সন্তুর ধারণা হল বাইরে গিয়ে সে ডক্টর প্রকাশ সরকারকে দেখতে পাবে। কারণ ভোর থেকে প্রকাশ সরকারের উধাও হয়ে যাবার সে কোনও যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছে না।
কিন্তু বাইরে এসে দেখল, একটা সাইকেল-রিকশার ওপর একজন সম্পূর্ণ অচেনা লোক গা এলিয়ে শুয়ে আছে। দেখলে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। লোকটির গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি, পায়ের চটিও বেশ দামি। কিন্তু লোকটির চেহারার সঙ্গে এই পোশাক যেন একেবারেই বেমানান। লোকটির গায়ের রং পোড়া-পোড়া, মুখে পাঁচ-ছ দিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মাথার চুল উসকো-খুসকো।
শিশির দত্তগুপ্ত আর অরিজিৎ দেববর্মনও লোকটিকে চিনতে পারলেন না।
সাইকেল-রিকশাচালকটি হতভম্ব মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
শিশিরবাবু প্রথমে শুয়ে থাকা লোকটির হাত ও বুক পরীক্ষা করে দেখলেন যে সে বেঁচে আছে কি না। তারপর রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, একে কোথায় পেলে?
রিকশাচালক বলল, বাবু, আমি তো কিছুই বুঝতে পারতেছি না। ফিসারি অফিসের ধার থেকে দুটি বাবু কাঁধ ধরাধরি করে উঠলেন। আমারে হেঁকে বললেন, সার্কিট হাউস চলো! খানিকবাদে আমি একবার পিছু ফিরে দেখি এক বাবু নেই। আর-এক বাবু এরমধারা এলিয়ে পড়ে আছেন।
একজন মাঝপথ থেকে নেমে গেল, তুমি টেরও পেলে না?
না, বাবু! আমি তো আগে আর পেছুন ফিরে তাকাইনি!
কিন্তু গাড়ি তো হালকা হয়ে গেল। তা ছাড়া একজন লোক নেমে গেলে গাড়িতে একটা ঝাঁকুনিও তো লাগবে?
মাঝখানে এক জায়গায় রাস্তা খারাপ ছিল, সেখানে এমনিতেই তো গাড়ি লাফাচ্ছিল?
যে-লোকটি নেমে গেছে, তাকে দেখতে কেমন মনে আছে?
জামা আর প্যাটুলুন পরা এমনি সাধারণ ভদ্রলোকের মতন!
আর এই লোকটি কি তখন নিজে থেকেই তোমার রিকশায় উঠেছিল?
অন্য বাবুটির কাঁধ ধরাধরি করে এল। আমি ভাবলুম বুঝি শরীর খারাপ।
সন্তু বলল, চামেলি এই লোকটিকে চেনে কি না একবার দেখলে হয়।
শিশিরবাবু বললেন, এমনও হতে পারে, এই লোকটির সঙ্গে মিঃ রায়চৌধুরীর কেসের কোনও সম্বন্ধই নেই। এ হয়তো সার্কিট হাউসের অন্য ঘরে থাকে। যাই হোক, দেখা যাক।
ধরাধরি করে লোকটিকে নিয়ে আসা হল সার্কিট হাউসের অফিস-ঘরে। ম্যানেজার কিংবা দারোয়ানরা কেউই লোকটিকে চেনে না।
সন্তু গিয়ে চামেলিকে ডেকে আনল। অরিজিৎবাবু রইলেন কাকাবাবুর কাছে।
চামেলি লোকটিকে দেখে বলল, ও মা, এ আবার কে? একে তো কখনও দেখিনি।
শিশিরবাবু সার্কিট হাউসের ম্যানেজারকে বললেন, লোকটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিতে। একজন পুলিশ সেখানে রেখে দিলেন লোকটিকে পাহারা দেবার জন্য।
কাকাবাবুর ঘরে ফিরে এসে সন্তু জিনিসপত্র সব গুছিয়ে ফেলল। তাদেরও সার্কিট হাউস ছেড়ে চলে যেতে হবে। শিশিরবাবু এখানকার মহারাজার একটি গেস্ট হাউসে তাদের থাকবার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন।
চামেলি এই সময় বলল, স্যার, আমি তা হলে এবারে যাই?
অরিজিৎবাবু বললেন, তুমি যাবে? কোথায় যাবে?
বাড়ি যাব। আমি আর এখানে থেকে কী করব?
তোমার আবার আগরতলায় বাড়ি আছে নাকি? আমি তো যতদূর জানি তোমার বাড়ি ধর্মনগরে।
না, মানে, এখানে আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে।
তোমার বন্ধু কে, তার নামটা তো জানতে হচ্ছে। সে-ও নিশ্চয় তোমারই মতন।
শিশিরবাবু বললেন, একটু আগে তুমি বললে, তুমি কাজ হাসিল না করতে পারলে ওরা তোমায় মেরে ফেলবে। তারপর একটু বাদে বললে, তুমি আগের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে কাকাবাবুর সেবা করবে। আবার এখন বলছ বন্ধুর বাড়ি যাবে। তুমি দেখছি পাগল করে দেবে আমাদের!
অরিজিৎবাবু বললেন, তোমায় আর ছাড়া হবে না। জেলখানাই তোমার পক্ষে ভাল জায়গা।
চামেলি যেন খুব ভয় পেয়ে গেছে, এইভাবে বলল, না, না, আমায় আর জেলে পাঠাবেন না। আমার জেলের মধ্যে থাকতে একদম ভাল লাগে না!
কাকাবাবু আগাগোড়া চুপ করে চোখ বুজে বসে আছেন। এসব কথা শুনছেন কি না কে জানে!
শিশিরবাবু এবার বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, উঠুন, এখন আমাদের যেতে হবে।
সন্তু বলল, ওকে ধরেধরে তুলতে হবে। উনি নিজে হাঁটতে পারেন না।
শিশিরবাবু লজ্জিতভাবে বললেন, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো! চলল, তুমি আর আমি ওঁকে ধরে নিয়ে যাই।
কাকাবাবু এবারেও কোনও কথা বললেন না, ওদের বাধাও দিলেন না।
সার্কিট হাউস ছেড়ে বাইরে যাবার সময় সন্তুর মনে পড়ল ডাক্তার প্রকাশ সরকারের কথা। ভদ্রলোক কোথায় যে গেলেন? এর পর তিনি ফিরে এলেও সন্তুদের খুঁজে পাবেন কি না কে জানে!
শিশিরবাবু একটা স্টেশান ওয়াগান আনিয়েছিলেন। সেটার পেছন দিকে শুইয়ে দেওয়া হল কাকাবাবুকে। তারপর গাড়িটা ছেড়ে দিল।
ত্রিপুরার রাজাদের অনেকগুলো বাড়ি। তার মধ্যেই কয়েকটি বাড়িতে অতিথিশালা করা হয়েছে। সন্তুরা যে বাড়িটাতে এসে পৌছল, সেটা দেখলে রাজার বাড়ি মনে হয় না। বাড়িটা এমনিতে বেশ সুন্দর, ছোট্টখাট্টো, দোতলা। সাদা রঙের। সামনে অনেকখানি বাগান। মনে হয় কোনও সাহেবের বাড়ি। হয়তো এক সময় কোনও সাহেবরই ছিল।
সবাই মিলে উঠে এল ওপরে। দোতলায় মাত্র তিনখানা ঘর আর বেশ চওড়া বারান্দা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘরটা সন্তুদের জন্য খুলে রাখা হয়েছে।
অরিজিৎবাবু বললেন, নীচে রান্নার লোক আছে, কেয়ারটেকার আছে, যখন যা চাইবে দেবে। তোমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। একজন নার্স পাঠিয়ে দিচ্ছি, সে সারাক্ষণ থাকবে। আর একজন ডাক্তারও এসে দেখে যাবেন একটু বাদে।
শিশিরবাবু বললেন, একতলার ঘরে দুজন পুলিশও থাকবে। অচেনা কোনও লোককে ওরা ওপরে আসতে দেবে না। তোমরাও কোনও অচেনা লোকের সঙ্গে দেখা কোরো না। তোমার কাকাবাবুর এখন একদম চুপচাপ নিরিবিলিতে থাকা উচিত।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখানে টেলিফোন আছে? হঠাৎ কোনও দরকার পড়লে খবর দেব কী করে?
শিশিরবাবু বললেন, হ্যাঁ। একতলায় টেলিফোন আছে। তাছাড়া কোনও দরকার হলে আমার পুলিশদের বোলো, ওরাই সব ব্যবস্থা করবে।
অরিজিৎবাবু বললেন, আমায় এক্ষুনি অফিসে যেতে হবে। দিল্লিতে সব খবর জানানো দরকার। সন্তু, কলকাতায় তোমাদের বাড়িতে কোনও খবর পাঠাতে হবে?
একটু চিন্তা করে সন্তু বলল, না, থাক।
শিশিরবাবুরও কাজ আছে, তাকেও এখন যেতে হবে। দুজনেই আবার বিকেলে আসব, বলে নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।
বারান্দার একটা ইজিচেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কাকাবাবুকে। অনেকক্ষণ থেকে তিনি একেবারে চুপ করে আছেন। শিশিরবাবু আর অরিজিৎবাবু এর মধ্যে কাকাবাবুর সঙ্গে দু-একবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কাকাবাবু কোনও উত্তর দেননি। এখনও তিনি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আকাশের দিকে।
কাকাবাবুর বেশ কয়েক কাপ কফি খাওয়ার অভ্যেস সকালবেলা। আজ উনি মোটে এক কাপ চা খেয়েছেন। বেলা এখন প্রায় এগারোটা। সেইজন্য সন্তু কাকাবাবুর কাছে গিয়ে আস্তে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, কফি খাবে? আমাদের সঙ্গে কফি আছে, নীচের লোকদের বানিয়ে দিতে বলতে পারি।
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে মুখ ফেরালেন সন্তুর দিকে। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে তারপর বললেন, তুমি…তুই সন্তু না?
সন্তু ব্যভাবে বলল, হ্যাঁ, কাকাবাবু?
একবার মনে হচ্ছে সন্তু, আর একবার মনে হচ্ছে সিংমা। আমি কিছুই মনে রাখতে পারছি না রে। মাথার মধ্যে সব যেন কী রকম গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
একথা শুনেও সন্তু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কাল রাত্তির থেকে সে কাকাবাবুর মুখে এত স্বাভাবিক কথা আর শোনোনি।
সে বলল, কাকাবাবু, তুমি কয়েকদিন একটু বিশ্রাম নাও, তা হলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমরা কোথায় এসেছি রে? এই জায়গাটা কোথায়?
এটা ত্রিপুরার আগরতলা।
আশ্চর্য! শেষ পর্যন্ত আমাকে এখানেই নিয়ে এল!
কেন কাকাবাবু? এখানে তোমার অসুবিধে হবে?
কী জানি! আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না!
কাকাবাবু আবার চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। সন্তু আর কফি খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না।
প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে সন্তু একটা পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে নিল। তারপর ঘুরে দেখতে গেল সারা বাড়িটা।
অন্য দু খানা ঘরের মধ্যে একটা ঘরে তালা বন্ধ, অন্য ঘরটি খোলা। সেটার দরজা ঠেলে সন্তু দেখল, ঘরটি বেশ বড়, এক পাশে একটা খাওয়ার টেবিল আর অন্য পাশে কয়েকটা সোফা-কৌচ সাজানো। একটা বেশ বড় রেডিও রয়েছে সেখানে। সে-ঘরের দু দিকের দেওয়ালে দুটো ছবি। একটা ত্রিপুরার আগেকার কোনও মহারাজার, আর একটা রবীন্দ্রনাথের।
তিনতলার একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে সন্তু দেখল ছাদের দরজা তালাবন্ধ। সন্তু একটু নিরাশ হয়েই নেমে এল। যে-কোনও নতুন বাড়িতে গেলেই তার ছাদটা দেখতে ইচ্ছে করে।
সন্তু নেমে গেল একতলায়।।
সিঁড়ির পাশের ঘরটার সামনেই টুল পেতে দুজন সাদা-পোশাকের ষণ্ডামাকা পুলিশ বসে আছে। সন্তুকে দেখেই একজন জিজ্ঞেস করল, কী, কিছু লাগবে?
সন্তু বলল, না, বাগানটা একটু দেখতে এসেছি।
বাগানটি বেশ যত্ন করে সাজানো। নিশ্চয়ই মালি আছে। গোলাপ আর জুই ফুলই বেশি। সন্তু কক্ষনো ফুল ছেড়ে না, ফুল গাছে থাকলেই তার দেখতে ভাল লাগে। সে মুখ নিচু করে এক-একটা ফুলের গন্ধ নিতে লাগল।
বাগানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সন্তু অনেক কথা চিন্তা করতে লাগল। সকাল থেকে কত ঘটনাই না ঘটে গেল!
একটা ব্যাপার সন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না। প্রথমে তাদের থাকবার কথা ছিল পুরী। তারপর হঠাৎ সেই প্ল্যান বদল করে তাকে আর কাকাবাবুকে নিয়ে যাওয়া হল গৌহাটিতে। সেখান থেকে আবার তাদের আনা হল এই আগরতলায়। এক রাত্তিরের মধ্যে এসব ঘটেছে। তবু আগরতলায় এত লোক তাদের কথা জানল কী করে? আর এখানে তাদের এত শত্রুই বা হল কেন?
সন্তু এই সব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল, হঠাৎ একটা বিশ্রী শব্দ শুনে সে চমকে উঠল। কী রকম যেন স্প্রে করার মতন ফিস ফিল্স শব্দ।। সন্তু সামনে তাকিয়ে দেখল একটা সাপ ফণা তুলে আছে তার দিকে।