৯ম অধ্যায়
সঞ্জয়ের কালোচিত কর্ত্তব্য উপদেশ
জনমেজয় কহিলেন, ব্রহ্ম! ভগবান্ বেদব্যাস প্রস্থান করিলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কি করিলেন? আর ঐ সময় ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ও কৃপ প্রভৃতি বীরত্ৰয় কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতেছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। আমি আপনার নিকট অশ্বত্থামার কাৰ্য্য শ্রবণ করিয়াছি। এক্ষণে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে যাহা কহিলেন, তাহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইতেছে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ। অনন্তর সঞ্জয় দুর্য্যোধন ও তাঁহার সৈন্যগণের বিনাশে হতবুদ্ধি হইয়া ধৃতরাষ্ট্রসমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! নানাদেশীয় ভূপালগণ কুরুক্ষেত্রে আগমন করিয়া আপনার পুত্রগণের সহিত পিতৃলোকে প্রস্থান করিয়াছেন। দুৰ্য্যোধন বৈরতা উচ্ছিন্ন করিবার মানসে সমুদয় পৃথিবী উচ্ছিন্নপ্রায় করিয়াছে। এক্ষণে আপনি যথানিয়মে পুত্র, পৌত্র ও পিতৃগণের প্রেতকার্য্য সম্পাদন করুন।” অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের মুখে এইরূপ নিদারুণ বাক্য শ্রবণ করিয়া বিচেতন ও মৃতকল্প হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন সর্ব্বধর্ম্মজ্ঞ মহাত্মা বিদুর তাঁহাকে ভূতলশায়ী দেখিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! সমুদয়: জীবকেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হইবে। অতএব আপনি শোকপরিত্যাগপূর্ব্বক গাত্রোখান করুন। প্রাণীগণের জন্মের পূর্বে অভাব, তৎপরে কিয়দ্দিন মাত্র স্থিতি এবং পরিশেষে নিধনানন্তর পুনরায় অভাব লক্ষিত হয়; অতএব তাহাদিগের নিমিত্ত শোক করা বিজ্ঞোকের কর্ত্তব্য নহে। শোক, করিলে মৃতব্যক্তিকে প্রাপ্ত বা স্বয়ং মৃত্যুমুখে নিপতিত হওয়া যায় না। তবে আপনি কি নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছেন? দেখুন, লোকে সংগ্ৰামবিমুখ হইয়াও মৃত্যুগ্রস্ত হয় এবং যুদ্ধ করিয়াও জীবিত থাকে। কাল উপস্থিত হইলে কেহই তাহা অতিক্রম করিতে পারে না। কাল সমুদয় জীবকেই আকর্ষণ করে। কালের প্রিয় বা অপ্রিয়, কেহই নাই। তৃণরাশি যেমন বায়ুর বশীভূত হইয়া উড্ডীন হয়, প্রাণীগণও তদ্রূপ কালের বশীভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করে। ইহলোক সমুদয় জীবগণকেই একস্থানে গমন করিতে হইবে। অতএব কালবশবর্তী ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত শোক করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। আর আপনি যেসমস্ত মহাত্মার নিমিত্ত শোক। করিতেছেন, বস্তুতঃ তাহারা শৌচ্য নহেন। তাঁহারা সমরে নিহত হইয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন। বীরগণ যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া যেরূপ সহজে স্বর্গলাভ করেন, অন্যান্য লোকে প্রভূতদক্ষিণ বহুসংখ্যক যজ্ঞ, তপস্যা ও বিদ্যাপ্রভাবে সেরূপ সহজে স্বর্গারোহণে সমর্থ হয় না। আপনার পক্ষীয় সমুদয় বীরই বেদবেত্তা ও ব্রতপরায়ণ ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহই সংগ্রামবিমুখ হয়েন নাই। তাঁহারা বিপক্ষদিগের শরীরানলে শরাহুতি প্রদান ও অনায়াসে শত্ৰুনিক্ষিপ্ত শরনিকর গ্রহণ করিয়াছেন। তবে আপনি কি নিমিত্ত তাঁহাদের নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছেন? যুদ্ধই ক্ষত্রিয়দিগের স্বর্গলাভের উত্তম পথ। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সংগ্রাম অপেক্ষা আর কিছুই শ্রেষ্ঠ নহে। আপনার পক্ষীয় মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণ পরমগতি লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা কখনই শোচনীয় নহেন। অতএব এক্ষণে আপনি স্বয়ং আশ্বাসিত হইয়া শোক সংবরণ করুন। শোকাভিভূত হইয়া কৰ্ত্তব্য কার্য্যের অনুষ্ঠানে বিরত হইবেন না।”