে এসেছিলো জানি না; ঘুম ভাঙতেই দেখি, আমার সামনেই ক্যাপ্টেন নেমোটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আড়মোড়া ভাঙতে গিয়েই চোখে পড়লে প্রথমে। দেখি, এক গজ উঁচু একটি অতিকায় সামুদ্রিক মাকড়শা গনগনে চোখে রাজ্যের ক্রুরতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওৎ পেতে থাকার ভঙ্গি ডাঙার হিংস্র প্রাণীদের মতোই এই মূর্তিমান বিভীষিকাটি যে কোনো মুহূর্তে প্রচণ্ড ভাবে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তা বুঝতে আমার মোটেই দেরি হলো না–আর তাতেই আমার চটকা ভেঙে গেলো। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালুম। কোনসাইল আর ক্যাপ্টেন নেমোর অনুচরটিও তক্ষুনি উঠে দাঁড়ালে। ক্যাপ্টেন নেমোর ইঙ্গিতে তার অনুচরটি তার বন্দুকের কুঁদো দিয়ে এক বিষম আঘাত হানলে এই অষ্টভুজ মাকড়শাটিকে, বাস, পরমুহূর্তেই সেই দানবিক কীটটার আট বাহু কিলবিল করে কুণ্ডলী পাকিয়ে গেলে যন্ত্রণায় প্রচণ্ডভাবে ছটফট করতে লাগলো সে।
আবার এগিয়ে চললুম আমরা। ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে সিন্ধুতলের জমি। সেই গাঢ়-নীল কুয়াশাও ক্রমশ সব-কিছু ঢেকে ফেলেছে। এখানে এসেই ক্যাপ্টেন নেমো বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিলেন। বল্লমের মতো আলোর ফলা অন্ধকারকে আক্রমণ করে হঠিয়ে দিলে। তারপরেই সামনে তাকিয়ে দেখি এ্যানিট পাথরের খাড়া দেয়াল। বোঝা গেলো, ক্রেসপো আইল্যাণ্ডের তলায় আসা গেছে।
ক্যাপ্টেন নেমো থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এটাই তাঁর রাজ্যের সীমাতারপরেই প্রবলকঠিন ডাঙা। এবার ফিরে যেতে হয়। ফেরার সময় নেমে আমাদের অন্য পথে নিয়ে এলেন। বেশ খানিকটা চড়াই বেয়ে ওঠবার পর হঠাৎ একটি সামুদ্রিক শ্যাওলার ঝোপ লক্ষ্য করে বন্দুক ছুড়লেন ক্যাপ্টেন নেমো। অমনি ছটফট করতে করতে একটি সিন্ধু-ভেদড় ছিটকে পড়লো। লম্বায় প্রায় পাচফুট হবে এই সিন্ধু-ভোঁদড়, রুপোলি আর বাদামী রঙের চামড়াটা নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান হবে–বোধ করি সেই জন্যেই মরা ভোঁদড়টিকে নেমোর অনুচরটি কাঁধের উপর ঝুলিয়ে নিলে।
ক্রমে আবার বালির রাজ্যে চলে এলুম। জল এখানে এতই কম যে মাঝেমাঝে আমাদের উল্টো-প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছিলো জলের উপরে। দূরে নটিলাস–এর আলো ঝাঁপশাভাবে দেখা যাচ্ছে। নটিলাসকে দেখে তাড়াতাড়ি এগোতে যাবো, অমনি এক ধাক্কায় নেমে আমাকে গুল্মরাশির উপরে ফেলে দিলেন। তার সঙ্গীটিও কোনসাইলকে তেমনি জোর করে ওই ঝোঁপের আড়ালে শুইয়ে দিলে। হঠাৎ এই আক্রমণের কারণ কী, তা বোঝবার আগেই দেখি ক্যাপ্টেন নেমোও মাথা নিচু করে আমার পাশে শুয়ে পড়েছেন। তাঁর সঙ্গীটিও তা-ই করলে।
তারপরেই যা চোখে পড়লো তাতে আমার বুকের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। দেখি দুটো প্রকাণ্ড আকৃতির হাঙর মাথার উপর দিয়ে মন্থরভাবে ভেসে যাচ্ছে। জলের এই নেকড়ে দুটির সামনের দিক থেকে ফসফরাসের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো বলে চিনতে মোটেই অসুবিধে হয় না। হাঙর! স্বচ্ছ ফটিকের মতো চোখ, বিকট মুখে সারি-সারি প্রবল-ভীষণ দাঁত, আর রূপোর মতো পেট নিচে থেকে স্পষ্ট দেখা গেলে। প্রায় ছুঁয়ে গেলে তারা আমাদের, তবু যে দেখতে পেলো না এটা আমাদেরও পরম সৌভাগ্য। না-হলে এই ভীষণ সিন্ধু-নেকড়ের সঙ্গে যুদ্ধে কী ফলাফল হতে কে জানে।
আধ ঘণ্টা পরে নটিলাস-এ পৌঁছোলুম। বাইরের ঢাকনাটা তখনো খোলা; ভিতরে ঢোকার পর ঢাকনাটা বন্ধ করে ক্যাপ্টেন নেমে একটা বোম টিপে দিলেন। আস্তে-আস্তে ঘরের জল নেমে গেলো।
ড়ুবুরি-পোশাক খুলে রেখে যখন নিজের কামরার দিকে এগোচ্ছি, তখন অবসাদে আমার সর্বাঙ্গ ভারি হয়ে এসেছে।