০৯. সতেরো, আঠারো অপেক্ষা করো
এরকুল পোয়ারো পরদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে গেলেন পরিচিত একজন এজেন্টের সঙ্গে। তিনি নাট্য জগতের এক স্বনামধন্য ব্যক্তি। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে দিলেন পোয়ারো। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলেন অক্সফোর্ডে।
পোয়ারো মনস্থির করলেন মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে দেখা করবেন। তার কাছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার আছে। আগে থেকেই সমস্ত আয়োজন করে রাখলেন।
পরদিন ভোরবেলা তিনি বেরিয়ে পড়লেন গ্রামের উদ্দেশ্যে। সাড়ে নটায় গথিক হাউসে এসে উপস্থিত হলেন। সেই সময় মি. ব্লাস্ট লাইব্রেরিতে ছিলেন। ছোকরা একটি চাকর পোয়ারোকে তার কাছে নিয়ে গেলেন।
করমর্দন করে কুশল বিনিময় করলেন দুজনে।
ব্লাস্ট সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তাকে সনাক্ত করতে পেরেছেন কি মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ, তাকে সনাক্ত করা গেছে।
ব্লাস্ট সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন–আপনি খুবই ক্লান্ত। আগে বসুন। একটু বিশ্রাম নিন। তারপর সব শুনব।
পোয়ারো দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। তিনি একটি সোফায় বসে পড়লেন। তারপর বলতে শুরু করলেন–ধন্যবাদ, মি. ব্লাস্ট। সত্যিই আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত। তবে বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে কিছু কথা জানানোর জন্য এসেছি কিন্তু তা আপনার ভালো না লাগতেও পারে।
ব্লাস্ট উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন–কেন সে কি আর বেঁচে নেই?
পোয়ারো নিরাসক্ত স্বরে বললেন–সেটা নির্ভর করছে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন তার ওপরে।
ব্লাস্ট ভুকুঁচকে বললেন–যে কোনো মানুষই হয় মৃত না হয়, জীবিত হতে পারে। মিস সেইনসবারি সীল এর মধ্যে যে কোনো একটি হবেন।
পোয়ারো কৌতূহলী হয়ে বললেন মিস সেইনসবারি সীল? ইনি কে?
ব্লাস্ট অবাক হয়ে বললেন–সে কি আপনি একে চেনেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো আমতা আমতা করে বললেন–না–তা ঠিক নয়। একজনকে অবশ্যই ওই নামে চিনি। তিনি কলকাতায় থাকতেন, মিশনারীদের হয়ে কাজ করতেন। সম্প্রতি তিনি এখানে এসেছেন। মহারানি নামের একটি জাহাজে চড়ে। সেই জাহাজে মি. অ্যামবেরিটিসও এসেছেন। তবে তারা একই শ্রেণির যাত্রী ছিলেন না। তাঁরা দুজনেই লণ্ডনে নামেন। পথে দুজনের আলাপ হয়। ভদ্রলোক উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি মিস সীলকে মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানান স্যাভয় হোটেলে, মহিলার কাছে সে এক অত্যাশ্চর্য অনুভূতি। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল তিনিও যেন বিরাট কিছু পেতে চলেছেন। কারণ ওই অতি সাধারণ মধ্যবয়স্কা মহিলা যে তাঁর সামনে এক সোনার খনির দরজা উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে তা তিনি জানতেন না। অথচ মহিলা নিজে এ-বিষয়ে কিছুই অনুমান করতে পারেননি।
মি. ব্লাস্ট চিন্তাক্লিষ্ট স্বরে বললেন–তাহলে আপনি বলছেন ওই মহিলা মিসেস চ্যাপম্যানকে খুন করেননি?
পোয়ারো গম্ভীর সুরে বললেন কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এটা এক কঠিন সমস্যা। ঠিক আছে যেখান থেকে রহস্যটা আমি প্রত্যক্ষ করেছি সেখান থেকে বলি। সে একটা জুতো কাহিনি।
ব্লাস্ট আশ্চর্য হয়ে বললেন–অভূতপূর্ব ঘটনা। শেষে কিনা একটা জুতো?
পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে বললেন–হ্যাঁ, অভূতপূর্বই বটে! একটা বকলস আঁটা জুতো, দন্তচিকিৎসক হেনরি মর্লের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি এসে থামল ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের দরজায়। গাড়ি থেকে প্রথমেই একটি জুতো পরা পা বেরিয়ে এসেছিল। আমি লক্ষ্য করলাম পায়ের মালিক কোনো এক মহিলা। তার জুতোটি আমার পছন্দ হল না। সস্তা দামের জুতো। তবে নতুন চামড়ার তৈরি। তাতে বড় একটা চকচকে বকলস লাগান।
মন দিয়ে বকলসটা আমি দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ওই মহিলা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। চেহারা কিংবা পোশাকে আকর্ষণ করার মতো কিছুই ছিল না। চল্লিশোর্ধ এক মহিলা। পরনের পোশাকটিও কম দামি।
ব্লাস্ট বললেন মিস সেইনসবারি সীলকে আপনি দেখেছেন?
নিশ্চয়ই। তিনি নামতে গিয়ে একটু বিপদে পড়েছিলেন। তার জুতোর বকলস গাড়ির দরজায় আটকে গিয়েছিল। ফলে সেটা ছিঁড়ে যায় এবং ছিটকে এসে পড়ে রাস্তায়। আমি সেটা তুলে তাঁকে দিই। এরপর তিনি মর্লের বাড়ির ভেতর চলে যান। আর আমিও আমার গন্তব্যে রওনা দিই। এখানেই ঘটনার সূত্রপাত এবং শেষ।
আবার সেদিনই ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমার সঙ্গী ছিলেন চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ। মর্লের মৃত্যু রহস্যের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমরা গিয়েছিলাম। তখনও তিনি তার জুতোর বকলস সেলাই করতে পারেননি। ওই দিনই সন্ধ্যায় তিনি তাঁর হোটেল থেকে অন্তর্ধান হয়েছিলেন। এই গেল প্রথম পর্ব।
এবার দ্বিতীয় পর্বে আসছি। এরপর একদিন জ্যাপ আমাকে ডেকে পাঠান কিং লিওপোল্ড ম্যানসনে। সেখানের একটি ফ্ল্যাটে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। মৃতদেহটি ছিল একটি সিন্দুকের মধ্যে। আমার উপস্থিতিতে সিন্দুকটি ভোলা হয়েছিল। তার মধ্যে থাকা একটা বকলস লাগানো পুরোনো জুতো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মি. ব্লাস্ট বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন–এরপর কি হল?
আপনি বোধহয় আমার কথার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি? যে জুতোটা লাশের পাশে পাওয়া গেছে সেটি পুরোনো। অর্থাৎ ব্যবহার করা। আমরা স্থানীয় সূত্রে জানতে পারি, মিস সেইনসবারি সীলকে সেদিন সন্ধ্যায় কিং লিওপোন্ড ম্যানসনে দেখা গিয়েছিল। সকালে ছিল নতুন জুতো অথচ সন্ধ্যায় তা হয়ে গেল পুরোনো। কোনো মহিলা কখনোই এক দিনে দু’জোড়া জুতো ব্যবহার করে না। আশা করি আপনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন, মি. ব্লাস্ট।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট জানতে চাইলেন তার কি দু’জোড়া জুতো থাকতে পারে না?
–অসম্ভব! কখনোই ছিল না। আমি এটার ওপর জোর দিচ্ছি এই কারণে জ্যাপ ও আমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলাম, গ্লেনগাউরি কোর্টে। তার সব জিনিসপত্র আমরা নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম, সেখানে বকলস লাগানো দ্বিতীয় কোনো জুতোর সন্ধান পাওয়া যায়নি, এবার নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে বুঝবেন?
ব্লাস্ট মুচকি হেসে বললেন–আমি তেমন গুরুত্বের কিছু দেখতে পাচ্ছি না, মঁসিয়ে পোয়ারো।
এরকুল পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–ঠিক আছে আপনার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন কিছু নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। আমি আমার জুতোটা হাতে নিয়ে দেখি। নিখুঁতভাবে দেখলাম। দেখলাম বকলসটা হাতে সেলাই করা হয়েছে। তখনই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল। তাহলে কি সকালে আমি ভুল দেখিছি। পুরোনো জুতো পরা ছিলেন। মিস সীল। রোদের আলোয় যেটা চকচক করছিল। আর নতুন বলে মনে হয়েছিল।
মি. ব্লাস্ট সকৌতুক বললেন–হয়তো এটাই আসল ব্যাখ্যা।
পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন–না, না, এটা হতে পারে না। আমার চোখ আমাকে ধোঁকা দেবে না। আর একবার লাশটা পরীক্ষা করলাম। যা দেখলাম তা আমাকে খুশি করতে পারল না। বার বার ভাবলাম মুখটা ওইভাবে বিকৃত করার কারণ কি? যাতে চেনা না যায় সেই জন্য? নাকি প্রমাণ লোপাট করার জন্য?
মি. ব্লাস্ট অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন–নতুন করে এসব নিয়ে আলোচনার কি খুব দরকার আছে?
পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ঝরে পড়ছে। তিনি বললেন–আছে বইকি। একে একে যেভাবে সত্য উদঘাটন করছি সেটা আপনার জানা উচিত। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, এখানে কি কিছু গলদ আছে। মৃতদেহে মিস সেইনসবারি সীলের পোশাক রয়েছে। রয়েছে একজোড়া জুতো ও ব্যাগ। এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন মুখ বিকৃত করা হল? তবে কি পুলিশকে ধাঁধায় ফেলার জন্য করা হয়েছে। অথবা এটা মিস সীলের দেহ নয়? এমন সময় মাথায় বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিল একটা ভাবনা। তবে কি এটি মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ? তাদের মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। চুল ও আকৃতিতে দুজনেই সমবয়সি। তবে একটা মিল হল তাদের দুজনের পায়ের মাপ দু’ধরনের। মিস সীল দু’নম্বর জুতো পরতেন। আর অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান পরনে পাঁচ নম্বর জুতো। অর্থাৎ মিস সীলের পা মিসেস চ্যাপম্যানের চেয়ে বড়। আমি ভাবলাম মিস সীলের পায়ে যদি খুঁত থাকে তবে জুতো ঢিলে হবে অথচ তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এই ব্যাপারটা আমার সবকিছু গোলমাল করে দিচ্ছিল। অনেক খুঁজে খুঁজে মিসেস চ্যাপম্যানের লেখা একটি ডায়েরিক আমি পাই। যার মধ্যে তিনি তার পরিচিত লোকেদের ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখেছিলেন। তাতে মি. হেনরি মর্লেরও ঠিকানা লেখা ছিল। তিনি ছিলেন মিসেস চ্যাপম্যানের দাঁতের ডাক্তার। এরপরের ঘটনা আপনার অজানা নয় মি. ব্লাস্ট। করোনারের আদালতে দেহটা মিসেস চ্যাপম্যানের বলে সনাক্তকরণ করেছিলেন হেনরি মর্লের উত্তরাধিকারী।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট চঞ্চল হয়ে উঠলেন। পোয়াারোর তা দৃষ্টিগোচর হয়নি। তিনি আপনমনে বলে বললেন–আবার আমি ভাবতে শুরু করলাম, মিস ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের প্রকৃতি কীরূপ? উত্তর পেলাম–তিনি ভারতে ছিলেন। মিশনারীদের হয়ে কাজ করেছেন। তাই তাকে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মানুষই বলে মনে হয়। তবে দেখে মনে হয় তেমন চালাক চতুর নয়।
তাহলে সেইনসবারি সীল নামে অন্য কোনো মহিলা আছেন কি? ভাবলাম থাকতেও পারে। আপনি একজন স্ত্রীলোকের কথা বলেছিলেন। যিনি নিজেকে বিদেশী চর বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আর আপনার স্ত্রীকেও চেনেন বলেছিলেন। তিনিই কি খুন করে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছেন? আমার বিশ্বাস তিনি জানতে পেরেছেন যে তাকে ইংল্যান্ডের পুলিশ খুঁজছে? তবে কি ধরে নিতে হবে যে তিনি পরিকল্পিতভাবে এই খুনটা করেছেন? অথবা খুনিকে সহযোগিতা করেছেন? আবার এই সঙ্গে এমনও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কেউ তাঁর চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। মিস সীল অতীতে একজন নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন। তাই তাঁর কাজে চতুর অভিনয়ের ছাপ রেখে গেছেন।
এই ব্যাপারে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন ইলিং-এর মি. বার্নেস। তিনি মি. হেনরি মর্লের একজন রোগী। তাঁর স্থির বিশ্বাস কাকতালীয়ভাবে দুটি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মর্লের ও অ্যামবেরিওটিসের অস্বাভাবিক মৃত্যু। আমি তাঁর মতে একমত হতে পরিনি। আমার মতে দুষ্কৃতিদের আসল টার্গেট ছিলেন মি. ব্লাস্ট অর্থাৎ আপনি।
ব্লাস্ট হাসতে হাসতে বললেন–এটা অমূলক ধারণা নয় কি?
–মন থেকে বলছেন তো কথাটা মি. ব্লাস্ট? আপনি নিশ্চিত জানেন অনেকেই আপনাকে পথের কাঁটা মনে করে। তাই সরিয়ে দিতে তারা তৎপর হয়েছে।
–হ্যাঁ, মানছি আপনার যুক্তির যথার্থতা আছে। তবে এর সঙ্গে মি. মর্লের মৃত্যুর কি সম্পর্ক আছে?
–এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমিতব্যয়ী হঠকারি এক মানুষের জীবন। অর্থাৎ বড় মাপের এক অপরাধ।
–আপনার বক্তব্য কি প্রমাণ করে দিচ্ছে, ভুল হয়েছে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মি. মর্লে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন?
একথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মলে আত্মহত্যা করেননি তাঁকে খুন করা হয়েছে। এমনকি অ্যামবেরিওটিসকেও সনাক্ত করা যায়নি যে, তাকেও খুন করা হয়েছে। কিন্তু কি তার উদ্দেশ্য? কেন এতবড় বিপদের ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল? বার্নেস জেরায় কুবল করেছেন আপনার নাম পৃথিবী থেকে মুছে দেবার জন্য লোক লাগানো হয়েছিল। আর সে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল হেনরি মর্শে বা তার অংশীদারকে। তাদের মোটা টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল।
ব্লাস্ট চিৎকার করে বললেন–অবাস্তব সব কথাবার্তা বলছেন আপনি?
–সত্যিই কি তাই, মি. ব্লাস্ট? পথের কাঁটা উপরে ফেলতে যে কোনো গোবেচারা নিরীহ লোকই উপযুক্ত। কেউ তাকে সহজে সন্দেহ করবে না। এক্ষেত্রে মর্লের চাকরটাই তো সবচেয়ে কম সন্দেহজনক। সেই কারণে ওকে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়াও সহজ উপায়।
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এটা তো আগে ভাবিনি।
কথাটা যখন আমার ভাবনায় এল তখনই সত্যের প্রথম কিরণ আমি দেখতে পেলাম।
–আর তাই মি. বার্নেসের মত গ্রহণ করলেন?
–না। আমি নীতিগত দিকটাই গ্রহণ করেছি।
–মানে? ঠিক বুঝলাম না।
–প্রথম থেকেই ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কখনো উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে, আবার কখনো অনিচ্ছায়। কারণ আমি যাতে মনে করি এটা কোনো একজন ব্যক্তির হিংসার ফল নয়, এটা সমগ্র জনগণের অপরাধ, অর্থাৎ আপনিই ওদের মূল টার্গেট। যেহেতু আপনি ব্যাঙ্কার, অর্থনীতি নিয়ামক, রক্ষণশীলতার ধারক।
কিন্তু প্রত্যেক জনমানসের একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে। এখানেই আমি ভুল করি। আমি ব্যক্তিগত জীবনের কথা কখনো ভাবিনি। আপনাকে খুন করার ব্যক্তিগত কারণ ছিল, অনেকেই আপনাকে চেনেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভালোবাসেন। আবার অনেকে ঘৃণাও করেন। আপনার ওপর ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের ওই আক্রমণ ছিল রাজনৈতিক অপরাধ। এর অন্য কোনো যুক্তি আছে কি? আমার বিশ্বাস ঝোঁপের আড়ালে আর একজন লুকিয়ে ছিল। তার পক্ষে আপনাকে গুলি করা সহজ ছিল, তারপর বিপদ বুঝে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। আর পিস্তলটা ফ্র্যাঙ্কের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। তারপর স্বাভাবিকভাবেই সেটা ফ্র্যাঙ্ক কার্টার তুলে নেবে।
আর একটা কথা আমার মাথায় এল। ফ্রাঙ্ক কার্টারের কাছাকাছি আপনি আমি ছাড়াও আর একজন ছিল। সে হল হাওয়ার্ড রেইকস। মর্লের মৃত্যুর দিনও সে কুইন শার্লট স্ট্রিটে ছিল। সে আপনার নীতির ঘোরতর বিরোধী। সে আপনার ভাইঝিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। আপনার মৃত্যুর পর আপনার ভাইঝিই হবে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
তবে কি অপরাধটা ব্যক্তিগত? ব্যক্তিগত লাভ চরিতার্থ করার জন্যই কি এই হত্যালীলা? আমি কেন এটাকে জনগণের অপরাধ বলে ভেবেছি? কারণ জোর করে এই ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিন গির্জায় স্তোত্র শুনে আমার চোখ খুলে যায়। আমি সত্যকে উপলব্ধি করি।
আমি নিশ্চিত একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল। কিন্তু এর পেছনে কার হাত আছে? একজনের দ্বারাই সম্ভব। প্রথমে আমি ভুল পথে চালিত হয়েছিলাম। কারণ এতে বিশাল ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। অপরাধী জীবনের মায়া ত্যাগ করে এই কঠিন কাজটা করতে উদ্যোগী হয়েছিল? আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে সবই মিলে যাবে। এতে মিস সেইনসবারি সীল মস্ত বড় ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। তবে এখন প্রশ্ন, তিনি কোথায়?
অর্থাৎ দু’জন সেইনসবারি সীল ছিলেন। একজন বুদ্ধিহীনা, সৎ স্ত্রীলোক, অন্যজন দুটো খুনের সঙ্গে জড়িত আর রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট। স্ত্রীলোক দুটি হওয়া সম্ভব। এখন আমরা ধরে নিতে পারি মিস সেইনসবারি সীল এই গল্পের মুখ্য চরিত্র।
পোর্টার মিস সীল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছিল, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, মি. ব্লাস্ট? সে বলেছিল, মিস সীল বহুবার কিং লিওপোল্ড ম্যানসনে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিনও তিনি, সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওই বাড়ি থেকে বেরোতে তাকে কেউ দেখেনি। ঘটনা পরম্পরায় দেখা গেল সেই স্থান পূরণ করেছে দ্বিতীয় সেইনসবারি সীল। তিনি আসায় মিস সীলকে নকল করেন, তাঁর মতো পোশাক ও বকলস লাগানো জুতো পরেন। তারপর রাখেল স্কোয়ার হোটেলে যান। তার জামা কাপড় গুছিয়ে একটি ব্যাগে ভরেন। এরপর সেই হোটেলের বিল মিটিয়ে চলে আসেন গ্লেনগাউরি হোটেলে। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। প্রথমজনের ছদ্মবেশের আড়ালে দ্বিতীয়জন অভিনয় করেন। তাকে শেষ দেখা গেছে লিওপোল্ড ম্যানসনে ঢুকতে। মর্লের মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায়।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট জানতে চাইলেন–আপনার মতে সিন্দুকের মৃতদেহটা ম্যাবেল সেইনসবারি সীলেরই।
–অবশ্যই, তা না-হলে মৃতার মুখ কেন ওইভাবে ক্ষতবিক্ষত করবে? আমাদের বোকা বানানোর কৌশল এটা।
–কিন্তু দাঁত?
সেই ব্যাপারটা এখনও স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে। দন্তচিকিৎসকই এটা প্রমাণ করতে পারে। মর্লে স্বয়ং আজ মৃত। তিনি জীবিত থাকলে একটা সুরাহা হত। মৃতার পরিচয় জানতে সুবিধা হত। আসল কাগজপত্র সব লোপাট করা হয়েছে। চার্টে আগের নামের ওপর নতুন লেবেল লাগানো হয়েছে।
এরকুল পোয়ারো একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন। তাই আপনি যখন প্রশ্ন করলেন মিস সেইনসবারি সীল আজও বেঁচে আছেন কিনা, আমি উত্তর দিয়েছিলাম সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। কারণ তখনও আমি বুঝতে পারিনি কোন সেইনসবারি সীলের কথা জানতে চাইছিলেন? আসল না নকল?
ব্লাস্ট বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার নাম যশ আছে। আমার অজানা নয় তা। তাই আপনি যা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাই অকাট্য বলে মানতে হবে। তবে একজন নারী অন্য একজন নারীকে খুন করতে পারে? বিশেষ করে সৎ সরল বোকা একজনকে।
—হ্যাঁ, এটা আপনি খাঁটি কথা বলেছেন। এর উত্তরও আমি ভেবে রেখেছি, শুনবেন? আমার বিশ্বাস ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের মানুষের মুখ স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল। তাই তাঁকে খুন হতে হয়।
মি. ব্লাস্ট শিহরিত হলেন। বললেন, আপনি পাগলের মতো কিসব বলছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো বললেন, আমি দ্বৈত সত্ত্বাকে আবিষ্কার করেছি। একজন নিরীহ, সৎ মহিলা। যিনি ভারত থেকে এখানে এসেছেন। অন্যজন চালাক বুদ্ধিমতী নামকরা এক অভিনেত্রী। এবার আপনাকে বলতে হবে দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারের সামনে কাকে দেখেছিলেন। যিনি আলাপ হওয়ার মুহূর্তেই বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী তাঁর প্রিয় বান্ধবী ছিলেন। মিস সীলের বন্ধুদের জেরা করে জেনেছি আসল মিস সীল এত প্রগলভ নন। তাঁর পক্ষে কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে একথা বলা সম্ভব নয়। তাহলে ধরতে হবে যার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে তিনি মিথ্যে। আসল মিস সীল ইনি নন। ইনি জাল, প্রতারক। এর বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল, তাই মিথ্যের আশ্রয় নেন তিনি। আসল মিস সীল এভাবে অবলীলায় মিথ্যে বলতে পারতেন না।
ব্লাস্ট মাথা নেড়ে সায় দিলেন। হ্যাঁ, আপনার এই ব্যাখ্যা যুক্তিসঙ্গত। এ বিষয়ে এখনও অজানা। তবে এর সঙ্গে আর কারা জড়িত আছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে নিশ্চয়ই?
এরকুল পোয়ারো বললেন–অবশ্যই দেখা হচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক আপনার স্ত্রী একজন যশস্বী মহিলা। তাই তার সাথে মিস সেইনসবারি সীলের পরিচয় থাকা অসম্ভব কিছু নয়। তিনি হতে পারেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অথবা একজন মিশনারী, এমনকি অভিনেত্রী ভাবলেও ভুল হবে না। সুতরাং রেবেকা আর্নেস্ট নয়।
মি. ব্লাস্ট, আমি যে ব্যক্তিগত ও জনগণের জীবনের কথাটা বলেছিলাম এখন তা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আপনি সামান্য একজন জুনিয়র পার্টনার ছিলেন। একজন ধনী স্ত্রীলোককে বিয়ে করে আপনি বিরাট ব্যাঙ্কার হয়েছেন। খবরের কাগজে ছবিসহ আপনার কথা মাঝে-মধ্যে প্রকাশিত হয়। এবার নিশ্চয়ই আপনাকে বোঝাতে পেরেছি, আমি সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ঘটনাটা দেখেছি। আপনার কাছে মানুষের জীবন তুচ্ছ বলে মনে হয়। আপনি একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেভাবেই জীবনযাপন করছেন। অন্যের মূল্য আপনার কাছে কখনো ছিল না।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট গম্ভীর স্বরে বললেন আপনার বক্তব্য বোধগম্য হল না, মঁসিয়ে পেয়ারো?
পোয়ারো শান্তভাবে বললেন–আপনি রেবেকা আর্নেস্টকে বিয়ের আগে অন্য একজনকে বিয়ে করেছিলেন, আপনার প্রথমা স্ত্রী বেঁচেছিলেন তখন, সে কথা গোপন করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রেবেকা আর্নেস্টকে। আপনার প্রথমা স্ত্রীর এক্ষেত্রে সম্মতি ছিল। আপনার বিলাসিতা ও ক্ষমতার লোভে আপনি দু’জনকেই প্রতারণা করেছেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট বিরক্ত হয়ে বললেন–কে আমার প্রথমা স্ত্রী?
এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন তিনি থাকতেন কিং লিওপোন্ড ম্যানসনে। আপনার বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন মিসেস অ্যালবার্ট, চ্যাপম্যান নামে পরিচিত তিনি। আপনি একজন সিক্রেট এজেন্টকে খুঁজে পান। আপনার পরিকল্পনা মতো কাজ এগোতে থাকে। কারো মনে সন্দেহ জাগেনি। তবে প্রকৃত সত্যটা অন্তরালেই থেকে যায়। আপনি জানেন রেবেকা আর্নেস্টের সঙ্গে আপনার বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। এতবছর পরে কোনো বিপদের সম্মুখীন হবেন তা আপনার আশাতীত ছিল। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। হঠাৎ সেদিন চার্চে একজন মহিলা আপনাকে চিনতে পারেন। কথা বলতে বলতে আপনার স্ত্রীর প্রসঙ্গ তোলেন। সেসময় আপনার ভাইঝি মিস ব্লাস্ট সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মহিলাটির সব কথা তার কানে যায়। অতএব রহস্য উন্মোচন করা আমার পক্ষে সহজ হয়ে যায়।
ব্লাস্ট কাতর স্বরে বললেন–সেদিন আমাদের দুজনের মধ্যে কি কথা হয়েছিল তা আমি নিজেই আপনাকে বলেছি মঁসিয়ে পোয়ারো।
না, আপনার ভাইঝির চাপে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। যাতে আপনাকে সন্দেহের তলিকার বাইরে রাখা হয়, তারপরও মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটে। ম্যাবেল সেইনসবারি সীলের সঙ্গে অ্যামবেরিওটিসের পরিচয় হয়। তিনি তাঁকে মধ্যাহ্ন ভোজে আমন্ত্রণ জানান, কথা প্রসঙ্গে মিস সীল আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলেন। মিস সীল জানতেন না অর্থনীতির জগতে আপনিই একচ্ছত্র সম্রাট। কিন্তু অ্যামবেরিওটিস সেটা জানতেন। গুপ্তচর বৃত্তি ছাড়াও ব্ল্যাকমেলিং তার স্বভাব ছিল। তিনি বুঝেছিলেন সোনার খনির দরজা খোলার চাবি হাতে পেয়ে গেছেন। তাই তিনি ব্ল্যাকমেল করার জন্য আপনাকে চিঠি লিখেছিলেন অথবা টেলিফোন করেছিলেন। তাই না, মি. ব্লাস্ট?
এরকুল পোয়ারো একটু থামলেন। তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন ব্লাস্টের মনোভাব। তিনি লক্ষ্য করলেন রাস্ট মাথা নীচু করে বসে আছেন, আর তার মুখ থমথম করছে।
পোয়ারো সেসব গ্রাহ্য করলেন না। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
–একজন ব্ল্যাকমেলার মোকাবিলার পথ একটাই। সে যাতে পৃথিবীর আলো আর না দেখতে পারে তার ব্যবস্থা করা। আর সবচেয়ে সহজ উপায় হল কোনো দন্তচিকিৎসকের চেয়ার, যেখানে মানুষ অসতর্ক থাকে।
এই নাটকের আর এক মজাদার চরিত্র হল অ্যালফ্রেড। হেনরি মর্লের ছোকরা চাকর। তার বয়ানে আমি আলোর দিশা দেখতে পাই। সে আমাকে বলেছে সে গোয়েন্দা গল্প পড়তে খুব পছন্দ করে। সেদিন যে গল্পটি পড়ছিল তার নাম পৌনে বারোটার খুন। সমাপতন এটাই, কারণ মলে খুন হন ঠিক সেই সময়েই। আপনি তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে তাকে গুলি করেছিলেন। সেটা চাপা দেওয়ার জন্য মর্লেকে অনুকরণ করে বেল বাজান। বেসিনের কল খুলে দেন এবং বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। আপনি এমন সময় বেছে নেন যে নীচে নামার সময় অ্যালফ্রেড ছদ্মবেশী সেইনসবারি সীলকে উপরে পৌঁছে দিচ্ছিল! আপনি এলিভেটরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরমুহূর্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন তারপর উপরে গিয়ে সোজা সার্জারিতে ঢোকেন।
অ্যালফ্রেড তখন ঘরে ঢোকেনি। তাই মর্লেকেও দেখেনি, সে শুধু জল পড়ার শব্দ শুনেছিল। আপনি ও আপনার সহযোগী নকল মিস সীল এবার মর্লের দেহ টেনে অফিস ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ক্ষিপ্র গতিতে নামের লিস্ট থেকে নামগুলি উল্টেপাল্টে দিয়েছিলেন। এবার একটা সাদা অ্যাপ্রন ও কোর্ট পরে ডাক্তার সেজে বসে রইলেন। আপনি জানতেন এরপর অ্যামবেরিওটিসের পালা। তাই তার অপেক্ষায় রইলেন। মিস সেইনসবারি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। আর অ্যালফ্রেড প্রথা অনুযায়ী তাকে পথ দেখিয়ে দেয়।
মিনিট কয়েক পরে অ্যামবেরিওটিস ঘরে এসেছিলেন। তিনি হেনরি মর্লেকে আগে কখনও দেখেননি। তিনি সেই প্রথম এসেছিলেন। আর আপনাকেও চিনতেন না তিনি। তাই তার মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। এবার আপনি তাকে সার্জারিতে নিয়ে গেলেন এবং নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতে বলেছিলেন। তিনিও নির্দ্বিধায় বসে পড়েছিলেন আর কোন দাঁতে ব্যথা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর অতি মাত্রায় অ্যাড্রিনালিন ও প্রোচেশ মিশিয়ে ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
যে দু’জন লোক আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছিল তারা মৃত। তৃতীয় ব্যক্তিকেও আপনি খুন করেছিলেন। যা আপনার ভাষায় নিতান্ত প্রয়োজনীয়। মলের আত্মহত্যার কাহিনিতেও কেউ চিহ্নিত হবে না, কারণ অ্যামবেরিওটিসকে তিনিই ভুল করে হত্যা করেছিলেন বলেই আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে এবং সবাই সেটা বিশ্বাসও করবে।
সবই পরিকল্পনা মাফিক চলছিল। কিন্তু বাদ সাধলাম আমি। আমি মঞ্চে অবতরণ করলাম। এখান থেকেই আপনার দুর্ভাগ্য শুরু হল। আমার সন্দেহ ঘনীভূত হল। আপনিও সেটা বুঝতে পারলেন তাই কিছু একটা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন। আবার আপনি আপনার সহযোগীর শরণাপন্ন হলেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে ফাসাতে চাইলেন। তাকে ব্যবহার করলেন। তাকে কাজের লোভ দেখিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলেন। এবং বাগানে মালির কাজে নিযুক্ত করলেন। এমনিতে কেউ তাকে বিশ্বাস করত না। সুতরাং সে যাই বলুক না কেন কেউ কর্ণপাত করবে না। নিজেকে বাঁচাতে পারবেন। এরমধ্যে সিন্দুকের দেহ আবিষ্কৃত হবে। সবাই প্রথমে মিস সীলের দেহ বলে মনে করবে। পরে মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ বলে জানাজানি হলে উত্তেজনা চরমে উঠবে। আর তখন পুলিশ মিস সীলকে খুঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এছাড়া আপনি ইচ্ছে করলে মাঝ পথেই তদন্ত বন্ধ করে দিতে পারেন।
আমার অনুমান ঠিক হল। আপনি তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হলেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন। নিরুদ্দিষ্ট মহিলাকে খুঁজত বের করার দায়িত্ব নিতে বললেন। আপনার আপ্ত-সহায়ক টেলিফোনে আমাকে হুমকি দিতে লাগলেন। তবে নিজের কণ্ঠস্বর গোপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও তিনি অভিনয়ে পটু। তাই তার পক্ষে এটা করা অসম্ভব নয়। তিনি আপনার প্রথমা স্ত্রী মিসেস অলিভেরার কণ্ঠস্বর নকল করেছিলেন এতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়।
নাটকের শেষ অঙ্কও সাজানো হয়ে গেছে। আমাকে ক্রমহ্যামে আমন্ত্রণ জানানো হল আমিও সাদরে তা গ্রহণ করলাম। ঝোঁপের পাশে গুলিভর্তি একটি বন্দুক ফেলে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আপনার চাকরকে। আপনি জানেন বন্দুকটি কেউ হাতে নিলে তা থেকে সহজেই গুলি বেরিয়ে আসবে। বেচারা ফ্র্যাঙ্ক কার্টার আপনার মতলব বুঝতে পারেনি। তাই সে পায়ের কাছে বন্দুকটি পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিয়েছিল আর হাতে নাতে ধরাও পড়ে যায়।
আর এসবই আমাকে ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র। সত্যিই আপনার বুদ্ধির তারিফ করা উচিত, মি. ব্লাস্ট।
মি. ব্লাস্ট একটু কেঁপে উঠলেন। তিনি তিনি শান্তভাবে বললেন–মাফ করবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কস্টা জানতে পেরেছেন? আর কতটাই বা এগিয়েছেন, তা কি জানতে পারি?
পোয়ারো বললেন আমার হাতে একটা বিয়ের সার্টিফিকেট এসেছে। সেটা পেয়েছি অক্সফোর্ডের কাছের এক রেজিস্ট্রি অফিস থেকে অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট ও গার্ডা গ্ল্যান্টের। বারোটা পঁচিশে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কুইন শার্লট স্ট্রিটে মর্লের অফিসে গিয়েছিল। সেই সময় দু’জন লোক মর্লের সার্জারি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তা ফ্র্যাঙ্কের দৃষ্টিগোচর হয়। তার কথায় প্রথম জন একজন মোটা ভদ্রলোক অর্থাৎ অ্যামবেরিওটিস আর দ্বিতীয় জন আপনি, কার্টার আপনাকে চিনতে পারেনি। সে অ্যালফ্রেডকেও কাছে পিঠে দেখতে পায়নি। তাই সে অনুমতির তোয়াক্কা করে না। সে ঢুকে পড়ে মর্লের সার্জারিতে। আর সেই প্রথম মর্লেকে মৃত অবস্থায় দেখে। অর্থাৎ মর্লের আগেই মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং বলা যেতে পারে অ্যামবেরিওটিসের চিকিৎসা যিনি করেছিলেন তিনি মলে না। অন্য কেউ। আর তাকেই মর্লের হত্যাকরী হিসেবে ধরতে হবে।
–আর কিছু বলার আছে মঁসিয়ে পোয়ারো।
-হ্যাঁ, আছে। আপনি শুনলে অবাক হবেন, আজ সন্ধ্যায় হেলেন মন্ট্রেসরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ব্লাস্ট চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তারপর তীক্ষ্ণস্বরে বললেন–তাহলে আপনার তদন্ত শেষ।
পোয়ারো বললেন না। আসল হেলেন মন্ট্রেসর কানাডায় থাকতেন। তিনি সাত বছর আগে সেখানেই মারা যান। আপনি সেকথা জেনেও আমাদের কাছে গোপন করেছিলেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট হেসে উঠলেন। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, আপনি বুদ্ধিমান। ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনি গার্ডার নাম শুনেছেন। ও এক সময় থিয়েটারে অভিনয় করত। ব্যাপারটা আমরা গোপন রেখেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ম্যাবেল সেইনসবারি সীল। তিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত। তিনি কিছুদিনের জন্য একটা ভ্রাম্যমান সংস্থার সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। গার্ডা নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ক্রমে ক্রমে তার চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে জানতে পেরেছি তিনি একটি ছেলের প্রেমে পড়েছেন। বরাবরই তিনি বুদ্ধিহীনা ছিলেন।
এরপর আলাপ হয় রেবেকার সঙ্গে। পরে প্রেম। এবং ধীরে ধীরে তা বিয়েতে রূপ পায়। এ যেন রাজসিক ব্যাপার। বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক রেবেকাকে বিয়ে করে আমি রাজার চালে চলতে লাগলাম। কিন্তু গার্ডাকে আমি ছাড়তে পারিনি। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। তাই ওকে আমি রেবেকার সম্পর্কে সব জানাই। ব্যাপারটাকে ও উদার মনে মেনে নিয়েছিল। এদিকে রেবেকাকেও ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতে পারতাম না। ওকেও আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করতাম। একে অপরকে খুব ভালো বুঝতাম। তাছাড়া অর্থনীতিতে সে পারদর্শী ছিল। হঠাৎ একদিন সে মারা গেল। এতে আমি দারুণ শোক পেয়েছিলাম।
রেবেকার দুঃখ ভুলতে আমি গার্ডার কাছে আবার যেতে লাগলাম। আমাদের গোপন দেখাশোনায় দারুণ উত্তেজনা বোধ করতাম। সে নামকরা অভিনেত্রী ছিল। অভিনয়টা–সে খুব চমৎকার করত। একই অঙ্গে বহু রূপের মতো সে একসঙ্গে সাত-আটটা চরিত্রে অভিনয় করতে পারত। বহু নাম ধারণ করত। এক এক অঞ্চলে গিয়ে। যেমন ইংল্যান্ডে মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। আবার পারীতে আমেরিকান বিধবা বলেও নিজের পরিচয় দিতেন। আমি ব্যবসার কাজে প্যারীতে যেতাম। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতাম।
মাঝেমধ্যে আমাকে নরওয়েতে যেতে হত। অবসর মুহূর্তে মাছ ধরতাম। সেখানেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হত। সে যেত ছবি আঁকার কাজে। তারপর ওকে নিয়ে এলাম আমার গ্রামের বাড়ি ক্রমহ্যামে। তার পরিচয় দিলাম দূর সম্পর্কের বোন হিসেবে। নাম রাখলাম হেলেন মসের। এটা আমাদের কাছে মজার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা আমাদের রোমান্সের কথা কাউকে লজ্জায় বলতে পারতাম না। অবশ্য আমি গার্ডাকে পুনর্বিবাহ করতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। কারণ অতীত স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। তাছাড়া গার্ডা আমার জীবনধারার পক্ষে বড্ড বেমানান। সে আমার সরকারি কাজকর্ম একদম সহ্য করতে পারত ন। আসল কথা হল, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করাতে আমরা দুজনেই আনন্দ পেয়েছিলাম।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট একটু থেমে দম নিলেন। আবার তিনি বলতে শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। গলার স্বর তীব্র। মিস সীলের ওপর যত রাগ ছিল উগরে দিলেন।
তিনি বললেন–ওই মূর্খ স্ত্রীলোক সব নষ্টের গোড়া। সব ওলট-পালট করে দিল। বহু বছর আমাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ছিল না। হঠাৎ সেদিন চার্চে তার সঙ্গে দেখা হল। এত বছর পরেও চিনতে পারল আমাকে। অ্যামবেরিওটিসের সঙ্গে আমার সম্পর্কে আলোচনা করেছিল। এসব কথা আমি জানতে পারি। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিই দ্রুত কিছু একটা করার। আমি স্বার্থপর নই। তাই আমার নিজের জন্য চিন্তা ছিল না। আমার ভাবনা ছিল সমস্ত দেশবাসীর জন্য। আমি বিপদে পড়লে অথবা আমার জীবনহানি হলে সমস্ত দেশেরই ক্ষতি হবে। ইংল্যান্ডে যা কিছু হয়েছে তার অনেকটাই আমি করেছি। দেশের প্রতি আমার অবদানও কম নয়। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, দলতন্ত্রে নয়। আমরা মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়তে চেয়েছিলাম। তবে অত্যাচার করে নয়। আর সেইসব নষ্ট করতে চেয়েছিল এক হতভাগ্য শয়তান লালমুখো গ্রীক। মঁসিয়ে পোয়ারো, এদেশ আমায় ছাড়া চলবে না। গার্ডাও সেটা অনুভব করেছিল। তাকে ব্যবহার করলাম। মিস সেইনসবারি সীলকে সরিয়ে দিতে হবে। তার মুখ বন্ধ করতে হবে। মিস সেইনসবারি সীলের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
একদিন গার্ডাকে পাঠালাম ওর কাছে। সে তার সঙ্গে দেখা করে বলল, আমি মিসেস চ্যাপম্যানের পেয়িংগেস্ট হয়ে রয়েছি। তুমি একদিন এসো সেখানে। তোমায় চায়ের নিমন্ত্রণ রইল। সেইনসবারি সীলের মনে পাপ ছিল না। সে এসেছিল মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটে। আগে থেকেই গার্ডা প্রস্তুত ছিল। আমার পরিকল্পনা মতো চায়ের মধ্যে মেডিসিন মিশিয়ে দিয়েছিল সে। ম্যাবেল সন্দেহ না করেই সেটা পান করেছিল এবং চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল। এবার মিসেস চ্যাপম্যানের গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন। আমরা দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, এবার অ্যামবেরিওটিসকে সরাতে হবে। সেইমতো ব্যবস্থা নিলাম। আমি রোগীর ছদ্মবেশে দন্তচিকিৎসক মর্লের চেম্বারে গেলাম। তাকে খুন করলাম। এবার পালা অ্যামবেরিওটিসের। তিনি আমাকে চিনতেন না। তাই ডাক্তারের পোশাকে আমাকে দেখে তার কোনো সন্দেহ হয়নি।
এবার পোয়ারো তাঁকে হাত নেড়ে থামালেন। তিনি জানতে চাইলেন–মর্লেকে মারলেন কেন?
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট শান্ত স্বরে বললেন–বাধ্য হয়ে একাজ করতে হয়েছে আমাকে। সত্যিই মর্লেকে মারার জন্য আমি দুঃখিত।
দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একসময় ব্লাস্ট বললেন–এবার কি হবে, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন–এ খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য হেলেন মসেরকে পুলিশ আগেই গ্রেপ্তার করেছে।
ব্লাস্ট সহজ ভঙ্গীতে বললেন এবার আমার পালা, তাই তো, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–অবশ্যই, আমার কথার অর্থ তাই হয়।
–কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি এতে খুশি হননি?
–আপনার ধারণা সত্যি, মি. ব্লাস্ট, আমি খুশি হইনি।
–আমি তিনজনের হত্যাকারী। আমি নিশ্চিত, বিচারে আমার ফাঁসি হবে। তবে আপনি আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবেন।
–ঠিক বুঝলাম না। পরিষ্কার করে বলুন।
–আমি এদেশের জন্য অপরিহার্য, এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। অর্থনীতির স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য আমাকে দেশের প্রয়োজন। প্রধানত দেশের মঙ্গলের জন্যও আমাকে সবার দরকার।
–হ্যাঁ তা হতে পারে।
–আপনিও স্বীকার করছেন।
–অবশ্যই। দেশের যা কিছু ভাল আপনি তার প্রতিভূ। স্থায়িত্ব, সুস্থতা ও সৎ ভাবনার জন্যও আপনার খ্যাতি আছে।
ব্লাস্ট মাথা নীচু করে কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন–ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো। তাহলে এখন আপনার করণীয় কি?
–আপনি চাইছেন এই মামলা থেকে আমি হাত গুটিয়ে নিই, মি. ব্লাস্ট?
–হ্যাঁ, সেটাই আমার ইচ্ছে।
—আর আপনার স্ত্রী গার্ডার কি হবে?
–আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি অবহিত আছেন। আর আমি উচ্চ পর্যায়ের লোকেদের সঙ্গে মিশি। সুতরাং ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। ভুয়ো সাক্ষী দাঁড় করাব। আর রটিয়ে দেব সনাক্তকরণে ভুল হয়েছে।
-আমি যদি তা মেনে না নিই, তাহলে?
–তাহলে আমিও প্রস্তুত। সবই আপনার ওপর নির্ভর করছে। আপনাকে আবারও বলছি, নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমি এইসব ব্যাখ্যা দিচ্ছি না। আমি কেবল দেশের স্বার্থরক্ষা করতে চাইছি। আর কেন তা করেছি আপনার অজানা নয়, মঁসিয়ে পোয়ারো। এতে আমার নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধি হবে না।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তিনি বললেন–এ-সব জায়গাতে সঠিক মানুষ হিসাবে আপনি বিরাজ করছেন। আপনি সৎ, জ্ঞানী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। তবে এর অন্য একটি দিকও আছে। যে তিনজন মানুষ আজ মৃত, তাদের আপনি হত্যা করেছেন, সেকথা অস্বীকার করবেন কিভাবে, মি. ব্লাস্ট?
–হ্যাঁ, তাদের কথাও আমি ভেবে রেখেছি, মঁসিয়ে পোয়ারো। প্রমাণ করে দেব ম্যাবেল সেইনসবারি সীল বিকৃত মস্তিষ্কের স্ত্রীলোক, অ্যামবেরিওটিস একজন গুপ্তচর ও ব্ল্যাকমেলার। অসৎ মানুষ।
–আর মলের ক্ষেত্রে কি যুক্তি দেবেন?
–মর্শের জন্য আমার দুঃখ হয়। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। সকলের উপকারে এগিয়ে আসতেন। তবে তিনি না থাকলেও কারো কিছু আসে যায় না। ওরকম অনেক দাঁতের ডাক্তার আছে এদেশে।
–হ্যাঁ, আপনার যুক্তি মেনে নিচ্ছি। তবে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কি দোষ করেছিল? তাকেও কোনো অনুশোচনা ছাড়াই মারতে চাইছিলেন।
–তার প্রতি আমার কোনো দয়া মায়া নেই। সে অভদ্র নীচ প্রকৃতির মানুষ।
পোয়ারো শেষ চেষ্টা করে বললেন–সব কিছুর ওপরে সেও একজন মানুষ।
–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমরা সবাই মানুষ।
–আপনি স্বীকার করছেন আমরা সবাই মানুষ। কিন্তু একথা আপনি মনে রাখেননি, মি. ব্লাস্ট। আপনার মতে ম্যাবেল সেইনসবারি সীল পাগল আর বুদ্ধিহীনা। অ্যামবেরিওটিস অসৎ মানুষ এবং ফ্র্যাঙ্ক কার্টার একজন বাজে লোক। আর মর্লে শুধুমাত্র একজন দন্ত চিকিৎসক, যা নাকি দেশে অনেক আছে। ঠিক এখানেই আমার আর আপনার দৃষ্টিকোণে পার্থক্য। আমার কাছে আপনিও যেমন, ওই চারজনও তাই। আপনার জীবনের যতখানি মূল্য আছে ঠিক ততটাই ওদের জীবনও মূল্যবান।
–আপনি ভুল করছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। ওই চারজন ও আমি এক নই।
–না, আমি ঠিক বলছি। আপাতদৃষ্টিতে আপনি সৎ, গুণী বিশ্বাসযোগ্য, দৃঢ়চেতা ব্যক্তি। কিন্তু অন্তরে আপনি ক্ষমতালোভী। তাই ওই চারজনের জীবন আপনার কাছে মূল্যহীন বলে মনে হয়েছে। ওই চারজনকে বলিদান দিয়ে নিজের স্বার্থ সফল করতে দ্বিধা করেননি আপনি।
আপনি কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো। সমগ্র জাতির ভাল মন্দর দায়িত্ব আমার ওপর অর্পন করা হয়েছে। এটা তো আপনি মানেন?
–আমার ভাবনা চারজনকে নিয়ে। আমি ওই চারজনকে রক্ষা করতে পারলাম না আর সমগ্র জাতির কথা ভাবব কি করে? নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্য যাদের বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন আপনি।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন–এটাই আপনার শেষ কথা, মঁসিয়ে পোয়ারো?
এরকুল পোয়ারো দৃঢ় কণ্ঠে বললেন–হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা। বলেই তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন ঠিক সেই মুহূর্তে দুজন তোক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল।
এরকুল পোয়ারোর জন্য দু’জন অপেক্ষা করছিল। একজন জেন অলিভেরা এবং অপরজন তার প্রেমিক। নাম হাওয়ার্ড রেইকস।
জেনের মুখ ফ্যাকাশে, ক্লান্ত। সে ম্যাস্টলপিসের সামনে দাঁড়িয়েছিল, পাশে ছিল হাওয়ার্ড।
জেন পোয়ারোকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইল–কি হল, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো বললেন সব শেষ।
হাওয়ার্ড তীক্ষ্ণস্বরে বলল–সব শেষ মানে?
পোয়ারো বললেন মি. অ্যালিস্টেয়ারকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হাওয়ার্ড বিদ্রূপ করে বলল–আমি ভেবেছিলাম আপনি ওই লোকটার অর্থ ও বুদ্ধির কাছে বিকিয়ে যাবেন। আপনি হার মানতে বাধ্য হবেন। আপনার বুদ্ধি বিবেচনা লোপ পাবে। যাক, আপনার এ-উপকারের কথা সমগ্র ইংল্যান্ডবাসী চিরদিন মনে রাখবে।
জেন বলল-না, আমি একবারও তা ভাবিনি। মঁসিয়ে পোয়ারোর ওপর আমার আস্থা ছিল।
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তোমরা এখন মুক্ত। এ পৃথিবী তোমাদের। তোমরা নতুন পৃথিবী রচনা করো। তোমাদের এই নতুন পৃথিবীর মানুষ মমতাময় হয়ে উঠুক। এইটুকুই আমার প্রার্থনা।